#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪১
ভিজে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরু। পাশে অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার রিচ্যুয়াল শেষ হতেই অপূর্ব অগ্রসর করল কলতলার দিকে। মল্লিকা বাধা দেয়, “এই অপু, একা যাচ্ছিস তোর বউকে কে নিয়ে যাবে। কোলে করে কলতলায় নিয়ে যা।”
অপূর্ব ফিরে আরুর দিকে তাকাল। প্রতিবেশীদের উপস্থিতির কারণে আরুকে তুলতে লজ্জা অনুভূত হলো তার। মণি রঙ্গ করে বলে, “অপু তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন? শুধু আমাদের সাথে ঠোঁট কাটা হলে চলবে, গ্ৰামবাসীর সামনেও তো হতে হবে না-কি?”
“গ্ৰামবাসী আর তুমি কি এক চাচি? তুমি আমার বয়সী। তোমার সাথে আমি যা করতে পারি, অন্যের সাথে তা করা সম্ভব নয়।” মৃদু কণ্ঠে বলে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল অপূর্ব। আরু তার কাঁধে হাত রাখতেই কলতলায় চলে গেল অপূর্ব। ভেতরে ঢুকে আরুকে নামিয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিল। ভেজা সেন্ট গেঞ্জি খুলে টিউবওয়েলের হাতলে রেখে বলে, “ফটাফট কল চেপে পানি তোল, গোসল করে বের হতে হবে।”
“পারব না।” কঠোর ভাবে বলে টিউবওয়েলের হাতল উপরে তুলে। প্রথমবার আরুর এমন ভঙ্গিমা দেখে অপূর্ব হতভাগ না হয়ে পারল না। অথচ কখনো অপূর্বর মুখে মুখে তর্ক করে না আরু। অপূর্ব চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “কী বললি তুই? আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস কোথায় পেলি? এদিকে আয়।”
“আসব না। পারব না। আজ আপনি পানি তুলে আমাকে দিবেন, গোসল করতে। না-হলে এখন আমি মাথার কাপড় ফেলে এই ভেজা অবস্থায় চলে যাবো। এবার আপনার মত?” বুকে হাত গুজে বলে আরু। অপূর্ব বুঝতে পারে, তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে প্রথমবার নিজে টিউবওয়েল চেপে পানি তুলে আরুর গোসলের জন্য। অপূর্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বলছে, ‘তোর খবর আছে আরু।’
__
সূর্য আজকাল সময়ের আগে মেঘের আড়ালে তলিয়ে যায়। বর্ষাকালে সূর্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দিলেও বর্ষার কারণে গরম অনুভূত হয় না। আরু একা বারান্দায় গিয়ে বসে বৃষ্টি উপভোগ করছে। তাদের উঠান জুড়ে একাধারে নৃত্য পরিবেশন করছে বৃষ্টি। হঠাৎ কল এলো অপূর্বর ফোনে। অপূর্ব ফোন রেখে হাঁটতে গেছে। ফোনটা রিসিভ করে সালাম বিনিময় করতেই ওপাশ থেকে ইমদাদ হোসেন বলে, “আরু, অপূর্ব কোথায়? তোরা কখন আসবি? আমি কি গাড়ি নিয়ে আসব?”
“না বাবা, আসতে হবে না। উনি বাড়িতে নেই, ফিরলে আমি তাকে নিয়ে চলে আসব।”
“আচ্ছা। তুই আর অপূর্ব একা আসিস না। সবাইকে নিয়ে আসিস।”
“আচ্ছা। রাখি।” তারপরে কল রেখে আরু নিচে গেল। বৃষ্টির মাঝে সবাই ক্যাসেট দিয়ে ভূতের সিনেমা দেখছে। অপূর্ব ফিরে নিজেও যোগ দিয়েছে সবার সাথে। তুর ও শেফালী ওড়না মাথায় দিয়ে রেখেছে ভয়ে, কখনোবা আংশিক মাথা বের করছে। সুমি তৎক্ষণাৎ চা নিয়ে হাজির হলো। আরু এগিয়ে সুমির হাত থেকে ট্রে নিয়ে সবাইকে চা পরিবেশন করতে থাকে। সবাইকে দিয়ে এক পর্যায়ে অপূর্বর হাতে চা দিয়ে বলে, “বাবা ফোন দিয়েছিল, আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। কখন যাবেন?”
“আমি গেলেও থাকতে পারব না। কাল থেকে আমার চেম্বার খোলা। তুমি যেতে চাইলে দিয়ে আসব।” চা নিয়ে চুমুক বসায় অপূর্ব। অনিতা লক্ষ্য করে এগিয়ে এসে বলে, “কী হয়েছে আরু, মুখ কালো করে আছিস কেন?”
