#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৬
সারফারাজের কথা শোনার মতো মেয়ে অর্নিলা না। তাকে বারণ করা হলেই সে শুনবে এমনো না। সে উড়নচণ্ডী! যখন তার যা মন চাইবে তাই করে। এতো সুন্দর গোলাপী রঙের জামদানি শাড়িটা উপহার পাবার পর পরে না দেখতে পেলে বড্ড আফসোস লাগবে। তাই ঘর ফাঁকা হতেই সে দরজা বন্ধ করে শাড়ি পরতে শুরু করল। কিন্তু সে তো শাড়ি পরতে জানে না। তাতে কি? এই যুগের ইন্টারনেট কাজে দিবে কবে? মোবাইলে ভিডিও অন করে শাড়ি পরতে ব্যস্ত অর্নিলা!
দু তিনবার শাড়ি প্যাচ দিচ্ছে, কিছুই হচ্ছে না। কুচি দিতে গিয়ে তাল গুলিয়ে ফেলছে। ইশ্! ভিডিতে কি সহজই না মনে হচ্ছে। যেই সে পরতে যাচ্ছে অমনি কতো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একবার তো ভাবল, এর চেয়ে পড়াশোনা সহজ। ওই হিসাববিজ্ঞানের রেওয়ামিল ও বোধহয় এর চেয়ে দ্রুত মিলে যেত, সে মিলিয়ে ফেলতে পারত। বরাবরই হিসাববিজ্ঞানে সে একটু কাঁচা। মনে হতো, আর্থিক বিবরণীর চেয়ে বড় কোন কঠিন বিষয় নেই। আজ মনে হচ্ছে, শাড়ির প্যাচ বোঝার চেয়ে কঠিন বিষয় আর কিছু হতে পারে না। একবার পুরোপুরি শাড়ি পরার পর খেয়াল করল শাড়ি উল্টো পরেছে। আঁচল চলে গেছে কোমরের ভাঁজে। রেগে মেগে অস্থির হয়ে শাড়ি বিছানায় ছুড়ে মারল। চুলো/য় যাক শাড়ি! পরা লাগবে না কিছু হুহ!
ফের দু মিনিট আবারো শাড়ি তার হাতের মুঠোয়। এবার সমস্ত মনোযোগ ওদিকে। ইশ, এতো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে স্যারের কাছে আর মা/র খেতে হতো না। তখন যে মনোযোগ সব থাকে কোথায়? বুঝে উঠতে পারে না। তার ফর্সা শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান কোমরের অংশ ফুটে উঠেছে লাল রঙের ব্লাউজ আর পেটিকোট এ। কে বলে? মোটা মেয়েদের শাড়িতে মানায় না। অর্নিলা কে তো বেশ মানায়। সেদিন প্রথমবার পরেই সে বুঝে গেছে। মামনী কতো আদর করে বলল, ”আমার অনিকে ভারী মিষ্টি লাগছে! ওই তো, হ্যাঁ বিয়ের দিন। কাজল লেপ্টে দিল কানের লতিতে। কারো নজর না লেগে যায় বুঝি!” একাকী হেসে উঠল অর্নিলা। এবার সে শাড়ি পরেই ফেলব। তাকে পরতেই হবে!
