#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
#পর্ব: ০৭
“আরু আমি তোমার জন্য পাক্কা একঘণ্টা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। এত দেরিতে কেন এলে? ঐ ছেলেটার কাছে থেকে চিঠি নিলে কেন?” গর্হিত কণ্ঠে বলে কালাচাঁন।
নিজের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে মেয়েরা শৌখিন না-হোক ফেলনা নয়।
কালাচাঁদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্ৰসর হলো। আরু পারল না, কালাচাঁন আটকে দিল পথ। আরুর সাথি তন্বি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, “তোরে না কয়দিন কইছি কালাচাঁন। একদম আরুর পিছে লাগবি না। আরু ওর মামারে বললে তোর মতো কালাচাঁন মাটির নিচে যেয়ে মাইট্টা চাঁন হয়ে যাবে।”
“তন্বি তুই আমার আর গোলাপী সুন্দরীর মাঝে আসবি না। (অতঃপর মোলায়েম কণ্ঠে বলে) আরু বিশ্বাস করো, আমি তোমারে মেলা ভালোবাসি। তুমি আমারে গ্ৰহণ কইরা লও।”
“আমি বিয়ে করব, সিনেমার নায়ক। সবাই বলে আমি অনেক সুন্দর। আমি সুন্দর হয়ে তোকে কেন বিয়ে করব? আমি বিয়ে করব সুদর্শন পুরুষকে।” বিদ্রুপ করে বলে আরু। ক্ষান্ত করার প্রচেষ্টা করে কালাচাঁন বলে, “দেখো গোলাপী, সাদা কালো বিপরীত। সাদা আছে বলেই কালোকে সবাই তাচ্ছিল্য করে। কালো আছে বলেই সাদার এত কদর। তুমি আমারে বিয়ে করলে সবাই বলবে, কালার ঘরে চাঁন আইছে। আমার কালাচাঁন নাম সার্থক হবে।”
“রাখ তোর কালাচাঁন, রাতে আকাশ থাকে অন্ধকার। এই অন্ধকার আকাশে কালাচাঁনকে দেখাই যাবে না। আমি সাদাচাঁন-ও বিয়ে করব না। আমি বিয়ে করব সূর্যকে। সূর্য আট মিনিট উনিশ সেকেন্ডে পৃথিবীতে আলোকিত করে দেয়। যখন সে আমার ব্যক্তিগত সূর্য হবে তখন আলো আসতে কোনো সময় লাগবে না।” আরুর এরুপ কথাতে ক্ষেপে গেল কালাচাঁন। আরুর হাতটা আরেকটু চেপে ধরল। শহরের মেয়েদের স্পর্শ করা যতটা সহজ ভাবে নেওয়া সম্ভব, গ্ৰামের মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। আরুর চোখ জলে পূর্ণ হয়ে এলো। ক্রোধে ফোঁস করে বলে, “কালাচাঁনের বাচ্চা, তোর সাহস হয় কীভাবে আমাকে স্পর্শ করার? তুই আমার অপূর্ব ভাইকে চিনিস না। সিনেমার হিরোদের মতো ভাঁজ কা/টা তার দেহ। এক ঘু/সিতে তোকে কালাচাঁন থেকে চ্যাপাচাঁন করে দিবে।”
আরুর চ্যাঁচানো শুনে ভীত কালাচাঁন হাত ছেড়ে দৌড়ে পালাল। কালাচাঁনের স্পর্শ করা হাত ঘষতে ঘষতে রক্তিম করে ফেলল আরু। লোকে জানলে বলবে, পরপুরুষ আরুকে ছুঁয়েছে।
উ/ন্মা/দ হয়ে হেঁটে চলেছে আরু। তন্বি আরুকে থামানোর চেষ্টা করে। চার রাস্তার মোড়ে এসে আলাদা পথ ধরে তন্বি, বইখাতা আঁকড়ে ধরে মামাবাড়ির পথ ধরে আরু। অপূর্ব-কে সে টাকা দিয়ে ভাড়া করে কালাচাঁনকে পি/টু/নি খাওয়াবে।
‘টগবগ! টগবগ! টগবগ!’ করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে অপূর্ব ছুটে আসে। আরুকে উদাসীন হয়ে হেঁটে যেতে দেখে বিস্মিত হলো অপূর্ব। পায়ের নূপুরের ভিন্ন ‘বিষাদের’ সুর শুনে ঘোড়ার গতিরোধ করল অপূর্ব। বলে, “উ/ন্মা/দের মতো হাঁটছিস কেন?”
