#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি
৭.
বহুদিন বাদে সকল ফ্রেন্ড একত্রিত হয়ে আনন্দ উল্লাশে মেতে উঠেছে। গ্রাজুয়েশন শেষে প্রায় সবাই এখন কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউবা সংসার সামলাচ্ছে। এত ব্যস্ততার মাঝে বন্ধুদের খোঁজ রাখা মুশকিল প্রায়। জমজমাট আড্ডা শেষে বাসায় ফেরার পালা এলো। প্রিয়তা ফুটপাত ধরে একা হাঁটতে লাগলো।
‘আইসক্রিম খাবেন?’
প্রিয়তার এই কন্ঠের মালিককে চিনতে কষ্ট হল না। সে পাশ না ফিরেই বলল,
‘এখানে কি করছ আয়াজ? তোমাকে না আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছি?’
আয়াজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। নির্লিপ্ত ভাবে বলল,
‘আপনি যতবার দূরে যেতে বলবেন আমি তত স্টেপ আপনার কাছে এগিয়ে আসব। চাইলে ট্রাই করে দেখতে পারেন।’
প্রিয়তা কিছু বলল না। সে জানে আয়াজ যেটা বলেছে সেটাই করবে। হঠাৎ আয়াজ বলে উঠলো,
‘এখানেই দাঁড়ান। আমি আসছি। কোথাও জাবেন না প্লিজ।’
প্রিয়তা শুনলো। চুপচাপ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। আজ তার মন ভিষণ রকম ভালো। সে ভেবেছে আজ আয়াজের ছোট আবদারগুলো সে পূরণ করবে। কেমন হয় আয়াজকে চমকে দিলে?
মিনিট খানেক বাদে দুটো আইসক্রিম হাতে আয়াজ এগিয়ে এলো। একটা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিতেই প্রিয়তা মিষ্টি করে হাসলো। আয়াজের হাত থমকে গেল। মুগ্ধ হয়ে সে প্রিয়তার পানে চাইল। কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘আপনি হাসবেন না প্রিয়। আমি তাহলে নিয়ম ভঙ্গ করে কোনো অন্যায় করে ফেলব।’
প্রিয়তা দু পা দূরে সরে দাঁড়ালো। কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ফ্রি আছ তুমি?’
আয়াজ যেন আবার চমকাল। আজ প্রিয়তা একের পর এক চমক দিয়ে চলছে। আয়াজ মিষ্টি করে হাসলো। সুন্দর করে উত্তর দিলো,
‘আপনি বললে আমি সর্বদা ফ্রি।’
প্রিয়তা মাথা নাড়াল। কিছু না বলে সামনের দিকে পা বাড়ালো। আয়াজ প্রিয়তার না বলা কথা বুঝে নিল যেন। মুচকি হেসে সেও প্রিয়তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে সে সুর ধরলো,
‘তোর এক কথায়
আমি রাখব হাজার বাজি।
তোর ইশারায়,
আমি মরে যেতেও রাজি।’
____________
বাসায় ফেরার পুরো রাস্তাটা হেঁটেই এলো তারা। আয়াজ প্রিয়তাকে তার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। পুরো রাস্তায় তাদের কোনো কথা হয়নি কিন্তু তবুও এই সময়টুকু আয়াজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল।
ছোটবেলা থেকে অযত্নে বড় হওয়া প্রিয়তা বড্ড ভালোবাসার কাঙাল। একটুখানি ভালোবাসা পেতে সে নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি। সেখানে আয়াজের এই নিখুঁত ভালোবাসাকে সে কিভাবে পায়ে ঠেলে দিবে? কিন্তু তার যে ভয় হয়। ভিষণ ভয়। এই সমাজ আর সমাজের মানুষের ভয়। তারা যে এ সম্পর্ককে স্বাভাবিক ভাবে নিবে না। আর আয়াজের পরিবার? তারা কি কখনো প্রিয়তাকে মেনে নিবে?
