নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৪৪

0
337

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৪

“শেফালী, কেঁদো না। মানুষের জীবন নদীর মতো। তারা নিজের মতো বইতে পারেনা। উপত্যকা হিসেবেই তাদের চলতে হয়।” কথাটা বলে আংটি দুটো কুড়িয়ে বিছানায় বসে কালাচাঁন। শেফালী হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কাঁদব না? আমি তিয়াস ভাইকে কতটা ভালোবাসি জানেন আপনি?”

শেফালী তেড়ে গিয়ে কালাচাঁনের কলার টেনে ধরল। আলতো মাথা নিচু করে নেয় কালাচাঁন। মনে মনে হাসে, ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে গিয়ে জোতার মালা গলায় পরেছে। গ্ৰামবাসীরা একশো একটা আঘাত করেছে। সৌজন্য হেসে বলে, “তিয়াস ভাই আমাকে সব জানিয়েছে। তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার হাতে ন্যস্ত করেছে। গোলাপিকে হারিয়ে বিয়ের কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিন তুমি যখন আমার হয়ে সবাইকে বলেছিলে, আমাকে গ্ৰাম থেকে বের না করতে। সেদিন মায়ের মনে তুমি জায়গা করে নিয়েছিলে। আমার এই রঙহীন জীবন আলোকিত করতে, মাকে তোমাকে পছন্দ করেছে।
শেফালী অতীত ভোলা যায় না, তাই বলে অতীত আঁকড়ে ধরে থাকা উচিত নয়। তোমাকে আমি গোপালির মতো ভালোবাসতে পারব না। তবে তোমাকে ভালো রাখতে পারব।”

আঁকড়ে ধরা হাতটাতে আংটি পরিয়ে ছাড়িয়ে নিল কালাচাঁন। বিছানার একপাশে সেঁটে শুয়ে পড়ল। শেফালী অপলক দৃষ্টিতে কালাচাঁনের দিকে তাকিয়ে আছে। কালাচাঁনের ভালোবাসা ছিল খাঁটি। হঠাৎ কানে এলো পোকাদের শব্দ। অচেনা জায়গায় এমনিতেই ভীতু শেফালী। ভয়েটা তড়তড় করে বেড়ে যাচ্ছে। ভয় কাটাতে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ল শেফালী। শুনতে পেল ফোঁপানোর শব্দ। পুরুষেরা সহজে ভেঙে পড়েনা, তার উদাহরণ কালাচাঁন।
__
সাত জন যুবক যুবতি হেঁটে যাচ্ছে মাটির রাস্তা দিয়ে। প্রথমত আরু গোসল করেছে সন্ধ্যায়, দ্বিতীয়ত চাদর নিয়ে আসেনি। তাই ঠকঠক করে কাঁপছে আর হাঁটছে। হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুমি ও তিয়াস সম্মুখে এগিয়ে গেছে। তার আগে এগিয়ে গেছে তিস্তা ও সুজন। অপূর্ব দু-হাতে বউ ও বোনকে ধরে হাঁটছে। আচমকা অপূর্বর হাত ছেড়ে রাস্তার কিনারে নদীর দিকে মুখ করে বসে পড়ল আরু। গড়গড় করে বমি করল। অসময়ে আরুর এই অবস্থা দেখে অপূর্ব আরুর নিকট যায়। ঝুঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়‌। আরুর চোখে-মুখে এক ক্লান্তি বিরাজমান। যত্ন করে বলে, “কী হয়েছে আরুপাখি, শরীর খারাপ?”
“পঁচা মাছের বিশ্রী গন্ধ আসছে। আমার বমি পাচ্ছে।”
অপূর্ব তার শরীর থেকে চাদর খুলে আরুর গায়ে জড়িয়ে দিল। উন্মুক্ত হলো পানের লাল পিক। আরু চাদর দিয়ে নাক ঢেকে অপূর্বর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে পুনরায় হাঁটা শুরু করল। সুমি ও তিয়াস অনেক সামনে এগিয়ে গেল। এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যায় তিয়াস। পিছিয়ে ওদের জন্য দাঁড়ায়। দূর থেকে বলে, “ভাই, দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?”
“স্কুল থেকে ফিরে রান্না করেছে, না খেয়েই এখানে চলে এসেছে। খালি পেটে পচা মাছের গন্ধে বমি করেছে।”
“পচা মাছ পেলেন কোথায়?”
“মনেহয় জাল থেকে মাছ ছাড়ানোর সময় দু-একটা ঝোপঝাড়ে পড়ে ছিল। সেটাই পচে দুর্গন্ধ ছাড়াচ্ছে।

অপূর্বরা এগিয়ে আসতেই কিঞ্চিৎ আলোতে অপূর্বর সাদা‌ শার্টে লাল দাগ দেখে বলে, “আপনার শার্টের এই অবস্থা হয়েছে কীভাবে ভাই?”

