#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩৯
কলিং বেল বেজে যাচ্ছে পর পর, শান্ত’র ইচ্ছে করছে না বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলতে। অমি থরমড়িয়ে উঠে তাকাল দরজার দিকে। তারও বুঝতে বাকি নেই কেউ একজন এসেছে। এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে গেল।ছুটে গেল দরজার কাছে, ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। অনেকটা বিরক্তি নিয়ে শান্ত এবার উঠল বিছানা ছেড়ে। বিরক্তি টা দ্রুত রাগে পরিণত হয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে। বেশ রাগ নিয়েই দরজা খুলল। খানিকটা অবাক হলো তবুও বিরক্তি স্বরে বলল, “তুমি!
চশমিস হাঁপিয়ে উঠেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে, দেখি সরুন তো।
ধাক্কা দিয়ে শান্ত কে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল নিঝুম। দৌড়ে গেল রান্না ঘরের দিকে, ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেতে লাগল। শান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সোফায় এসে বসল। শান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি হয়েছে? এতো তাড়াহুড়ো করে কেন এলে?
“কি হয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, এটা কি আমার জিজ্ঞেস করা কথা নাহ!
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথা গুলো বলল নিঝুম। শান্ত দৃষ্টি সরিয়ে কথাও ঘুরয়ে জিজ্ঞেস করল, “খেয়েছ কিছু?
“না, ক্ষিধে পেয়েছে।
“ভাত আর ইলিশ মাছের তরকারি আছে, খাবে!
“নাহ, ইলিশ মাছ খাবো না।
“কেন?
“ইচ্ছে করছে না, তাই!
শব্দ করে শ্বাস ফেলল শান্ত। রান্না ঘরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে ডিম করে বলল, “ডিম ভাজা দিয়ে খাবে!
“আপনি আমায় ভাত ভাজা করে দিবেন।
“আমাকে তোমার কি মনে হয় বলো তো, আমার বাসায় এসে আমাকেই এভাবে অর্ডার করছো।
“আপনার ভাগ্য ভালো, আমি আপনার সাথে স্বাভাবিক ভাবে এখনো কথা বলছি। এখন রেঁধে দিন খুব ক্ষিধে পেয়েছে আমার।
বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল নিঝুম। শান্ত’র ইচ্ছে করল কিছু কঠিন কথা বলতে, কিন্তু কেন যেন আর বলতে পারল না। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে পেঁয়াজ কাটতে লাগল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতে লাগল নিঝুমের দিকে। বুঝতে পারছে না এই মেয়েটা কিসের এতো অধিকার দেখাচ্ছ। রাগ তো এখন নিজের উপর উঠছে। সেও কেন তার কথা শুনছে!
নিঝুম চট করে উঠে দাঁড়াল। বলে উঠল, “আমি ফ্রেস হয়ে আসছি!
শান্ত খুন্তি হাতে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে উঠল, “কি হচ্ছে টা কি, তুমি কি পেয়েছ বলো তো।
কথার পাত্তা দিল না নিঝুম। ফ্রেস হয়ে এসে দেখল শান্ত প্লেটে খাবার রেখে সোফায় বসে আছে। নিঝুম এক গাল হেসে বলল, “ধন্যবাদ অশান্ত!
“খেয়ে দেয়ে বের হও জলদি!
“আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
শান্ত কৌতুহলী স্বরে, “কি?
“খেয়ে নেই, পরে বলছি!
নিঝুম খেতে আরম্ভ করল। শান্ত নিশ্চুপ হয়ে দেখছে তাকে। শান্ত’র দিকে ফিরে চামচ উঠিয়ে বলল, “অশান্ত আপনার রান্না তো অসাধারণ। এক চামচ খেয়ে দেখবেন।
“আমি রোজ’ই খাই, তুমি খাও!
বলেই উঠে পড়ল। ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করে গরম করতে লাগলো সে। ক্ষিধে এখন তারও পেয়েছে। নিঝুম উঠে এসে দাঁড়াল শান্ত’র পাশে। অমিও এসে হাজির। নিঝুম খানিকটা দূরে সরে গেল। বাটিতে ক্যাট ফুড ঠেলে অমি’র কাছে এগিয়ে দিল শান্ত। নিঝুম হঠাৎ বলে উঠল, “অশান্ত আমি এখন কি করবো?
