চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-৪২

0
388

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪২
১২৫.
তালুকদার বাড়িতে অর্পণ ফিরেছে সন্ধ্যা সাতটায়।নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে শার্ট’টের বোতামগুলো একটা একটা করে খুলতে নিলেই পিছনে থেকে দুটো অচেনা হাত পেচিয়ে ধরেছে।অর্পণ কপালে ভাজ ফেলে গা থেকে অচেনা হাতদুটো ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে তাকায়।

কে?তন্নী!

হ্যা,আমি।কেমন আছো তুমি?

হুম,ভালো।কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি তোর সমবয়সী।সম্পর্কে আমি তোর বড়ো হই।তাই সম্মান দিয়ে কথা বল!

হুম!তোমাকে সম্মান দিতে আমার বয়ে গেছে।শুনো না,তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

শুনার মতোও হলে অবশ্যই শুনবো।কিন্তু উল্টোপাল্টা ব’লে খবর আছে।কি বলবি বল?আর ব’লেই কে*টে পর!

বলছি,তন্নী নিজের নার্ভাস কাটিয়ে মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল,

আ..মি।

হুম।আমি।তারপর কি?

ইয়ে..মানে..আসলে আমি না ভালোবাসি।আই মিন অ..ন্ত…

তন্নীর কথা শুনে অর্পণ বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল,

ইয়ার্কি হচ্ছে হ্যা!সেই কখন থেকে ইয়ে,মানে,আমি,ভালোবাসি?এসব কি?আমি তোর বড় হই।আর তুই ভালোবাসার কথা আমাকে বলতে এসেছিস।থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে দিব!বেয়াদব।যা নিজের রুমে যা।যা বলছি।অর্পণের ধমকে তন্নী ঘাবড়ে গেলো।মন খারাপ করে নিজের ঘরের দিকে গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।এইদিকে অর্পণের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো।যাকে ভালোবাসি সে বুঝতে চায় না আমায়।আরেকজন আসছে নিজের ভালোবাসা নিয়ে।যতোসব ফাউল।গায়ের শার্ট টেনে খুলে নিচে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল।এখন মাথা ঠান্ডা করা প্রয়োজন।মাথা ঠান্ডা না হলে নেক্সট মিটিংয়ের জন্য প্রস্তত হতে পারবে না।
ঝর্ণা ছাড়তে মাথায় পানি পড়তে লাগল। চোখে,মুখে পানি পড়তেই চোখ বুঝে নিতেই পুতুলের মুখটা ভেসে ওঠে।

গোসল শেষ করে নিচে নেমে আসে।কফিতে চুমুক বসিয়ে সোফায় পা টান করে বসে।এরমধ্যে রাবেয়া ডিউটি শেষ করে বাসায় আসেন।ছেলের ভাবমূর্তি এত শক্ত দেখে মনে মনে ব’লেন।এর আবার কি হলো?

ছেলের মাথায় হাত রাখতেই চোখ মেলে তাকায়।

মা..!

হুম কি হয়েছে? আমার বাপ আজ এত আপসেট কেন?কিছু হয়েছে?

মায়ের হাতটা ধরে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু বসিয়ে বলল,আমি একটা ভুল করেছি?কাউকে আঘাত করার আগে তার সত্যিটা জানো জরুরি ছিল।আমি ঠিক করিনি।

রাবেয়া ছেলের গালে হাত রেখে বলল,কাকে আঘাত করেছো আব্বু?কি তার অপরাধ?

