#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি
১০.
একের পর এক ম্যাসেজ আসছে। প্রিয়তা কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই নিখিলের সমস্যা কি? এত ম্যাসেজ কেন দিতে হবে? আর সে ম্যাসেজ দিলেও বা প্রিয়তা কেন রিপ্লাই করবে? প্রিয়তা আবারো বইয়ে মন দিল। অবহেলায় পড়ে রইলো ফোনটি আগের স্থানে। এর মাঝে ডোরবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখল বাড়িওয়ালা দাদু থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা বুঝে না সবসময় এমন থমথমে মুখ করে থাকার কারণ। দিদাকি তাকে আদর যত্ন করে না? প্রিয়তা মিষ্টি হেসে সালাম দিল। জবাবেও দাদু থমথমে মুখে তাকালো।
‘কিছু বলবেন দাদু?’
‘আমার বাড়িতে থাকতে কিছু নিয়ম আছে। সেগুলোই জানাতে এসেছি।’
এমন কাঠকাঠ কথায় প্রিয়তা না চাইতেও বিভ্রান্ত হলো। মানুষ বুঝি শুরুতেই এমন কথা বলে!
‘জ্বি। ভেতরে এসে বসুন?’
লোকটা জবাব দিলো না। তবে হাতের ইশারায় বুঝাল সে এখানেই ঠিক আছে। প্রিয়তা নড়েচড়ে দাঁড়াল। তার কেমন জানি নিজেকে আসামি আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধকে জজ বলে মনে হচ্ছে। প্রিয়তার একটা ভুল কথা তার প্রাণ কেড়ে নিবে এমন দমবদ্ধ অনুভূতিতে প্রিয়তা হাঁসফাঁস করে উঠলো। বাড়িওয়ালারা বুঝি এমনই হয়!
‘চাকরি কর নাকি?’
‘জ্বি।’
‘রাত করে বাড়িতে ফেরা চলবে না। সে তুমি যত বড় চাকরিই কর না কেন।’
প্রিয়তা ঝটপট জবাব দিলো,
‘জ্বি না বড় চাকরি করি না। প্রাইমারি স্কুলের গেস্ট টিচার।’
লোকটা চশমার উপর থেকে কপাল কুঁচকে তাকালো। এখানে কপাল কুঁচকানোর কি আছে? প্রিয়তার ইচ্ছা হলো লোকটাকে বলতে,’দাদু আপনার কপালের চামড়া কি ছোট থেকেই অমন কুঁচকানো?’
‘দরজা জানালা আটকাই থাকবে। একা মেয়ে মানুষ। সাবধানতা নিজের মধ্যে। আমি আমার কর্তব্য পালন করলাম মাত্র। আমি এখন যাচ্ছি তুমি দরজায় খিল দাও।’
‘জ্বি দাদু।’
____________
কিছুদিন ধরে আয়াজ ভিষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রিয়তার সাথে তার দেখা হয়না এক সপ্তাহের বেশি। কেবল রোজ রাতে সময় করে দশ মিনিট ভিডিও কলে কথা হয়। দুজন মানব মানবী নিরবে একে অপরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। দুজনেই সারাদিন বাদে তার প্রিয় মানুষটাকে দুচোখ ভরে দেখে নেয়। তাদের সকল ক্লান্তি একে অপরের চোখে তাকিয়েই যেন দূর হয়ে যায়। তবে এ নিয়ে দুটো মানুষের কারোর কোনো অভিযোগ ছিল না। সুন্দর করে মানিয়ে নিয়েছে তারা। তবে আজ ঘটনা ভিন্ন। রাত একটা বাজতে চলছে কিন্তু আয়াজের কোনো খোঁজ নেই। কল করলেও রিসিভ হচ্ছে না। চিন্তিত হয়ে সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করছে প্রিয়তা। একটুতে উত্তেজিত হওয়া মানুষ নয় সে। তবুও সে উত্তেজিত হয়ে উঠছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেতে শুরু করেছে। মাথার মাঝে এলোমেলো অগুছালো খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু হলো না তো ছেলেটার!
ঘড়িতে রাত একটা বেজে সাতাশ মিনিট। ঘড়ির কাঁটার টিক টক শব্দ আর মশার গুনগুন গান পরিবেশকে থমথমে করে তুলেছে। প্রিয়তার রুমের লাইটটি এখনো জ্বলছে। ঘুমঘুম চোখে প্রিয়তা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বুঝে আসতে চাইছে যেন। কিন্তু তার অবচেতন মন বলছে এখনি কল আসবে। তার মনের কথা বৃথা যায়নি। নিঃশব্দ কামরার দ্যজা জানালা কাঁপিয়ে বেজে উঠলো ফোন। প্রিয়তার ঠোঁট কোনে খেলে গেল এক টুকরো হাসি। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সময় নিয়ে আয়াজ উত্তর দিলো,
‘ক্ষুদা পেয়েছে প্রিয়তা। একটু নিচে আসবে? ভাত আছে?’