শান্ত অপ্রস্তুত গলায়, “কোন ব্যাপারে?
“আহনাফ পরশু তার সাথে ডেটে যেতে বলেছে আমাকে।
ক্ষীণ স্বরে কথাটা বলল নিঝুম। চামচ দিয়ে খাবার নড়াচড়া করছে সে। শান্ত’র এমন ভাব যেন কিছুই হয় নি। স্বাভাবিক ভাবেই বলেই উঠল, “তো বেশ তো যাও!
নিঝুম এবার ওদিকে গিয়ে, “আপনি ফোনে বললেন আহনাফ আমার কার্ড পড়েছে, সত্যি!
“হুম।
নিঝুম অস্থির হয়ে, “এখন আমি কি করবো?
“কি আর করবে, এতোদিন যেটা চেয়েছিলে সেটাই তো পেয়ে যাচ্ছো।
“কিন্তু অশান্ত আপনি বুঝতে পারছেন না।
“না বোঝার কি আছে।
নিঝুম খাবার মুখে নিয়ে কিছু একটা বলল,শান্ত সেটা বুঝতে না পেরে তার দিকে ফিরল। অতঃপর নিজের খাবারের প্লেট হাতে সোফায় এসে বসল। পিছন পিছন আসছে নিঝুম। শান্ত খাবার মুখে দিয়ে বলল, “এতো টেনশন করো না, আহনাফ যখন ডেটে যেতে বলেছে এর অর্থ ও নিজেও তোমাকে নিয়ে কিছু অনুভব করছে।
“আপনাকে বলেছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত মাথা নাড়ল। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শান্ত এবার উঠে গিয়ে আবারো গেল রান্না ঘরের দিকে। ফ্রিজ থেকে সফট ড্রিংকের ক্যান বের করে মুখে পুড়ল। পেছন পিছন আবারো এলো নিঝুম। মুখে চামচ নিয়ে শান্ত’র সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “অশান্ত এখন আমি কি করবো, খুব ভয় করছে আমার।
“ভয়ের কি আছে?
“জানি না, অশান্ত!
“কি হলো কি?
“জানি না, অন্যরকম লাগছে আমার। কেমন জানি মনে হচ্ছে।
শান্ত’র চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল নিঝুম। শান্ত চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমাকে কেন এসব বলছো?
‘নিঝুম আবারো ঘুরে ওদিক গিয়ে শান্ত’র সামসামনি এসে দাঁড়াল।
“অশান্ত!
‘এই তুমি থামবে, তোমার নাম চশমিস না দিয়ে বাচাল দেওয়া দরকার ছিল।
“অশান্ত আমি কিছু বুঝতে পারছি না, আহনাফ বলেছে তিনি কফি শপের বাইরে থাকবে, আমার যেতে ইচ্ছে যেতে না হলে দরকার নেই। টেনশনে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, অশা..
কথা শেষ করবার আগেই শান্ত রেগে বিরক্ত হয়ে নিঝুম কে দেওয়ালে চেপে ধরল। থতমত খেয়ে গেল নিঝুম। স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল শান্ত,
“কি বুঝতে পারছো না তুমি, তুমিই তো একসময় বলেছিলে আপনাকে কে পছন্দ করো তুমি। তার জন্য কার্ডে লিখো নি, ওকে তুমি ভালোবাসো। তিশা কে প্রথমবার আহনাফের সাথে দেখে কাদো নি, যতবার ওদের একসাথে দেখেছ ততোবার রেগে যাও নি। আমায় এসে বলো নি, ওদের একসাথে সহ্য হচ্ছে না। এতো দিন এসব আহনাফ না জানলেও তোমার অনুভূতি’র কথা এখন জানে সে। আহনাফও পা বাড়িয়ে দিয়েছে, তাহলে তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন। পিছিয়ে পড়তে চাও, এসবের পর এতো কিসের দ্বিধা তোমার। তুমি কি এখনো বুঝতে পারছো না কাকে ভালোবাসো। তোমার অনুভূতিটা কার জন্য! কাকে চাও তুমি…
