#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৮ [বর্ধিতাংশ]
“নীলপদ্ম দেনমোহর হিসেবে ধার্য করিয়া ও নগদ বুঝিয়ে পাইয়া, সুন্দরনগর গ্ৰামের চেয়ারম্যান মোতাহার আহসানের বড়ো ছেলে অপূর্ব আহসান আপনাকে
নিকাহ করিতে আসিয়াছে, বিয়েতে রাজি থাকলে, বলেন মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।” উপস্থিত সবাই আরুর মুখের দিকে তাকালো কবুল শোনার জন্য। আরুর অন্তরে ‘নীলপদ্ম’ শব্দর পুনরাবৃত্তি চলছে। আরু কবুল উচ্চারণ না করাতে পুনরায় হুজুর বলে, “রাজি থাকলে বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
নয়না পেছন থেকে আরুকে ঠ্যালা দিয়ে অব্যক্ত স্বরে বলে, “আরু সবাই অপেক্ষা করছে, কবুল বল।”
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল!”
“আবার বলুন কবুল।”
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল!”
আরও একবার কবুল বলুন।”
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
“আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই শুনেছি। আপনারা এখন স্বামী স্ত্রী।” হুজুর বলতেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেল বাইরে। অতঃপর ভবিষ্যৎ জীবনের সুখের আশায় নবদম্পতির জন্য দুহাত তুলে দোয়া চাইলো। পারুল আঁচলে মুখ আড়াল করে কেঁদে উঠলে সেই রোল পৌঁছে গেল আরুর কানে। কঠোর আরু উঠল ফুঁপিয়ে। নয়না একটু চাপা গলায় বলে, “পারুল কাঁদছিল কেন? আরু তোর বাপের বাড়িতে গেছে। আরুর যত্নে কোনো ত্রুটি থাকবে না। তুই এক থালা খাবার এনে আরুকে খাইয়ে দে। সকাল থেকে না খাওয়া মেয়েটা, চেয়ারম্যান বাড়ির পুত্রবধূ বলে কথা, আদৌ খেতে পারে কি-না কে জানে।”
নয়না এক থালা খাবার এনে আরুকে দুই লোকমা খাওয়াতে পারে কেবল। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে অপূর্ব ঘরে প্রবেশ করে। মেয়ে জামাতাকে দোয়া ও দুধ খাইয়ে হাতে তুলে দিল পারুল। চোখের জলে বলে, “আমার একটাই মেয়ে অপু, ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি তোকে দিলাম।”
ঝাপসা চোখে সম্মুখে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দুই সেকেন্ড দেখে অপূর্বর হাতটা খামচে ধরল আরু। অপূর্বর দিকে একটু সেঁটে যেতেই অপূর্ব লক্ষ্য করে ফিসফিসিয়ে বলে, “কালাচাঁনকে দেখে ভয় পাওয়া কিছু হয়নি, ও আহসান বাড়ির হবু জামাতা।”
“মানে?”
“মানে শেফালীর সাথে কালাচাঁনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে সময় করে সব বলব।” রুমালে অধর আড়াল করে বলে অপূর্ব। নাছোড়বান্দা আরু তবুও প্রশ্ন করে, “তাহলে আমি কিছু জানি না কেন?”
“ফুফুও জানে না। আজ সকালে হয়েছে। এই পরিস্থিতির ভেতরে কাউকে বলেনি বাবা। আমাদের বিয়ের পর্ব শেষ করে সবাইকে বলবে।” অপূর্ব নতজানু হয়ে বাক্য তোলে। বর্ষাকাল বিধায় মেঘে ঢেকে এলো স্বচ্ছ অন্তরিক্ষ। বাড়ি যাওয়া নিয়ে মোতাহার আহসান তাড়া দিতেই কেঁদে উঠল পারুল, ইমদাদ। আজকে বোনকে হারানোর কষ্ট অনুভব করে বাদ গেল না অয়ন। অপূর্ব আরুকে পাঁজাকোলা করে ঘরে থেকে নামাতেই বড়ো বড়ো কয়েকটা বৃষ্টি পতিত হওয়ার পাশাপাশি ধরা দিল সূর্যের তেজহীন ছবি। অপূর্ব তার গন্তব্যে আরুকে নামাতে আরু লক্ষ্য করল টাইসনকে। সোনালী রঙের ঘোড়াটা নতজানু হতে, অপূর্ব উঠে বসল তাতে। আরু কান্নায় ইতি ঘটিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি ঘোড়ায় চড়ে এখানে এসেছেন?”
