নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৪৩ [বর্ধিতাংশ]

0
333

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৩ [বর্ধিতাংশ]

মাটির উনুনে রান্নার কারণে হাতে ও মুখে কালি লেগেছে শেফালীর। একদিকে লাকড়ি দেওয়া অন্যদিকে তরকারি দেখার জন্য শেফালী পেয়ে উঠছে না। আরু হাসতে হাসতে পিঁড়ি টেনে বসল। রঙ্গ করে বলে, “সারাবছর মা চাচিদের রান্না খেয়ে এসেছিস। এবার একটু তোর শাশুড়িকে রান্না করে খাওয়া।”

“আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোরা আর ছেলে পেলি না? একটা জঙ্গল এটা‌। আশেপাশে কেউ থাকেনা। আমি এখানে কীভাবে থাকব? একবার বাড়িতে যাই, আর আসব না।”

“হাস্যকর শেফু। কিছুক্ষণ পর তোকে পাকাপোক্ত এখানে রাখতে কাজি সাহেব নিয়ে আসছে তিয়াস ভাই। মার্কেট বন্ধ তাই ছোট চাচির বিয়ের শাড়ি এনেছে তোকে সাজাতে।” হাসতে হাসতে বলে আরু। মা ও চাচিরা ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে রসুইঘরে এসে পৌঁছেছে। সুমিকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে শেফালী মণিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা, আমি এখানে থাকব না। তুমি আমাকে নিয়ে যাও। এখানে আমার ভয় করে।”

“স্বামী থাকলে সেখানে তোর কীসের ভয়? কোনো ভয় নেই। বিয়ের পর কালাচাঁনকে আঁচলে বেঁধে রাখবি। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে যাতে ও ঘরে থাকে।” শেফালীর মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেয় মণি। তখনই শুনতে পেল অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর। অতঃপর শোনা গেল তিয়াসের গলা। অর্থাৎ কাজি সাহেব এসেছে। শেফালীর মন ভার হলো। মা ও চাচিরা শেফালীকে বোঝাতে শুরু করল। দীর্ঘক্ষণ পর তাঁরা শেফালীকে নিয়ে বারান্দায় গেল। রান্না ইতোমধ্যে শেষ।
শেফালীকে বধূবেশে তৈরি করে নিয়ে গেল ঘরে। মোতাহার আহসানের নেতৃত্বে নিকাহনামা লিখেছে কাজি। কালাচাঁনের নিকাহ পড়ানো শেষ। কোনে উপস্থিত হতেই কাজি সাহেব শুরু করলেন, “একশো এক টাকা ধার্য করিয়া ও নগদ টাকা বুঝিয়ে পাইয়া মরহুম আব্দুল লতিফ সিদ্দিকের একমাত্র পুত্র কালাচাঁন সিদ্দিক আপনার নিকাহ করিতে চায়। আপনি কি বিয়ে রাজি আছেন মা? তাহলে বলুন কবুল।”

শেফালীর চোখ থেকে পানি ঝরল মাটিতে। তাকিয়ে দেখল তার প্রিয়জনের মুখ। কবুল উচ্চারণ করার পর এই একা বাড়িতে ফেলে রেখে যাবে আহসান পরিবার। কাছের মানুষদের ছেড়ে শেফালী কীভাবে এখানে থাকবে? মুখে হাত দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শেফালী। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি বিয়ে করব না, আমি বাবা মাকে ছেড়ে কোথাও থাকতে চাই না। আমি বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। তাদের ছেড়ে কীভাবে এখানে থাকব।”

পেছনের বারান্দা থেকে মেয়ের কান্না শুনে কেঁদে ফেললেন মণি। আবেগপ্রবণ হলো শাহিনুজ্জামান। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এটাই নিয়তি। বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েকে বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িকে আপন করে নিতে হয়।”

“এতই আপন করে নিতে হয় যে, বোনের বিয়েতেও খবর দেয় না।” বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করে তিস্তা‌। তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সুজন। উপস্থিত সবাই বিস্মিত তিস্তাদের দেখে। এতকিছুর মাঝে তিস্তার কথা মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। জাহানারা উৎফুল্লিত হয়ে তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এতরাতে কীভাবে এলি, খবর পেয়েছিস কীভাবে?”

“তোমাদের কাছে পর হয়ে গেলেও তিয়াসের কাছে এখনো বোন। ও আমাকে জানিয়েছে।” কথাটা বলে শেফালীর পাশে বসে তিস্তা। মোতাহার আহসান খোশমেজাজে বলেন, “তোকে দেখে আমার ভালো লাগল। আমাদের চলে যাওয়ার পর ভাইবোনের সম্পর্ক এভাবে থাকুক।”

পরিবারের বড়ো মেয়ে হওয়ার কারণে তিস্তা সবার আদরের। মোতাহার আহসান চোখের ইশারায় শেফালীকে ঈঙ্গিত করল। দুঃখী মুখ করে তিস্তা বলে, “মন খারাপ করিস না শেফু বেবি। তুরের বিয়েটা হতে দে, তারপরে আমরা তিনজনে ঘর জামাই থাকব। বাড়ির মেয়ে তিনজনের সাথে দুইজন বউ পারবে না।”

কবুল বলার লক্ষণ পাওয়া গেল শেফালীর মাঝে। আড়চোখে তিস্তার পানে চেয়ে বলে, “তুমি ঠিক বলছ তো?”