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থেমে গেল শান্ত। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিঝুম। ঢোক গিলল শান্ত। নিঝুমের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। মোহিত হয়ে পড়ে সে, ভুল করে বসল নিঝুমের দিকে আরো খানিকটা এগিয়ে। নিজের অনুভূতি গুলোকে সামলাতে ব্যর্থ হলো শান্ত আরেকবার। একা এই সময়টা যেন তার আবেগ কে নিজের আয়ত্তে রাখতে ব্যর্থ হলো। মুখ ঘুরিয়ে নিল নিঝুম! বোধ হলো শান্ত, এমন অস্বস্তিকর পরিবেশ হবে এটা কল্পনাও করে নি সে। দ্রুত পিছিয়ে এলো সে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারল না। বিচলিত হয়ে আবারো এসে বসল সোফায়। নিঝুমের দিকে ফিরে তাকানোর মতো সাহস এখন আর তার নেই। নিঝুম ফিরে এলো রান্না ঘর থেকে। শান্ত’র বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল মুহুর্তেই। নিঝুম নিশ্চুপ হয়ে এসে বসল তার’ই সামনে। নির্বিকারে খেতে লাগল, ভাবটা এমন কিছুই হয় নি।
শান্তও চুপচাপ খেতে লাগল। কিন্তু এখন আর খাবারে মন নেই তার। সময়টা নিরবেই গেল, খাওয়া শেষ করে রান্না ঘরের দিকে গেল নিঝুম। শান্ত বহু কষ্টে ওদিকে মুখ করে তাকাল। নিঝুম পানি খাচ্ছে, অমিও তার খাওয়া শেষ করে শান্ত’র পায়ের কাছে এসে বসল। খাওয়া হচ্ছে না শুধু শান্ত’র। পানি খেয়ে এসে আবারো সোফায় এসে বসল নিঝুম। শান্ত’র ভাবটা এমন সে খুব মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। নিঝুম শান্ত’র দিকে ফিরে বলল,”অশান্ত! এখনো খাচ্ছেন আপনি!
খানিকটা কেঁপে উঠল শান্ত। দ্রুত তা সামলে নিচের দিকে তাকিয়েই বলল, “হুম!
“আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি, আর ধন্যবাদ!
শান্ত জবাবে মাথা নাড়ল। নিঝুম ব্যাগটা কাঁধে নিল। পা বাড়িয়ে দরজার দিকে আগাতে নিল। শান্ত মুখ ফিরে তাকালো পিছনের দিকে অমনি নিঝুম আবার পিছন ফিরল। সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিল শান্ত। নিঝুম ডেকে উঠল, “এই অশান্ত, দরজা বন্ধ করুন!
“আসছি!
শান্ত উঠে দাঁড়াল। নিঝুম দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা সাহস জুগিয়ে সামনের দিকে তাকাল শান্ত। নিঝুমের মুখোমুখি হয়ে বলে উঠল, “কি করবে তুমি এখন?
“ভেবে নিয়েছি!
“তাহলে যাচ্ছো পরশু।
মৃদু হাসল নিঝুম। শান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিঞ্চিত হাসল!
——
শান্ত কে কল করেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু এখনো এসে পৌঁছাল না। অস্থির হয়ে আহনাফ কল করল আরেকবার! রিসিভ করে ওপাশ থেকে শান্ত কিছু বলার আগে আহনাফ বলে উঠল, “এতোক্ষণ লাগে তোর আসতে!
“দরজাটা খুল।
“আসছি!
কলটা কেটে এগিয়ে গেল আহনাফ। শান্ত কে দেখতে পেয়ে অস্থিরতাটা কিছুটা কমল। দুজনেই উঠে এলো ছাদে। শান্ত গ্রিলের উপর বসে পড়ল, পাশে দাঁড়িয়ে আহনাফ!
“কি হয়েছে এতো জরুরি তলব।
“কিছু না, এমনেই তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।
“তোর কি মনে হয় না তুই একটু বেশি টেনশন করছিস।
“নিঝুম তোকে বলেছে তাই নাহ।
“তাতে কি? তুই তো কিছু বলিস নি।
“আমি বলতাম, কিন্তু এটাও জানতাম বের হয়ে তোর সাথেই প্রথমে কথা বলবে।
শান্ত’র দিকে ফিরে কিঞ্চিত হেসে কথাটা বলল আহনাফ। শান্তও মুচকি হাসল।
হাতের ব্রেসলেট টা ঘুরাতে ঘুরাতে কথাটা বলল শান্ত। এই ব্রেসলেট টা আহনাফ’ই গিফট করে ছিল। মজার বিষয় ছিল, ব্রেসলেটের এক কোনে নাম লেখা ছিল। শান্ত’র হাতে যেই ব্রেসলেট তাতে লেখা আহনাফের নাম আর আহনাফের টাতে শান্ত’র নাম। শান্ত’র মন টা যেন হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গেল। মন ভালো করার আরেকটা বিষয় ছিল আজকের চাঁদ। আহনাফ চাঁদের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলল, “চাঁদ টা আজ বড্ড সুন্দর!
