#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৬
“অপূর্ব ভাই, মেয়েদের ছবি দেখাতে ঘটক এসেছে। মামি ডাকছে আপনাকে।” বলতে বলতে অপূর্ব-র কক্ষে প্রবেশ করল আরু। একই গতিতে বিরতি না দিয়ে আরু ফিরতি পা বাড়ালে অপূর্ব থামিয়ে দিল, “দাঁড়া, একসাথে যাই।”
মধু খেয়ে ঠান্ডা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে অপূর্ব-র। এজন্য হলেও আরু-কে ছোট করে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। চাদর জড়িয়ে একসাথে বৈঠকখানায় গেল আরু ও অপূর্ব। অনিতা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ঘটক তার আনা পাত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাজিয়ে দেওয়ার খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলে, “আমার কাছে খাসা পাত্রী আছে, চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে কথা। নিরানব্বই খান ছবি আছে।”
“নিরানব্বই-এর পর একশো নাম্বার পাত্রী আমাদের আরু।” অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলেন অনিতা। আচমকা সবাই তাকাল। পরিস্থিতি সামলাতে বলেন, “আপনি ছবিগুলো দিন।”
ঘটক ছবি দেখানো শুরু করল। প্রতিটা ছবির মেয়েকে একনজর দেখে আরুকে দেখে অপূর্ব। তার প্রণয়ী হৃদয় আরুর প্রতিচ্ছবির সন্ধান চাইছে। নিরানব্বই খানার মাঝে এক খানা ছবি পছন্দ করা হলো। সেই খানা রেখে দিল। ঘটক আহ্লাদিত হয়ে বলে, “তারাও চেয়ারম্যান। আমি কথা বলে রাখব। পরশুদিনই আপনারা মেয়ে দেখতে যেতে পারবেন।”
“পরশুদিন কেন? কালকেই যাবো। ছেলের বয়স বাড়ছে। আর দেরি করা যাবে না।” অনিতা বলেন। ঘটক সায় দেয়, “ঠিক আছে। তবে বিয়ের সময় আমাকে টাকা পয়সা যা দেন দিয়েন। সাথে একটা ছাতা দিয়েন।”
ঘটকের এই অবদান নতুন নয়। নতুন ঘটকালি করতে গেলে ছাতা নিয়ে শুরু করে আহ্লাদ। ঘটক পান খেয়ে বিদায় হলেন। আরু পান বানাতে বসল। সবাইকে দিয়ে অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“অপূর্ব ভাই, পান খাবেন?” সংশয়ের বশবর্তী হয়ে বলতে বলতে নানি জানের পানের ডালা থেকে মস্ত বড়ো একটা পান নিয়ে নিল আরু। প্রয়োজনের তুলনায় অধিক জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে মুখে দিল আরু। চম্পা তেড়ে এসে ছিনিয়ে নিলেন পানের ডানা। রাগান্বিত হয়ে বলেন, “তুই কি গরু হয়ে চাস আরু? পান খেলে পড়াশোনা হয়না।”
অপূর্ব আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিল আরুর। পান চিবুকে আরুকে বেশ উচ্ছ্বাসিত দেখাচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত সময়ে সিগারেট টেনে যতটা প্রফুল্লচিত্তে দীপ্ত থাকত অপূর্ব, ততটা। গ্ৰামে এসে হুক্কা ছাড়া কিছু ছোটে না তার। জর্দা নেশার মতো কাজ করে বলেই নারীরা একটি পানে সারাদিন অভুক্ত থাকতে প্রস্তুত। উদ্ভাসিত হয়ে শুধাল, “আরু বেশি জর্দা দিয়ে মনমাতানাে একটা পান বানিয়ে দে।”
ব্যাস, নির্বাক্যে চম্পা পানের ডালা দিয়ে দিল। আরু ঢেড় জর্দা দিয়ে পান বানাল, অপূর্ব তা গ্ৰহণ করতে নারাজ। আধ কৌটা জর্দা পানে ঢেলে মুখে দিল। উপস্থিত সবাই কিৎকর্তব্যবিমঢ়। বিলম্বে ঝালে হাঁসফাঁস করে কিঞ্চিৎ ব্যবধান করে ওষ্ঠদ্বয়। পৃথক অংশ ছেড়ে লাল রস যেন প্লাবিত হয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। অতঃপর চিৎকার করে উঠে অপূর্ব, “ঝাললললল।”
জিভ দিয়ে ঠেলে বাইরে ফেলে দিয়েছে পানের চর্বণ করা অংশ। সামান্য আগে খেজুরের রস পান করেছে, এখন যুক্ত হয়েছে পান। হঠাৎ করে অপূর্ব-র মনে হলো, পৃথিবী সূর্যকে ছেড়ে অপূর্বকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ভ্রু স্ফুরিত করে বলে, “কী পান খাওয়াইলি মোরে? একদম নেশা ধরাইলি।”
অপূর্ব নিজেকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হয়ে বমি করে দিল। আরু বরাবর নিচে থাকার দরুন সরাসরি আরুর দেহে পতিত হলো। আরু নাক চেপে বাজখাঁই গলায় বলে, “দিলেন তো, আমার থ্রি-পিছ নষ্ট করে। গাও ছুইয়া যায় সেই মার্কেট থেকে বাবাই আমাকে এই জামাটা এনে দিয়েছে।”
“দেবো টেনে এক চড়, তুই তো অপুকে পান সেদেছিলি। বেশ করেছে। যেই শাড়িটা এনেছিলি, ওটাই পালটে নে।” মায়ের ধমকে আরু তুবড়ে গেছে। মামির শাড়িটা নিয়ে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো। কিয়ৎক্ষণ পর দিঘির পানিতে শব্দ হলো। আরু এই ঠান্ডাতে আবার দিঘিতে নেমেছে?
