#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৯ (বর্ধিতাংশ)
অপূর্বকে দেখা যাচ্ছে না নদীতে। অপূর্বর চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে আরু। গতকাল ছিল পূর্ণিমা। পূর্ণিমার লগ্ন এখনো যায়নি। জোয়ারের পানি তট ছুঁইছুঁই। ভাবাবেগ নেই বাকি কারো। আরুও ঝাঁপ দিল নদীতে। চমকাল উপস্থিত সবাই। হাত দুটো ঝাপটাতে ঝাপটাতে পৌঁছে গেল অপূর্বর কাছে। অপূর্ব পানি থেকে মাথা তুলে। আরুকে নিকটে দেখে ভীষণ চমকায়। ললাটে ভাঁজ ফেলে বলে, “তুই এখানে কী করছিস? এই ঠান্ডা পানিতে নেমেছিস কেন? তোর টিউবওয়েলে গোসল করা উচিত ছিল।”
আরুর কাছে পৌঁছাল না শব্দ। উভয়ের মাঝের দূরত্ব শূন্যতায় নামিয়ে দুহাতে গলা ঝাপটে ধরল অপূর্বর। ভর সম্পূর্ণ অপূর্বর দেহে পতিত হওয়ার কারণে তলিয়ে গেল পানিতে। পায়ে ঠেকল কাদামাটি। পানিতে ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়েও শব্দ করতে পারল না অপূর্ব। আরুর মাথায় হাত রেখে ভরসা দিয়ে পিছিয়ে গেল। তটে আসতেই দৃশ্যমান হলো বুক। আদুরে গলায় বলে, “এই বাবুর মা, পানিতে নেমেছিস কেন?”
“আপনি তো সাঁতার জানেন না, পানিতে কেন নামলেন?” আরুর প্রশ্নে প্রশস্ত হলো ললাটে। বোধগম্য হলো এমন আচরণের কারণ। দিঘিতে গোসল করেনা অনেকদিন। টিউবওয়েল চেপেই গোসল করে নিত্যদিন। তাই দৃষ্টিনন্দন হয়নি বিষয়টি। জবাব দেয় প্রশ্নের, “সে-তো আরও আগে শিখেছি। আরও আগে বলতে, আরও আগে। তোকে নদী থেকে উদ্ধার করার পর। সেদিন যদি আমি সাঁতার জানতাম তবে, আমিই তোকে উদ্ধার করতে পারতাম। এখন যেহুতু গ্ৰামে থাকি, তাই সাঁতার জানা জরুরি।”
আরু এক গাল হাসল। ছেলেটা তার জন্য সাঁতার শিখেছে। কালাচাঁন ও সুন্দরী দাঁড়িয়ে ছিল তীরে। ঘুরে আসতে পা ফেলে বলে, “এই ঠান্ডা নদীর পানিতে গোসল করার ইচ্ছে নেই। আমরা বরং ঘুরে আসি।”
আরু ও অপূর্ব সাঁতরে পৌঁছাল পাড়ে। এগিয়ে গেলে ওপরে উঠতে সাহায্য করল তিস্তা। পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “ওকে কেন পানিতে নামতে দিলি?”
“আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরু ঝাঁপ দিয়েছে। কীভাবে আটকাতাম। এই আরু তুই পানিতে কেন ঝাঁপ দিলি?”