“হুম অনেকখানি, আজ পূর্ণিমা নাকি!
“হুম। আচ্ছা শান্ত, তোর কি মনে হয়। নিঝুম কাল আসবে।
“বোধহয় আসবে!
“এর অর্থ তুই নিজেও সিউর না।
“তুই কি সিউর।
“শান্ত জানিস, আমি খুব করে চাই কাল ও আসুক।
“একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিস দেখি।
“ভালোবাসা কি না জানি না, তবে কিছু একটা তো আছে।
শান্ত হাসল। ইচ্ছে করল একবার তানিশার কথাটা বলতে। কিন্তু বলল না, থাক বলে আর কি হবে। তানিশাও কম কিছু ভালোবাসে না ওকে। কিন্তু সত্যি কথাটা তো এটাই, “যে আমাদের ভালোবাসে আমরা তার কদর দেই না, বরং যাকে আমরা ভালোবাসি তার পিছুই ছুটতে থাকি।” সেই দশা এখন তানিশার।
শান্ত হাত বাড়িয়ে আহনাফের পকেট থেকে ফোনটা বের করল।অন করতেই তিশার ছবি ভেসে উঠল। শান্ত হেসে বলল, “এখনো এটা চেঞ্জ করিস নি।
“কালকের পর করবো।
শান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা কিন্তু ঠিক না আহনাফ।
“কেন?
“আমার ফোনে তোর আর আমার ছবি। তুই তো পারতি তোর ফোনে আমার আর তোরটা রাখতে।
“না, রাখবো না বলেই ভেবে রেখেছি।
“আহনাফ!
“অনেক রাত হয়েছে, চল খেতে আয়। বাবা আজ রান্না করেছে তোর জন্য।
আহনাফ এগিয়ে গেল। শান্ত দাঁড়িয়ে বলল, “আহনাফ দাঁড়া!
“কি?
“আজ তো একটা ফয়সলা হয়েই যাবে?
“কোন ব্যাপারে?
“বল কে? আমি নাকি নিঝুম? বন্ধুত্ব নাকি ভালোবাসা!
শান্ত জানত আহনাফ হেসে বলবে, “পাগল হলি নাকি, বাচ্চাদের মতো কথাবার্তা বলছিস। কিংবা নিবে তার নাম। কিন্তু না, এবার তা না করে আহনাফ বলে উঠল, “ভালোবাসা!
“তুই ভালোবাসার জন্য আমাকে ছেড়ে দিবি আহনাফ!
“যা ছেড়ে দেব কোথায় বললাম।
“যা! কথা নেই তোর সাথে!
হন হন করে বের হয়ে গেল শান্ত। ওই এতো টুকু ব্যাপারে শান্ত মারা*ত্মক রাগ করে বসল। আহনাফ তার নামটা নিল না কেন?
রাতে খাবার শেষে বাসায় ফিরে আসা অবদি আহনাফের সাথে একটু কথা বলল না শান্ত। আহনাফ বেশ অবাক হলো কিন্তু বেশ মজা লাগছিল তার। তাই আর কথা বাড়াল না। কিন্তু বাসায় পা রাখতেই শান্ত’র মন বদল হয়ে গেল। কেমন এই নিস্তব্ধ রুমে নিজেকে খুব একা লাগছিলো তার। নিঃসঙ্গতা যেন ঘিরে ধরল তাকে। নিঝুমের কথা মনে পড়তে লাগলো বেশ। বেডরুমটা অন্ধকার করে রেখে বিছানার কাছে এসে মেঝেতে বসে পড়ল সে। ফোনটা বের করে অন করতেই ভেসে উঠল তার আর আহনাফের ছবি। মনে পড়ে গেল আহনাফের ওই কথা। নিজেকে আরো একা বলে মনে হলো। রাত অনেক, তবুও কি ভেবে ফোন করতে নিল নিঝুম কে। কিন্তু ফোন যাবার আগেই তড়িখড়ি করে কেটে দিল ফোনটা। অন্যদিন হলো অনেক মেসেজ আসতো নিঝুমের থেকে। কিন্তু আজ এলো না, ফেসবুকে নিঝুমের আইডি থেকে কোন নৌটিফিকেশনও না। আইডিটা আরো ১ ঘন্টা আগেই এক্টিভ ছিল তবুও কি মনে পড়ল না চশমিসের অশান্ত কে। ক্লান্তি চলে এলো মনের ভিতর। হাঁপিয়ে উঠেছে শান্ত নিজের সাথে লড়তে লড়তে। চোখ বন্ধ করে বসে রইল চুপটি করে।
আজকের সকালটা সুন্দর! ভোরে উঠা আহনাফের স্বভাব। হঠাৎ আজকের সকালটা অন্যরকম বলে মনে হচ্ছিল তার। তিশা তাকে ছেড়ে চলে গেছে আজ ৪ টা মাস হতে চলল। নিজেকে এতো তাড়াতাড়ি সামলিয়ে নিতে পারবে ভাবতে পারে নি আহনাফ!
