#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৭
১৩৪.
পুতুল আমার মামা জনাব শাফকাত খান।যার নামটা আমার নানু মা খুব শখ করে ভালোবেসে রেখেছিলো।সবার ছোট্ট সন্তান ব’লেই তার সব গুনা পার পেয়ে যেতো।তার ছোট্ট ছোট্ট ভুল গুলো কবে এত বড় হলো কেউ বিশেষ নজরে রাখেনি।তাঁকে ছোট্ট বেলা থেকে যদি অপরাধগুলো আঙুল তুলে দেখিয়ে দিত।সে ভুল।তাহলে ওই দিনটাই আসতো না।সেই সময় তোমার জম্ম হয়েছে।তুমি তোমার মায়ের সবে কোল জুড়ে।তখন তুমি একটা ফুটন্ত শিশু।যার চোখে ছিল শত মায়া আর ভালোবাসা।তোমাকে নিয়ে তোমার মা শত লড়াই করে তোমাকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন।
সময়টা ফ্লাগুন মাসের শেষের দিক।ছোট মামা বাংলাদেশে আসে ছুটি কাটাতে।তার জাপানে বিজনেস আছে।তোমার মা,বাবা যেখানে থাকতো।সেই গ্রামে ঘুরতে যান।তোমার মায়ের দিকে তার নজর পড়ে।তোমার মা,তোমার বাবাকে নিয়ে একটা ছোট্ট সংসার গড়ে ছিল।সেই ঘরে হাসি টুকু সে নষ্ট করেছে।হ্যা,পুতুল।তোমার মায়ের সৌন্দর্য দেখে তার মনে কু বাসনা জাগে।সে তখন এটাও জানতো।তোমার মা বিবাহিত তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।তবুও তার লালসা কমে নিই।তোমার মা’কে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন বাজে প্রস্তাব তোমার বাবা-র কাছে দেয়।সেই সময় তিনি তোমার মায়ের সঙ্গে তেমন মিল মোহাব্বত ছিল না।তোমার দাদীর জন্য যে দূরত্ব হয়েছে।সেটা আরো গভীর টেনে নিয়েছেন আমার মামা।আর তখন সংসারের ফাটল আরো বেশি ধরেছে।তোমার মা যখন এসব জানতে পারে তখন অলরেডি দেড়ি হয়ে গেছে।তোমার বাবা চওড়া সুদে মামার থেকে টাকা নিয়ে জুয়া খেলে।সেই সব জুয়া হেরেছে।মামা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।সাদা কাগজে তোমার বাবা আগেই টিপসই করে দিয়েছিল।তাই সে কাগজে মামা নিজের মতো কথা সাজিয়ে বয়ান লিখেছে।কাগজে লিখা রয়েছে তিন মাসের মধ্যে যদি টাকা পরিশোধ না করতে পারে।তাহলে তোমার বাবার জেল হবে।আর মোস্তফা সরোয়ার ভয় পেয়ে যান।শুরু হয় তোমার মায়ের ওপর অত্যাচার।চাপ দিতে থাকে বাপের বাড়ির টাকার এনে দেওয়ার জন্য।কিন্তু তোমার মা কখনোই তার বাবার বাড়িতে পা রাখেনি।তোমার মায়ের গহনাগুলো শেষমেষ বিক্রি করে দেওয়া হলো।মামাকে তিন ভাগের এক ভাগের টাকা দেওয়া হলো।কিন্তু বাকি দুইভাগের টাকা পরিশোধ হয়নি।যার ফলে মাসের পর মাসে গেল।সেই দুই ভাগের টাকা সুদের হারে বাড়তেই লাগল।আবার টাকা পরিমাণ আগের জায়গায় চলে গেলো।এরমধ্যেই মামা বিদেশে চলে গেছে।কিন্তু তোমার মা’কে পাওয়ার বাসনা ছাড়েনি।তোমার বয়স তখন পাঁচ বছর শেষ হয়ে ছয় পা পরেছে।তোমার মা দ্বিতীয়বার সন্তান ধারণ করেন।ভাবেন একটি সুস্থ সন্তান তাকে দিলে তিনি ঠিক হবেন।ভুল পথে আর চলবে না।কিন্তু তোমার মায়ের সব আশায় পানি পড়ে গেলো।তোমার দাদীর অত্যাচারে।তোমাকে অবহেলা করা।যা তাকে কষ্ট দিত।তোমার মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে গ্রামের নতুন বাড়ির কাজের জন্য লোক নেয়।হাজিরা আশি টাকা ছিল।
সেখানে তোমার মা নাম দিয়েছিল।তোমাকে আম গাছের নিচে খেলতে দিয়ে একটু দূরে সরে ইট ভেঙ্গেছেন পাথর দিয়ে।হাতে ফোসকা পড়েছে কিন্তু কষ্টকে দমিয়ে কাজ করেছেন।পেটের সন্তান তখন অপুষ্টিতে ভুগছে।সন্তানের মুখে খাবার তুলতে তাকে কষ্ট করতে হয়েছে।সকাল দশটায় কাজ শুরু হতো বিকেল পাঁচটায় কাজ শেষ করতো।দুপুরে একঘন্টা খাবারের জন্য বিরতি ছিল।