শিকদার বাড়ি বাইরে থেকে যেমন আগের যুগের ভেতরেও তাই। এই ঘরের পুরোনো দরজা এখন আর আগের মতো সুরক্ষিত নেই। খুব সহজেই সেই দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলা যায়। বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অর্নিলা যখন শাড়ির প্যাচ বুঝতে ব্যস্ত ঠিক তখনি দরজার আড়াল থেকে উঁকি মারছিলো ব/খাটে নিয়াজ। চরিত্র/হীনের সাথে সাথে লজ্জা শরম ও লোপ পেয়েছে তার। অর্নিলা উল/ঙ্গ কোমর, উদাম পিঠের অংশ নজর কেড়ে নিচ্ছিল তার। মা/তাল চোখে, পাগ/লের মতো তাকে দেখছিলো সে। এতোই গভীর ছিল তার মাঝে, বুঝেনি কখন এসে যমরাজ পিছনে এসে আ/স্তানা বাঁধল। হঠাৎ করেই শার্টের কলার চেপে ধরতেই হুঁশ ফিরল তার। ফারাজ তখনো বুঝতে পারেনি কি দেখছিলো নিয়াজ! অজান্তেই দরজা খুলে ফেলল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে শাড়ি হাতে পিছন ফিরল অর্নিলাও। হতভম্ব সে। শাড়ি তখনো তার হাতের মাঝে। অর্নিলা এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে ফারাজ নিজেও শরম পেয়ে গেল। দ্রুতই দরজা বন্ধ করে দিল সে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হলো বুঝতে সময় লাগল অর্নিলার। একের পর এক কাণ্ড। বুঝতে পারার পরপরই কোনমতে শাড়ি পেঁচিয়ে নিল শরীরে। দরজার কাছে আসতেই
তট/স্থ সে। শরীর জমে গেছে তার। নিয়াজ ভাইয়ের কান্নার আওয়াজ। তার সাথে ফারাজ ভাইয়ের কঠোর স্বর, ”আমার বউয়ের দিকে নজর দিবি তুই? আমার বউয়ের দিকে। আজ তো তোকে আমি মে/রেই ফেলব!“
শরীর ঝনঝন করে উঠল অর্নিলা। দরজা খুলে বাইরে কি হচ্ছে দেখার সাহস হলো না তার। এক জায়গায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। ধস্তা/ধস্তির শব্দ! হুল/স্থুল একটা কাণ্ড বেঁধে গেছে। দরজার আড়াল দিয়ে উঁকি মারল অর্নিলা। তার দম/বন্ধ হবার জোগাড়! ফারাজ ভাইয়ের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। ঘেমে একাকার সে। শার্টের কয়েকটা বোতাম খোলা । তারেক ভাই কোনভাবেই ফারাজ ভাইকে আঁটকে রাখতে পারছে না। হিং/স্র বাঘ যেন শিকা/রকে হাতছাড়া করতে চাইছে না। অর্নিলা শুকনো ঢোক গিলল। তার গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেল। শরীর শিউরে উঠল। বাক/রুদ্ধ সে! ফারাজ ভাইকে রাগতে দেখেছে, কিন্তু রেগে মা/রতে কখনো দেখেনি। বরাবরই ভাই রেগে গেলে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত, কিংবা দু একটা ধ/মক দিত। এমনকি আরাফাতের সাথেও তাকে মারা/মারি করতে দেখেনি। সেই ভাই আজ এতোটা রে/গে আছে!
রাগে ফুঁস/ছে সারফারাজ। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। তারেক পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে। হাতে বেল্ট এখনো শক্ত হাতে। আরেকদফা মার/তে পারলে যেন শান্তি মিলত। কতোটা সাহস! তার বউয়ের দিকে বাজে নজর দিচ্ছে, তার ঘরে লুকিয়ে উঁকি মার/ছে। জঘন্য! বলতেও লজ্জা লাগছে তার। তারেক ছেড়ে দিল ফারাজ কে। তবুও নড়ছে না। মনে হচ্ছে ফারাজ দ্বিতীয় দফায় আবার শুরু করবে। হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দরজার দিকে তাকাল।
