নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৩৬

0
427

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৬

পারুল মাটির উনুনে চা তৈরি করছে। রান্নাঘরের দিকটাতে বাতির ব্যবস্থা নেই বিধায় একটা হ্যারিকেল জ্বালিয়ে কাজ করছে পারুল। আরু তাকে সঙ্গ দিতে কাঁচের চায়ের কাপগুলো নামিয়ে ধোয়ার জন্য দিঘির দিকে যেতেই পারুল থামায় তাকে। চা’পাতা দিয়ে রঙ পরীক্ষা করতে করতে বলে, “দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে, ভুলে গেছিল? দিঘিতে নতুন পানি না ফেলা পর্যন্ত কোনো কাজ করা যাবে না। নাহলে রোগব্যাধি হবে।”

অমনি আরুর মন বিষণ্ন হলো। সন্ধ্যার আগে টেনে আনা পানিতে কাপগুলো ধুতে থাকে। পারুল চায়ের ডেক্সি উনুন থেকে নামিয়ে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলে, “আজকে স্কুলেও গেলি না, পড়তেও গেলি না। পড়াশোনার করার ইচ্ছে নেই তোর?”

“কাল থেকে যাবো। বকো না প্লীজ।”

“আমার সাথে ইংরেজিতে ফুটানি করবি না। প্রতিবার পরীক্ষায় সবার সেরা হয়ে প্লেট নিয়ে আসিস। এবার যদি লাড্ডু নিয়ে আসিস তাহলে তোর খবর আছে।” কড়া গলায় শাসায় পারুল। আরু চাপা রাগ দেখিয়ে হারিকেন নিয়ে ঘরে চলে গেল। ততক্ষণে পারুলের চা ঢালা শেষ। অন্ধকার হয়ে যেতেই চ্যাঁচিয়ে বলে, “আরু। হারিকেন নিয়ে গেলি কেন? আমি এই অন্ধকারে চা নিয়ে যাবো কীভাবে? অপূর্ব আমাকে এই চায়ের কাপের সেট বিদেশ থেকে এনে দিয়েছে। অন্ধকারে কিছু সাথে বেঁধে যদি পড়ে কাপ ভেঙে যায়। তোর খবর আছে।”

অতঃপর আরু খালি হাতেই এলো রান্নাঘরে। লাকড়ি না দিলেও আগের লাকড়িতে মৃদু আলো জ্বলছে। ধপাধপ পায়ে এসে পারুলের হাত থেকে কাপের ট্রেটা কেড়ে একই গতিতে চলে গেল। বৈঠকখানায় আরুর দুই চাচি ও চাচাতো ভাইবোন বসে আছে। অতিথিরাও বাদ নেই। আরু সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। টিনের ঝাড় থেকে খই বের করে দুই থালাতে ঢেলে সবাইকে দিল। তারপরে আবার চলে গেল নিজের ঘরে। বইটা খুলে পৃষ্ঠা উলটে মনযোগী হওয়ার প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু বোনদের জ্বালায় বারবার বিঘ্ন ঘটছে পড়াতে। ওর ছটফটে মন নিবদ্ধ বৈঠকখানায়। তখন সন্তর্পনে সেখানে প্রবেশ ঘটে মিহিরের। আরুর জন্য আনা চকলেট বক্সটা টেবিলের উপরে রেখে বলে, “এটা তোর।”

“ধন্যবাদ।”

“কোনো কারণে তোর মন খারাপ আরু? আমার সাথে কথা বলছিস না। আগে আমি আসলে তুই অনেক খুশি হতি।” বলতে বলতে খানিক ঝুঁকল আরুর উপর। আরু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ‘তোমাকে একটা চুমু খেয়েছিলাম, এজন্য অপূর্ব ভাই ছলেবলে কৌশলে একশোর বেশি চুমু আদর করে নিয়েছে। চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছে। আর কোনো ভুল করতে চাইনা।’ মনে মনে পুনরাবৃত্তি করে বাক্য। তৎক্ষণাৎ কানে এলো একদল লোকের কথা। মনে হলো আহসান বাড়ির চাঁদের হাট মৃধা বাড়িতে বসেছে। চকিতে আরু সেদিকে যেতে চাইলেও দমিয়ে নিল। তাদের সামনে নিজেকে পড়াকু প্রমাণ করতে হবে।

