অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয় #লাবিবা_আল_তাসফি ৮.

0
451

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৮.

এক মগ গরম কফি হাতে ছেলের রুমে ঢুকলেন শাকিলা। আয়াজ তখন ল্যাপটপের স্ক্রিণে তাকিয়ে ভিষণ মনোযোগ দিয়ে অফিসের কিছু ফাইল দেখছে। কফির মগটা পাশে রেখে ছেলের পাশে বসলেন তিনি। পরম স্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‘বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে বাবা? ক্লান্ত লাগছে তোমাকে। এত প্রেশার এখনি কেন নিতে গেলে?’

আয়াজ শুকনো করে হাসলো। ল্যাপটপ কোল থেকে নামিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো করে গুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

‘এই সামান্য কাজ আমাকে দুর্বল করার ক্ষমতা রাখে না মা। তোমার বৌমার নিরব আঘাত আমাকে ভেঙে দিচ্ছে। তোমার উচিত বৌমাকে শাসন করা। তোমার একমাত্র ছেলেকে সে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে এর শাস্তি কি হওয়া উচিত?’

শাকিলা বিস্ময় নিয়ে ছেলের দিকে চাইলেন। কোন বৌমার কথা বলছে আয়াজ? সে তো কোনো বৌমাকে চেনে না। ছেলেকি তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিল? শাকিলা গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল,

‘তুমিকি আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছ?’

‘উহু।’

‘তাহলে বৌমা কে?’

‘যাকে আমি বিয়ে করবো।’

‘তুমিকি মেয়ে ঠিক করে ফেলেছ?’

‘চার বছর পূর্বে।’

‘তোমাদের সম্পর্ক এতদিনের আর আমাকে জানালে না!’

‘তার পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাকে এখনো এক সাগর পরিমাণ পথ পারি দিতে হবে মা। খুব পাষাণ হৃদয়ের মানবী সে মা। এই দেখ আমি কতটা পুড়ছি তার জন্য কিন্তু আজ দুদিন ধরে সে তার সাথে যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে।’

বাচ্চাদের মতো করেই একের পর এক অভিযোগ করে চলল আয়াজ। শাকিলা চুপ করে ছেলের অভিযোগ শুনলো। আয়াজ ছোট থেকেই গম্ভীর। খোলামেলা ভাবে কথা বলেনা সে কখনো। নিজের মাঝে সবটা লুকিয়ে রাখতেই সে পছন্দ করে। আজ তার ছেলেটা কতটা কষ্ট পেয়ে তার সাথে সব শেয়ার করছে ভেবেই তির চোখ ছলছল করে উঠলো। মেয়েটাকে সামনে পেলে সে অবশ্যই এর জবাব চাইবে। শাকিলা স্বযত্নে ছেলের মাথায় হাত ছোঁয়াল।

__________

প্রিয়তা আজ নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। হাতে নীল রেশমি চুড়ি। খোঁপায় ফুটন্ট গন্ধরাজ ফুল। চোখ ভরা কাজল। আর লালে রাঙানো ঠোঁট। বাতাসের তালে তালে কানের ঝুমকো জোড়া দুলছে। কপালের দুপাশে নেমে আসা সরু চুলগুচ্ছ বারবার বাতাসে নিজের স্থান থেকে নড়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা বিরক্ত হলেও খুব যত্ন নিয়ে তা গুছিয়ে নিচ্ছে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে বিরষমুখে আশপাশে নজর বুলাল প্রিয়তা। তার এত যত্ন করে সাজা কি ব্যর্থ হলো? প্রিয়তার সুন্দর মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে এলো। রাগ হলো ভিষণ। এ মুহূর্তে নিজের গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পর লাগাতে পারলে কিছুটা হলেও শান্তি লাগত। নিজের থেকে ছোট কোনো ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এরকম সেজেগুজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই তাকে সোভা পায় না। কিন্তু সে ষোল বছরের এক কিশোরীর মতো প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে। বারবার ব্যস্ত চোখে প্রেমিককে খুঁজছে। এগুলো নেহাত বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়।

আয়াজ এলো ঠিক দু ঘন্টা পর। এলোমেলো চুল, চোখের নিচে কালচে ছাপ আর অগোছালো পোশাকে আয়াজকে দেখে প্রিয়তার বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো। এতক্ষণ জমিয়ে রাখা রাগটা যেন নিমিষেই উদাও হয়ে গেলো। আয়াজের দিকে এগিয়ে আসতেই আয়াজ ব্যথাতুর কন্ঠে শুধাল,

‘আমায় কষ্টের মাঝে রেখে আপনার এ সাজ কার জন্য প্রিয়? সে কি আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে আপনাকে?’

আয়াজের চোখ ছলছল করে উঠলো। এই কঠিন ছেলেটার চোখে পানি দেখে প্রিয়তা চমকাল। পরমুহূর্তে ভিষণ ভালোলাগা কাজ করলো। এই অতিব সুদর্শন পুরুষটা যে কেবল তার উইল সে হাতে পেয়ে গিয়েছে। প্রিয়তা মুচকি হেসে জবাব দিলো,

‘এক বাচ্চা প্রেমিকের অপেক্ষায় ছিলাম। অলরেডি তিনি আমাকে দু ঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছে। আর এখন নিজেই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।’

প্রিয়তা একটু থেমে আবারও বললো,

‘এসব বাচ্চা সামলানো ভিষণ কষ্টের বুঝলে? কখন না কেঁদে দেয়! মানুষ কি ভাববে বলোতো?’