তার অপরাধ সে কাউকে ভালোবেসেছে।এমনকি বারবার বলতে এসেও কথা শুনেছে। আমি আজ এই হাত দিয়ে তাকে আঘাত করেছি।আমি তার ভাই হয়ে তার ওপরের রাগারাগি করেছি।আমি তন্নীকে মেরেছি।

রাবেয়া ছেলের মুখ প্রাণে তাকিয়ে আছেন।

মা,আমাদের তন্নী কাউকে ভালোবাসে।এমনকি তার সন্তান নিজ গর্ভে ধারণ করেছে।আমাদের না জানিয়ে সে গোপনে বিয়ে আরো ছয়মাস আগে করেছে।আর সে ছেলেটা আর কেউ নয়।আমার বাবার বন্ধু জানে জিগারের ছেলে অন্তর।দিহান সাহেবের ছেলে।যার সাথে আমার ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।পুতুলের সাথে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কারণ ছিল আমাদের বোন তন্নী।হ্যা মা,আমাদের তন্নীর সাথে অন্তর এর পরিচয় দুই বছরের বেশি।আর বিয়েতে ওদের মত ছিল না।সেখানে তন্নী আমি ভাবতেই পারছি না।এসব কি হয়ে গেলো?সবটা আরো আগে জানলাম না কেনো?ওকে বিদেশে পড়তে পাঠানো উচিত হয়নি।এমনকি এসব সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে, বাচ্চা।চাচা,চাচী এখনো এসব জানে না।তাদের রিয়াকশন কেমন হবে বুঝতে পারছো?তাদের আদরের কন্যা তাদের কাছে বিষয়টি লুকিয়েছে।আমি কি করব? বুঝতে পারছি না।

অর্পণের কথা শুনে রাবেয়া চমকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাফিন এবং তার বিবি মাসুদা মুখ দেখে তব্দা খেয়ে উঠে।কিছু বলার আর বোঝার বাকি নেই।তারা সবটা শুনতে পেয়েছে।দু’তলায় উপরে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তন্নী কাঁদছে।দ্বিতীয়বারের মতো অর্পণ এর রুমে যখন ঢুকে এবং জোর করে তার মনের সব কথা ব’লতে নেয়।তখনই অর্পণ ঠাসস করে এক গালে থাপ্পড় মেরে দিয়েছে।এতখন ভাই বকেছে, মেরেছে।এখন বাবা,মা তার পুরো ব্যাপারটা শুনেছে।আজ তাকে আস্ত রাখবেনা।ভয়ে ঢোক গিলো।

সাফিন তালুকদার মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন।কিন্তু মাসুদা তালুকদার চুপটি করে ছিলেন না।মেয়ের অপর গালে শক্ত করে কষিয়ে চড় লাগান।আর তাতেই তন্নী উড়মুড়ু করে পরে যেতে নিলেই রাবেয়া ধরে ফেলেন।

মাসুদা কি করছো তুমি?এতো বড় মেয়ের গায়ে কেউ হাত তুলে?শান্ত হও।

ভাবি কি করে শান্ত হব?এই মেয়েকে বিদেশে পাঠালাম পড়তে।আর তিনি প্রেম করে বিয়ে বাচ্চা অবধি সব করে এখন এসেছে পরিবারকে জানাতে।সব যখন তোদের মন মতো করবি।তাহলে আমাদের এখন কেন বলেছিস?যা তুই চলে যা।তোর মতো মেয়েকে আমি চাই না।অসভ্য মেয়ে,মা,বাবার সম্মান নষ্ট করে এখন সাধু সাজা হচ্ছে। ইচ্ছে করছে!তন্নীর দিকে মারার জন্য হাত আবার উঠে।তন্নী ভয়ে বড় চাচীর পিছনে মুখ লুকিয়ে নেয়।

মাসুদা শান্ত হও।এভাবে রাগারাগি করে সমস্যা সমাধান হবে না।ওরা ভুল অবশ্যই করেছে।এমনকি তন্নী গর্ভবতী।এটা চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না।আমি তোমার ভাইকে খবর পাঠিয়েছি।সে কাল সকালে বাড়িতে আসছে।সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত যেতে হবে।আর তাছাড়া দোষ দু’জনের তাই দুই পরিবারকে এটার সমাধান করতে হবে।

ভাবী ওরা কী মানবে?

