#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৮
এক দিকে নদী অন্য দিকে সারিবদ্ধ গাছ। গাছের পর বিশাল বিশাল ধানখেত। তার অধিকাংশ ধান কে/টে ঘরে তোলা হয়েছে। অবশিষ্ট কুটো কে/টে ফেলা রাখা হয়েছে খেতে। সবকিছু অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে ছাদ খোলা গাড়ি। ইতোমধ্যে মাগরিবের আজানে মুখরিত চারপাশ। আরু উঁকি দিয়ে আনন্দনগর দেখার চেষ্টা করছে। অপূর্ব আরুর মাথাটা ভেতরে টেনে থমথমে গলায় বলে, “সমস্যা কী? বাইরে মাথা বের করছিস কেন? অতিরিক্ত ঠান্ডায় কুয়াশা হিমাঙ্কের নিচে নেমে তুষারের মতো পড়ছে। এমনিতেই আমরা লঞ্চে করে এসেছি। এখন তুই এমন পা/গ/লা/মি করলে ঠান্ডার লাগবে।”
“লাগবে না ঠান্ডা। দেখুন, কী সুন্দর! হালকা হালকা তুষার পড়ছে। মনে হচ্ছে আমি অ্যান্টার্টিকা মহাদেশে আছি।”
“অ্যান্টার্টিকা মহাদেশে থাকে পেঙ্গুইন, সেখানে মানুষ থাকতে পারে না। তুই কি মানুষ না? পেঙ্গুইন? তোর পেটে মানুষ পাখি না-কি পেঙ্গুইন পাখি।” অপূর্ব বিস্মিত হয়ে বলে। উপস্থিত সবাই হাসল। জানা সত্ত্বেও অজানার ভান ধনে প্রয়াস বলে, “ভাই, আপনি বুঝি বাবা হবেন?”
“হুঁ। আমিও তাই জানি। আমার মতে, এই সময়ে মেয়েদের সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু তোমার ভাবি আমার কথা শোনে না।”
“কচুর ডাক্তার আপনি। ডাক্তার হয়েও আপনি আমার অসুখ বুঝতে পারেননি। আমি যতটা মেধাবী ছাত্রী ,আপনি ততটা মেধাবী ছিলেন না। নির্ঘাত টুকে পাস করেছেন।” ভেংচি কা/ট/ল আরু। অপূর্ব তো মনের ডাক্তার। তার বোঝা উচিত ছিল আরুর মন খা/রা/পের কারণ। এক নিমেষে অন্যের রোগ সারিয়ে দিতে পারলেও বউয়ের কাছে টুকে পাস করা ডাক্তার। ততক্ষণে গাড়ি এসে থেমেছে তার গন্তব্যে। এগারো জন গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে দাঁড়ায় প্রবেশদ্বারের কাছে। ফোন বের করে কর্মচারীর নাম্বারে ডায়াল করল। ঘন কুয়াশায় নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে কল ঢুকল না। তবে কিছুক্ষণের ভেতরে হারিকেন হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো একজন চাদর ঢাকা লোক। পাকা দাড়ি, শ্যাম বর্ণ গায়ের রং, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। অন্যহাতে লাঠি। ঠুকঠুক করে লাঠিতে ভর দিয়ে বলে, “তোমরা কি আহসান বাড়ির লোক, মির্জা বাড়িতে এসেছ?”
“জি। আপনি ইলিয়াস আলী?”