আয়াজ হেসে ফেলল প্রিয়তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে। সাথে প্রিয়তাও হাসলো। আয়াজ হাসলে ডান গালে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়। যা এই প্রথম প্রিয়তার নজরে এলো। সে মুগ্ধ হয়ে তার ছোট্ট প্রেমিকে দেখলো। নিঃসন্দেহে ছেলেটা ভিষণ সুন্দর। আগে কেন নজরে এলো না?

__________

‘আপনার পাশে আমায় বড্ড বেমানান লাগছে প্রিয়।’

ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল আয়াজ। প্রিয়তা বিরোধিতা করলো। বলল,

‘তোমায় উদাস প্রেমিকের মতো লাগছে আয়াজ। সুন্দরী প্রেমিকার পাশে উদাস প্রেমিকের কম্বিনেশন সবথেকে সুন্দর। বেমানান লাগার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি যতবার শাড়ি পড়ব তুমি এমন অগোছালো ভাবেই আমার পাশে হাঁটবে।’

আয়াজ মাথা নাড়িয়ে হাসলো। সূর্যের সরু আলো প্রিয়তার মুখে পড়ছে। চমৎকার লাগছে দেখতে। আয়াজ হাত দিয়ে আড়াল করলো সূক্ষ সে রশ্মিকে। অভিযোগ করে বলল,

‘আমি ছাড়া আপনাকে কেউ ছুলে আমার ভিষণ হিঃসা হয় প্রিয়। সূর্যের ও জানা উচিত আপনি কেবল আমার। আপনাকে ছোঁয়ার সাহস দেখানো তার মোটেই উচিত নয়।’

প্রিয়তা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আয়াজ মুগ্ধ হয়ে তা দেখলো। প্রেয়সীর এ রূপ তার প্রথম দেখা। প্রিয়তাকে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে আগে কখনো সে দেখেনি। ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো মন।

____________

প্রিয়তা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা করে। পুরোটা দিন সে আজ বাড়ির বাহিরে কাটিয়েছে। ড্রয়িংরুমে বসে জাহিদ প্রিয়তার ফেরার অপেক্ষা করছিল। প্রিয়তা ড্রয়িংরুমে মামাকে দেখেও না দেখার মতো করে রুমে চলে যাচ্ছিল কিন্তু বাঁধা দিল জাহিদ। গম্ভীর কণ্ঠে ঢাকে বলল,

‘এখানে এসে বসো। কথা আছে।’

প্রিয়তা দ্বিরুক্তি করলো না। চুপচাপ মামার দেখানো সোফায় বসলো। জাহিদ প্রিয়তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

‘কোথাও গিয়েছিলে?’

‘হুম।’

‘সারাদিন বাসায় ফেরোনি। তুমি এখন যথেষ্ট বোঝ। এভাবে সারাদিন বাসার বাহিরে থাকা কি সোভা পায়?’

প্রিয়তা মাথা নিচু করে রইল। উত্তর দিলো না। জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরপর বলল,

‘তাহলে তোমার মামি আমাকে যা কিছু বলেছে সব সত্যি? তুমি সত্যিই কারো কথা শুনছ না?’

প্রিয়তা এবারো কোনো কথা বলল না। তার ভিষণ অভিমান হলো। সে তো মাত্র আজ একদিন বাহিরে ছিল। মামা কিভাবে মামির সবকথা বিশ্বাস করে নিল?
প্রিয়তার নিস্তব্দতা জাহিদের পছন্দ হলো না। তার মনে হলো অতি আদর দিয়ে প্রিয়তাকে সে চরম বিয়াদপ বানিয়ে ফেলেছে। বাড়ির মেয়ে কাউকে না জানিয়ে সারাদিন ঘরের বাহিরে থাকছে এটা মানুষ জানলে কত কথা রটাবে! তিনি আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তোমার বয়সের মেয়েরা সংসার করে খাচ্ছে। তোমার আপত্তি থাকায় এতদিন আমি তোমায় কিছু বলিনি। কিন্তু সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। আমি চাই খুব শীঘ্রই ভালো কোনো পাত্র দেখে তোমায় তার হাতে তুলে দিতে। আশি করি তোমার কোনো আপত্তি নেই।’

‘যদি থাকে?’

প্রিয়তার পশ্নে জাহিদ ভিষণ রকম বিরক্ত বোধ করলো। কপাল কুঁচকে তিনি কঠিন কন্ঠে বলল,

‘এখনো তুমি বলতে চাইছ তোমার আপত্তি আছে? আমার ঘরেও একটা মেয়ে আছে। আমার একটা সংসার আছে এটা ভুলে যেও না। আমি চাইনা তোমাকে নিয়ে এ সংসারে আর কোনো ঝামেলা হোক। এখন সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।’

কথাগুলো বলে জাহিদ গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। প্রিয়তা ঠাঁয় বসে রইল। জাহিদের বলা কথাগুলো বারবার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ মামাও তাকে বলতে চাইল সে এই পরিবারের অশান্তির কারণ! প্রিয়তা উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে। তার নিজেকে ভিষণ একা লাগছে। এলোমেলো অবস্থায় বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল। তাকে একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আর কত অবহেলা সইবে সে? এ বাড়ির কেউ তাকে মানুষ ভাবে না। তার যে একটা মন আছে সেটাই সবাই ভুলে বসেছে।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here