#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৪
১২৯.
পুতুল অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পরে আছে।রাবেয়া চেক-আপ করে ছেলের মাথায় হালকা করে থাপ্পড় লাগিয়ে বলল,
বেয়াদব।সত্যি করে বল কি করেছিস?তোর কারণে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে।
আমি,আমি আবার কি করলাম?একটু লাটিমের মতো ঘুরিয়ে শেষ পাতে একটা চুমু দিয়েছি।ব্যাস এতুটুকুই।
তোর এতটুকুই তার জন্য ভারি পড়ে গেছে।বিয়ে হতে দেড়ি বউকে ঝাটকা দিতে দেরি নেই।
বারে বউ আমার।আমি একটু আদর দিতেই পারি।এতে এত শকটের কি হলো?আর এক চুমুতে বউ অজ্ঞান হলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে?আমি কি এই জম্মে বাবা ডাক শুনব না?ছেলেকে বিরবির করতে দেখে আরেক থাপ্পড় তার বাহুতে লাগিয়ে বলল,যা বাহিরে যা।পরে আসবি।অর্পণ মন খারাপ করে বাহিরে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে পুতুলের জ্ঞান ফিরে আসে।চোখ মেলে সেই বউ পাগলকে না দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেলে।মামা তাকে এ কোন পাগলের গলায় দিল।
আম্মু আপনি ঠিক আছেন?রাবেয়ার ডাকে পুতুল তাকিয়ে ইশারায় বলল,
সে ঠিক আছে।
সারাদিন পেটে কিছু না পড়ায়।আর অতিরিক্ত দূর্বলতার জন্য এমন হয়েছে।কিছু খেয়ে নিন।রাবেয়া হাত ধুয়ে পুতুলের মুখের সামনে খাবার ধরে বলল,নেও হা কর!এমন রোগা-সোগা মেয়ে মানুষকে আমি আমার বাড়িতে ছেলের বউ করে ঘরে তুলবো না।রাবেয়া বক্তব্যে পুতুল অবাক চোখে তাকিয়ে।পুতুলের কৌতুহল বুঝতে পেরে বলল,
আমি অর্পণের আম্মু।তালুকদার বাড়ির বড় বউ রাবেয়া।অসীম তালুকদার আমার স্বামী।
অর্পণের মায়ের কথায় পুতুল আরেকদফা চমকে উঠে।
আর তুমি আমাদের বউমা নও।আমাদের মেয়ে হয়ে যাবে।তবে সেটা আজ নয়।তোমার স্বপ্ন,তোমার লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর।এই বিয়েটা সবকিছু বিবেচনা করেই ঘরোয়াভাবে দেওয়া হ’য়েছে।কি করতাম?একদিকে আমি যেমন অর্পণের মা।আরেকদিকে তোমারও মা হ’য়েছি।দায়িত্ব ও কর্তব্য দু’টোই নিষ্ঠার সাথে পালন করতে চেয়েছি।কাউকে আঘাত করে তার স্বপ্ন ভঙ্গ করে বউ করে নিতে আসতে চাইনি।কিন্তু ছেলের পাগলামি।আর তোমার কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।একদিন বিয়ে যখন করতেই হবে তখন সেটা আজ করলে ক্ষতি নেই।নিয়মমতো তুমি তোমার মামার কাছেই থাকবে।কিন্তু শরীয়ত মতে তুমি বিবাহিত।এবং তোমার ঘর,বর দু’টোই আছে।তোমার যখন ইচ্ছে যা খুশি করতে পারো।আমি তোমাকে পুরো স্বাধীনতা দিচ্ছি।
নেও এখন খেয়ে শরীর ঠিক রাখ।নিজের লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য।পুতুল খেতে চাইছে না।মুখটা তিতা হয়ে আছে।রাবেয়া মিষ্টি করে হেসে প্লেটের ভাত গুলো ভাগ ভাগ করে নিলো।
