#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি
২.
‘তোমার আচরণ আমাকে বারবার হতাশ করছে। তোমার কি মনে হয়না তোমার আচরণ পরিবর্তন করা উচিত?’
‘জি মনেহয়।’
ছেলের এমন সহজ স্বীকারোক্তি হজম হতে চাইল না তারিকুল সাহেবের। এমন স্বীকারোক্তি পরে কেমন কথা বলা উচিত সেটাই ভাবছেন তিনি। আজ তিনি খুব পাকাপোক্ত ভাবেই প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন ছেলেকে কিছুটা ধমকি ধামকি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার ছেলে খুব সুন্দর ভাবেই তার সাজানো গোছানো আয়োজে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। ছেলের চতুরতা তাকে বরাবরের মতই হতাশ করলো। পৃথিবীর সকল বাবা যেখান একজন চতুর সন্তানের আশা করে সেখানে তরিকুল সাহেব ভাবেন এর থেকে একটা গর্ধোবকে মানুষ করা তার জন্য সহজ ছিল। অন্তত সে তার কথা মান্য করে চলত। এই ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করতে করতেই তার কিলো চুলে পাক ধরেছে। হতাশ চিত্তে তরিকুল সাহেব বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। নিজের কামরার দিকে যেতে যেতে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ভেব না তুমি আমাকে পরাজিত করতে পেরেছ। এবার তোমার ভাগ্য তোমায় সাহায্য করেছে। পরবর্তীতে তোমার বাঁচার সব রাস্তা আমি বন্ধ করে দিব।’
তরিকুল সাহেব যেতেই শাকিলা দম ছেড়ে বাঁচলো। আজ কোনো যুদ্ধ না বেঁধে যায় এমনটা ভেবেই তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলছিলেন। ছেলের গালে ভাত তুলে দিতে দিতে শাসনের স্বরে তিনি বললেন,
‘কতবার তোমাকে এমন করতে না করেছি? তোমাদের বাবা ছেলের যন্ত্রণায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয়বার আর আমি তোমায় ক্ষমা করবো না বলে দিলাম।’
মায়ের বাধ্য ছেলের মত আয়াজ মাথা নাড়িয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। শাকিলাও আর কিছু বলতে পারলো না। ছেলেটার সুন্দর মুখটার দিকে তাকালে সে আর রাগ করে থাকতে পারে না। এমন চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছেলেটা তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। তরিকুল সাহেব ইয়াং টাইমে এমন সুদর্শন ছিলেন। শাকিলার এখনো মনে আছে যেদিন তরিকুল সাহেব তাকে দেখতে গিয়েছিল সেদিনের কথা। এত মুরব্বিদের সামনেও শাকিলা লজ্জার কথা ভুলে হা করে তাকিয়ে ছিল। পরে এ নিয়ে কত লজ্জাই না তাকে পেতে হয়েছে!
খাওয়া শেষে রুমে এসে লম্বা করে বিছানায় শুয়ে পড়ল আয়াজ। পুরো শরীর ব্যথায় টনটন করছে। আজ কলেজ মাঠে ফুটবল খেলা ছিলো। বিপক্ষ দল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে আয়াজকে আঘাত করেছে। তবে আয়াজ এর বিপরীত কোনো আঘাত তাদের দেয়নি। কারণ তার দেওয়া আঘাত তো এত অল্প হতে পারে না! তার দেওয়া আঘাত ওদের কলিজা পর্যন্ত দাগ বসিয়ে দিবে।
আয়াজ শুয়ে থেকেই ফোন স্ক্রোল করতে লাগলো। প্রিয়তার একাউন্টে যেতেই দেখলো প্রিয়তা দু ঘন্টা পূর্বে একটি পোস্ট করেছে। যেখানে তার পরনে আকাশি রঙের জামদানি শাড়ি। যেটা আজ সকালেই তার পরনে ছিল। ছবিটাযে ক্যান্ডিট তা দেখেই বুঝে ফেলার মতো। প্রিয়তা কোন ভাবনায় বিভোর এমন সময় ছবিটা ক্লিক করা হয়েছে। ক্যামেরা ম্যান যে তার দক্ষ হাতে ছবিটা ক্লাক করেছে সেটা একদম ক্লিয়ার। আয়াজের এটাও বুঝতে বাকি রইল না যে ক্যামেরা ম্যানটা কোনো এক পুরুষ। কেননা প্রিয়তার সামনে থাকা কফি মগে কোনো পুরুষালি অবয়বের প্রতিবিম্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। আয়াজের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
‘অন্য পুরুষের সাথে সময় কাটানোর খুব বড় মূল্য দিতে হবে আপনাকে প্রিয়। এ ব্যাপারে আমি কখনোই বিন্দু পরিমান নরম হবো না। যতটা খুশি উড়ে নেন আর অপেক্ষা প্রহর গুনতে থাকেন। আপনার পাখা ছাঁটার আয়োজন আমি খুব শীঘ্রই করছি।’
__________
প্রিয়তা সবাইকে খাবার দিয়ে না খেয়েই রুমে চলে গেলো। কিন্তু এ নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। সবাই যে যার মতো করে খেতে লাগলো। কাজের মেয়ে রত্না প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো প্রিয়তার জন্য। প্রিয়তা তখন তার ছোট্ট রুমের জানালা ঘেঁষে রাখা টেবিলে ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছিল। রত্না দরজা নক করতেই প্রিয়তা তাকে ভেতরে আসতে বলল।
‘আপা আপনে বোজলেন কেমনে আমি আসচি?’
