নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৪২

0
333

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪২

চালের উপর বৃষ্টির ধারা নৃত্য পরিবেশন করছে। রাস্তার দুই ধারে থাকা কদম গাছে কদম ফুল ফুটেছে। সেই গাছে আশ্রয় নিয়েছে নাম না-জানা বহু প্রজাতির পাখি। ঠান্ডা আবহাওয়ায় কোল বালিশ জড়িয়ে আরু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর পাঁচটা দিনের মতো আজকে রাতটা কাঁটছে তার। মৃধার বাড়ির লোকেরা শত ডেকেও আরুকে বিছানা থেকে উঠাতে পারেনি। বিনিময়ে শুনতে হয়েছে আরুর বাজখাঁই গলা।
মধ্যরাতে পেছনের ঘরে প্রবেশ‌ করে কেউ। কদম ফুলের গুচ্ছ টেবিলের উপর রেখে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় উঠে। কোল বালিশ থেকে আরুকে ছাড়িয়ে টেনে নেয় হৃদমাঝারে। রাতের অন্ধকার পেরিয়ে আলোর সূচনা হলেও বৃষ্টির বিরতি দেওয়ার নাম নেই। তারা নিজের কাজে ব্যস্ত। মোরগ ডেকে সবাইকে সকালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে মোরগ নিজে ঠাওর করতে পারেনি ভোরকে। লম্বা চুলগুলো হাত খোঁপা করে উঠে বসল আরু। অনুভব করল পাশ থেকে জড়িয়ে রাখা একটা হাত তার শাড়ি ভেদ করে নগ্ন পেট স্পর্শ করছে। চকিতে পাশে ফিরতেই মিলল অপূর্বর মুখশ্রী। গতকাল রাতে এই বিছানায় একা ঘুমিয়েছিল, অপূর্ব এলো কীভাবে? রাতে প্রখর বাদল ছিল। সেই সময়ে অপূর্বর আসা অসম্ভব। চাপা অভিমান নিয়ে অপূর্বকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নামল আরু। নজরে এলো একগুচ্ছ কদম। দৃষ্টিতে সরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। পেছনের দরজা খুলে মাটির সিঁড়িতে দাঁড়াতেই দেখল, রসুইঘর থেকে ধোঁয়া উড়ছে‌। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রসুইঘরে ঢুকে। নয়না পারুলকে দেখে হেসে বলে, “তুই উঠেছিস, ভালো করেছিস। জামাইকে তুলে মুখ ধুতে বল। নিজেও মুখ ধুয়ে পিঠাগুলো দিয়ে আয়।”

“জামাইকে যদি এত খাওয়ানোর শখ তাহলে নিজে গিয়ে দিয়ে আসুন। আমি পিঠা দিয়ে আসতে পারব না। কালকে তো বড় মুখ করে বলেছিল, ‘কাজ আছে, বৃহস্পতিবার ছাড়া যেতে পারব না।’ রাতে চোরের মতো কেন এসেছে‌? বের করে দিতে পারলে না?” বলতে বলতে নিমগাছের ডাল ফেলে দাঁত মাজতে থাকে আরু। পারুল চোখ রাঙিয়ে বলে, “বিয়ে হয়ে গেছে, এবার গলার স্বর ছোটো কর। জামাই ঘরে, তোর কথা শুনলে কী ভাববে!”

“আরু তুই মুখ ধুয়ে অপূর্বকে জাগা।” নয়না বলে। তখনই বাড়ির ভেতরে ঢুকে আসে‌ পাঁচ যুবতি। বৃষ্টি খরা দিয়েছে। সাথী বলে, “ভাইয়া কখন এসেছে চাচি?”

“মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজে মিষ্টি, পান, বিস্কুট নিয়ে এসেছে। রাতের বৃষ্টি, জ্বর না আসলেই হয়। এতরাতে আসার কী দরকার ছিল, সকালে আসতে পারত।” হাত নাড়িয়ে বলে অনিতা। অতঃপর তন্বী বলে, “আরুকে কষ্ট করে যেতে হবে না, আমরা যাচ্ছি। গতকাল রাতে ভাই আসেনি বলে, কী রেগে ছিল! কত কষ্ট করে বিছানা সাজালাম, সবকিছু নষ্ট করে ফেলল।”