একটা লোকমা তুলে বলল,
এটা রাজিয়ার নামে।তোমার জন্মদাত্রী মায়ের জন্য।খেয়ে নেও।মায়ের কথা শুনতেই পুতুল প্রথম লোকমা মুখে নিলো।তার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।রাবেয়া নিজের আঁচল টেনে পুতুলের চোখের পানি মুছে কপালে চুমু একে দিলো।
ভাত সামনে নিয়ে কাঁদতে নেই।এতে আল্লাহ নারাজ হন।রাবেয়া দ্বিতীয় লোকমা তুলে বলল,
এটা তোমার মামার নামে।যে মামা ছোট্ট থেকে পুতুলকে আজ এত বড় অবধি করেছেন।যার জন্য আমি আমার মেয়েকে পেয়েছি।তার আম্মাজান।আজ আমার ঘরের
রাজকন্যা হয়েছে।তার স্বপ্নে চলার দিনগুলোতে সাহস দিয়েছে।তার পাশে সব সময় রয়েছে।পুতুল হাসি মুখে দ্বিতীয় লুকমা মুখে নিলো।
তৃতীয় লুকমা পুতুলের সামনে তুলে বলল,
এটা সেই ছোট্ট জানের জন্য।যাকে বাবা নামক অমানুষ পিতার হাত থেকে বাচাঁতে তুলে দিয়েছে মামা,মামীর কোলে।সাজু,সাথে তার ঠাঁই হয়েছে মামী নামক আরেক মায়ের সঙ্গে।তার জম্মের সময়ে তার মা নামক রমনী মৃত্যু হয়েছে।সে জানে না।কিন্তু আমার এই আম্মু তোও সব জানে।আজ জেনেও চুপ শুধু মাত্র মিলনের জন্য।এত বছর ধরে যাদের মা,বাবা জেনেছে।আজ যদি অন্য কেউ তার মা,বাবা এটা শুনে।সে মানতে পারবে না।কষ্ট পাবে ব’লে চুপ।রাবেয়া সাথে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় চলে গেছে।পুতুলের খাওয়া শেষ আরো আগেই।রাবেয়া বলা কথাগুলো তাকে সেই পূরনো ক্ষত মনে করিয়ে দিয়েছে।না চাইতেও রাবেয়া বুকে পরে কান্না করছে।
এই কান্না আজকেই শেষ।এরপর আর কান্না নয়।শুধু হাসি,আর আনন্দ থাকবে।আমি জানি আজ কথাগুলো বলায় তুমি কষ্ট পেয়েছো।বিশ্বাস কর বলতে চাইনি।কিন্তু আমার মনে হলো,তুমি ভাবছো এই বিয়েটা তোমায় করুণা করে দেওয়া হয়েছে।সবাই করুনা করেছে।কিন্তু এসব মিথ্যে।আমরা প্রথম থেকেই সবটা জেনেই মেনেই নিয়েছি।
এতখন হয়ে গেছে পুতুলের কোনো খবর নেই অর্পণ অস্থির হয়ে গেছে।আর থাকতে না পেরে দুম করে রুমে ঢুকে পরে।রুমে প্রবেশ করতেই মায়ের কোলে পুতুলকে দেখতে পায়।তার বক্ষ জুড়ে একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেছে।ভীরু পায়ে এগিয়ে আসতেই দেখে তার আদূরনী ঘুমিয়ে আছে।মায়ের কোলে নিজের বউকে এভাবে পরম মমতাময় কোলে ঠাঁই পেতে দেখে নিজেরও লোভ লাগছে।মায়ের অপর পাশে বসে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রয়।এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেও ঘুমিয়ে পরে।বোনের বিয়ের দুই রাত জাগ্রত ছিল।কিন্তু আজ সব কিছুর সমাধান হয়েছে।তার আদূরনী তার অর্ধাঙ্গিনী তার হয়ে গেছে।একে অপরের সঙ্গে বাঁধা পড়েছে।বিবাহ নামক মিষ্টি সম্পর্কে।যেখানে হালাল করে প্রিয়তমাকে পাওয়া হয়েছে।এই স্বামী,স্ত্রী মিষ্টি সম্পর্ক সত্যি সুন্দর।
১৩০.
