তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼 মিমি_মুসকান #পর্ব_৩

0
509

তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩

ফ্লাটের কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে। তাহমিনা বেগম রান্না ঘর ছেড়ে হাত ধুয়ে কোনমতে দৌড়ে এলেন। দরজা খুলতেই নিঝুমের ক্লান্ত মুখ খানা দেখে হেসে দিলেন উনি। নিঝুম মা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন তাহমিনা বেগম কে!

“কেমন গেলো প্রথম দিন!

“অনেক ভালো।

“অনেক ক্লান্ত লাগছে তোকে!

“হুম, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি মা!

“জানিস পাশের ফ্লাটের আপার সাথে আমার খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে।

“ভালো তো! হিনা কোথায়?

“পাশের ফ্লাটেই!

“স্কুলে কথা বলেছিলে!

“হুম কাল থেকে যাবে, যাই বলিস নিঝুম। এই নতুন জায়গাটা আমার বেশ লেগেছে।

নিঝুম ক্লান্ত বেশে সোফায় বসল। তাহমিনা বেগম মাথার উপরের ফ্যান ছেড়ে দিলেন। নিঝুম হেসে বলল, আমারও বেশ ভালো লেগেছে মা! আব্বু কোথায়?

“স্কুলে চলে গেছে। নিঝুম একটা কথা ভাবছিলাম!

“নতুন করে কি ভাবলে আবার!

“এই যে আমাদের এই নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ নতুন মানুষজন! তোর বাবার বদলি না হলে তো জানতেই পারতাম না!

“কিন্তু আমার সেই আগের পরিবেশ’ই আমার কাছে ভালো লাগতো। আব্বুর জন্য সবকিছু বদলাতে হয়েছে। ধুর ভালো লাগেনা!

তাহমিনা বেগম হাসলেন। নিঝুম কে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। তার মেয়েটা আসলেই অনেক ক্লান্ত। কপাল দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝড়ছে তার। নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ক্ষিদে পেয়েছে!

“অনেক!

“গোসল করে আয়, রান্না প্রায় হয়ে গেল!

“আচ্ছা!

এক লাফিয়ে উঠে ঘরে এলো নিঝুম। নিজের ঘর নিজে দেখেই খানিকক্ষণ থম মেরে রইল। সকাল বেলা বের হবার আগে ঘরের পরিবেশ মোটেই ভালো না। অগোছালো যা করার সেইই করেছিল। কিন্তু হিনা মনে হয় সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে। বলতে হবে মেয়েটা কাজের আছে!‌

নিঝুম এসে গোছানো বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল। তার খুব ক্লান্ত লাগছে। একদিনেই আজ কতোকিছু পার করল সে। চোখের চশমা রেখে কোলবালিশ কে জড়িয়ে ধরল। চোখ বন্ধ করে ভাবছে আজকের দিন! প্রথম দিনই যদি এতো জটিল হয় বাকি গুলো তো পরেই রইল।

হঠাৎ করেই উঠে বসল নিঝুম। মুখ চেপে ধরল দুই হাত দিয়ে। সে অবাক হচ্ছে একটা কথা ভেবে। তার সাথে এটা হবে ভাবতেও পারে নি সে। আহনাফ ( আহাদ ) কথা বলেছে তার সাথে। তার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে সে। এখনো কানে বাজছে সেই কন্ঠস্বর। লজ্জায় লাল হয়ে গেল নিঝুম। বালিশে মুখ গুঁজে মোচরা মুচরি করতে লাগলো। আবার আয়নায় দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই হাসতে লাগল।

কয়েক ঘন্টা আগে…

“তুমি সেই মেয়েটা না যে ফুলটা আগে তুলেছিলে!

এরকম কথা শুনে নিঝুমের কলিজার পানি শুকিয়ে গেল। কাঁপতে লাগলো সে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে, খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে তার। পেছন থেকে আবারো গলা ভেসে আসছে, কিছু বলছো না যে!

নিঝুমের পুরো শরীর শিহরণ বয়ে গেল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পেছনে ফিরল সে। আহনাফ কে দেখতে পেয়ে ভড়কে গেল। আকস্মিক ভাবে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। আহনাফ এক পা এগিয়ে এলো সামনে। নিঝুমের বোধ নেই সেখানে। এখনো অপলক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকেই তাকিয়ে আছে সে। নিঝুমের মুখের সামনে চুটকি বাজাল আহনাফ। নিঝুমের বোধ হলো। আহনাফ হেসে দিল। নিঝুম অবাক দৃষ্টিতে তার হাসির দিকেই তাকে রইল। একটা ছেলে কিভাবে এতো সুন্দর হতে পারে এটা ভাবতেই অবাক লাগছে তার। আহনাফ আবারো হেসে বলল, খুব সাহসী তুমি!

