নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৩৮

0
395

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৮

“একটা মেয়ে ‘কোন ছেলে দূর থেকে, তাকে কেমন নজরে দেখে’ সব বুঝতে পারে। আমি সবকিছু ফেলে তোর কাছে আসতাম ভালোবাসার টানে। এখন তুই বলছিস তুই আমাকে ভাইয়ের নজরে দেখিস নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছিস?” আরুর বাহু খামচে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কথা ব্যক্ত করে মিহির। টুস করে অবাধ্য অশ্রু কণা আরুর চোখ থেকে ঝরে পড়ে‌। আরুর চোখের পানি সহ্য করতে ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দিল মিহির। পারুল আরুকে পিছিয়ে বলে, “এখানে আমাদের কোনো দোষ দেখছি না, সেদিন এসেই আরুর জন্য প্রস্তার দেওয়া উচিত ছিল। আমরা কেউ আরুর বিয়ে অপূর্বর সাথে ঠিক করে রাখিনি। তখন বললে, আরুকে মিহিরের হাতে তুলে দিতাম।”

“না! বিয়ের আসরেও যদি ভাইজান আরুর সাথে অপূর্বর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতেন। তবে আমি সেই বিয়ে ভেঙে অপূর্বর সাথেই আরুর বিয়ে দিতাম। মোতাহার আহসানের কারণে আমার মেয়ে এখনো শ্বাস নিচ্ছে। তাই তাকে খুশি করা আমার দায়িত্ব।” দৃঢ় গলায় নিজের মতামত জানায় ইমদাদ। অতঃপর ব্যাগটা ফিরিয়ে দিল শিরীনের কাছে। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বলে, “আমি ওকে পেটে ধরেছি নাকি ঐ চম্পা তোকে পেটে ধরেছে? সবসময় তুই আহসান বাড়ির টান টানিস। তোর মেয়ের বিয়েতে আমি থাকব না, ঢাকাতে চলে গেলাম।”

“মা, আরু তোমার নাতনি।”

“যেখানে আমার মতামতের গুরুত্ব নেই, সেই বিয়েতে আমি থাকব না।” বলে মেয়ের সাথে ঢাকাতে যাওয়ার জন্য রওনা হলেন। বিয়ের দিন এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কারণে মেয়ের উপর ত্রুব্ধ হলেন পারুল। আরুর গাল চেপে ধরে রোষ নিয়ে বলে, “এত সুন্দর কে হতে বলেছে তোকে? তোর জন্য আমাকে যতটা অন্যের কাছে হেয় হতে হয়, অন্যের মেয়ে থাকার পরেও তাদের হতে হয় না।”

ব্যথায় আরুর চোখে পানি চলে এসেছে। ইমদাদ মেয়েকে ছাড়িয়ে উঁচু গলায় বলে, “বিয়ের দিনেও তুমি মেয়েটার গালে হাত দিলে? মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কী পাও তুমি?”

“ওর জন্য শিরীন আপার সাথে তোমার সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল।”

“আমার বোনের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, তাতে আমার কোনো আফসোস হচ্ছে না। তোমার কেন হচ্ছে?” আঙুল তুলে বলে ইমদাদ। আরু হেঁচকি তুলে কেঁদে চোখমুখে ছাপ ফেলেছে। ভেজা শাড়িটা অঙ্গেঈ শুকিয়ে গেছে। মায়ের প্রতি চরম অভিমান নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। মাটির উনুন থেকে দুই হাতে কালি তুলে নিজের শরীরে মাখতে থাকে। উপস্থিত সবাই হতভগ্ন হয়ে আরুকে থামাতে ভুলে গেছে। আরু অনবরত বলে যাচ্ছে, “এই বাড়িতে যতক্ষণ থাকব, আমি কালি মেখেই থাকব। সুন্দর হলে সমস্যা, অসুন্দর হলেও সমস্যা।”

