নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৪৭

0
342

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৭

দোতলা ছোটো লঞ্চ। ওপর থেকে নিচে তাকালে পানি দেখা যায়। এই প্রথম লঞ্চে উঠেছে আরু। আনন্দে রেলিং ধরে নিচে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তুর পাশে দাঁড়িয়ে ইশারা করছে ঘাটের দিকে। আরু কৌতূহল নিয়ে পাশে তাকাতেই বিস্মিত হচ্ছে। প্রয়াস ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে ঘাটের দিক থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। শঙ্কায় আরু জমে পেছনে তাকাল, অপূর্ব হেসে হেসে কথা বলছে। ঘনঘন পলক ফেলে তুরকে ঠ্যালা দিয়ে বলে, “প্রয়াস ভাই এদিকে আসছে কেন? ওনি দেখলে কিন্তু ভয়ংকর কিছু ঘটবে।”

“আমি তাকে আসতে বলেছি।”

“মাথা খা/রা/প তোর? আমি সিউর আজ কোনো ঝামেলা হবে। তুই তাড়াতাড়ি প্রয়াস ভাইকে যেতে বল।”

“সব প্ল্যান করা আছে। নো টেনশন ডু ফুর্তি।”

আরুর চিন্তার অন্ত নেই। করতে পারছে না ফুর্তি। প্রয়াস জ্যাকেটের পকেটে এক হাত রেখে অন্য হাতে ট্রাভেলিং ব্যাগ ঠেলতে ঠেলতে উপস্থিত হলো। মুচকি হেসে আরুকে অভিনন্দন জানায়, “ভাবী, কেমন আছেন? আমি যে ফুফা হচ্ছি, জানালেন না কেন?”

“আপনি কীভাবে জানলেন?” আরুর বোকা প্রশ্ন। জবাবে এক‌ গাল হেসে প্রয়াস বলে, “তুর জানিয়েছে।”

মাথায় হাত দিল আরু। মেয়েটা ঠোঁট কাটা। প্রকাশ হওয়ার আগেই প্রয়াসকে জানিয়ে দিয়েছে। আরু এই প্রসঙ্গ পালটে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে বলে, “আমার বাবুর না হওয়া ফুফাকে এখানে দেখলে আমার বাবুর বাবা তাকে পানিতে ফেলে দিবে। ফুফা হতে চাইলে এখান থেকে যেতে হবে।”

“দূরে দূরে থাকলে ফুফা হব কীভাবে? দেখা যাবে, বিয়েটাই হবে না।”
তিন জনের কথপোকথনের মাঝে এলো অপূর্ব। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলে, “আপনি কে?”

চেনার সত্ত্বেও অজানার ভান ধরে প্রয়াস বলে, “আপনি কে?”

“আমার বোন আর আমার বউ।”

“ওহ্। আসলে ঘাট থেকে দেখলাম, দুজনে নিচের দিকে ঝুঁকে নদী দেখছে। মাথা ঘুরে যদি পড়ে যায়, তাই বারণ করলাম ভাই।”
প্রয়াসের কথায় অপূর্বর মনে পড়ল, আরু ইদানীং মাথা ঘুরে। আরুকে টেনে কিনার থেকে মধ্যে আনল। সৌজন্য হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “ধন্যবাদ।”

হাত মিলিয়ে প্রয়াস বলে, “এটা আমার কর্তব্য। তা আপনারা কোথায় যাচ্ছেন ভাই?”

