নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে #ইফা_আমহৃদ পর্ব: ৫১

0
352

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫১

আরু কাঠের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে খরস্রোতা নদী উপভোগ করছে। নদী হলেও উপত্যকা গভীর নয়। বাহারি রঙের পাথরে চন্দন বাড়িয়ার ব্রিজ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ঝুলন্ত কাঠের ব্রিজে আরুর পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছে অপূর্ব। নিচে পাথরের ওপর বসে ক্যামেরায় মুহুর্ত বন্দি করতে ব্যস্ত সকলে। কুয়াশার আস্তরণ জমেছে বিধায় কাছের বস্তু ঘোলাটে দেখায়। ঠান্ডায় দু-বার কাশি দিয়ে নাকে হাত রাখতেই মৃদু ব্যথা অনুভব করল আরু। শুষ্ক হয়েছে গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়। মেরিলের কৌটা বের করে কিঞ্চিৎ আঙুলের ডগায় নিয়ে ছোঁয়াল আরুর ঠোঁটে। আরু এক পলক অপূর্বর দিকে দৃষ্টি রেখে ঝুঁকল ব্রিজ থেকে। প্রয়াসের বিষয়টা অপূর্বর থেকে লুকানো উচিত হয়নি আরুর। অপূর্বর দুহাত ধরে প্রেমপ্রবণ হলো আরু। জড়িয়ে আসা গলায় বলে, “আমি আপনাকে যতটা ভালোবাসি কিঞ্চিৎ পরিমাণ বেশি হলেও আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনি বুঝবেন, বিচ্ছেদ কতটা যাতনার।”

“হঠাৎ এত আবেগময় হয়ে যাচ্ছিস কেন? তুই তো একটা রোমান্টিক নয়। ব্যাপার কী? সত্যিটা বল।”

“বলুন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবেন। তবেই বলব।”

আরুর কথার জবাব না দিয়ে আদেশ দিল বলাল, “বল।”

“প্রয়াস ভাই ও তুর দুজন দুজনকে ভালোবাসে।” কথাটা বলে আরু দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। চোখ ছোটো ছোটো করে অপেক্ষায় রইল অপূর্বর উঁচু গলার। অপূর্ব নিশ্চল দৃষ্টিতে আরুর লজ্জা তড়তড় করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঠান্ডার ভেতরেও কপালে জমল লবণাক্ত জল। বাকিদের সাথে যোগ দিতে স্থির পা গতিশীল করলে আরুর হাতে কারণে থামল। কৌতূহল টেনে অপূর্ব বলে, “এত তাড়াতাড়ি ভালোবাসার সৃষ্টি হয়ে গেল? এটা ভালোবাসা নয়, ভালো লাগা। আমি এই বিষয় নিয়ে ওদের সাথে কথা বলব।”

“খালি চোখে যেটাকে ভালো লাগা বলছেন। সেটা ভালোবাসা। ওঁরা তিন বছর ধরে প্রেম করছে। আসলে প্রয়াস ভাই আমাদের গ্ৰামের ছেলে। মনে আছে আপনার, একটা ছেলের চিঠির জন্য মা আমাকে উঠানে বেঁধে চলা কাঠ দিয়ে মে/রে/ছিল। সেই চিঠিটা ছিল প্রয়াস ভাইয়ের তরফ থেকে তুরকে দেওয়ার জন্য।” নতজানু হয়ে কথাগুলো বলে তাকাল অপূর্বর পানে। অপূর্ব বিস্মিত, নির্বাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। লহমায় চেপে রাখা হাতটা আলগা হয়ে খসে পড়ল। দ্বি মুহূর্তে নিজেকে সং‌যত করে প্রতুক্তি চাইল, “তারমানে প্রয়াসের এখানে আসা সাজানো নাটক? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত? ও আসলে আমাকে চিনেও না চেনার ভান ধরেছিল? প্রথমবার ও আমাকে এভাবে ঠকাল।”

“আপনি ভুল ভাবছেন। প্রয়াস ভাই সবার মন জয় করার জন্য অপরিচিত সেজেছে। সময় ও সুযোগ বুঝে সবটা জানাত।”