তৎক্ষণাৎ অপূর্ব চলে এলো বাইরে। পরনে তার ঢিলেঢালা একটা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। এই পোশাকটা আরু চেনে, ইমদাদ হোসেন মৃধার। আরু প্রায়ই ধুয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিল অপূর্বকে দেখে। অপূর্ব কাশতে কাশতে আরুর কাছে গেল। গাছ থেকে ডাল ভেঙে বলে, “আমাকে আর কষ্ট করে ডাকতে যেতে হবে না, আমি চলে এসেছি। তবে তোমাদের একটু কষ্ট করতে হবে। টিউবওয়েল চেপে পানি তুলে দিতে হবে মুখ ধোয়ার জন্য।”

“অবশ্যই দুলাভাই। প্রয়োজনে আপনার গোসলের পানিও তুলে দিবো।” মিতুর কথায় আরু ফিক করে হেসে ফেলল। নিমের ডাল ফেলে দিয়ে দিঘির দিকে যেতে যেতে অকপটে বলে, “নিমগাছের ডালে হবে না, বাকল লাগবে। শুধু মুখ না ধুইয়ে পাঁচজনে মিলে গা ধুইয়ে দে। পারলে মুখের ভেতরে হাত দিয়ে অন্তরটাও ঘষে দিস। তোদের দুলাভাইয়ের মুখে এক, অন্তরে আরেক। অন্তরটা পরিষ্কার থাকলে এক কথা বিরাজ করবে।”

“আরু, জামাইকে কী বলছিস এগুলো! নিজের কাজে যা।” পারুল থমথমে গলায় বলে। আরু চলে গেল দিঘির পাড়ে। দিঘির দিকে ইঙ্গিত করে অপূর্ব বলে, “সুন্দরী মেয়ে কিংবা আত্মীয়র ভেতরে বিয়ে করো না, বউয়ের থেকে সম্মান পাবে না।”
__
মাটিতে হোগলা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপূর্ব জোতা খুলে বস। বিভিন্ন ধরনের পিঠা ইতোমধ্যে অপূর্বর সামনে সাজিয়ে রেখেছে পারুল। আরু হাতপাখা নিয়ে বসে আছে। ঠান্ডা বলে হাওয়া করতে হচ্ছে না অপূর্বকে। অপূর্ব জামাই পিঠা ভেঙে মুখে দিয়ে বলে, “মা, এত আমি খেতে পারব না। আপনারা সবাই বসুন। একসাথে খাবার খাই।”

“না, তুই আমাদের জামাই। প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসেছিস। তোর খাওয়া শেষ হলে আমরা খাবো।” পারুল গ্লাসে পানি ঢেলে বলে। বিপরীতে অপূর্ব বলে, “আমি তো অহরহ এসেছি। আজ প্রথম নয়।”

“এতদিন এসেছিস ফুফুর বাড়ি হিসেবে, আজ এসেছিস জামাই হিসেবে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।” পারুল থামতেই অপূর্ব খাওয়া শুরু করে। আরু মনে মনে ছক করে বলে, “প্রথমবার শাশুড়ির হাতের তৈরি পিঠা খাচ্ছে জামাই। স্মরণীয় করে রাখতে হবে। উনি আবার লজ্জা পায়, তোরা একটু খাওয়া।”

আরু উঠে যেতেই পাঁচ যুবতি বসল হোগলায়। অপূর্বকে কোণঠাসা করে সমস্ত খাওয়া মুখে তুলে দিল। অপূর্ব ফেলতেও পারছে না। ঠেসে ঠেসে সব খাবার শেষ করে ঢেকুর তুলে ঘরে চলে গেল। ঠিকভাবে হাঁটাচলাও করতে পারছে না। পেটে হাত দিয়ে রেখেছে। পারুল জামাইয়ের পক্ষ নিয়ে বলে, “তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি, জামাইকে জোর করে খাওয়ালি। যদি বদহজম হয়। আমি জিরা দিয়ে স্পেশাল একটা টোটকা বানিয়ে দিচ্ছে। অপুকে খাওয়া।”