অপূর্বর মনে পড়ল তখনকার কথা। আরু কাঁচুমাচু করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পুনরায় আরুর হাত ধরে অপূর্ব বলে, “এই গোরুটা পানের পিক ফেলেছে। গোরুর মতো পান চিবানো শিখেছে। সাদা শার্টে এই দাগ উঠবে? ঘষে ঘষে যদি এই দাগ আরু উঠাতে না পারে, তাহলে ওর শরীরে দাগ করার দায়িত্ব আমায়।”

আরু চোখ রাঙিয়ে তুরকে ইশারা করে। তুর মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। হাত ছাড়িয়ে সুমির হাত ধরে হাঁটা দিয়ে বলে, “তোমরা সবাই আস্তে হাঁটছ কেন? আমার পা ব্যথা করছে।”

“তুর। তুই আমার একমাত্র আদরের বোন। যখন তুই হাঁটতে শিখেছিস, তখন মা-বাবা দেশে ফিরে এসেছে। আমাকে জোর করে ভিনদেশে রেখে এসেছে। এক প্রকার চাপা রাগে আমি এতদিন দেশে ফিরিনি। মা তখন আরুকে আমায় বধ করার অ/স্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কেবল আরুর টানেই আমি দেশে এসেছি। ছোটবেলায় তোকে তেমন কোলে নিতে পারিনি, চাইলে এখন বড়ো ভাইয়ের কোলে উঠতে পারিস।”

বলেই হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে অপূর্ব। তুর এই সুযোগটাকে মিস করতে চায়না, তাই অপূর্বর গলা ধরে ঝুলে পড়ল। ভাই বোনের এই মিষ্টি সম্পর্কগুলো আজীবন অক্ষত থাকুক।
__
শীতকালের আগমনের আগেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা এসে জানালার পাশে বসেছে। পাখিদের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় কালাচাঁনের। কালাচাঁনদের বাড়ি নদীর কিনারায় একটু ভেতরে থাকাতে শীত বেশি পড়ে। তবে অন্যদিনের তুলনায় আজ শীত অনেকটা কম। কালাচাঁন অনুভব করে কেউ তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। কালাচাঁন আলতো ঘাড় কাত করে শেফালীর তৈলাক্ত ও ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখতে পায়। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ছেলেটি। গতরাতে যে বিয়ে করে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে, আজ সে কালাচাঁনকে অবলম্বন করে রেখেছে। কালাচাঁন শেফালীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াতে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বেই দরজার করাঘাত পড়ল। অনবরত করাঘাত বাড়তে শুরু করল। দরজার বিপরীত পাশ থেকে তুর বলে, “দুলাভাই, আর কত ঘুমাবেন। উঠুন। বিয়ের পর দিনে এত ঘুমায় না!”

শেফালীর তন্দ্রা হালকা হয়ে এলো। চোখ মেলে সর্বপ্রথম নজরে এলো কালাচাঁনের লাল রঙের পাঞ্জাবি। চকিতে ঠ্যালে পিছনে যেতেই বিছানা থেকে মাটিতে পড়ল শেফালী। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। কালাচাঁন বিছানা থেকে উঠে নিজেই কম্বল ভাঁজ করে পাশে রাখে। এটা তার নিত্যদিনের কাজ। অতঃপর কমলা রঙের একটা পাজামা-পাঞ্জাবি কাঁধে নিয়ে দরজা খুলে দিল। তুরের পেছনে সুমি দাঁড়িয়ে ছিল। হাত দিয়ে কালাচাঁনের পথ আটকে বলে, “নন্দাই সাহেব, রাত কেমন কেটেছে।”
“আপনার ননদকে জিজ্ঞেস করুন।” লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে দিঘির দিকে গেল কালাচাঁন। আড়াল থেকে বেরিয়ে সুমিদের সাথে যোগ দিল আরু ও তিস্তা। কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে শেফালীকে বিছানায় দেখতে পেল। ততক্ষণে মাটিতে থেকে শাড়ি ঝেড়ে বিছানায় বসেছে শেফালী। গতরাতের শাড়িতে ভাঁজ না দেখে অকপটে সুমি বলে, “শেফালী এভাবে কোমরে হাত দিয়ে কেন বসে আছো?”
“ব্যথা পেয়েছি।”
“অ্যাহ!”
“সত্যি বলছি। ধাক্কা দিলে ব্যথা পাবোনা?”
“বোন, তুই বাইরে গিয়ে এই কথা বলিস না। তাহলে আমাদের মানসম্মান শেষ।” আরু হেসে বলে।
“শেফালী কি তোর মতো? ও সব বুঝে। তোকে যখন প্রশ্ন করেছিলাম, তখন অপূর্ব ভাইকে ধরিয়ে দিয়েছিস। আমাদের সাথে যদি শেয়ার না করে, কার সাথে করবে? ওর কি ননদ আছে?” আরুকে খানিক রঙ্গ করে বলে তিস্তা। রঙ্গ বুঝতে পারল না আরু। বিপরীতে তেজ দেখিয়ে বলে, “আমি খা/রা/প এটা বলতে চাইছো? তোমরা থাকো তোমাদের মতো। আমি আর তোমাদের বিরক্ত করব না।”

বলেই রাগান্বিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আরু। চার জন যুবতি বুঝতে পারল না, আরুর ব্যবহারের মানে। আরু সহসা রাগে না, আজ সামান্য কারণে রেগে গেল। আরু পেছনের দরজা দিয়ে রসুইঘরে এসে দাঁড়াল। অনিতা ও জাহানারা নাস্তা তৈরি করছে। আরু পিঁড়ি পেতে বসতেই অপূর্ব ডাক্তার নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সুন্দরী যার কাছে পরীক্ষা করেছিল, সে অপূর্বর পরিচিত বলে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। অপূর্ব ডাক্তারকে ঘরে রেখে রসুইঘরে এসে বলে, “মা, ডাক্তার এসেছে। এক চাপ চা দাও।”

জাহানারা কাপে ছাঁকনি দিয়ে চা ঢালতে ঢালতে আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আরু চা আর বিস্কুটগুলো নিয়ে যা।”
“পারব না। আমি কি এই বাড়ির বউ? যে বউ তাকে বলো। সে-তো এত বেলাতেও ঘুমাচ্ছে আর আমরা সাতসকালে হাজির।”

অজানা কারণে আরুর মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে। জাহানারা আড়চোখে অনিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “ইদানীং ওর কী হয়েছে ভাবী? কথায় কথায় ছ্যান ছ্যান করে ওঠে।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here