কেনো মানবে না?সাফিন তুমি আইনের রক্ষক।তুমি শুধু মেয়ে বাবা হয়ে নয়।একজন পুলিশ অফিসার হয়ে ভাব।তারা দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক।এদের নিজস্ব মত রয়েছে।অন্তর এবং তন্নীর এটা আবেগের বয়স নয়।আর যা করার তারা অলরেডি করে ফেলেছে।এখন আমাদের দুই পরিবারের মন সায় না দিলেও মানতে বাধ্য হব।আর যে আসছে তাকেও অবহেলা করতে পারি না।এতে তার তোও কোনো দোষ নেই।আমাদের চোখে তন্নী,অন্তর দোষী হলেও শিশুটি নিষ্পাপ।তার সুস্থভাবে জম্ম এবং পৃথিবীর আলো দেখার অধিকার আছে।

১২৬.
এক সপ্তাহ পর…
আজ তালুকদার বাড়িতে ছোটখাটো বিয়ের আয়োজন হয়েছে।বিয়ে হচ্ছে তালুকদার বাড়ির মেয়ের।অসীম তালুকদার দিহান সাহেবকে সবটা ব’লেন।এবং পরবর্তী দুই পরিবারের মতেই বিয়ে হচ্ছে।জেফিন এর বিয়েতে সায় আছে।গরিব চাষা মেয়ে রেখে জাতের মেয়ে একটা ছেলে চয়েস করায়।তিনি গায় গুই প্রথমে করলেও পরে আপত্তি করতে পারেননি।

এইদিকে বিয়ের আসরে বর বেশে বসে আছে অন্তর,এবং কনে তন্নী।অর্পণ গম্ভীর মুখে সবটা করছে।দুই পরিবারের সামনে বিয়ের আনুষ্ঠানিক শেষ হতেই গেইটের সামনে আসে।পুতুল আজ তালুকদার বাড়িতে পা রাখেনি।দূরে দাঁড়িয়ে বিয়ের সবটাই দেখলো।ছেলে,মেয়ে কবুল বলতেই সে কয়েক পলক তাকিয়ে চলে যেতে নিলেই অর্পণের সামনে পরে গেলো।পুতুলকে দেখে অর্পণ পকেটে ফোন রেখে সামনে ঘুরে এলো।

পু.তু.ল তু.মি!

পুতুলের চোখ দুটো গম্ভীর আর মুখ শক্ত।ঠোটেঁ কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি।এই হাসিতেই ব’লে দিচ্ছে তার না হওয়া বর আজ তাদের গ্রামের মেয়েকে ঘরে তুলছে।অবশ্য কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকের মেয়েকে বিয়ে অনায়াসে করা যায়।কিন্তু গরিবের মেয়েকে নয়।গ্রামের লোকের কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস না হলেও এখন নিজ চোখে দেখতে পাওয়া সেটা অস্বীকার করবে কি করে?অর্পণ তালুকদার তার বোনকে খুশিমনে বিয়ে দিচ্ছে।সবটা দেখতে পেয়ে ওহ পুতুল চুপ।চুপচাপ গাড়িতে উঠে দুই ভাইকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেলো।এইদিকে অর্পণ কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে।তাঁকে আবার ভুল বুঝলো।গাছের সাথে হাতটা জোর আ*ঘাত করে বলল,শিট,শিট।হাত কে*টে র*ক্ত পড়ছে।অর্পণের সেইদিকে খেয়াল নেই।

বোনকে বিদায় দিতে দিতে অন্তরের পাঞ্জাবি গলারটা ঠিক করতে করতে বলল,

আমাদের দূর্বল ভেবো না দুলামিঞা।আমরা মোটেও দূর্বল নই।তোমার কারণে যদি কোনোদিন আমার বোনের চোখ থেকে এক ফোটা পানি ঝরে।তাহলে সেই দিন বোঝাবো অর্পণ কি চিজ?এটাকে হুমকি ভাবো।কিংবা উপদেশ।

স্বাধীন মেয়েকে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে ওহ চুপ রইলো।গ্রামের লোকের কথা তাহলে মিথ্যে নয়।তাদের সেই বরযাত্রী এখন তালুকদার বাড়ির মেয়ে জামাই।তারা বন্ধু থেকে আত্মীয়তে রূপান্তরিত হয়েছে।