“হ্যাঁ।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল।” এক নাগাড়ে বলে ফেলে শেফালী। এতক্ষণ হেঁয়ালি করা মেয়েটাকে হঠাৎ এভাবে কবুল উচ্চারণ করাতে সবাই হাসল। শাহিনুজ্জামান ও মণি তাদের একমাত্র মেয়ে শেফালীকে কালাচাঁনের হাতে তুলে দিয়ে বলে, “আমার একমাত্র মেয়ে শেফালী। তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা মন্দ। কেবল আমার ভাইয়ের কথাতে শেফালীর সাথে তোমার বিয়েতে রাজি হয়েছি। আমাদের কাছে মেয়ের সুখই আমার সুখ। মেয়ে অসুখী হলে এই বিয়ে ভাঙতেও আমাদের সময় লাগবে না।
আমাদের বাড়ির ভাগনিকে তোমার হাতে তুলে দিতে না-পারলেও, মেয়েকে তুলে দিয়েছি। আশা করি, আমাদের মান রাখবে।”
সুন্দরী শেফালীর হাত ধরে বলে, “কালাচাঁন নয়, শেফালীর দায়িত্ব আমি নিলাম। ওকে সুখে রাখার দায়িত্ব আমার। কালাচাঁনকে যখন জুতার মালা গলায় পরিয়ে গ্ৰাম থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তখন কেবল এই শেফালী আমার কোল খালি হতে দেয়নি। তাই শেফালীকে কালাচাঁনের বউ করে এনেছি। আমি বিশ্বাস করি এই শেফালী আমার কালাচাঁনকে বুঝতে পারবে।”

অতঃপর সুন্দরী চোখের ইশারা করলেন শেফালী ও কালাচাঁনকে। ঈঙ্গিত বুঝতে পেরে পা ছুঁয়ে সালাম করে আশির্বাদ চায় ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য। মোতাহার আহসান বলেন, “দুজন দুজনকে বুঝে সবার দায়িত্ব নেওয়াই সংসার। দোয়া করি কালাচাঁন ও শেফালী সুখী হোক। কালাচাঁন তোমাকে আমি ভরসা করে ভাই ও ভাবীকে বুঝিয়ে শেফালীকে দিয়েছি। ওদের কাছে আমার মাথা হেঁট করবে না।”

“জি চাচা।”

“আমরা এগোই। মা আপনি শেফালীর সাথে থাকবেন?” মোতাহার আহসান চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বলে। চম্পা সায় দিল, “কাছের কেউ থাকলে শেফালী ভরসা পাবে। আমি আজ থাকি।”

মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা চলে গেলেন। থেকে গেল জাহানারা, মল্লিকা ও ছোটোরা। হাসতে হাসতে বারান্দায় গেল তিস্তা। সুমি, তুর ও আরু পেছনের বারান্দা গোছাচ্ছে। তিস্তা ব্যাগ থেকে কিছু গাঁদা ফুল বের করে বিছানার উপরে রাখল। সুমি ভ্রু কুঁচকে বলে, “তিস্তা আপু ফুল পেলেন কোথায়? চাচা তাড়াতাড়ি আসতে বলাতে আমরা ফুল সংগ্রহ করতে পারিনি।”

“দিঘির পাড়ে কয়েকটা গাঁদা ফুল গাছ লাগিয়েছি। আসার সময় হঠাৎ চোখ পড়ল ফুলের দিকে। তাই পরিস্থিতি আন্দাজ করে নিয়ে এলাম।”

অতঃপর চারজনে মিলে হাতে হাতে ফুল দিয়ে ঘর গুছিয়ে ফেলল। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে কালাচাঁন ও শেফালীকে বাসর ঘরে নিয়ে এলো। তিয়াস একজোড়া স্বর্ণের আংটি বের করে শেফালীর হাতে দিয়ে বলে, “আজ থেকে তোর জীবন শুরু হয়েছে। অতীত ভুলে গিয়ে কালাচাঁনকে নিয়ে সুখী হ। আমাদের ভাগ্যে যা লেখা আছে, তাকে নিয়েই জীবন সাজাতে হবে।”

শেফালী তাকাল তিয়াসের দিকে। কালাচাঁনের বিচারের দিন তিয়াস শেফালীকে স্বার্থপর বলেছে। এরপর আর কখনো কথা হয়নি। আজ আবার কথা বলেছে। অথচ এই মানুষটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে। অন্যদিকে কালাচাঁন আরুর দিকে তাকিয়ে আছে। মুক্তার মতো দাঁত পানে লাল হয়েছে। ঠোঁটের মাঝ থেকে চুইষে পড়ছে লাল রঙের তরল পদার্থ। এতে আরুকে মোহনীয় লাগছে কালাচাঁনের। এই বাসর সাজানোর কথা ছিল আরুর নামে, অথচ সেখানে শেফালী। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কালাচাঁন বলে, “আপনারা যেতে পারবেন না-কি আমি দিয়ে আসব?”

“আজ তোমাদের বাসর। নিজেদের সময় দাও। আমরা যেতে পারব।” বিরতি দিয়ে অপূর্ব বলে, “যদি হাত ভেঙে থাকে, তাহলে আমি নিজ দায়িত্বে আমার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আর আমরা ভাইবোনেরা তাকে সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে ঘুরেও আসব কয়েকদিন।”

“আচ্ছা ভাইয়া।” কালাচাঁন বলে। অতঃপর সবাই দলবেঁধে বেরিয়ে গেল আহসান বাড়ির উদ্দেশ্যে। দরজার খিল তুলে দিল কালাচাঁন। পরক্ষণে লক্ষ্য করল, তিয়াসের দিয়ে যাওয়া জুয়েলারি বক্সটা মাটিতে পড়ে আংটি দুটো পায়ের কাছে এসেছে গড়িয়ে। মাটিতে বসে অঝোর ধারায় কাঁদছে শেফালী। কালাচাঁন কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অন্তঃকরণ ক্ষয় হচ্ছে আরুর নামে। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে কামনা করেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here