ঘোড়া দেখে আরু ভুলে গেল উ/ন্মাদনা। বাদামী সম্পূর্ণ দেহের রঙ। চুলগুলো ১৬ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ফিকে বাদামী। লেজ ২৪ ইঞ্চি লম্বা ও সম্পূর্ণ লেজ চুল দ্বারা আবৃত। অপূর্ব-র সামনে শেফালী বসে আছে। আরুকে দেখে শেফালী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “জানিস আরু, অপূর্ব ভাই আমাদের সবাইকে ঘোড়ায় চড়িয়েছে। টগবগ টগবগ করে চলছে ঘোড়া। কী মজা।”
‘মজা’ শব্দটা শোনার পর স্পৃহা জাগল ঘোড়ার পিঠে চড়ার। আরু যদি আহসান বাড়ির মেয়ে হতো, তবে অনায়াসে সেই অবদান করতে পারত। কিন্তু তার চাচাতো ভাই সাবিত ছোট। একমাত্র মিহির ভাই আছে। যদিও সে আরুকে যথেষ্ট ভালোবাসে, তবুও। আরুর মন পড়ে অপূর্ব বলে, “শেফালী তুই নাম, আরু উঠুক।”
“আমি তো মাত্রই চড়লাম। আরেকটু থাকি।” আবদার তার।
“ধাক্কা দেওয়ার আগে নাম। নাহলে হাত-পা ভাঙবে।”
অগত্যা অপূর্ব-র সাহায্যে শেফালী নামল ঘোড়া থেকে। নিজের বইখাতা শেফালীর হাতে দিয়ে ঘোড়ার দিকে এগোল আরু। অপূর্ব মাটিতে নেমে আরুর কোমর আঁকড়ে ঘোড়ার উপর তুলে দিল। অতঃপর নিজেও আরোহণ করে পেছনে। আদেশ করে টাইসনকে, “ছুটে চল টাইসন।”
পুনরায় টগবগ করে ছুটল সে। গতিশীল হওয়ার পর মুহুর্তেই আরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখ ভয়ে নিমজ্জিত হয়ে গেল। অপূর্ব হাতে আঁচড় কে/টে বলে, “নামব, আমার ভয় করছে।”
“এটুতেই ভয়! তোর না-কি সারাজীবনের ইচ্ছে ছিল রাজকুমার বিয়ে করার?” ঘোড়ার বেল্ট ধরে আস্ফালন করতে করতে বলে অপূর্ব।
“হম। আমি রাজকুমার বিয়ে করব। তার পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নিজেকে রানীর পরিচয় দিবো।” অপূর্ব-র বক্ষে হেলান দিয়ে নিজের কল্পনায় প্রবেশ করল আরু। ঘোড়ার বেল্ট থেকে হাত আরুর ডান কাঁধে রেখে বলে, “রাজকুমার থাকে দূরে, বহুদূরে। একদম সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে। সে আসে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে। পক্ষীরাজ ঘোড়ার ডানা হয়, আমার ঘোড়ার নাইবা হলো। আমিও আমার রাজকুমারীকে রানীর রুপ দিতে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে ঘোড়া নিয়ে এসেছি।”
আরু মাথা তুলে অপূর্ব-র দিকে তাকালো। তারমানে অপূর্বও কোনো রাজপুত্র। কোনো রাজকুমারীর জন্য এসেছে। ঈষৎ ঈর্ষা অনুভূত হলো আরুর। এই গ্ৰামে হাজার থেকে লক্ষাধিক মেয়ের বিয়ে হয়েছে অথচ কোনো রাজকুমার ঘোড়া নিয়ে আসছি। এই প্রথম কোনো নারীর জন্য ঘোড়া নিয়ে এসেছে। আরুর স্পৃহা জন্মালো সেই সৌভাগ্যবতী নারীর ললাটে ললাট ঠেকাতে। বামহাত দিয়ে নিজের কপাল মেপে নিল। একমাত্র চার আঙুল কপালের মানুষের ভাগ্যে জোটে ভালো কিছু। কিন্তু সেই সৌভাগ্যবতীর ললাট নিশ্চয়ই পাঁচ আঙুল হবে, লাখে এক বলে কথা। কিন্তু আরুর কপাল তিন আঙুলের।
ততক্ষণে বাড়ির প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেছে ঘোড়। আরু ও অপূর্ব উভয়ে নেমেছে। রাখাল চাচা ঘোড়া নিয়ে গেছে গোয়ালে। আরুর মন খারাপ অপূর্ব চট করে পড়ে ফেলল, অতঃপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, ‘স্যরি আরু, তুই যথেষ্ট ছোট ও বাচ্চা। তোর ভাগ্যে আমি নেই। প্রার্থনা করি, তোর জন্যও কোনো রাজকুমারের আগমন ঘটুক।’
অপূর্ব ভাবল, আরু একটু ক্ষেপে যাবে। একটু অভিমান পুষবে। অপূর্ব আবার সেই অভিমান মুছে দিবে। অপূর্ব-র ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আরু বলে উঠে, “অপূর্ব ভাই ঘোড়া কেন দাঁড়িয়ে ঘুমায়? কেন? সারারাত দাঁড়িয়ে ঘুমাতে ওদের পা ব্যথা করে না বুঝি?”