“আমি কি জানি অপূর্ব ভাই সাঁতার জানে? তাই ভয়ে ঝাঁপ দিয়েছি।” শীতে কাঁপতে কাঁপতে আরু বলে। বেশিক্ষণ ভেজা অবস্থায় থাকা ঠিক নয়। তাই বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেছে। পুল পেরিয়ে যোগ দিয়েছে কালাচাঁন ও সুন্দরী। অপূর্ব আরুকে আড়াল করে হাঁটতে হাঁটতে তিয়াসকে বলে, “কাকতাড়ুয়া হয়ে এক ঘণ্টা তোকে থাকতে হবে। সময় আমি জানিয়ে দিবো।”
_
লাল রঙের লেপ জড়িয়ে রাজকীয় হয়ে বসে আছে আরু। ঠকঠক করে কাঁপছে শীতে। অপূর্ব দিনদুপুরে হারিকেন জ্বালিয়ে বিছানার ওপরে রেখে বলে, “ছ্যাক দে। ঠান্ডা কমে যাবে।”
লক্ষ করল আরুর মাথার খোঁপা পূর্বের মতোই খোঁপা করা। ভেজার কারণে দলা পাকিয়ে আছে চুল। অপূর্ব খোঁপা খুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে দিতে দিতে বলে, “ভেজা চুলগুলো মুছিস নি কেন? ঠান্ডা লেগে যেতে পারত।”
“আমার চুল কি অন্যদের মতো ছোট যে শুকিয়ে যাবে। আজ সারাদিনেও শুকাবে না।”
“এখানে বসে থাকলে শীত কমবে না। চল একটু হেঁটে আসি।”
লেপ ভাঁজ করে গুছিয়ে আরুর হাত ধরে বের হলো অপূর্ব ও আরু। ঠান্ডায় রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা। একজন বৃদ্ধা উঠান ঝাড়ু দিতে দিতে লক্ষ করে ভিনদেশী যুবক-যুবতিকে। মাথায় কাপড় টেনে মৃদু গলায় বলে, “কারা তোমরা? আগে তো এই গ্ৰামে দেখিনি। কোন বাড়িতে এসেছ?”
উঠান বেশ বড়। একপাশে মাটির উনুন। রান্না করছে মধ্যবয়স্ক এক নারী। তরকারি কাটছে এক যুবতি। আরু ও অপূর্ব রোদ পোহাতে সেই বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বৃদ্ধার প্রশ্নের উত্তর দেয়, “আমরা মির্জা বাড়ির অতিথি।”
“কোন মির্জা বাড়ি? ইস্কান্দার মির্জার পরিত্যক্ত বাড়ি?”
“হ্যাঁ! আমি ইস্কান্দার মির্জার মেয়ে চম্পার নাতি।”
বৃদ্ধ খুশি হলেন ব্যাপক। চোখে ফোটল অশ্রু। ঝাড়ু ফেলে দুটো পিঁড়ি এনে উঠানে দিয়ে বলে, “তোমরা চম্পার নাতি? বসো তোমরা। কেমন আছে চম্পা?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।”
অপূর্বর মনে হলো, এই বৃদ্ধা নিবিড়ভাবে চেনা চম্পাকে। তবুও সৌজন্যস্বরুপ বলে, “আপনি আমার দাদিজানকে চিনেন?”
“তোমার দাদিজান হওয়ার আগে আমি চম্পাকে চিনি। এই পথঘাট সাক্ষী আমাদের সখিত্বের। এই শীতকালে আমরা কয়েকজন সখী মিলে ধানের অবশিষ্ট ছড়া তুলতে যেতাম। ছড়া থেকে চাল বানাতাম। সেই চাল ও হাঁসের ডিম দিয়ে আমরা চড়ুইভাতি খেলতাম।” বৃদ্ধার চোখে দেখতে পেল অতীতের স্মৃতি। বৃদ্ধার নাতনি গেল আমাবলি পিঠা নিয়ে আসতে। থালা ভরতি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করল। আরু পিঠা খেতে খেতে বলে, “আপনার নাম কী দাদি? দাদিজানকে আপনার কথা জানাতে হবে।”
“আমার নাম আফিয়া। চম্পা আমাকে ব্যঙ্গ করে আতি বলে ডাকে। পারলে চম্পাকে একবার গ্ৰামে আসতে বলো, কতদিন দুই সখী গল্প করিনা।”
“আপনি দাদিজানের সাথে কথা বলবেন?”