আজ সাদা পরনে সবকিছুই সাদা। সাদা রঙের মাঝে আহনাফ কে শুভ্রর মতো লাগে। কেমন এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে আহনাফ, কফি শপের বাইরে। ঘড়ির কাঁটা চলছে নিজ গতিতে, একে থামাবার কেউ নি। কিন্তু যতোই সময় আগাচ্ছে ততোই যেন ভয় বেড়ে যাচ্ছে আহনাফের। শান্ত কে ৫ বার কল করেছিল, শান্ত ধরল না। গতরাতের রাগ নিয়ে কি এখনো বসে আছে নাকি। ভেবে রেখেছ নিঝুম না আসলে শান্ত’র কাছেই যাবে সে।
আধঘন্টা পার হয়ে গেল, নিঝুমের এখনো দেখা নেই। আহনাফ ভেবে নিল নিঝুম বোধহয় আর আসবে। এতোটা দুঃখ পাবার কথা ছিল না, তবুও মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। গাড়ির দরজা খুলে শেষবারের মতো চোখ বুলাল রাস্তায়। হঠাৎ করেই দেখল নিঝুম আসছে। কাঁধের ব্যাগটা আলতো করে ধরে হেঁটে আসছে নিঝুম।দুজনের চোখাচোখি হতেই নিঝুম একগাল হাসল। স্বভাবমতো উঁচু করে হাত উঠিয়ে হাত নাড়াল সে। আহনাফ কিঞ্চিত হেসে পা বাড়াল। নিঝুম আজ পরেছে সাদা রঙের একটা টপস। গলায় বেবী পিংক রঙের একটা উড়না। কাকতালীয় ভাবে হলেও দু’জনের চয়েজ এতোটা মিল হয়ে গেল অদ্ভুত ভাবেই। আহনাফের মনে হচ্ছিল নিঝুম কে অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। সে এগিয়ে এসে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না।
“যাহ, এসে পড়লাম তো।
আহনাফ মৃদু হাসল। হাত বাড়িয়ে বলল,”চলো যাওয়া যাক।
মাথা নেড়ে চোখের চশমা ঠিক করে পা বাড়াল নিঝুম!