প্রিয়তার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। চোখ ভরা ঘুম যেন নিমিষেই উদাও হয়ে গেলো। শিরশির করে কেঁপে উঠলো দুচোখের পাতা। প্রিয়তা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,
‘আমি আসছি।’
কল কেটে যাওয়ার পরও দু মিনিট থম মেরে বসে রইল সে। আয়াজ ছেলেটা দিন দিন বড্ড পাজি হয়ে যাচ্ছে! কেমন করে ডাকে! “প্রিয়তা!” আবার তুমি করেও বলছে! প্রিয়তা বড় করে শ্বাস নিলো। ব্যস্ত পায়ে রান্না ঘরে যেয়ে প্লেটে ভাত তুলে নিল। ডাল ছাড়া আর কিছুই নেই। ব্যস্ত হাতে একটা ডিম ভেজে নিল। ব্যাস এতেই চলবে।
ল্যাম্প পোস্টের আলোতে ফরমাল পোশাক পরিহিত আয়াজকে প্রিয়তার একজন অতিবসুদর্শন পুরুষ বলে মনে হলো। আয়াজের ক্লান্তিতো মোড়ানো মুখটা তার সৌন্দর্যের কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। প্রিয়তা এগিয়ে আসতেই আয়াজ গাড়ির ডোর খুলে দিল। প্রিয়তা কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপচাপ উঠে বসলো। আয়াজ গাড়ির ভেতর ঢুকে ডোর লক করে দিল।
‘এত রাতে আমার বাসার সামনে কেন?’
‘তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্রেমিকা নেই আমার তাই।’
আয়াজের উত্তরে প্রিয়তার বুকের ভেতর আবারো ছলকে উঠলো। ছেলেটার কথা এমন কেন? তার প্রত্যেকটা কথা প্রিয়তার বুকের ভেতর কাঁচের মতো গেঁথে যায় তা কি সে জানে না? নাকি জেনে বুঝেই প্রিয়তাকে ঘায়েল করতে এই অস্রের ব্যাবহার!
‘বাড়িতে তোমার মা রান্না করেনি?’
আয়াজ গম্ভীর উত্তর দিলো,
‘আমার মা তোমারও মা হয় প্রিয়তা। এরপর আর কখনো এভাবে বলবে না। মা বলে সম্বোধন করবে। আমার সবকিছু তোমার। ইভেন মা টাও।’
প্রিয়তা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াল।
‘খাইয়ে দাও।’
প্রিয়তা পিটপিট করে তাকালো। এই পুচকে তার উপর হুকুম জারি করছে!
‘হাত নেই তোমার? খেয়ে নাও। আর কখনো এমন পাগলামি করবে না। যদি কেউ দেখে নেয় কি হবে বুঝতে পারছ?’
‘বিয়ে করে নিব। প্রবলেম সলভ।’
প্রিয়তা রেগে গেল। সিরিয়ায় ব্যাপারেও ছেলেটার গা ছাড়া ভাব। তার এ ধরণের ব্যাবহার একদম পছন্দ না। প্রিয়তা কিছুটা কঠিন হয়ে বলল,
‘তোমার বাচ্চামি বন্ধ কর আয়াজ। বিয়ে বললেই বিয়ে হয়ে যায় না। তুমি এখনো বাচ্চা রয়ে গেছ। তোমার পরিবার কখনো আমায় মেনে নিবে? আমার যোগ্য সম্মান তোমার পরিবারের কাছ থেকে দিতে পারবে তুমি?’
প্রিয়তা রাগে ফুঁসে চলছে এখনো। আয়াজ একমনে তাকিয়ে থাকলো প্রিয়তার দিকে। হঠাৎ বলে উঠল,
‘নেমে দাঁড়ান প্রিয়তা।’
প্রিয়তা না বুঝতে পেরে আয়াজের চোখে তাকালো। আয়াজ পুনরায় একই কথা আওড়াল।
‘বাহিরে নেমে দাঁড়ান।’
অবুঝের মত প্রিয়তা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতে শব্দ করে গাড়ির ডোর বন্ধ করে দিল আয়াজ। জোর শব্দে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। কিছু বোঝার আগেই শো করে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল আয়াজ। খাবার প্লেট হাতে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। পরক্ষণে অপমান আর খারাপ লাগায় চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো পানি। আয়াজের এমন ব্যবহার তীব্রভাবে আঘাত করল প্রিয়তার আত্মসম্মানকে। এই পুচকে ছেলের এত কিসের দাপট? রাগে মুখশ্রী লাল হয়ে এলো। বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভিতর ঢুকে নিঃশব্দে মেইন গেট লক করে নিজের ফ্লাটে চলে এলো সে। রাতে আর ঘুম হলো না। রুমের বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে বসলো প্রিয়তা। ধোঁয়া ওঠা কাঁপে চুমুক বসাল। তার মুখে আঁধার ছেয় আছে। তার গভীরতা এই রাতের আঁধারকেও হার মানাবে। প্রিয়তা নিজের বিহেভে অবাক হলো। সে কি বদলে যাচ্ছে? এই যে সে আয়াজের উপর রাগ করার চাইতে বেশি মন খারাপ করছে। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? তার এখন উচিত ঝটপট আয়াজকে তার সকল সাইট থেকে ব্লক করে দেওয়া। কিন্তু সে তা না করে দেবদাসের মতো চা খেয়ে শোক পালন করছে। দেবদাস! মেয়েরাও দেবদাস হয়? নাকি দেবদাসি!
প্রিয়তা আবারো চায়ের কাপে চুমুক বসাল। তার এভাবে আয়াজকে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। ছেলেটা দিনকে দিন চরম বিয়াদপ হয়ে যাচ্ছে। সবটাই শাসনের অভাব!
প্রিয়তা আড় চোখে ফোনের দিকে তাকালো। নাহ এখনো কোনো টেক্সট বা কল আসেনি। প্রিয়তার চোখ ছলছল করে উঠলো। অভিমান হলো খুব। একটা মেসেজ দিলে কি এমন হতো?
চলবে……….
(ভুলত্রুটি, ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।)