ঢাকা কাজের শহর কিংবা বেঁচে থাকার চাবিকাঠি।হ্যা ছোট ছোট গ্রাম থেকে অনেক ছেলেরা জীবিকার তাগিদে এই শহরে মাটিতে পা রাখে।নিজের পরিবার আপনজনের থেকে দূরে ফেলে আসে।তারা সকাল সাতটা মধ্যে কাজের জন্য বের হয়।আর ব্যাচেলার রুমে ফিরে রাত নয়টা কিংবা দশটায়।আবার কখনো কখনো নাইট ডিউটি করে কিছু বাড়তি অর্থর আশায়।এই দুনিয়ায় টাকা যার কাছে আছে।সে মূল্য আরকদর বেশি হয়।যার পকেটে টাকা নেই।তার মুল্য নেই।কারণ সবাই জানে সে ফকির।আজ পুতুল এই শহরে মামাকে ছাড়া প্রথমবার পা রাখছে।তার পাশে রয়েছে অর্পণ তালুকদার।তার হাতের মুঠোয় নিজের ছোট্ট হাতটা শক্ত ধরে রাখা।মনে হচ্ছে সে হাত ছাড়লেই পুতুল হারিয়ে যাবে।সে নিজের প্রিয়তমাকে আগলেই রেখেছে।এমনকি তার স্বপ্ন পূরণ করতে সব কাগজ পত্র তৈরি করে বলল,
সই করতে।পুতুল পুরো কাগজটা পড়ে সই করে দিল।আজ তার মেডিকেল কলেজের প্রথমদিন।সবকিছু আলহামদুলিল্লাহ ভালো হচ্ছে।নিজের স্বপ্নটা এত কাছেই সে ছুটেছে।
পুতুল চোখের পাতা বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাল রাতের দৃশ্যটি।মামা তাকে মেডিকেলে ভর্তি করতে নিজের শেষ সম্ভবলটুকু বিক্রি করতে গঞ্জে যায়।সেই খবর অর্পণের কানে আসে।সে কিছুতেই শেষ অবলম্বন তাদের চাষের জমিটুকু বিক্রি করতে দেয়নি।সে নিজের বিবি ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে যানে।তাই বিয়ে যখন হয়েছে এখন পুতুল মানুক কিংবা না মানুক।অর্পণ তালুকদার তার স্বামী।তাই শরীয়ত মতে সে নিজের স্ত্রী দায়িত্ব নিবে।স্বাধীন প্রথমে দ্বিধা করলেও অর্পণের বুঝে তাকে থামতেই হয়।স্বাধীন বলল,
বউয়ের সব দায়িত্ব যখন তুমি নিয়েছো।তাহলে তাকে নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমার।কালকে তুমি নিজে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাবে।স্বাধীনের কথায় অর্পণ সায় দেয়।
আর আজ তারা ঢাকায়।সবকিছু সম্পূর্ণ হতেই পুতুলকে নিয়ে নিজবাস ভবনে উঠে।
একটা তিন কামরার রুম।এড জাস্ট বাথরুম, গোসলখানা।রান্না ঘর আলাদা।এ-ই রুম গুলো তাদের বাড়ির তিন রুমের এক রুমের সমান।এত বড় বাড়িতে এই লোকটা একা থাকতো।পুতুল সবকিছু নিজের হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে লাগলো।কিচেন রুমে এসে পুতুল অবাক।কি সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।অর্পণ ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,
তুমি এখানে কি করছো?খিদে পেয়েছে।আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হও।আমি রান্না বসিয়ে দিচ্ছি।পুতুলকে যেতে ব’লে অর্পণ ফ্রীজ থেকে মাংস বের করে ভিজিয়ে নিলো।গ্যাস চালু করে ডাল বসিয়ে দিলো।অপর চুলায় ভাত বসানোর জন্য পানি ফুটিয়ে চাল ধুয়ে দিল।এইদিকে পুতুলের মুখটা হা হয়ে গেছে।এই বান্দা রান্না করতে জানে।সবকিছু এত নিখুঁতভাবে কিভাবে করছে।পুতুল চোখ দুটো চুলকে আবার তাকিয়ে রয়।অর্পণ ছু*রির সাহায্যে পিয়াজ কুচি করছে।টমেটো কাটছে।মরিচ,আলু কাটছে।পুতুল দা,বটি দিয়ে কা*টাকা*টি করলেও ছু*রির সাহায্যে কখনো করেনি।আজ স্বামী রুপে এই মানুষকে দেখে হতভম্ব হচ্ছে।এই লোকটা ছোট বেলায় নাকি বাদর ছিল।তার মায়ের মুখে শুনা বানী।পুরো গ্রামের মানুষকে জ্বালিয়ে মারতো।কারো গাছের ফল তোও কারো মুরগী,কবুতর,ছাগল চুরি করতো।তার হাত থেকে কিছুই রেহাই পেতো না।অবশ্য তাদের বাড়িতে গিয়েও রানীকে চুরি করে।আর সেইদিন সে রাগে তার জুতা ছুড়ে মেরেছিল।তখন কি জানতাম?এই লোকটা ভবিষ্যতে আমার জামাই হবে।আবার পড়াশোনা করেছে।রাজনীতি করছে।তাহলে এসব রান্নাবান্না ঘরের কাজ কবে শিখলো?অর্পণ নিজের কাজের মাঝে একবার ঘুরে পিছনে তাকায়।
তুমি এখনো দাঁড়িয়ে কেনো?যাও ফ্রেশ হও।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে বলল যাচ্ছি।যেতে যেতে আরেকবার ঘুরে তাকিয়ে গেলো।
চলবে…