সময়টা পেরিয়ে গেল দারুন ভাবে, কিছুটা এগিয়ে নেওয়া যাক তাহলে। রাত তখন শুরু। এই ৮ বাজে বোধহয়! আজানের আওয়াজে চারদিক মুখোরিত। ঝড়ের গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে শান্ত! মুখ চোখ লাল হয়ে আছে তার, নিজেকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। গায়ের শার্টটা ঘেমে একাকার। শ্বাস নিতেও এখন কষ্ট হচ্ছে অনেক। কষিয়ে গাড়ি ব্রেক করল করল শান্ত। হাতের ব্রেসলেট টা খুলে রেখে দ্রুত বের হয়ে এলো সে। আর একটু থাকলে যেন মরেই যেত সে। শ্বাস নিতে এখনো কষ্ট হচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক করে শ্বাস নিতে। সামনের ভবনের দিকে তাকাল সে।
এতো উঁচু ভবনের একদম উপরে শান্ত। নিজেকে এতোটা নিঃশ্ব বোধহয় আগে কখনো মনে হয় নি তার। ছাদের এক কোনে ধপাস করে বসে পড়ল সে। না মন মানাতে পারে নি সে , পারে নি নিঝুমের জন্য আনা সেই অনুভূতিগুলো ভুলে যেতে। এমনটা কি খুব দরকার ছিল, না হলেই কি হচ্ছিল না। অজান্তেই চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আহনাফ আর নিঝুমের ঘনিষ্ট মুহূর্তের কথা। যতোই ভাবছে ততোই যেন একাকী হয়ে পড়ছে। খুব জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে এখন। উঠে দাঁড়িয়ে গ্রিলের এপাশ হয়ে বসে পড়ল। উপরের দিকে তাকাল, চাঁদ কে অনেকটা অস্পষ্ট দেখছে। নিচে তাকাতেই গম্ভীর হয়ে গেল। জায়গাটা ভীষণ ফাঁকা, ওপারে রাস্তায় ব্যস্ত হয়ে গেছে গাড়ির ছোটাছুটিতে। কানে বাজছে আহনাফের কথা। আহনাফ বলেছিল ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের মাঝে সে ভালোবাসা বেছে নেবো। কেন বলল এই কথা আহনাফ। মন মানাতে পারছে না শান্ত। তাকে যদি বলা হতো তাহলে সে বন্ধুত্ব’ই বেছে নিতো। কিন্তু ভালোবাসা! সত্যি কি তাকে এতো অবহেলা করা যেত। শুকনো ঢোক গিলল শান্ত, মাথায় চেপে বসল অন্যকথা। উঠে দাঁড়াল সে।
১০ তলা এই উঁচু ভবনের গ্রিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে শান্ত শক্ত হাতে। রাতের আঁধারে ঢেকে যাওয়া চাঁদ এবার উঁকি দিয়েছে। নিজে তাকিয়ে হাজারো ব্যস্ত গাড়ি ছোটাছোটি করতে দেখছে। কি করবে এখন শান্ত, এক পা কি বাড়িয়ে দেবে। কেন বা দেবে না। আজ সে হেরে গেছে। একজন বন্ধুর কাছে হেরে গেছে, হেরে গেছে ভালোবাসার কাছে। তাকে বেছে নিতে হতো হয়তো বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসা। কিন্তু সত্যি কি তা সম্ভব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়াল শান্ত। অতঃপর….
রাত তখন ১০ টা! আহনাফ অনেকটা ক্লান্ত।আজকের দিনটা বেশ স্মরণীয় তার কাছে। ইচ্ছে মতো একটি ছবি সেট করে রাখল ওয়ালপেপারে। হঠাৎ মনে পড়ল শান্ত’র কথা। ঘন্টা খানিক আগেও কল করছিল তাকে। অবাক করার মতো কান্ড ছিল শান্ত তাকে একবারও কলবেক করল না। বিব্রত হয়ে আবারো নিজেই ফোন করল। আশ্চর্য! ফোন এখন ব্যস্ত। কার সাথে কথা বলছে শান্ত। আহনাফ কল কাটলো। দু মিনিট কল করতে যাবে অমনি ফোন বেজে উঠল। প্রথম শান্ত ভাবলেও পরক্ষণে আহিমের নাম চোখে পড়ল। হালকা কেশে কলটা রিসিভ করে বলল, “হ্যালো!
“আহনাফ!
“হুম, আচ্ছা শান্ত কি তোর সাথে এখন। শয়*তান টাকে কখন থেকে কল করছি , ধরছে না কেন? দে তো একটু ওকে।
অনেকটা অপ্রস্তুত গলায়, “আসলে আহনাফ…
“কি হয়েছে?
জোরে জোরে শ্বাস নেবার শব্দ ভেসে আসছে কানে।প্রতিমুহূর্তে হুমড়ি*ধুমড়ি করে বাড়ি থেকে বের হলো আহনাফ। কানে এখন একটাই কথা বাজছে তার। শান্ত’র এক্সি*ডেন্ট হয়েছে। শান্ত কে কল করতে গিয়ে পুলি*শ ফোনটা রিসিভ করে আর বলে। ব্যস যথেষ্ট ছিল এতোটুকু। কোথায় কি হলো কখন হলো কিছুই শুনলো না। ছুটে বেরিয়ে গেল শুধু। সারা শরীরে এখন অদ্ভুত এক ধরণের অনুভব। এই মনে হচ্ছে তার সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে তার থেকে। চোখের সামনে সবকিছু ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে!
#চলবে….