হকচকিয়ে গেল অর্নিলা। মনে হলো ফারাজ ভাই তাকেই দেখছে। চমকে উঠল সে। ফারাজ ভাই তো এদিকেই এগিয়ে আসছে। পিছিয়ে গেল দু পা। ধপ করে দরজা খুলে ফারাজ ভাই শক্ত করে তার বাহু চেপে ধরল। কেঁপে উঠল অর্নিলা। এমনটা আগে কখনো হয়নি। দ্রুত ঘরের বাইরে এসে পড়ল। বিধ্ব/স্ত অবস্থায় নিয়াজ পড়ে আছে চাচার কোলে। চাচা যেন রাগে চুপ/সে গেছে। সায়মা ভাবী দূরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনাটা সে নিতে পারছে না। তাদের বাড়িতে এসে তাদের ঘরেই তার দেওর কে এভাবে মা/রল। নিয়াজের চোখ ফুলে উঠেছে। গাল
কে/টে রক্ত পড়ছে। ঠোঁটের কাছেও কা/টা। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। আধো আধো চোখে তাকাল ফারাজের দিকে। ফারাজ তার দিকে তাকিয়েই আঙুল তুলে বলে উঠল, ”এরপর আমার বউয়ের দিকে তাকালে তোর চোখ তুলে ফেল/ব, মনে রাখিস!” কথাটা বলা অবধিই। আর এক বিন্দু এখানে থাকবে না। বেল্ট ছুঁড়ে মার/ল মেঝের দিকে। অর্নিলার হাত চেপে বেরিয়ে এলো শিকদার বাড়ি থেকে। অর্নিলা চুপচাপ চলে এলো। কোন শব্দ করল না, মুখ ফুটে একটা কথাও বের হলো না। এই প্রথম ফারাজ ভাই কে তার এতো ভ/য় লাগছে।
গাড়িতে এসে বসল তারা। গাড়ির ড্রাইভার হম্ভি/তম্ভি করে ছুটে এলো। দূরে কোথাও বুঝি চা খাচ্ছিল। সারফারাজ মৃদুস্বরে বলল, “বাসায় চলো!” ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করল। গাড়ির এককোণে ফারাজ ভাই আর অন্য কোনো অর্নিলা। কোনমতে পেঁচানো শাড়ি পরেই এসেছে সে। এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মন বলছে, বাসায় যাওয়ার পর ফারাজ ভাই তাকেও একধাপ পিটা/বে। যা হয়েছে সব এই শাড়ির জন্য। মানা করেছিলো তো শাড়ি পরতে, কেন যে পাগলামি করে পরতে গেল। প্রাণ আসে আর যায়। কান্না চেপে রাখতে পারল না সে। ফিরে তাকাল ফারাজ ভাইয়ের দিকে। রক্ত/বর্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়া এদিকেই চেয়ে আছে। প্রথমবারের মতো অর্নিলা নিশ্চুপ হয়ে কাঁদতে লাগল। এই প্রথমবার সে নিশ্চুপে কান্না শিখল।
.
শিকদার বাড়ির হাল মোটেও ভালো না। গরম পরিবেশ এখনো গরম, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাদের বাড়ির কাজের লোকের সংখ্যা নেহাত কম না, নিয়াজ যে সবার সামনে সারফারাজের সামনে মা/র খেলো এটা সবাই দেখেছে। কানাঘুষা ও চলছে। ডাক্তার কে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। নিয়াজের চোখ, গাল, ঠোঁটে মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। গায়ের শার্ট খুলতে দেখা গেল পিঠে দা/গ বসে গেছে। শুধু দাগ তাই না, একদম পূর্ণ বেল্টের ছা/প। মাপ দিলেও এক ইঞ্চি মিস হবে না। একটা জানো/য়ার কে এভাবে মারে না, যেভাবে তার ছেলেকে মেরে/ছে। এর প্রতি/শোধ সে না নিয়ে থাকবে? অবশ্যই নিবে! তার নাম ইয়াতিম শিকদার। এতো সহজে ছেড়ে দিবে না। কখনোই না!
আরিফ হাসান বাসায় ছিলেন না। শাহিনুর বেগম ও বিকালের দিকে একটু বের হয়েছেন। আরাফাত সবে বাইর থেকে এসে সোফায় বসল। টিভি ছাড়ার উদ্দেশ্য রিমোট খুঁজতে লাগল। এর মধ্যে দেখল হঠাৎ সিধু ছোটাছুটি করছে। সিধু তাদের বাসায় কাজ করে। বাজার করা থেকে শুরু করে বাগানে পানি দেওয়া, গাড়ি ধোঁয়া অনেক কাজই এই ছেলে একা করে। কাজের ছেলে একটা। সিধু ছুটে এসে বলল, “বড় ভাই আইছে!”