তখন সেখানে উপস্থিত হয় আহসান বাড়ির ছোটরা। আরুকে এই অবস্থা দেখে ছুটে আসে তিস্তা। কান্নায় আরেক দফা ভেঙে পড়ে আরু। নয়নাও ধমকালো পারুলকে, “তুই এটা ঠিক করলি পারুল। বিয়ের দিন মেয়ের রূপ সবাই দেখবে, সেখানে তোর জন্য মেয়েটা কালি মেখে বসে আছে‌। কিছুক্ষণ পর মেয়েকে দেখতে আসবে গ্ৰামের লোক, মেয়ের এই অবস্থা দেখলে মন্দ বলবে। বুঝিয়ে শুনিয়ে কলতলায় নিয়ে যা।”

নয়নার কথা মেনে আরুকে ধরে পারুল বলে, “চল গোসল করবি।”

“বলেছি না, এই বাড়িতে এমনই থাকব। হাত ছাড়ো আমার।” আরু প্রবল তেজ নিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল‌। তিস্তা, তুর ও শেফালী জোরপূর্বক আরুকে ধরে টেনে নিয়ে গেল কলতলায়। ছিটকিনি তুলে দিয়ে তিস্তা বলে, “বিয়ের দিন কেউ এমন কাজ করে?”

“আমি করতে চাইনি, মা করেছে। আমি যখন বিদায় নিয়ে চলে যাবো, একটুকুও কাঁদবো না। কালাচাঁন আমাকে ভালোবাসে তাতে কি আমার দোষ? মিহির ভাই আমাকে ভালোবাসে, তাতে কি আমার দোষ? সবকিছুতে মা আমার দোষ খুঁজে বেড়ায়। তাই রাগে কালি লাগিয়েছি।
__
সকল জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে বরবেশে মৃধা বাড়িতে উপস্থিত হলো অপূর্ব। অপূর্বর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আহসান বাড়ির একদল পুরুষ ও মেয়েরা। সাথী, সিঁথি, আঁখি, তন্বী, মিতু সাবিত ও অয়ন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বরযাত্রীদের উপরে কঠোর নিয়ম জারি করে, “চেয়ারম্যান বাড়ির চাঁদের হাট মৃধা বাড়িতে পড়েছে। তবে এক হাজার টাকার কমে কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না।”

“ভাগ্যিস আমার এমন আয়োজন করে বিয়ে হয়নি, এত আয়োজন করে বিয়ে করলে শালিকা ও শ্যালক বাহিনী সব টাকা হাতিয়ে নিতো।” তিয়াস বলে। উপস্থিত সবাই একটু হাসে। শেফালী ব্যতিব্যস্ত হয়ে তুরের কানে ফিসফিস করে বলে, “আমরা যদি ওদের দলে থাকতাম, তাহলে ভাগ পেতাম।”

“চুপ। ওরা আমার ভাইয়ের টাকা নিয়ে যাচ্ছে আর তুই ভাগ নিয়ে পড়েছিস? কীভাবে টাকা বাঁচাতে পারব, সেটা ভাব।” চোখ পাকিয়ে শেফালীকে উদ্দেশ্য করে বলে তুর। ভাইয়ের টাকা বাঁচাতে পণ করে সবাইকেই ঠেলে সামনে চলে গেল তুর। আচমকা ধাক্কায় শেফালী গিয়ে ধাক্কা খেল কালাচাঁনের সাথে। কালাচাঁন শেফালীকে আঁকড়ে ধরে নিজের সামনে নিয়ে এলো। আরও অনেক পুরুষ এসেছে বরযাত্রী হিসেবে, তাদের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে সামনে নিয়ে বলে, “এত ছোটাছুটি কেন করো? বিয়ে বাড়ির এই ভিড়ের পড়ে গেলে তোমার হাড়গোড় সব ভেঙে যাবে।”

এই প্রথম কোনো পুরুষ তাকে রক্ষা করল। ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করতে করতে শেফালীর মনে শূন্য থেকে একে পৌঁছে যায় ভালোবাসার কাটা। শেফালী সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তুর একটু জোর নিয়ে বলে, “এত টাকা দেওয়া যাবে না। তোমরা সাতজন আছিস, আমি পঞ্চাশ করে সাতজনকে তিনশো পঞ্চাশ টাকার সাথে পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়ে তিনশো টাকা দিবো। যদি নিতে চাও, তাহলে এটাই পাবে।”