সকাল ডাকা ভোরে উঠে বাড়ির সব কাজ সেরে বাহিরে কাজ করেছেন।আবার সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফিরেছে।কিন্তু তার শান্তি কোথাও ছিল না।তোমার মা যে ক’টাকা পেতে সেগুলো তোমার মায়ের থেকে কেঁড়ে নিতে চাইতো তোমার বাবা।তাকে না দিলে চ*ড়,থা*প্পড়,গা*লি।তবুও তিনি ধৈর্য্য ধরেছিলেন।স্বামী ঠিক হবে এই আশায়।কিন্তু আমার মামা সাড়ে চার বছর পর আবার দেশের মাটিতে পা দেন।তোমার বাবাকে জুয়ার আড্ডা থেকে তুলে নিয়ে যান নিজের আস্তানায়।টাকার জন্য চাপ সৃস্টি করেন।পুলিশের ভয় দেখান।শেষে পরিকল্পিত হয় টাকা একসপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে। আর না হয় তার বউ রাজিয়াকে এখানে তার ঠিকানায় পাঠাতে হবে।যদি রাজি না হয়।তাহলে বাড়িতে ঢুকেই তার বউকে তুলে আনবে।এবং যতদিন তাদের মন না ভরবে।ততদিন রাজিয়াকে এই পুরাতন গোডাউনে পরে থাকতে হবে।তাদের আয়েশ মিটলেই ছেড়ে দেওয়া হবে।তোমার বাবা তার শর্তে রাজি হননি।কথায় দেয় টাকা ব্যাবস্থা করবেন।কিন্তু টাকার কোনো ব্যাবস্থা হয় না।শেষে তাদের পুকুরের সামনে বড় মাঠের জমিটাকে বন্দক দেওয়া হয়।ঠিক হয় তোমার মা,তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিলেই ছাড়াবেন।কিন্তু জমিটা হাত ছাড়া হলো।সময় মতো টাকা পরিশোধ না করতে পারায়।সেই রাগ গিয়ে পরে তোমার মায়ের ওপর।আটমাসের গর্ভবর্তী রাজিয়া মা’র খায়।তালাক হয়।অবশেষে আশ্রয় নেয় বাবার বাড়িতে।তোমার মা তোমাকে নিয়ে দূরে চলে যাওয়ার সাহস পায়নি।মোস্তফা এবং আমার মামার চুক্তি স্বাক্ষর থেকে শুরু করে সবকিছু সেই দিন অন্য কারো মাধ্যমে তোমার মা জেনে যায়।নিজের এবং নিজের অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করেই গ্রাম ছাড়া হয়।আর আমি এসব জানতে পারি আমার বড় মামার জনাব নাজিফ হুসাইন খান থেকে।ছোট মামার অপকর্মের কথা জানতে পেরে প্রচুর মারেন।নানীমা আদরের ছেলেকে মা’র খেতে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়।জ্ঞান ফিরে জানতে পারে তার ছোট ছেলেকে এই মাসের মধ্যে বিয়ে দিয়ে একেবারে জন্য জাপানে পাঠাবেন।যাতে আর কোনোদিন বাংলাদেশে পা না রাখতে পারে।ততদিন পর্যন্ত তাকে ঘরে আটকে রাখেন।বিয়ে হতেই এই দেশ ছাড়া করেন।বর্তমানে বউ,বাচ্চা নিয়ে তিনি বিদেশে স্যাটেল।নানাজান তাকে দেশে আনতে যান।কিন্তু আমি তার মুখটা দেখতে চাই না।তার কথা উঠলেই মনে হয় সে পাপী তার পাপের জন্য আমরা দায়ী।তার জন্য তোমার মায়ের এই করুন পরিনতি।তোমার মায়ের কষ্টের পেছনে আমাদেরও কোথায় না কোথাও দায়ী।পুতুল আমি জানি তুমি এসব শুনে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছো।কিন্তু আমি কি করব বলো?আমি তোমাকে না ব’লে থাকতে পারিনি।আমার মনে হয়েছে এটা তোমার জানা উচিত।আর তাছাড়া সত্যি কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না।সেটা একদিন না একদিন প্রকাশ পাবে।অর্পণ নিজের কথাগুলো শেষ করে পুতুলের দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠে।পুতুল ফ্লোরে বসে হাঁটুতে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ফুফিয়ে কাঁদছে।মায়ের কথা মনে পড়তেই তার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে।আল্লাহ কি তার মায়ের কপালে একটু সুখ লিখে রাখেনি?এত কষ্ট সত্যি কি তার পাওনা ছিল?তার মা কোন সুখের আশায় ঘর বেঁধেছেন।কিসের আশায় বেঁচে ছিল।কি পেয়েছেন তিনি?শুধু কষ্ট।কষ্ট ছাড়া তার জীবনে একটু সুখ ধরা দিলে কি হতো?