পুতুল নিজের মনকে শক্ত করতে বিছানার চাঁদর খামচে ধরেছে।নিজেকে স্বাভাবিক করতে সিদ্ধান্ত নিলো এই গ্রামের মাটিতে সে আর থাকবে না।সে কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে।সকাল হতেই নিজ আসল গন্তব্যে চলে যাবে।শুধু মামাকে জানিয়েছে।

সকাল বেলা পুতুল ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনের থেকে নেমে গেলো।একটা সিটে ব্যাগটা রেখে তার পাশে নিজে বসে ভাবতে লাগল।এরপর শুরুটা কোথা থেকে করবে?চোখ বুঝতেই মামার কথাগুলো মনে করে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।যেখানে তার ভবিষ্যৎ পরে আছে।

এইদিকে অর্পণের রাতে ঘুম হয়নি।ভোর হতেই রুহিতপুর গ্রামে ছুটে আসে।আর আসতেই শুনতে পায় পুতুল এই গ্রাম কাল রাতেই ছেড়ে চলে গেছে।কিন্তু কোথায় যাবে?শহরে তার কে আছে?অর্পণ ঢাকায় বাইক নিয়ে ছুটে চলে।আষাঢ়ের বৃষ্টিতে তার পুরো শরীর ভিজে একাকার সেই দিকে মন নেই।মুখে বিরবির করছে।পুতুল ব’লে।

অপরদিকে পুতুল ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে আছে।আষাঢ়ের বৃষ্টিতে সে-ও ভিজে একাকার।কিন্তু বৃষ্টিটা আজ তার গায়ে লাগছে না।সে অন্য চিন্তায় ব্যাস্ত।অর্পন নিজের লোকের মাধ্যমে জানতে পারে পুতুলের বর্তমান ঠিকানা।সেখানে পৌঁছে বাইক থেকে নেমে বগিতে এবং সব জায়গায় চেক করতে থাকে।আর অবশেষে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে।

পুতুল চোখ মেলে তাকাতেই অর্পণকে সামনে দেখতে পায়।তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই অর্পণ তার হাত ধরে ফেলে।

পুতুল তার হাতটা ছাড়িয়ে নিতে হাত মুচড়ায়।কিন্তু আজ অর্পণ ওহ তাকে ছাড়ছে না।পুতুলের হাতটা শক্ত করে ধরেছে।

অতিরিক্ত বৃষ্টি জন্য সবাই দূরে দাঁড়িয়ে আছে।আশেপাশে কিছুর দেখা মিলছে না।পুতুল মুখ ঘুরিয়ে সামনের রাস্তার প্রানে তাকিয়ে।

পালিয়ে যাচ্ছো।আমি তোও জানি আমার আদূরিনী বউ পালিয়ে যেতে পারে না।সে আর পাঁচটা মেয়ের মতো ভীতু ডিম নয়।সে সাহসী। সে লড়তে জানে।সে আমার আদূরনী।আমার ভালোবাসা।ইয়েস,আমি আমার সাহসী এই ধানিলংকাকে ভালোবাসি।তাকে নিজের করে পেতে চাই।একটিবার শুধু মাএ একটিবার বিশ্বাস করে আমার এই হাতটা শক্ত করে ধরে দেখো।কথা দিচ্ছি তুমি ঠকবে না।আমি আছি তোমার কাছে।তোমার ছায়া হয়ে।শুধুমাত্ত তোমারই জন্য।

কালো বোরকা ভিজে আছে।তার সাথে পুত্তুলের চোখের পানি।সুর্দশন পুরুষটি তার থেকে উঁচু হওয়া তার কপালের চুইয়ে পানির ফোটাগুলো তার কালো বোরকা আবরণে মুখ বরাবর পড়ছে।পুতুল নিজের হাত ছাড়াতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ে।অর্পণ তবুও পুতুলের হাতটি ছাড়ে না।বরং পুতুলের বরাবর বসে,উল্টো ওপর হাতটির সাহায্য পুতুলের গালে হাত রাখে।

প্লিজ চলে যেওনা।আমি নিঃশ হয়ে যাবো তুমি বিহীন।আমি তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত বাঁচতে পারব না।বিকজ আই লাভ ইউ।আই রেয়লি লাভ ইউ সো মাচ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here