অপূর্ব বলে, “আমরা আনন্দনগর যাচ্ছি। ভালো ডাক্তারের খোঁজে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

“আমি সাধারণত ট্যুরিস্ট। সময় পেলেই দেশ ঘুরি। কোথায় যাচ্ছি ঠিক জানি না। যেখানে যাই মিনিমাম চার দিন থাকব।” শুরু হলো হবু শ্যালক ও দুলাভাইয়ের কথপোকথন। অপূর্ব বিদেশে থাকতে সময় পেলেই বনভোজনে যেত। সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির করছে প্রয়াসের সাথে‌। আওয়াজ তুলে লঞ্চ অগ্রসর হলো যাত্রাপথে। আরু চেয়ারে বসে প্রকৃতি দেখছে। ঠান্ডা লাগলেও এই দৃশ্য এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সুন্দরীর দুই পাশে শেফালী ও কালাচাঁন বসে আছে। সম্পর্কে বিরাজমান কিন্তু। সুন্দরী চায়, এই দম্প্রতি সুখী হোক। চেয়ার থেকে উঠে আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার সাথে একটু ওয়াশরুমে যাবে?”

“চলুন।” আরু ও তুর দুজনে চলল সুন্দরীর সাথে। সুজন ভালো ছবি তুলতে পারে। ক্যামেরা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে প্রয়াস। শেফালীদের থেকে কিঞ্চিৎ দূরে তিস্তার ছবি তুলে দিচ্ছে সুজন। শেফালী কাতর দৃষ্টিতে তিয়াস ও সুমিকে দেখছে। কালাচাঁন জানে শেফালীর ভাঙা হৃদয়ের কথা। ফাঁকা চেয়ারে শেফালীর পাশে বসে বলে, “শেফু, চলো একটু হেঁটে আসি।”

“ইচ্ছে করছে না।”

কালাচাঁন উঠে এগোল। না বলার পরেও শেফালী কালাচাঁনের পেছনে পেছনে গেল। তিস্তা ওদের লক্ষ করে বলে, “একসাথে দাঁড়া, ছবি তুলে দেই। তোদের তো কাপল পিক নেই।”

তারপরে ক্যামেরাবন্দি করল দুজনের ছবি। অপূর্ব প্রয়াসের সাথে কথা বলতে বলতে বলে, “আমার বউ কোথায়? আমিও কাপল পিক তুলব।”

“অপূর্ব ভাই, সব জায়গায় জোড়া জোড়া। কিন্তু আপনারা তিন জন। এজন্য আরু জোড়া নিয়ে আছে, আপনাকে পাত্তা দিচ্ছেনা।”

“এই শীতে বউ ছাড়া থাকা যায় না। তাই বউ রাগ করে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথে রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছি।” অপূর্বর কথায় মাঝেই সেখানে এলো আরু। শুরু হলো তাদের ছবি তোলার মুহূর্ত। দুপুর গড়িয়ে আসতেই টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খেতে বসল সকলে। প্রয়াস সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অপূর্ব তাকে থামায়‌। খিচুড়ি রান্না করে দিয়েছি। অপূর্ব নিচের টিফিন ক্যারিয়ান নিয়ে আরুকে নিজের হাতে খাওয়ায়। চাদর খামচে ধরে ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে ও খাচ্ছে আরু। অপূর্ব নিজের জ্যাকেট খুলে আরুর কোলের ওপর রেখে বলে, “একটু আগেও তুই এতটা কাঁপিসনি।”

“ওয়াশরুমে গেলাম না? ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তুরের জন্য দাঁড়িয়েছি। পেছনে অনেক বাতাস। সেই বাতাসে কাঁপা শুরু হয়েছে, থামার নাম নেই।” খেতে খেতে কথা ও কম্পন চালিয়ে যাচ্ছে আরু। উঠল মস্তকে। ছিপি খুলে বোতল তুলে পান করল পানি। মাথায় চাপড় দিয়ে বলে, “আস্তে আস্তে খা।”

“আর খাবো না।”

“ঠিক আছে।” অতঃপর অপূর্ব নিজে খেতে থাকল। দীর্ঘক্ষণ পূর্বে রান্নার ফলে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। খেয়ে সবাই কাঁপছে। প্রয়াস খেয়ে সবাইকে প্রস্তাব দিল, “চলুন সবাই মিলে চা খাই। ঠান্ডা খিচুড়ি আর পানি খেয়ে ভেতরটা বরফ হয়ে গেছে।”