চাপা অভিমান নিয়ে করুন গলায় আঁখি বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি তো একবারই বিয়ে করবেন। শ্যালক শালিকাদের একবারই খুশি করতেন পারবেন। এক হাজার টাকা দিন না? আরুকে আমরা এত কষ্ট করে সাজিয়েছি, দরজার জন্য না হোক, আরু সাজের জন্য দিন।” এতক্ষণ অপূর্ব রুমাল মুখে নিয়ে একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। অপূর্বর দূর্বলতা আরুকে নিয়ে আসতেই অপূর্ব বুকের ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হয়ে উঠল। শেরয়ানির পকেট থেকে পাঁচশো টাকার দশটা নোট বের করে টেবিলের উপরে রেখে বলে, “আমি চেয়ারম্যান বাড়ির বড়ো সন্তান অপূর্ব আহসান। বাবার পরে আমিই ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানরা সবসময় মাথা উঁচু করে ঢুকে, তাই ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান অপূর্ব আহসান মাথা উঁচু করে ঢুকবে। (বিরতি টেনে) ভোটটা যাতে আমার নামে যায়।”

অপূর্বর কথায় উৎফুল্ল হয়ে সবাই করতালি দিল। অতঃপর লাল ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে অপূর্ব। তাকে খাওয়ানো হলো শরবত ও মিষ্টি। অতঃপর নিয়ে আসনে বসানো হলো। অপূর্ব যাওয়ার‌ সময় ফিসফিস করে বলে, “আরুর সাজ যদি আমার পছন্দমতো হয়, তাহলে আরও পাবে।”

তুর ছুটে তন্বীর হাত ধরে বলে, “আমাকে ভাগ দিস বান্ধুবী।”

“একদম না, তোকে এক টাকাও দেওয়া হবে না। তুই আমাদের বিপক্ষ দল।” বলে টাকা ভাগ না করে মেয়েরা ছুটে গেল আরুর কাছে। হালকা সাজে মাথায় দোপাট্টা টেনে বসে আছে আরু। পাঁচ কুমারী প্রবেশ করে আরুর মাথা থেকে খুলে ফেলল দোপাট্টা। হালকা সাজটা মুছে ফেলতেই পারুল বাক্য তোলে, “কী করছিস, অনেক কষ্টে ভাবী সাজিয়ে দিয়েছে। মুছে ফেলছিস কেন?”

“কারণ সাজটা সুন্দর না, আমরা পাঁচজনে সাজাচ্ছি।” আঁখি বলে। তারপরে আরুর সাজ ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। ‘তুর ও শেফালী’ আরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে, আরুকে সাজাতে দেখে ব্যঙ্গ করে বলে, “দরজা নিয়ে এত মেতেছিলিস যে, আরুকে সাজাতেই পারিস নি?”

“সাজিয়েছিল মা। কিন্তু অপূর্ব ভাই বলেছে আরুকে যদি সুন্দর করে সাজাতে পারি, তাহলে আরও টাকা দিবে। তাই সুন্দর করে সাজাচ্ছি।” সাথীর কথা শুনে সেখান থেকে মন খারাপ করে শেফালীকে নিয়ে চলে গেল তুর। দুই বোনকে খুঁজতে এসে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো তিস্তা। চিন্তিত হয়ে বলে, “তোরা এখানে বসে কী করছিস?”

“কপাল চাপড়াচ্ছি। কনেপক্ষের মেয়েরা আরুকে সাজিয়ে টাকা নিচ্ছে, দরজা ধরে টাকা পাচ্ছে। আমরা যদি সকালে ওদের দলে যেতাম, তাহলে আমরাও পেতাম।” মন খারাপ করে তুর বলে। তুরকে বুকে টেনে তিস্তা বলে, “পাগল বোনরা, এখনো মূল আকর্ষণ বাকি। আমরা বাসর সাজিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের থেকে ডাবল আদায় করে নিবো।”

“সত্যি?”

“হম।” তিস্তা শব্দটা উচ্চারণ করার পূর্বেই শেফালীর হাত ধরে তুর ছুটে গেল বাড়ির দিকে। বিভিন্ন ধরনের ফুলের ব্যবস্থা করতে হবে তাদের।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here