নিঝুম মুচকি হাসল। কিছু বলতে নিল ঠিক তখনই বেজে উঠল আহনাফের ফোন। কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে চলে গেল আহনাফ। নিঝুম বিস্ময় চোখে তার চলে যাওয়া দেখতে লাগল। অবাক করার বিষয় ছিল এই ক্ষণিকের আলাপে এই ছেলেটার জায়গা করে নিয়েছে সে নিজের মনে!

তাহমিনা বেগম খানিকক্ষণ পরে এসে দেখে নিঝুম বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। এই বলল গোসল করে আসছি কিন্তু তা না করে ঘুমাচ্ছে। মনে হয় অনেকটা ক্লান্ত নিঝুম। আর জাগাঙাথলেন না তিনি নিঝুম কে। ঘুমোতে দিলেন!

—–

পরদিন ভার্সিটিতে এসে নিঝুমের বেশ অবাক লাগল। সবাই এক জোট হয়ে হঠাৎ করে ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেন। নিঝুম আশপাশ তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। সবাই কি জানি বলাবলি করছে আর উপরের দিকে তাকাচ্ছে। তাদের দেখাদেখি নিঝুমও তাকাল উপরের দিকে। উপরের দিকে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া। একটা মেয়ে ছাদের গ্রিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আরে এসব কি? মেয়েটা কি আত্নহত্যা করবে নাকি। কি ভয়াবহ কান্ড! সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে, আবার কেউ কেউ ফোনে ভিডিও করছে। কিন্তু মেয়েটা কে বাঁচানোর চেষ্টা কেউই করছে না। নিঝুম সবাইকে ঢ্যালেঢুলে ভেতরে যেতে নিল। হঠাৎ করেই তার হাত কেউ ধরে ফেলল। নিঝুম তাকিয়ে দেখল তিথি!

“তিথি!

“কোথায় যাচ্ছিস?

“আরে মেয়েটা কে বাঁচাতে!

“পাগল হলি নাকি?

“ছাড় তুই আমায়, না হলে মেয়েটা এবার লাফিয়ে পড়বে!

অতঃপর হাত ছুটিয়ে নিঝুম দৌড়াদৌড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। ছাদের দরজার কাছে আসতে আসতে হাঁপিয়ে গেল নিঝুম। দরজায় দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে সে। জোরে চিৎকার চিৎকার করতে করতে বলল, এই থামো থামো কি করছো তুমি!

বলেই এগিয়ে এসেও থেমে গেল নিঝুম। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। গ্যাং ডেভিল’র সব সদস্য এখানে। এমনকি আহনাফ অবদি! মেয়েটা ছাদের গ্রিলে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর সরি বলছে। তার সামনের একটা ছেলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে বাকি সবাই নিঝুমের দিকে। তানিশা অবাক হয়ে বলল, তুমি এখানে?

নিঝুম দম ছেড়ে ছেড়ে সামনে এসে বলল, তোমরা মেয়েটা কে বাঁচাও, নাহলে ও লাফিয়ে পড়বে!

নিঝুমের কথা শুনে আহনাফ বাদে সবাই উচ্চস্বরে হেসে দিল। মেয়ের সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা এবার পিছু ঘুরল। নিঝুমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল সে। আহিম আর নীলাভ্র হেসে নিঝুমের কাছে এসে বলল, তুমি সেই মেয়েটা না যে গতকাল ভয়ে কাপছিলে?

দিয়া এসে নিঝুমের ঘাড়ে হাত রেখে বলে, মনে হচ্ছে গতকাল তোমাকে ঠিকভাবে শিখাতে পারি নি। নাহলে আমাদের সম্পর্কে তোমাদের কেউই কিছু বলে নি!

দূরে দাঁড়ানো ছেলেটি বলে উঠল, মেয়েটা কে?
গলার স্বর শুনে সামনে তাকাল নিঝুম। চিনতে কষ্ট হলো না, গতকালের বাইকের ছেলেটা! মানে শান্ত ! শান্ত হেঁটে কাছে এসে বলল, তোমাকে কোথায় দেখেছি বলো তো!

রিয়া বলে উঠে, গতকাল তোকে কিছুবলেছিল নাকি?

শান্ত নিঝুমের সামনে এসে দাঁড়াল। নিঝুম শুকনো ঢোক গিলে তাকাল আহনাফের দিকে। শান্ত নিঝুমের মাথায় বাড়ি দিয়ে বলল, তুমি গতকালের সেই মেয়েটা না যে ফুল তুলতে গিয়েছিল!

তানিশা হন হন করে এসে বলে, ফুল! কোন ফুল?

শান্ত হেসে তাকায় তানিশা’র দিকে। তানিশা রক্তবর্ণ চোখে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে। নিঝুম কাঁচুমাচু হয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। তানিশা চিৎকার করে বলে, সাহস কি করে হয় তোমার ফুল তোলার? এতো সাহস কোথায় পেলে তুমি!

নিঝুম ভয়ে কেঁপে উঠে। শান্ত শব্দ করে হেসে বলে, আসছে অন্য কে বাঁচাতে, এখন দেখো তুমি নিজেকে কি করে বাঁচাও!