__
তুরকে প্রয়াসের চিঠি দিয়ে অশ্রুপাতে ভেঙে পড়ল আরু।
অপূর্ব বোনেদের ঘর অতিক্রম করার সময় কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কৌতুহল বশত ভেড়ানো দ্বার উন্মুক্ত করল। আরু-কে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখে হৃৎপিণ্ড তার কাজ ভুলে গেল। তুর একাধিকবার প্রশ্ন করছে কী হয়েছে? আরু প্রত্যুত্তর বিহীন কেঁদে চলেছে। অপ্রসন্ন হয়ে বলে, “বলবি তো কাঁদছিস কেন?”
আরু তার বামহাতটা বাড়িয়ে দিল। হাতের কবজির কাছে লালচে বর্ণ হয়ে আছে। ছিলে গেছে বোধহয়। হেঁচকি তুলে বলে, “কালাচাঁন আমার হাত ধরেছে তুর। আমার মন চাচ্ছে, হাতের চামড়া তুলে ফেলি।” অতঃপর ক্রন্দনরত অবস্থায় সবকিছু খুলে বলে আরু।
আরুর নিকট পৌঁছে অস্থিরচিত্তে জেরা করল অপূর্ব, “কখন ঘটেছে এইসব?”
অপূর্ব-র আগমনে আশ্চর্যান্বিত হয়ে উঠল আরু। নিজের করা প্রশ্নে জবাব না পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে অপূর্ব। রক্তিম হাতে বল প্রয়োগ করে পুনরায় অভিন্ন প্রশ্ন করে।
হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ব্যথাহত কণ্ঠে বলে, “স্কুল থেকে আসার সময়। যখন আপনার সাথে দেখা হলো।”
‘এজন্য উন্মাদের মতো লাগছিল?’ অপূর্ব নির্লিপ্তভাবে বলে, “তখন কেন বললি না। এখন চল।”
ভীত হয়ে গেল আরু। কোনোভাবে মায়ের কাছে খবর গেলে আস্তো রাখবে ওকে। কম্পিত গলায় বলে,
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 💚
গত পর্ব নিয়ে অনেকের অভিযোগ দেখলাম,
১.আরুর পোশাক নিয়ে। আগেই বলেছি একটা পুরনো দিনকে কেন্দ্র করে লেখা। সেক্ষেত্রে অবিবাহিত মেয়েরা এমন শাড়ি পরতে পারে। আরুকে আমি একদম গ্ৰামের মেয়ে হিসেবে লিখতে চেয়েছি। তাছাড়া আগামী পর্ব থেকে পোশাক নিয়ে আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।
২.আমার তিনটা ভাই আছে। কেউ বড়, কেউ ছোট। গ্ৰামে গেলে এত খুশি হতো যে, জড়িয়ে ধরতো। 🤐 কাউকে ছাড়তো না। সে কিন্তু আমার আপন ভাই না। এটা ভালোবাসা। একটা অধিকার বোধ। আমার বোনকে কত বছর পর দেখছি, সেই আনন্দ।🫠
একই ঘটনা যদি হঠাৎ করে হয়, তবে আমরা চমকে যাই। কিন্তু পুনরাবৃত্তি হলে আমরা স্বাভাবিক ভাবে নেই। তেমনি আরু আর মিহিরের আগমনের দৃশ্যটা ছোটবেলা থেকে।
কোনো প্রশ্ন? ভালোবাসা রইলো সবার জন্য 💚
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/