“এখানেই ওদের সম্পর্ক আমি দাঁড়ি টানলাম। তুর প্রয়াসকে এখানে আনার আশকারা দিয়েছে। ওকেও আমি দেখে নিব। বাবা মায়ের অবর্তমানে আমিই তুরের অভিভাবক।” বলেই অপূর্ব এগোল। চেতনা ফিরতে অপূর্বর উদ্দেশ্যে বিঘ্ন ঘটাতে আরু ছুটল পেছনে পেছনে। অপূর্ব অবিচল হয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়াল, আরু তখন নামল ব্রিজ থেকে। অসংখ্য পাথরের মাঝে পা স্থির রাখতে পারল না। পানির কারণে পিছলে গেল। ধপাস করে চিত হয়ে মাটিতে পড়ল সে। সেই শব্দে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো আরু। অপূর্ব তেজ শুন্যতায় নেমে গেছে। চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এসে আরুকে টেনে তুলতে তুলতে বলে, “পড়লি কীভাবে? কোথায় লেগেছে দেখি।”

“দরদ দেখাতে হবে‌না। আপনার জন্যই পড়েছি। মনে হচ্ছে কোমরটা ভেঙে গেছে।” কপালে ভাঁজ ফেলে রাগ দেখাল আরু। চোখ বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করার প্রচেষ্টা করল। আদৌ লাভ হলো কি-না, কেবল সে জানে। অপূর্ব নরম হলো। কর্পূরের মতো রাগগুলো উড়িয়ে আরুকে কোলে তুলে নিল। বিশাল আকারের একটা পাথরের ওপর বসিয়ে বলল, “কোথায় কোথায় লেগেছে দেখি আরু, এই সময়ে একটু ধীরে ধীরে হাঁটতে হবে।”

“ধীরে ধীরে হাঁটতে দিয়েছেন আমাকে? আপনার জন্য পড়েছি। আমার যদি কিছু হয়ে যেত, খবর ছিল আপনার। এখন শুধু কোমরে ব্যথা পেয়েছি। বাড়িতে গিয়ে মালিশ করে দিবেন।”

অপূর্ব স্বাভাবিক থাকার ভান ধরে প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি সাইকেল চালাতে জানো? সাইকেল সম্পর্কে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। আরুই আমাকে এখানে এনেছে। এই ব্যথা নিয়ে এখন আর সাইকেল চালাতে পারবে না। সম্ভব হলে তুমি একটা..

অপূর্ব বাক্য শেষ না করে পূর্বের কথার পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়ে দিল বার্তা। প্রয়াস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হুঁ। আমি পারি। আমি ভাবিকে সাইকেলে করে মির্জা বাড়িতে নিয়ে যাবো।”

তুর দুজনের দিকে চেয়ে ঝটপট বলল, “আমিও যাবো, ভাইয়া।”

অপূর্বর তেজ আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটতে শুরু করল। প্রিয়সীর যাতনার কারণ তুরকে মনে করল। অবাধ্য হাত প্রথমবার তার আদুরে বোনের গালে গিয়ে থামল। লহমায় গাল জ্বলে উঠলেও বি/স্ফো/রি/ত হলো পরিবেশ। সেই শব্দ প্রকৃতিতে লেগে আবার ফিরে এলো। আচমকা তুরের হাতটা ধরে সরিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “সমস্যা কী তোর? চোখে দেখতে পাস না, সাইকেলে মাত্র দুটো সিট? তুই বসলে ওরা বসবে কোথায়?”

তুচ্ছ বিষয়ে চড় হজম হলো না কারো। ক্রন্দনরোল তুলে উঠতেই তিস্তা এগিয়ে এলো। অপূর্বর হিংস্র থাবা থেকে তুরকে সরিয়ে বলল, “অপূর্ব ভাই, আপনি তুরের সাথে এমন করছেন কেন? বাচ্চা মেয়ে সাইকেল দেখে উঠতে চেয়েছে। বুঝিয়ে বললেই হতো। আপনি অহেতুক মাথা গরম করছেন।”