বলেই আবারো মেয়েটার দিকে আগায় শান্ত। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে, কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? এই না প্রেমপত্রে লিখলে আমার জন্য সব করতে পারো তুমি তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন দাও লাফ দাও!

মেয়েটা দাঁড়ানো অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, শান্ত, আ..আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কখনো করবো না এমনটা!

“আহ এভাবে বললে কি করে হবে বলোতো বেবী। নাও লাফ দাও! ভালোবাসার প্রমাণ দাও নাহলে আমি তোমাকে ভালোবাসবো কিভাবে?

মেয়েটা শব্দ করে কাঁদতে থাকে। আহনাফ শান্ত’র কাঁধে হাত রেখে বলে, বাদ দে অনেক হয়েছে?

“আরে সবে তো শুরু হলো। এখনো অনেক কিছু বাকি! কি হলো লাফ দাও!

নিঝুম রেগে উঠে, পেছন থেকে বলে উঠে, এভাবেই কিভাবে বলতো পারেন আপনি! জানেন না এখান থেকে লাফ দিলে সে মারা যাবে।

“None of your business, তানিশা…

তানিশা রেগে এবার গাল দুটোর চেপে ধরে নিঝুমের। ব্যাথায় ছটফট করতে থাকে নিঝুম। দিয়া, আহিম সবাই হেসে উঠে। তানিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, খুব সাহস বেড়েছে না তোমার, গতকাল ফুল তুলতে গেছিলে আর আজ এসে এখানে জ্ঞান দিচ্ছ! ( হাত ছেড়ে দিয়ে ) তোমার কোন ধারণা নেই আমি তোমার কি হাল করতে পারি!

ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে নিঝুম। শান্ত শব্দ করে হেসে বলে, এবার তোমার পালা। নাও জলদি করো। আমার সময় নষ্ট করছো তুমি!

মেয়েটা নিচের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, শান্ত!

“হুম! দাও লাফ দাও। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি!

নিঝুম আবারো পিছন থেকে বলে উঠে, না এমনটা করবে না তুমি!

সবাই অবাক হয়ে নিঝুমের দিকে তাকায়। শান্ত পিছনে ঘুরে বলে, কি বললে তুমি!

“বলেছি ও এমনটা কখনো করবে না।

তানিশা, দিয়া আর রিয়া একসাথে হেসে উঠে। দিয়া নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, বাচ্চামো কেন করছো? তোমার পথ তুমি দেখো না‌। এমনেতেও তোমার সাথে হিসাবনিকাশ এখনো বাকি আছে আমাদের!

নিঝুম আবারো চেঁচিয়ে উঠে বলে, না তুমি লাফ দিবে না কখনো না!

শান্ত আবারো হেসে উঠে। ঠোঁট কামড়ে বলে, তোমার মনে হয়, ও তোমার কথা শুনবে!

নিঝুম শুকনো ঢোক গিলে। শান্ত বাঁকা হেসে মেয়েটার দিকে ফিরে বলে, আমি এক থেকে তিন বলার সাথে সাথে লাফ দিবে, বুঝলে!

“না কখনো না!

“এক!

নিঝুম নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। শান্ত দুই না বলেই তিন বলে ফেলল। সাথে সাথে মেয়েটা লাফ দিল। নিঝুম সামনে দাড়িয়ে থাকা তানিশা ধাক্কা মেরে দৌড়ে গ্রিলের কাছে এলো। তার দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম! তানিশা নিঝুমের ধাক্কা খেয়ে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল। রিয়া আর দিয়া গেল তার কাছে।

গ্রিলের কাছে এসে নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিচের দিকে তাকাতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। শান্ত’র হাত ধরে ঝুলছে সেই মেয়েটা। বার বার বলে উঠছে, শান্ত হাত ছেড়ো না প্লিজ, হাত ছেড়ো না। আমি মরতে চাই না প্লিজ শান্ত!

শান্ত ছোট ছোট চোখ করে নিঝুমের দিকে তাকাল। নিঝুম অবাক চোখে শান্ত’র দিকে তাকাল। শান্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, গুড বাই!

বলেই হাত ছাড়ার চেষ্টা করতেই নিঝুম না বলে মেয়েটার হাত ধরে বসে। শান্ত মেয়েটার হাত ধরা অবস্থায় নিঝুমের দিকে তাকাল। অবাক লাগছে নিঝুমের সাহস দেখে। নিচে এর মধেই হইচই লেগে গেছে। অন্যসব স্যারদের কানে কথাটা গেলেও এখনো প্রিন্সিপালের কানে কথা যায় নি। কারোই সাহস হচ্ছে না কিছু বলার। তিথি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে নিঝুম উপরে। ফোনের উপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে ইফা কে। দৌড়াদৌড়ি করে ভার্সিটিতে ঢোকে ইফা। এমন কান্ড দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে উপরের দিকে! অতঃপর…

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here