উপস্থিত সবাই হাসল, অপূর্ব পেল খানিক লজ্জা। তিস্তা নিকটে এসে বলে, “অপূর্ব ভাই এখন তোর স্বামী। স্বামীকে কেউ ভাই বলে সম্বোধন করে? নিজেকে হাসির পাত্র বানাচ্ছিস কেন?”
আরু আড়ষ্ট হয়ে যেতেই অপূর্ব হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাতে নিজের হাত স্পর্শ করতেই চকিতে অপূর্ব তাকে সামনে উঠিয়ে নিল। ঘোড়ার ঘাড় ছুঁয়ে আদর করতেই তার পোষ্য ময়নাপাখির কথা মনে পড়ল। তিন ছানাকে নিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এসে বলে, “আরুপাখি আর আসবে না, আর আসবে না, আর আসবে না।”
“মা, ওমা। আমি ময়নাপাখিদের নিয়ে যাই?” বাবার বিটা ত্যাগ করার আগে আরু বলে। মেয়ের কথা রাখতে খাঁচা এনে, তিন ময়নাপাখি ধরে ভেতরে ঢুকালো। তারপরে তুলে দিল তিস্তার হাতে। আরুর মুখে হাসি ফুটতে অপূর্ব টাইসনকে আদেশ দেয়, “চল টাইসন। বাড়ির পথে ফিরে চল।”
টাইসন দুপায়ে ভর দিয়ে ডেকে টগবগ টগবগ করে ছুটে চলল। আশেপাশের জনগণ অবাক নয়নে দেখছে ওদের। আরু তার মাথা অপূর্বর বুকে হেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমার রাজকুমার সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসেছে, আমাকে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে রানী করে নিয়ে যাচ্ছে তার রাজ্যে।”
_
অনিতা বরন করা শেষ করে আরু ও অপূর্বকে ঘরে তোলার অনুমতি দিয়েছে। দুপা ফেলতেই আরুর নজরে এলো ফুল। অপূর্ব ফুলগুলো কুড়িয়ে আরুর শাড়িতে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আরুকে বসানো হলো বৈঠকখানায়, আহসান বাড়ির উত্তরসূরী বলে আরুকে দেখতে ভিড় করেছে গ্ৰামবাসীরা। অপূর্ব ততক্ষণে শেরয়ানি ছেড়ে পরিধান করেছে সাধারণ টিশার্ট ও লুঙ্গি। অপূর্বকে এমন রূপে দেখে অনিতা রাগান্বিত হয়ে বলেন, “বরবধূকে একসাথে দেখতে এসেছে গ্ৰামবাসীরা, আর তুই শেরয়ানি খুলে ফেলেছিস?”
“শরীর চুলকাচ্ছে, এই ভিড়ের ভেতরে আমি থাকতে পারব না। মনে হয় গায়ের ভেতরে লেপটে যাচ্ছে মানুষ।” বলতে বলতে লম্বা টিশার্টের হাতা গুটিয়েছে অপূর্ব। মল্লিকার বয়স অপরিপক্ক, রঙ্গ করে বলেই ফেলে, “কিছুক্ষণ পর বউকে তো ঠিকই লেপটে রাখতে পারবে। তখন শরীর চুলকাবে না, মনে হবে আরু চুলকানির ওষুধ।”
“এত ঘটা করে বিয়ে করেছি, বউকে বুকের সাথে লেপটে রাখতে। সহ্য নাহলেও আজকে লেপটে রাখতেই হবে, ওয়েডিং ফাস্ট নাইট বলে কথা। তাছাড়া বয়স তেত্রিশ, এখন না লেপটালে কবে লেপটাবো?” বলে কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে ধপাধপ পা ফেলে অপূর্ব বাইরে চলে গেল। ছেলের মুখে প্রথমবার লাগামহীন কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সবাই। অনিতা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, “ও বিদেশে বড় হয়েছে, এগুলো সেখানকার কমন কথা। তাই বলে মায়ের সামনে..!”