পারুল স্বামীর ভিটাতে আপনজনদের দেখে অসন্তুষ্ট হলো ব্যাপক। উত্তেজিত হয়ে বলে, “এই বৃষ্টিবাদলের দিনে এলে, পা ধুতে দেওয়ার মতো পানিও নেই।”

“শুনেছি তোদের দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে। চেয়ারম্যানের জামাইর বাড়ির দিঘিতে কে ওষুধ দিয়েছে, অনেক খোঁজ করেছি। এখনো ধরা পড়েনি। চেষ্টা করছি যাতে ধরা পড়ে যায়।” আরুর নানাজান বলে‌। যার জন্য এত ঘটা করে এসেছে আহসান পরিবার তার দেখা নেই তাই চম্পা আরুর সন্ধান করে, “আরুকে দেখছি না, কোথায় ও?”

“চা দিয়ে ঘরে গেছে। পারুলের সাথে মনে হয় ঝগড়া হয়েছে, মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।” নয়না থামলে ইমদাদ বলে, “মেয়েটাকে তোমার সবসময় ব/কতেই হবে?

“স্কুলেও যায়নি, পড়াশোনাও করেনি আজ। বলেছি তাই পড়তে গেছে.. পারুলের বাক্যে দাড়ি টেনে নিজ ঘর থেকে আরু চ্যাঁচিয়ে বলে, “শুধু এটা বলো নি, ‘প্লেটের বদলে লাড্ডু নিয়ে আসলে খবর আছে’ – বলো নি?”

পারুল পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। তাকে সেই ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা করতে মোতাহার আহসান ইমদাদ হোসেন মৃধাকে নিয়ে বাইরের ছোট রোয়াকে কথা বলতে গেলেন। তুর শেফালী ও সুমিও থেমে নেই, অনিতার ইশারায় চলল আরুর ঘরে। তিনজনের প্রবেশে বেরিয়ে গেল মিহির। আরু দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করতেই তুর আরুর আকর্ষণীয় শাড়িটা বের করল। আরু ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, “শাড়ি নামাচ্ছিস কেন?”

“তুই পরবি তাই।”

“আমি বর্ষাকালে শাড়ি পরি না। ঠান্ডায় শাড়ি শুকাতে চায় না।” আরুর সিদ্ধান্তকে ঠেলে দিয়ে ওড়না কেড়ে নিল শেফালী। শহরের কায়দা শাড়ি পরাতে শুরু করল।
_
মিহিরকে আরুর ঘর থেকে বের হতে দেখে মেজাজ হলো ক্রুব্ধ। ঠোঁট চেপে সামলানোর প্রয়াস করল অপূর্ব। এই ঘরে এখন মিহিররা ছাড়া কেউ নেই, সবাই পারুলকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। আধঘন্টা সময়ের মধ্যে বাহারি খাবারে টেবিলে সাজিয়ে ফেলল পারুল‌। শরবতের গ্লাস নিয়ে ধীর চুমুকে পান করছে দেখে পারুল রঙ্গ করে বলে, “অপু তুই আজ লজ্জা পাচ্ছিস কেন? লজ্জা পাওয়ার কথা নতুন বউয়ের। সুমি এই প্রথম এসেছে। ও চারপাশে ঘুড়েও দেখছে।”

“নতুন জামাইরা তো লজ্জা পাবেই।” অপূর্বর চোখ রাঙানো দেখে থেমে গেল তিয়াস। আরুকে ধরে ধরে নিয়ে এলো ওরা। সুমির ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র উঠে দাঁড়ায় তিয়াস। অপূর্বর পাশের জায়গা আরু গ্ৰহণ করতেই আহসান বাড়ির বড় কর্তা পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার মেয়েকে আমি ইমদাদের হাতে তুলে দিয়েছে অনেক আগে, এখন আমার নাতিকে ফিরিয়ে নিতে চাইছি। ইমদাদের এক্ষেত্রে আপত্তি নেই। তোর কী মতামত?”