“সেটা কি তোর থেকে আমি শিখব? সবাই সামনের দিকে এগোও, তুরের সাথে আমার কথা আছে। পিতা মাতার অবর্তমানে তুরের অভিভাবক আমি। তাই কেউ আমাকে উপদেশ দিতে এসো না।” অপূর্বর কথায় সবাই আরুর দিকে তাকিয়ে থাকল। গিরিগিটির মতো রং বদলায় অপূর্ব। এই ভালো, তো এই খারাপ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অপূর্ব ও তুরকে রেখে এগিয়ে গেল। আরু জানে অপূর্ব কেন তুরকে আলাদা করেছে, কিন্তু মুখ ফোটে বলতে পারল না।

সকলের থেকে দশ মিটার পিছিয়ে অপূর্ব ও তুর। ঝাপসা দেখা গেলেও কথা শোনার জো নেই। অপূর্ব কঠোর গলায় শাসাল তুরকে, “প্রয়াসের আশেপাশে যাতে তোকে না দেখি, নাহলে তোকে এখান থেকে সুন্দরনগর নিয়ে ফিরব না।”
পরপর টেনে বলে, “প্রেমিকের পরিচয় গোপন রেখে, অপরিচিত সাজিয়ে এখানে এনে অ/ন্যা/য় করেছিস তুই। তার শা/স্তি গ্ৰামে গিয়েই তোকে দেব।”

“মানে?” কাঁপাকাঁপা গলায় উচ্চারণ করল তুর।

“এই নদীতে তোকে পুঁ/তে রেখে যাব। আমার সাথে নাটক করছিস? কী ভেবেছিস, আমি জানিনা কিছু? চল বাড়িতে।” অপূর্বর ধমকে তুর সামনে এগিয়ে গেল। তুর বিচক্ষণতার পরিচয় দিল, এটা নিঃসন্দেহে আরুর কাজ। সেই অপূর্বকে জানিয়েছে। বিশ্বাসের এমন প্রতিদান দিল আরু?
__

হলদে আলোয় মির্জা বাড়ি আলোকিত। সবাই সেখানে থাকলেও, নেই তুর। একা ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। প্রচণ্ড তেজে ভয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা তুরের মাঝে। চোখ থেকে আপনাআপনি পানি ঝরল।
কুপির ওপরে সরিষার তেল ও রসুন গরম করছে তিস্তা। অতঃপর আরুর ব্যথার স্থানে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল, “ব্যথা কমেছে?”

আরুর মন উদাস, ননদ রূপী সখীকে না দেখে পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরেছে। তুরের সাথে একটু খোলাসা করে কথা বলার প্রয়োজন। উঁকিঝুঁকি দিল দোতলার সেই ঘরটিতে। সকলের আড়ালে কুপিটা নিয়ে অগ্রসর হলো তুরের কক্ষে। মেয়েটাকে উবুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে দেখে মলিন হলো মুখমণ্ডল। অপরাধীর মতো নরম গলায় বলল, “তুর, এখানে একা শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? ওখানে সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। চল! ওখানে যাবি?”

“আরু আমার মন ভালো নেই। এখান থেকে যা!”

“আরে শোন না… বলে তুরের হাত ধরতেই ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল তুর। শোয়া থেকে উঠে উচ্ছৈঃস্বরে বলে, “তোর মনে আনন্দ আছে, তাই তুই ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিস। কিন্তু আমার মনে কোনো আনন্দ নেই। তুই সখী হওয়ার যোগ্য নয়। কীভাবে পারলি আমার সাথে এমন কাজ করতে? ভাইয়াকে প্রয়াসের কথা জানানোর পেছনে কীসের স্বার্থ আছে তোর? ভালোবেসে তোরা তো নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিস। অন্যকে নিয়ে এত ভাবনা কীসের তোর? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, প্রয়াসকে যদি আমি না পাই। তাহলে তোদেরও আমি সুখে থাকতে দেব না। যে আনলে কালাচাঁন, শেফালী, মিহির পুড়ছে। একই আনলে আমরা দুজন তো পুড়বই, তোদেরও পুড়িয়ে ছাই করে দিব। যার নাম প্রেমানল।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ
গল্পটা প্রায় শেষের দিকে।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here