“হুঁ।”
অপূর্ব বাড়ির ল্যাণ্ডফোনে ডায়াল করল। রিসিভ করল অনিতা। মায়ের খোঁজখবর নিয়ে দাদিজানকে চাইল। চম্পা তখন পান চিবুচ্ছিল। অপূর্বর জরুরি তলবে পান চিবুতে বলে, “কচি বউকে নিয়ে ঘুরতে গেছ, বুড়ো বউয়ের কথা তোর মনেও ছিলনা। এখন কেন কল দিয়েছ? দুই নৌকায় পা দিয়ে চললে হবেনা।”
“ও তো বাচ্চা বউ। আমার যত্ন নিবে কীভাবে? তাই বুড়ো বউকে খুঁজছি।”
“যা পা/গ/ল! কী করছিস তোরা?” পান চিবুতে চিবুতে বলে চম্পা।
“আফিয়া নামের নতুন একটা বউ পেয়েছি। জামাই করতে আদরযত্ন করছে। তুমি কি বলো, বউ কি বানিয়ে ফেলব?”
“আতির কাছে তোরা? কোথায় ও। তোদের সাথে কীভাবে দেখা হলো? ওকে একটু ফোনটা দে। কতদিন হয়েছে ওর সাথে কথা হয়না।” চম্পার উত্তেজিত গলা শুনে অপূর্বর ফোন হাতে দিল আফিয়ার। জোতা খুলে আরু উঠে হাঁটতে থাকল। উঠানের কোনে শিউলি ফুলের গাছ। ঝরা শিউলি ফুল মাটিতে পড়ে সুবাস ছড়াচ্ছে। ঝুঁকে ফুল কুঁড়াতে থাকে আরু। আরুর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শিউলি ফুলের গাছ ধরে ঝাঁকাল অপূর্ব। আলগা ফুলগুলো অমনি আরুর চারদিকে পড়তে থাকল। তড়িঘড়ি করে ওড়না টেনে ফুলগুলো সংগ্রহ করতে লাগল। নীল স্বচ্ছ আকাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা কুয়াশায়। মোহনীয় লাগছে আরুকে। অপূর্বর চোখ আটকাল জিগার গাছে। এক ধরনের আঠা বের হচ্ছে সেই গাছ থেকে। অপূর্ব আরুর ওড়না থেকে শিউলি ফুল নিয়ে দুই পাশ জিগার আঠায় ডুবাল। অতঃপর শিউলি ফুল লাগাল। একের পর এক শিউলি ফুল লাগানোর কারণে তৈরি হলো মালা। আরুর গলায় পরিয়ে দিল। আরু মাথা নিচু করে বলে, “আমার এখানে কিছুই ভালো লাগছে না। সবাইকে মনে পড়ছে। কবে বাড়িতে যাবো?”
“কালকে আরেকবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। উন্নতি হলে ওষুধপত্র নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবো। খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে চন্দন বাড়িয়ার ব্রিজ দেখতে যাবে। সেখানে গেলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে”
কথা বলে দুজনে এগোল বাড়ির দিকে। ততক্ষণে দুই সখীর কথোপকথনের ইতি ঘটেছে। আফিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে অগ্রসর হলো ইলিয়াস আলীর বাড়ির দিকে।
ধানখেতে হোগলা বিছিয়ে খাবার সাজিয়েছে রোদে। গরম ভাতের সাথে উনিশ রকমের ভর্তা। আরুদের সেখানে পৌঁছানোর পূর্বেই সেখানে হাজির বাকিরা। শিউলি ফুলের গন্ধ পৌঁছে গেছে নাকে। কাছাকাছি আসতেই প্রয়াস বলে, “আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন ভাই?”
“শুধু আপনাদের জন্য ক্ষুধা সহ্য করছি। এত রকমের ভর্তার গন্ধে ক্ষুধা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।” তিয়াসের কথায় অপূর্ব ভ্রু কুঁচকাল। আসন পেতে হোগলায় বসে বলে, “এই ধানখেতে কাকতাড়ুয়া হয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাক তিয়াস।”
চমকাল তিয়াস, থমকে গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। সবাই ইতোমধ্যে থালা ধুয়ে ভাত খাচ্ছে। তিয়াস করুণ দৃষ্টিতে কাকতাড়ুয়ার বেশে ধানখেতে দাঁড়িয়ে আছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
এই গল্পে সবগুলো কাল্পনিক। আনন্দনগর গ্ৰামটাও।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/