“জি। ভেতরে আসুন। পরিত্যক্ত মির্জা বাড়িতে আপনাদের স্বাগতম। অনেকদিন পর এই বাড়ি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠল। ভেতরে আসুন সকলে।” হারিকেনের আলো ধরে সবাইকে ভেতরে নিলেন ইলিয়াস আলী। গা ছমছমে পরিবেশ। ক্ষমতার কারণে মোতাহার আহসান বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারলেও এখানে বিদ্যুৎ নেই। প্রতিটা মেয়ে তার প্রিয়তমর হাত জড়িয়ে ধরে আছে। অপূর্ব খানিক কৌতূহল নিয়ে বলে, “এখানে আলোর ব্যবস্থা নেই? বড় বাড়িতে আমরা এই কয়জন। ভয় করবে রাতে।”
“আলো নেই। হারিকেনের ব্যবস্থা করেছি সবার জন্য। নিচতলা তালাবদ্ধ, আপনাদের থাকার ব্যবস্থা দোতলায় করেছি। আপনারা সবাই ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিন। কাল সকালে আপনাদের গ্ৰাম ঘুরিয়ে দেখাব।”
“আচ্ছা।”
ইলিয়াস আলী বালতি ভরতি করে রেখেছিলেন পানি। সেই পানি দিয়ে সবাই হাতমুখ ধুয়ে পরিপাটি হয়ে নিল। খাবার টেবিলে বসতেই দেখতে পেল গোরুর গোশত ও রুটি। তরকারির রং যেমন, স্বাদও তেমন। তিয়াস খেয়ে বলে, “চাচা, কে রান্না করেছে এই খাবার?”
“আপনাদের ভালো লাগেনি?”
“অসাধারণ হয়েছে। আপনাকে দেখে মনে হয়না, আপনি রেঁধেছেন।”
“আমার স্ত্রী। আপনাদের আসার খবর শুনেই হাট থেকে গোরুর গোশত ও আটা কিনে এনেছি। স্ত্রী রান্না করে দিয়েছে।”
“আপনিও বসুন। আমরা সবাই একসাথে খাই।” সুজনের কথায় তাল মেলাল সবাই। কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয় ইলিয়াস, “আপনাদের চাচি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে না খাইয়ে সে খায় না। তাই বাড়িতে ফিরে একসাথে খাবো।”
বিয়ের এত বছরেও জীবন্ত ভালোবাসা। সবাই হাসে। তাকায় তার সহধর্মিণীর দিকে। অপূর্ব বলে, “তবে আপনি চলে যান। আমরা খেয়ে শুতে যাব।”
“এঁটো থালা-বাসন আমাকে ধুয়ে রেখে যেতে হবে। নাহলে দুর্গন্ধ আসবে।”
“আপনি যান, আমরা এইটুকু করে রাখতে পারব।” অপূর্ব লোকটাকে যাওয়ার অনুরোধ করলেও তিনি নাকচ করে। কিন্তু অপূর্ব যে একরোখা। তাই বেশিক্ষণ জেদ ধরে রাখতে পারে না ইলিয়াস। সবকিছুর দায়িত্ব সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তিস্তা ও সুমি মিলে থালা-বাসন ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলে।
__
ঘড়ির কাঁটা তখন দুইটার ঘরে। দোতলায় ছয়টা ঘরে এগারো জন মানুষ শুয়েছে। সবাই গভীর তন্দ্রায় ব্যস্ত। সবার কিনারের গোপন ঘরটিতে শুয়েছে অপূর্ব, আরু। তার সাথের ঘরটিতে সুজন, তিস্তা। তার পাশের ঘরে তিয়াস ও সুমি। বিপরীত দিকের ঘরে প্রয়াস। দ্বিতীয় ঘরে তুর ও সুন্দরী, শেষের ঘরে কালাচাঁন ও শেফালী। একদম পাশে হওয়ার কারণে ঠান্ডা একটু বেশিই। ভারী ভারী কাঁথায় শীত ঠেকাতে পারছেনা। দুজনের মাঝে তখন পাহাড় সমান দূরত্ব। যার নিচে হাওয়া প্রবেশের ব্যবস্থা করা। কালাচাঁন কাত হয়ে শেফালীর দিকে ফিরে বলে, “এদিকে আসো। ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে। এমন হাওয়া ঢুকতে থাকলে কাঁথা গরম হবেনা, ঘুমও হবে না।”