“মামি, ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাবা ফোন করেছিল। কিন্তু উনি বলছে, তার সময় নেই। আমাকে একা থাকতে।”
“ও কী কথা! এখন সময় না-থাকলে কবে সময় হবে? নতুন বিয়ে করেছিস শ্বশুর বাড়িতে যাবি, হানিমুনে যাবি। ছুটি নেই মানে কী?” তীক্ষ্ণ গলায় অনিতা বলে। অপূর্ব বৈঠকখানা ত্যাগ করে দোতলায় চলে গেল। তার মাথায় এখন প্রচণ্ড উত্তেজনা। দু-দিন পরপর ছুটি নেওয়ার কারণে কথা শুনতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আরু মন খারাপ নিয়ে সোফায় বসতেই ইমদাদ ছাতা মাথায় নিয়ে হাজির হয় আহসান বাড়িতে। তক্তার সাথে ঝুলিয়ে আরুকে রাগ দেখিয়ে বলে, “তোদের জন্য কত অপেক্ষা করব, কখন যাবি? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চল, তোর মা অপেক্ষা করছে।”
অনিতা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে, “আরু বেয়াইকে চা দাও।”
বেয়াই সম্বোধন শুনে প্রসন্ন হলেন ইমদাদ। খোশগল্পে মেতে উঠলেন বেয়াইয়ের সাথে। আরু বাবাকে চা দিয়ে উপরে গেল। অপূর্ব মনযোগী হয়ে কাগজে কিছু লিখছে। আরু আঁচলটা কোমরে গুঁজে বারান্দায় থাকা ময়না পাখিদের খাবার দিল। অতঃপর শব্দ করে ট্রাভেলিং ব্যাগ বিছানায় রাখে। গোছানো জামাকাপড়গুলো ছুড়ে ফেললে এলোমেলো হয়ে গেল তা। শব্দে বিরক্ত হয়ে অপূর্ব এক নজর তাকাল আরুর দিকে। চণ্ডাবতী রূপ দেখে অপূর্ব খাতা কলম পাশে রেখে পেছন থেকে আরুকে জড়িয়ে ধরে। অপূর্বকে ছাড়াতে ছাড়াতে আরু উড়ণচণ্ডী হয়ে বলে, “আদিখ্যেতা করছেন কেন? আমাকে একদম ধরবেন না।”
“চণ্ডী রূপে পুড়ে ছাই হওয়ার আগে তাকে থামানো উত্তম। (পরপর বলে) এত রেগে আছে কেন ময়না পাখিটা?” জড়িয়ে ধরেই বলে।
“একদম ময়না পাখি বলবেন না, বাবা নিতে এসেছে। আপনার খোঁজ করছে, তাকে গিয়ে বোঝান আপনি যাবেন না। বিয়ের আগে বউকে চোখে হারায়, বিয়ের পর কর্পূরের মতো উড়ে গেছে প্রেম।” অভিমানী শোনাল আরুর গলা। অপূর্ব তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ললাটে এঁকে দিল ভালোবাসার পরশ। চরম আদুরে গলায় বলে, “তুমি কি চাও তোমার স্বামীকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিক। প্রতিদিন মানুষ ফি দিয়ে অ্যাপয়েন্টম্যান্ট করে রাখে। কিন্তু আমার সাথে দেখা করতে পারে না। চিকিৎসক হিসেবে আমার উচিত ওদের রোগ সম্পর্কে জেনে বিস্তারিত পরামর্শ দেওয়া। আজকে তুমি যাও, আগামী বৃহস্পতিবার আমি যাবো। শুক্রবার থেকে শনিবার তোমাকে নিয়ে চলে আসব। আমার জন্য তুমি বাবা মাকে দেখতে পাবে না, এটা আমার ভালো লাগবে না। তাই প্রথম ও শেষবারের মতো আমি তোমাকে একা ঐ বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিলাম।”
আরুর রাগ নেমে এলো শূণ্যতায়। পরক্ষণে অপূর্বর কাছে তা হুরহুর করে বেড়ে গেল। একটা প্যাকেট আরুর হাতে দিয়ে বলে, “এটা রাখো!”
“কী এটা?”
“সামনে তোমার পরীক্ষা। আমি চাই না এখন নতুন কেউ আসুক।” অপূর্বর ইঙ্গিত বুঝতে সমস্যা হলো না আরুর। মুখ ফুটে বলার আগে নিচ থেকে অপূর্বর ডাক পড়ল। ইমদাদ হোসেনের ডাকে সাড়া দিতে অপূর্ব নিচে চলে গেল। রাগে হাতের প্যাকেটটা মুঠো করে ফেলে দিল খাটের নিচে। অতঃপর আবার জামা কাপড় গোছাতে ব্যস্ত হলো। গোছানো শেষে আরু ব্যাগ সমেত নিচে নামল। অপূর্ব ইতোমধ্যে বুঝিয়েছে ইমদাদ হোসেনকে। তাই জামাতা ছাড়াই মেয়েকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল মৃধা বাড়ির দিকে।
বাড়িতে একা আরুকে দেখে অপূর্বর খোঁজ করল পারুল। প্রথমবার জোড়া নায়র শ্বশুর বাড়িতে না এসে একা মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করল কেউ। আরু রাগ দেখিয়ে বলে, “আমাকে কেন এত কথা জিজ্ঞেস করছ, তোমার ভাইপো কোথায়? ওকে জিজ্ঞেস করো। আমার থেকেও তোমার ভাইপোকে বেশি বিশ্বাস করো।”
তারপরে নিজের ঘরে চলে গেল আরু। পাঁচ বান্ধুবীকে এভাবে ফুল দিয়ে ঘর সাজাতে দেখে বুঝতে বাকি রইল না, তারাও অপূর্বর জন অপেক্ষারত। আরুকে দেখে উত্তেজিত হয়ে মিতু বলে, “দুলাভাই কোথায়, তোদের জন্য কেমন ঘর সাজিয়েছি বল।”
প্রসন্ন না হয়ে অপ্রসন্ন হলো আরু। রেগে ফুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলল। আঙুল তুলে বলে, “আমি তোদের ঘর সাজাতে বলেছি? সাজিয়েছিস কেন? আর কখনো আমাকে জিজ্ঞেস না করে আমার ঘরে আসবি না। বের হ।”
ওরা আরুর রাগ দেখে বিলম্বে জিনিসপত্র নিয়ে ত্যাগ করল ঘর। আনমনে অপূর্বকে নিন্দা করে খাবার না-খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল আরু।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/