দশ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো আরু। মাথা ঘোরার মাঝে আরুকে বেসামাল অবস্থায় দেখে অপূর্ব এবার কিছু দেখতে পারল না। সেদিনের সেই শাড়ি, সেই ভেজা কেশ। টপটপ করে ঝরছে পানি। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। চুপসে যাওয়া মুখটা বড্ড আকর্ষণ করছে তাকে। নিত্যদিনের খোঁপা করা ঘন কেশ খোলা। হাঁটু ছাড়িয়েছে।
আরুর ঘরে প্রবেশের পরবর্তী মুহুর্তে সিঁথি প্রবেশ করে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “মিহির ভাই এসেছে আরু।”
তুবড়ে যাওয়া মুখমণ্ডল পরবর্তী মুহুর্তে প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। কুঞ্চিত বিশিষ্ট ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে উঠে। বলে, “সত্যি? কোথায় মিহির ভাই?”
বাক্য থামতেই মিহির প্রবেশ করল। একগাল হেসে বলে, “এখানে।”
আরু পা গতিরোধ করতে পারল না, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মিহিরকে। মিহিরের হাত তখন অপ্রত্যাশিত অংশে। আরুর একমাত্র ফুফুর ছেলে মিহির। বয়সটা চব্বিশ অতিক্রম করে সবে পঁচিশে পা রেখেছে। মিহির বলে, “বাড়িতে তোকে খুঁজে না পেয়ে সোজা এখানে চলে এসেছি। কেমন আছিস তুই?”
“একদম ভালো না। চকলেট এনেছ?”
মিহির একটা রেপিং করা প্যাকেট দিয়ে বলে, “ভুলে যাওয়া যায় বুঝি?” অতঃপর ডান গালে হাত রেখে ইশারায় বোঝাল কিছু। মাথা নাড়িয়ে আরু বলে, “না, আমি এখন বড় হয়ে গেছি।”
মিহিরের অভিমানী চোখে আরু দীর্ঘক্ষণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকতে পারল না। পায়ের আঙুলে ভয় দিয়ে কিঞ্চিৎ উঁচু হয়ে মিহিরের ডান গালে নিঃশব্দে দুবার ওষ্ঠ স্পর্শ করে। মিহির হেসে বলে, “কাঁধে উঠ, বাড়িতে নিয়ে যাই। (পারুলকে লক্ষ্য করে বলে) মামি আরুকে নিয়ে গেলাম। তোমরা গেলে তারাতাড়ি এসো। নতুবা আমি চললাম।”
কাঁধে উঠল না আরু, কোমরে উঠে কাঁধ ধরে রাখল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলল তারা। ঝাঁপসা নয়নে ক্রুব্ধ সংযত করে সবটা দেখে গেল অপূর্ব। অনুভব করল, তার প্রিয় কিছুতে ভাগ বসাচ্ছে অন্য কেউ। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বাছাই করা রাখা ফটোখানা এক লহমায় খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলে অপূর্ব। এর শাস্তি অতিদ্রুত পাবে তুমি।
__
দুহাতে বইগুলো আঁকড়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার জন্য পা চালাচ্ছে আরু। পেছন থেকে দ্রুত গতিতে সাইকেল এসে আরুর সমুখে স্থির হয়ে গেছে। পকেট থেকে একটা সাদা চিঠি বের করে অগোচরে আরুর দিকে এগিয়ে দিল। তরুণকে দেখে লাজুক হেসে চিঠি গ্ৰহণ করল আরু। বইয়ের ভাঁজে যতন করে রেখে বলে, “আমি তো ভেবেছি, আপনি আসবেন না প্রয়াস ভাই।”
“না এসে উপায় আছে? আসতে হলো তোমার জন্য। আমার জন্য ফুফি শাশুড়ির অনেক মা/র খেয়েছ শুনলাম। নাও তোমার জন্য ঝুড়িভাজা আর কিছু জরিবুটি নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিও। আর ধন্যবাদ।” একটা প্যাকেট বিশেষ করে আরুর জন্য এনেছে। গ্ৰহণ করতে না চাইলেও আরু গ্ৰহণ করে। পরক্ষণে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে আরু-কে অতিক্রম করে চলে গেল প্রয়াস।
সময় চারটা বেজে দশ মিনিট। গতকাল আরু বাড়িতে ফেরে নি। মামা বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছে। স্কুল ফ্রোকটা রেখে যাওয়ার দরুন বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। আজ অপূর্ব-র জন্য মেয়ে দেখতে যাবে, তাই তুর শেফালী স্কুলে আসেনি।
তালগাছ তলায় কালাচাঁন সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। যাতায়াতের সময় প্রায় আরুকে উত্যক্ত করে। আরুকে দেখে এগিয়ে এলো কয়েকপা। শ্রীহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে খপ করে আরুর হাত ধরে। গর্হিত কণ্ঠে বলে, “আরু আমি তোমার জন্য পাক্কা একঘণ্টা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। এত দেরিতে কেন এলে? ঐ ছেলেটার কাছে থেকে চিঠি নিলে কেন?”
নিজের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে মেয়েরা শৌখিন না-হোক ফেলনা নয়।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 💚
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/