রাত আনুমানিক দুটোর কাছাকাছি। তীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুম আলগা হয়ে এলো প্রিয়তার। চোখ টেনে মেলে পরিস্থিতি বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। বালিশের নিচে মোবাইল ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোন কানে ধরলো। কোনোরূপ কথা ছাড়াই গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল,
‘রাত বিরাতে কল করা ভিষণ রকম অযৌক্তিক কাজ। অন্যের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো এক রকম অভদ্রতা। আ…’
আর কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই গম্ভীর পুরুষালি গলায় আয়াজ বলে উঠলো,
‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ছাদে আসবেন। টাইম অনলি ফাইভ মিনিট। কুইক।’
কল কেটে গেল। ঘুমের ঘোরে প্রিয়তা কিছু বুঝলো না। কপাল কুঁচকে আবারো তলিয়ে গভীর ঘুমে। তার জীবনে এখন একমাত্র লক্ষ ঘুম। পাঁচ মিনিট অতিক্রম হতেই মোবাইল বেজে উঠল। প্রিয়তা নড়েচড়ে উঠলো। এবার তার ঘুম কিছুটা হালকা হয়েছে। কল রিসিভ করতেই আয়াজের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
‘ছাদে আসুন। নয়তো আমি আপনার রুমে চলে আসব ফর সিওর।’
প্রিয়তার ঘুম উড়ে গেলো। হতভম্ব হয়ে উঠে বসলো। এ কোন রূপ প্রকাশ করতে শুরু করেছে ছেলেটা? প্রিয়তা চাপা কন্ঠে বলল,
‘তুমি পাগল আয়াজ। এখন কি ছাদে আসার সময়?’
আয়াজ সুন্দর নম্র ভাবে জবাব দিলো,
‘অপেক্ষা করছি।’
ফোন কেটে গেল। প্রিয়তা থম মেরে বসে রইল কিছুক্ষণ। ছেলেটাকে আস্কারা দিয়ে ভিষণ রকম ভুল করেছে সে। মোবাইল স্ক্রিনে সময় দেখে গখয়ে ওড়না জড়িয়ে চুপিসারে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলো। কাঁপা পায়ে ছাদে উঠতেই একজোড়া হাত তাকে টেনে পাশে নিয়ে এলো। প্রিয়তা আতকে উঠল। চাঁদের আলোতে আয়াজের মুখ স্পষ্ট হতে প্রিয়তা স্বস্তি পেল।
‘এত রাতে এসবের মানে কি আয়াজ?’
‘মিস করছিলাম।’
প্রিয়তা থামলো। গভীর দৃষ্টিতে তাকালো আয়াজের পানে। চাঁদের আলোতে আয়াজের মুখটা ভিষণ কোমল পবিত্র লাগছে। প্রিয়তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আয়াজের চোখের পখপড়ি গুলো বড় বড়। আচ্ছা ছেলেদছর চোখের পাপড়ি এত সুন্দর হয়? আগেতো সে লক্ষ করেনি। আয়াজ চুপ করে প্রিয়তার কর্মকাণ্ড দেখতে লাগলো। মিটিমিটি হেসে সে আরো একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। প্রিয়তা চমকে উঠলো। পিছিয়ে যেতে যেয়ে বাঁধা পেল। আয়াজ শক্ত বাঁধনে আটকে ফেলেছে তাকে। প্রচন্ড গতিতে ছুটতে থাকা হৃৎপিণ্ড যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। পা দুটোও বেঈমানি করলো যেন। বিন্দু মাত্র স্থান থেকে নড়লো না। প্রীয়তা অনুভব করলো সে কাঁপছে। প্রচন্ড গতিতে কাঁপুনি দিচ্ছে তার হাত পা। আয়াজ গভীর চোখে প্রিয়তার চোখে চাইল। আচানক তপ্ত ঠোঁট ছোঁয়াল প্রিয়তার কপালে। প্রিয়তা স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড পর আয়াজ সরে এলো। কোনো কথা ছাড়া ছাদের রেলিং টপকে নেমে গেলো নিচে। প্রিয়তা চোখ কপালে নিয়ে তাকালো। দ্রুত পায়ে রেলিংয়ের কাছে আগাতেই দেখলো দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে ভারসাম্য রেখে খুব সহজেই নেমে গেছে আয়াজ। প্রিয়তা স্বস্তি পেল। একটুর জন্য তার প্রাণ উড়ে গিয়েছিল।