“ও গেলে পুরো বাড়ি ফাঁকা লাগবে। মাঝে মাঝে কাজেও আমাকে সাহায্য করে।”

“তারমানে মেয়েকে বিয়ে দিবি না?” মোতাহার আহসানের প্রশ্নে এতক্ষণে সবকিছু মস্তিষ্কে গোচর হলো। পারুলের চোখে পানি এলেও আরুর মুখে ফুটে উঠে হাসি। মাথার ঘোমটা টেনে লজ্জানত হয়‌। দ্বিধান্বিত হয়ে বলে, “আরুল সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর বিয়ে..

“বিয়েতে আরুর উপরে কোনো প্রভাব পড়বে না। সে ভাগ্নি হিসেবে থাকবে। অপূর্বর কাছে পড়ে আবার ফিরতে হয়। বিয়ে হলে অপূর্ব সবসময় পড়াতে পারবে। তাছাড়া অপূর্বর বয়সটাও তো বেড়ে যাচ্ছে।” উপস্থিত সবাই তখন পারুলের মতামত শোনার জন্য আগ্রহী। পারুল ‘হ্যাঁ’ জানাতেই একদল লোক ঘর ছেড়ে চলে গেল। পারুল থামানোর চেষ্টা করলেও শিরীনেরা থামল না।
__
জড়তায় আড়ষ্ট হওয়া আরুর পানে করতল মেলে দিলেই আরু ঘোমটার আড়াল থেকে একঝলক দেখে হাত বাড়িয়ে দিল। আরুর সেই হাতে বাম হাত রাখলে অনিতা জুয়েলারি বক্স খুলে অপূর্ব দিকে এগিয়ে দিল চকচকে আংটি। চকচক করা স্বর্ণের মাঝে এক পাথরের আংটি তুলে আরুর অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিল। অতঃপর হাতটা নিকটে এনে আরু নিবৃত্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকল। এটা যেন তার জন্য সৃষ্টি। তদানীং আরুর লাজুক ভাব বাড়িয়ে দিতে অপূর্ব বলে, “পদ্মবতী, পরে দেখো। আংটিটা আগে আমাকে পরিয়ে দিয়ে নাও পাখি।”

আরু দেখল অপূর্ব হাত বাড়িয়ে রেখেছে। অনিতার থেকে আংটি নিয়ে অপূর্বকে স্পর্শ না করেই পরিয়ে দিল অনামিকায়। সাথে পড়ল একফোঁটা অশ্রু, তা আনন্দের না-কি বিষাদের? গুরুজনদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরু দ্বি মুহূর্তে ছুটে গেল ঘরে। কাঠের দরজা ভিড়িয়ে পিঠে ঠেকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। এরপরে বিছানায় গিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে হেসে উঠে।

‘খুশি করল অপূর্ব, জড়িয়ে ধরে কোলবালিশ। দিস ইজ নট ফেয়ার আরু।’ বলে বুকে হাত গুজে অপূর্ব। আরু শোয়া থেকে উঠে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে, “আপনি গতকালকেও বললেন না, আজকে আংটি বদল করে ফেলবেন।”

“আমি নিজেই জানতাম না। হঠাৎ মা তাড়া দিল বিয়ের জন্য। (বিরতি টেনে) শুনেছি, এই শুক্রবার আমাদের বিয়ে সেড়ে ফেলবে। কিছুদিন আগে তিস্তার বিয়ে গেল। এই মুহূর্তে এত খরচ করে বড়ো করে বিয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক হবেনা।” বলতে বলতে আরুর পাশে বসে অপূর্ব। অপূর্বর গলা জড়িয়ে কোলে বসে আরু। আজ আলাদা এক অধিকার বোধ খুঁজে পাচ্ছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
লেখাতে মন বসানো দায়।
হলুদ ও বিয়ের দাওয়াত রইল।

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here