তারপরে রসুইঘরে গিয়ে পারুল অপূর্বর জন্য এক গ্লাস ঔষধ তৈরি করে নিয়ে এলো। পারুল দিতেই আরু ছুটে গেল ঘরে। অপূর্ব উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। অপূর্বকে দেখে মায়া লাগল আরুর‌। এভাবে শাস্তি না দিলেও পারত‌। প্রথমবার জামাই শ্বশুর বাড়িতে এসে ঘরে-বাইরে যাচ্ছে। ব্যাপারটা যদি ঘটে এবং জানাজানি হয়। খুব খারাপ হবে‌। অপূর্বর মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “মা, এটা পাঠিয়েছে। ধীরে ধীরে খেয়ে চোখ বন্ধ করে রাখুন।”

“তোর তো খুব ভালো লাগছে আমাকে এই অবস্থায় দেখে। নাচতে ইচ্ছে করছে। খাবো না আমি।” অপূর্ব শুয়ে থেকেই বলে। আরুর কষ্ট হয়। একটু চাপা অভিমান নিয়ে বলে, “আমি কখনো আপনার ক্ষতি চাইনা। একটু রেগে ছিলাম জাস্ট। এটা খান।”

অপূর্ব উঠে বসে ঠিকই, তবে গ্লাসটা কেড়ে টেবিলের উপর রেখে দিল। আরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে বলে, “মা বোধহয় আমাকে মিষ্টি দিতে ভুলে গেছে। কালরাতে এত মিষ্টি নিয়ে এলাম, একটিও পেলাম না।”

“আপনি এই ভরা পেট নিয়ে আবার মিষ্টি খেতে চাইছেন? এবার পেট ফেটে যাবে নির্ঘাত।”

“তবুও মায়ের মিষ্টি দেওয়া উচিত ছিল।”

“আপনি মিষ্টি খাবেন? আমি নিয়ে আসছি।”

“না, এখন আর খাবো না। মা ভুল করে মিষ্টি দেয়নি, তার মেয়ে হিসেবে তোর উচিত তার ভুল শুধরানোর। কাছে আয় আরু, আমাকে মিষ্টি মুখ করা।” বলে অপূর্ব মাথা এগোলে আরুর দিকে। আরুর অধরে অপূর্বর স্পর্শ পৌঁছাতেই ছটফট করে উঠে আরু। অপূর্বকে ফেলে ত্যাগ করে কক্ষ‌। অপূর্বর মনে পড়ে গতরাতের কথা। দোতলায় বসে কাজ করছিল অপূর্ব। রাত করে বাড়িতে ফেরে মোতাহার আহসান। দোতলায় আলো জ্বলতে দেখে সংশয় নিয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করে, “দোতলায় আলো জ্বালিয়ে রেখেছ কেন? এই গ্ৰামে বিদ্যুৎ কেবল আমার একার ঘরেই আছে। এত অপচয় কেন করছ?”

“অপূর্ব আছে দোতলায়।” অনিতা বাক্য তোলে।

“কেন? আরুর সাথে জোড়া নায়র যায়নি?”

“ওর কীসব কাজ আছে, তাই আরু একা গেছে।”

“অপূর্ব নিজেকে কী মনে করেছে? ওর যদি এতই ব্যস্ততা তাহলে এখন কেন বিয়ে করল? কালকে বিয়ে করেছে আর আজকেই ও এত ব্যস্ত হয়েছে যে, জোড়া নায়র যেতে পারেনি। ফুফু বাড়ির আবদার? অপূর্বর জন্য ঐ বাড়ির লোকদের কথা শোনাতে ছাড়বে পাড়া প্রতিবেশীরা? ফুফু বাড়ি তো শ্বশুর বাড়ি, তাই গুরুত্ব দিচ্ছে না। ওকে ঘুমাতে বারণ করে দাও, আমি খেয়ে ওর সাথে কথা বলল।” কথাটা বলে মোতাহার আহসান খাবার ঘরে গেলেন। অনিতা দ্রুত কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠে গেলেন। অপূর্বকে স্বামীর কথাটা জানাতেই তড়িগড়ি করে তৈরি হয়ে নিল। অনিতা ঘরে থাকা মিষ্টি, পান, বিস্কুট অপূর্বর হাতে ধরিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দিলেন। বৃষ্টি তখন ঝুম দিয়ে পড়ছে‌। অনিতা ঘরে গিয়ে অপূর্বর জন্য ছাতা নিয়ে এলেন। কিন্তু অপূর্ব দম না দিয়ে ভিজে চলে গেল। সেখানে গিয়ে নিজের পোশাক ছেড়ে ইমদাদ হোসেনের পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরিধান করে নিয়েছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here