প্রিয়তা মুচকি হেসে বলল,
‘এই অসময়ে তুই ছাড়া আর কেউ আসেনা আমার রুমে।’
প্রিয়তার কথা শেষ হতেই রত্না খাবার প্লেট প্রিয়তার সামনে রাখলো।
‘আমি নাহয় কামের মাইয়া তাই কেউ আমার দিকে খেয়াল দেয় না। কিন্তু আপনেতো তাগো পরিবারের লোক। আপনের সাথে এমন করে কেন? আপনের মতো শিক্ষিত হইলে আমি কবে এই বাড়ি ছাইড়া চইলা যাইতাম। আপনের মামির মতো দজ্জাল মহিলা আর একটা আমি দেখি নাই। তওবা তওবা।’
প্রিয়তা রত্নাকে চোখ গরম দিলো। রত্না মুখ বাকিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। কিছু একটা মনে পড়তেই বলল,
‘আপা একটা কথা বলবার ভাবছিলাম।’
‘এত ভাবার কি আছে? বলে ফেল।’
‘আপনের রুমে পাটি বিছাই ঘুমাইতে চাইছিলাম। ঐ রান্নাঘরের পাশে থাকতে কেমন যেন লাগে। মনে হয় কেডায় জেন হাঁটে বাড়ির মধ্যে। আপনের রুমে খালি রাইতে রাইতে ঘুমাইতাম।’
‘আচ্ছা।’
‘সত্যি আপা?’
‘হুম।’
‘আপা আর একটা কথা।’
‘বল।’
‘আপনের যে লাল রঙের একটা জামা আছেনা? ঐ যে লাল লাল ফুল? ঐরম একটা জামা আমারে কিইনা দিবেন? আমার বড় আপার বিয়া সামনের মাসে। আব্বায় সকালে কল কইরা বলছে। ছেলের অবস্থা ভালোই। অটো চালায়। আপার লগে নাকি মানাইব।’
‘আচ্ছা দিব।’
রত্না খুশি হলো। প্রিয়তাকে ওর ভালো লাগার অন্যতম কারণ হলো প্রিয়তা ওর সকল আবদার পূরণ করে। রত্নাকে খুশি হতে দেখে প্রিয়তার ও ভালো লাগলো। মেয়েটা মাত্র এগারো বছর বয়সে এ বাড়িতে এসেছে। এখন বয়স পনেরো। এই চার বছরে মেয়েটা একটুও পাল্টায়নি। প্রিয়তা যখন এসব ভাবছিল তখনই প্রিয়তাকে চমকে দিয়ে রত্না বলল,
‘আপা আপনে বিয়া করবেন না? আপনে তো আমার বড় আপার থেইকেও বড়। আব্বায় বলছে এরপর ভালো পোলা পাইলে আমারেও বিয়া দিয়া দিবে আর আপনে এখনো বিয়া করতে পারলেন না।’
প্রিয়তা রত্নাকে ধমক দিয়ে ঘুমাতে বলল। মেয়েটা আজকাল খুব বড় বড় কথা বলে। কবেনা এমন কিছু বলে বসে যা প্রিয়তার সম্মানকে ঢুবিয়ে দেয়।
বেডে শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসলো না প্রিয়তার। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত একটা ছাড়িয়েছে। চারদিক বেশ নিশ্চুপ। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক পরিবেশকে গম্ভীর করে তুলেছে। দূর থেকে দু একটা গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে আবার তা মিলিয়ে যাচ্ছে। হাইওয়ে থেকে তাদের বাড়ি অনেকটা ভেতরে হওয়ায় ব্যস্ত শহরের হৈচৈ খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না। প্রিয়তা বালিশের তলা থেকে হাতরে ফোন বের করে ফেসবুকিং করতে লাগলো। হঠাৎ একটা আইডি থেকে ম্যাসেজ আসলো। প্রিয়তা চেনে না এই আইডির মালিককে। কিন্তু আইডিতে অনেক সুন্দর শিক্ষামূলক পোস্ট দেখেই সে এড করেছিলো তার সাথে। কিছুটা কৌতুহল নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করতেই দেখলো সেখানে লেখা,
‘ রাত অনেক গভীর হয়েছে। ঘুমিয়ে পরুন। রাত জেগে অনলাইনে থাকা মোটেই ভালো কাজ নয়।’
প্রিয়তার কপাল কুঁচকে এলো। এই ব্যক্তি আসলে কে? প্রিয়তা ঝটপট টাইপ করল,
‘কে আপনি?’
প্রায় সাথে সাথেই সিন হলো। যেন ওপারের ব্যক্তি তার ম্যাসেজের অপেক্ষাই করছিল। উত্তর এলো।
‘আপনার অপ্রিয় কেউ।’
‘এটা আবার কেমন পরিচয় দেওয়ার ধরন?’
আর রিপ্লাই এলো না। প্রিয়তা এক দুই করে দশ মিনিট অপেক্ষা করলো। কিন্তু আর কোনো উত্তর এলো না। প্রিয়তা কিছুটা কৌতুহল বোধ করলো এই ব্যক্তির প্রতি। কিন্তু অনেক রাত হওয়ায় সে আর জেগে থাকতে পারলো না। তাছাড়া তাকে তার শরীরকেও কিছুটা বিশ্রাম দিতে হবে। ফোনের নেট অফ করে সে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। সকালে স্কুল আছে। আর রাত জাগা ঠিক হবে না। কিছুক্ষণের মাঝেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল প্রিয়তা।
চলবে………..