বাকি রাতটুকু প্রিয়তার নিদ্রাহিনতায় কাটলো। লজ্জা রাগ ভয়ের সংমিশ্রণে তৈরি অন্যরকম অনুভূতি অনুভব হচ্ছে তার। একটা অনিশ্চিত সম্পর্কের দিকে পা বাড়াচ্ছে সে। আদেও কি এর কোনো ভবিষ্যৎ আছে? চোখ ভিজে উঠেছে তার। হারাতে হারাতে সব হারিয়ে ফেলেছে সে। আর কিছু সে হারাতে চায় না।
__________
প্রিয়তা দুদিন ধরে ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। স্কুল থেকে অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়েছে। হেডমাস্টার ভদ্রলোক ও প্রিয়তার মিথ্যা অসুস্থতার নাটককে সত্য ভেবে ব্যাথিত হয়ে ছুটি মঞ্জুর করেছেন। স্নেহের কন্ঠে শুধালেন,
‘একটু ফল খাও। ঔষুধে অনিয়ম করো না। তোমার এখন ইয়াং এইজ। খাওয়া দাওয়া নিয়মিত করা দরকার। আমি সুযগ পেলে তোমায় এসে দেখে যাব। তুমি আমার মেয়ের মতো। আমি চাই তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে ফের। আর ছুটির ব্যাপারে একদম চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে রেস্ট নাও।’
প্রিয়তা মিথ্যায় পটু না হলেও সে খুব সুন্দর ভাবে তার অসুস্থতা রিপ্রেজেন্ট করেছে। নিজের এমন নিখুঁত অভিনয়ে নিজেই হতবাক হলো। কিন্তু ভদ্রলোকের জন্য খারাপ লাগলো। সে কতটা না স্নেহ নিয়ে প্রিয়তাকে আস্বস্ত করলো! কিন্তু সে তো জানেই না তার মেয়ের মতো মেয়েটা তাকে কি দারুণ মিথ্যার জালে ফাঁসিয়েছে।
ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে অন করতেই একের পর এক টেক্সট, ভয়েস ম্যাসেজ আসতে লাগলো। এই দুদিন প্রিয়তা সকল প্রকার যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে রেখেছিল। প্রয়োজন ব্যতিত রুমের দরজাও মিনিটের জন্য খোলা রাখেনি সে। একপ্রকার বন্দি বানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। এমনটা নয় সে ভিষণ মানসিক চাপে আছে। নিজেকে টাইম দেওয়ার নামে গন্ডারের মত পরে পরে ঘুমিয়েছে। দুদিনের টানা ব্রেকে তার মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে। সকাল থেকে সুজলা নানা কথা বলে যাচ্ছে। মিনিটের জন্য তার মুখ বন্ধ হচ্ছে না। কিন্তু প্রিয়তার তাতে মাথা ব্যাথা নেই। সে নিজের মতো করে খেয়ে দেয়ে রুমে চলে এসেছে। তাতে সুজলা আরো ক্ষিপ্ত হলো। হুংকার ছেড়ে বলল,
‘শরীরে তেল বেশি হইছে? আমার কথাকে দাম দিচ্ছিস না যে?’
‘কে বলেছে দাম দেই দেই না মামি? মাস শেষে সাত হাজার করে টাকা দেই। এটা কি যথেষ্ট না?’
কথাটা বলে প্রিয়তা রুমে চলে গেল। এদিকে সুজলা চিৎকার করেই চলছে। রত্না মুখ টিপে হাসছে। আজ একদম তার মন মত জবাব দিছে প্রিয়তা।
চলবে……….