“নাহলে নেই।”
“লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, এদিকে এসো। নাহলে আমি কাঁথা টেনে নিয়ে যাবো।” কথাটা বলে শেফালীকে কিছু সময় দিল কালাচাঁন। সময়কে সঠিক ব্যবহার করতে পারল না শেফালী। বিনিময়ে এক টানে সবটুকু কাঁথা টেনে নিল কালাচাঁন। খামচে ধরলেও শেষ রক্ষা হলো না। চাপা রোষে শেফালী ওড়না দিয়ে দেহ ঢেকে নিল। ঠকঠক করতে কাঁপতে থাকে অনবরত। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে শীতের তাণ্ডব তত বেড়ে চলেছে। নিরুপায় হয়ে শেফালী উভয়ের দূরত্ব ঘোচাল। কাঁথা ও কথা, উভয় টানতে টানতে বলে, “ছাড়ুন। শীত করছে।”
কালাচাঁন ছাড়ল। শেফালী কেবল কাঁথার ভেতরে ঢুকল না, ঢুকল কালাচাঁনের বাম পাঁজরে। যেন ভেঙে অন্য পাশ দিয়ে চলেও যাবে। কালাচাঁন তার উষ্ণ শরীর দিকে শেফালীর ঠান্ডা শরীর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে হেসে বলে, “তুমি এক লাইন কম বুঝলে হয় না? এই শীতে কাঁথা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। সেখানে তুমি অযথা আমাকে রাগ দেখিয়েছ।”
ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল কালাচাঁন, শেফালী। শোনা গেল নূপুরের শব্দ। ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে শব্দ। আরুর কানে যেতেই নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকাল। ফাঁকা ঢোক গলা বেয়ে নেমে গেল ভয়ে। অপূর্বকে জড়িয়ে রাখা হাতটা বুকের কাছে এনে ধাক্কা দিয়ে বলে, “শুনছেন, কে জানো নূপুর পরে নাচছে। আমার ভয় করছে।”
“কোথায়? আমি তো শুনতে পাচ্ছি না। বোধ হয় তুমি তোমার পায়ের নূপুরের শব্দ শুনতে পারছ, আরুপাখি। আমার বুকে শুয়ে থাকো। কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।”
“ভূত, পেতনি। অপূর্ব ভাই, আপনি শুনতে পারছেন না নূপুরের শব্দ?” আরু ভয়ে অপূর্বকে শক্ত করে ধরে কাঁপছে। অপূর্ব চোখ পরিষ্কার করে তাকাল। চোখে হলদে আলো পড়ার আগে কানে এলো নূপুরের শব্দ। অপূর্ব লক্ষ করল আরু নিশ্চল, অথচ বেজে চলেছে নূপুরের ধ্বনি। এবার অপূর্বর মনে ভয় হানা দিল। দুজনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে থাকল। কানে এলো দরজা ধাক্কা দেওয়ার মতো শব্দ। দরজায় করাঘাত করতে করতে কেউ যেন তিস্তার গলায় বলে, “অপূর্ব ভাই, দরজা খুলুন।”
অপূর্ব সাড়া দিল না। মাঝে মাঝে অন্যের কণ্ঠে কথা বলে তারা। শুনতে পেল তুরের গলা, “ভাইয়া দরজা খুলুন!”
“দরজা খুলুন।” তিয়াসের গলা।
“ম/রে গেলাম গো। দরজা খুলুন।” শেফালী বলে। চারটার বেশি গলা শুনলে অপূর্ব আরুকে নিয়ে উঠে বসে। এক হাতে আরুকে ধরে অন্য হাতে হারিকেন নিল। দরজার ছিটকিনি খুলতেই যুবক-যুবতিরা ঘরের ভেতরে ঢুকে হাঙ্গামা শুরু করে দিল, “চলুন আমরা এখন বাড়িতে ফিরে যাই।”
প্রয়াস বলে, “ভাই আমি পরিত্যক্ত বাড়ি ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন, ভূতের বাড়ি না।”
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/