প্রয়াসের দেওয়া প্রস্তাব পছন্দ হলো সকলের। ধাপে ধাপে পা ফেলে সবাই নিচতলায় চায়ের দোকানে গেল। এগারো কাপ চায়ের অর্ডার দিল। অর্ডার দেওয়া চা মনোমতো না হলেও ঠান্ডা কমানোর ওষুধ হিসেবে কাজ করছে। তিয়াস খানিক কৌতূহল নিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আমরা কোথায় যাচ্ছি? মানে আনন্দনগরে গিয়ে আমরা কোথায় থাকব?”

আরুর চায়ে ফুঁ দিয়ে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে এলো অপূর্ব। চা আরুর হাতে দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে প্রতুক্তি করে,
“তোমার-আমার দাদির বাবার বাড়িতে। দাদি হচ্ছে তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছেলে না থাকার কারণে তাঁদের মৃত্যুর পর বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। সেকেলের এক কর্মচারী বাড়িটার দেখাশোনা করে। বাবা প্রতি মাসে ডাকপিওনের মাধ্যমে চিঠি ও টাকা পাঠায়। আমাদের যাওয়ার কথা ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি।” বলতে বলতে অপূর্ব চা-টুকু খেয়ে ফেলেছে। প্রয়াস ছক কষে বলে, “যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি কি আপনাদের সাথে যেতে পারি? আসলে পরিত্যক্ত বাড়ি ভ্রমণ করার ইচ্ছে অদম্য।” বিরতি দিয়ে বলেন, “প্রয়োজনে আমার খাবারের খরচ আমি বহন করব।”

“আমার বাবা হচ্ছে, সুন্দরনগর গ্ৰামের চেয়ারম্যান। আপনি তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে টাকার বিনিময়ে খাবেন? এতে বাবা অপমানিত হবে। আপনার সমস্ত খরচ আমাদের।” আরুর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। চায়ের বিল পরিশোধ করার পূর্বেই প্রয়াস মিটিয়ে দিল। কেবল মুচকি হাসল সকলে। ইতঃপর আরুকে নিয়ে গেল নিচতলার ইঞ্জিনের কাছে। ইঞ্জিন ঘরের বাইরে বেশ গরম লাগছে। অপূর্ব আরুর হাত চাদরের নিচ থেকে বের করে লোহার সাথে লাগাল। কিঞ্চিৎ সময়ে উষ্ণ হয়ে এলো হাত। অপূর্ব হাসি দিয়ে আরুর অপূর্ব ভাই বলে, “ঠান্ডা কমেছে?”

“হুঁ। এখানে ঠান্ডাই লাগছে না। সবাইকে এখানে ডেকে নিয়ে আসি।”

“উঁহু। জাহাজে আমাদের একটু প্রাইভেট সময় কাটানোর দরকার। বাবু আসলে তখন তোমার সাথে গোপন সময় কাটাতে পারব কি-না, জানা নেই। আসো।” দুহাত বাড়িয়ে আরুকে কাছে ডাকল অপূর্ব। চাদর ফাঁক করে অপূর্বর ডাকে সাড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরল আরু। ঢেকে দিল অপূর্বকেও। আরুর তুলতুলে শরীরের তাপ অপূর্বকেও উষ্ণ করে দিয়েছে। বুকে মাথা রেখে পরম শান্তি অনুভব করে আরু বলে, “আমাকে এত কেন ভালোবাসেন?”

“তোমাকে ভালোবাসি না। আরুপাখিকে ভালোবাসি, নিজের বাম পাঁজরের একটি হাড়কে ভালোবাসি। যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”

অদূরে এক ঝাঁক গাঙচিল উড়ে আসছে লঞ্চের পেছনে পেছনে। মাছ খোঁজা রেখে তার সাক্ষী হচ্ছে অপূর্ব আরুর প্রেমময় লগ্নের।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here