আঁচলে মুখ আড়াল করে সেখান থেকে চলে গেল অনিতা।
_
গতমাসে অপূর্বর জন্য দোতলা ঠিক করেছে। ঘরের সামনে খোলা এক বারান্দা। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলে সাজানো হচ্ছে পালঙ্ক। অনিতা বিয়ের ভারী বেনারসি পালটে সুতি শাড়ি পরতে আরুকে পাঠিয়ে দিয়েছে অপূর্বর ঘরে। ট্রাভেলিং ব্যাগ খুলে তিস্তা আরুর জন্য লাল শাড়ি বের করতেই আরু বলে, “অপূর্ব ভাইয়ের আলমারিতে একটা বেনারসি আছে। ওটা বের করে দাও, আমি পরব।”
তুর আলমারি থেকে বেনারসিটা বের করে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তিস্তা ও সুমিকে দেখালো। তিস্তা চট করে বলে ফেলে, “এই বেনারসিটা তো বিয়েতে কেনা হয়নি। এটা এখানে এলো কীভাবে?”
“ভাবীর জন্য বিয়ের সরঞ্জাম কেনার সময় এটা ভালো লেগেছে, এজন্য অপূর্ব ভাই আলাদা করে কিনে রেখেছেন।”
“এখনও তুই অপূর্ব ভাইকে ভাইয়া বলে ডাকবি। তখন না তোকে বারণ করলাম। ওগো বলবি।” চোখ পাকিয়ে বলে তিস্তা। অপূর্বর থেকে ভাই শব্দটা কীভাবে সরাবে? অপূর্বকে আদৌ ওগো বলা যায়? আড়ষ্ট হয়ে বলে, “আমার লজ্জা করে।”
“সমস্যা নেই, আজকে রাতের পর সব লজ্জা চলে যাবে। অপূর্ব ভাই তোমাকে সাহায্য করবে। এবার এসো তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেই।” কথাটা বলে সুমি আরুকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত হলো। দীর্ঘক্ষণ পর আরুকে বেনারসি পরিয়ে ফুলের রানী সাজাতে উঠে পড়ে লাগল সকলে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা দশে পৌঁছাতেই অপূর্ব দরজার কাছে এসে কড়া নেড়ে উঠে। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানাতেই মেয়ের দলেরা আটকে দাঁড়াল অপূর্বর পথ। তিয়াস তিস্তাদের দলে থাকলেও সুজন নিজের মত বদলে অপূর্বর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তিস্তা রেগে বলে, “তুমি স্ত্রী রেখে শ্যালকের কাছে কেন গেলে?”
“কারণ শ্যালক দুলাভাই ভাই ভাই। এক টাকাও দেব না।” দৃঢ় ভঙ্গিতে বলে।
চোখ রাঙায় সুজনকে, “তোমাকে পরে দেখছি। (থেমে) দশ হাজার টাকা দিতেই হবে। নাহলে আজকে রাতে বউয়ের কাছে থাকার কথা ভুলে যান এবং আমরা এখান থেকে সরব না।”
অপূর্বর সুদর্শন দেহে প্রবল তেজ। এক ধাক্কায় সবাইকে ফেলে আরুর কাছে গিয়ে বসল। আরুর ঘোমটায় হাত রাখতে রাখতে বলে, “ভাইয়ের বাসরে থাকার ইচ্ছে থাকলে থাকতে পারিস।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 💚
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/