পুতুলের অবস্থা দেখে অর্পণ তার সামনে ছুটে আসে।তাঁকে ধরে উঠাতে চাইলে পুতুল তার হাতটা ছাড়িয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দেয়।দরজা বন্ধ করে সেখানেই পিঠ লাগিয়ে কাঁদতে থাকে।অর্পণ হাজার চেষ্টা করেও পুতুলকে ঘর থেকে বের করতে পারেনি।অর্পণ একটা নিশ্বাস ফেলে পুতুলের দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে বসে।পা দুটো দুই দিকে হালকা ছড়িয়ে বসে পড়ে।দিনের সূর্যের আলোটা রাতের আঁধার কালোতে সেই কখন হারিয়ে গেছে।দরজার দুই পান্তে দুই মানব মানবী বসে আছে।একজন কাঁদছে মায়ের জন্য।আর অন্য জন অপেক্ষা করছে।তার প্রিয়তমা কাঁদুক।কেঁদে মন হালকা হোক।তবুও দরজা খুলে তার কাছে আসুক।তার বুকে মাথা রেখে কাঁদুক।সে অপেক্ষা করবে।
১৩৫.
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়
মানে না তার পরাজয়
জীবন পরে ধুলোতে,হারিয়ে সঞ্চয়
যার কথা ভাসে মেঘলা বাতাসে
তবু সে দূরে তা মানি না
জানি না কেন তা জানি না
জানি না.।
রাত বেড়ে যায় ধীর পায়
বাতাসেরা যেনো অসহায়
শুকনো পাতার নূপুরে কে জেনো ডেকে যায়
যার উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা বাঁচে
সে হৃদয় ভাঙ্গে তা মানিনা
জানি না কেন তা জানি না
জানি না.।
প্রত্যেকটা সকালে প্রিয়তমাকে পাশে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে দিনটা শুরু হতো।কিন্তু আজ দুইদিন ধরে পুতুল তার সামনে আসে না।তার ঘুম ভাঙ্গা আগেই ঘর ছাড়ে।আবার তার ফিরে আসার আগেই নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে থাকে।প্রিয়তমা অবহেলা তাঁকে পুড়ায়।তবে কি এই কথাগুলো জানিয়ে সে ভুল করলো?তার আপসোস হচ্ছে।কেন বলতে গেলো?কিছু কিছু কথা না ব’লে হয়তো জীবনটা অল্পতেই সুন্দর হতো।সেই বা কি করবে।না ব’লে থাকতেই পারছিল না।এই কথা আজ অর্পণের থেকে না শুনে কাল যদি অন্য কারো কাজ থেকে শুনতো।তখন কি হতো?পুতুলের কষ্ট পেতো।তাঁকে ভুল বুঝতো?হয়তো সে আমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।তবুও ব’লে দিয়েছি।কষ্ট যখন আমার কারণে পেয়েছে।তখন আমি তার মান ভাঙ্গাবো।তার কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইবো।
সে হয়তো একদিন ঠিক বুঝতে পারবে।অর্পণ আজ নিজের কাজগুলো জলতি শেষ করে নিলো।তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে।পুতুলের সাথে তার অনেক কথা জমে আছে।
চলবে…