”বড় ভাই মানে? ফারাজ ভাই! তারা না দাওয়াতে গেল দুদিন থাকার কথা। এতো দু ঘণ্টার মধ্যে ফেরত এসে গেল!“
বলতে বলতে দেখল ফারাজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আরাফাত ঘাবড়ে গেল। ভাই কে দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ চ/টে গেছে। তার ভাইয়ের রা/গ যতোই থাকুক, তা কন্ট্রোল করার ধৈয্য আছে। আজ তো মনে হচ্ছে সব ধৈর্য্যের বাইরে। অর্নিলা কে হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা ঘরে ঢুকল সারফারাজ। আরাফাত রীতিমতো চমকে উঠল। কিছু বলার জন্য এগিয়ে যাবার আগেই ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিল। সিধু ভর্য়া/ত কণ্ঠে বলল, “বড়ভাই তো খুব রাইগা গেছে!”
“সিধু, আমার ফোন দেখো সোফার উপরে। এখুনি দাও। মা কে ফোন করতে হবে। ভাইয়া খুব রে/গে গেছে!“
অর্নিলা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ফারাজ ভাই। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রাগ কমে, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে ফারাজ ভাইয়ের রাগ বে/ড়ে যাচ্ছে। শক্ত গলায় ফারাজ ভাই বলে উঠল, ”তোকে না বলছিলাম, শাড়ি পড়ার দরকার নাই। তাও কেন শাড়ি পড়তে গেলি তুই?”
ফারাজ ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো অর্নিলা। সারফারাজ এক থ/মক দিতেই আবার চুপসে গেল।
“চুপ! একদম চুপ; ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবি না আমার সামনে। এই ঢং গিয়ে আমার বাবার সামনে কর আমার সামনে না।”
অর্নিলা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল, ”ফারাজ ভাই আমি তো..
“কি আমি হ্যাঁ! কি আমি! দরজা বন্ধ করতে জানিস না!”
“আমি তো দরজা বন্ধ করছিলাম ফারাজ ভাই কিন্তু কেমনে যে খুলে গেল….
“চুপ; একদম চুপ! মুখে মুখে আরেকবার তর্ক করলে না?.. বলেই হাত উঠালো সে। অর্নিলা ভ/য়ে চোখ বন্ধ মুখ সরিয়ে নিল। হাত মুঠোয় নিল শাড়িটা। সারফারাজ বহু কষ্টে নিজেকে থামাল। না! এটা পুরুষত্ব না! বউয়ের গা/য়ে হা/ত তুললেই নিজেকে পুরুষত্ব জাহির করা যায় না। ধপ করে পর পর দুটো আওয়াজ হলো। ভ/য়ে চোখ মেলে তাকাল না অর্নিলা। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখল আয়না ভেঙে/চুড়ে মেঝেতে পড়ে আছে। ভাইয়া ডেসিন টেবিলের আয়না ভেঙে ফেলেছে। দরজা খুলে বাইরেও চলে গেছে। তার এবার ভীষণ ভয় লাগছে। চিৎ/কার করে কেঁদে উঠলো সে। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে কাঁদতে লাগল। বেসামাল হয়ে নিচে কাঁচের টুকরো হাত কে/টে গেল। র/ক্ত পড়ছে গড়িয়ে। কান্নার রেশ আরো বেড়ে গেল। আরাফাত আর শাহিনুর বেগম ছুটে এলেন সারফারাজের ঘরের কাছে। বিধ্ব/স্ত অবস্থায় অর্নিলা কে দেখতে পেয়ে দুজনেই হতভম্ব! শাহিনুর বেগম ছুটে এসে অর্নিলা কে বুকে জড়িয়ে নিল। অর্নিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ”আমি কিছু করি নাই মামনী! আমি কিছু করি নাই!”
#চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/