অপ্রিয়_জনাব #Mehek_Enayya(লেখিকা) #পর্ব_০৮

0
177

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৮

আজ তাহেরাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। যেহেতু তাহসিয়া বিবাহের জন্য প্রস্তুত নয় তাই তাকে আর জোর করা হয়নি। আলাউদ্দিন তার এক বন্ধুর ছেলেকে পছন্দ করেছেন মেয়ের জন্য। তাই আজ মেয়েকে দেখে সমন্ধ ঠিক করে যাবেন। গৃহের কর্তিরা রসইকক্ষে রান্নার কাজে ব্যস্ত। উপমা আর ছায়া তাহেরার কক্ষে। আজ সে কী পরবে, কিভাবে কথা বলবে সব শিখিয়ে দিচ্ছে দুই ভাবি। ছায়া এখন অনেকটা সুস্থ। আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করতে পারে। নিজের যাবতীয় কাজ নিজেই করতে পারে। শুধুই ভারী কাজ করা নিষেধ।
তাঁদের কথার মাঝেই তুলিকা কক্ষে প্রবেশ করে। উপমা হাত বাড়িয়ে তার মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। দুই বছরের কী আদুরে মেয়েটি। তুলিকা আরাম করে বসে ছায়াকে বলল,
-আমার ভাই কী আজ আসবে না?
-সেটা আমরা কিভাবে বলবো আম্মাজানকে জিগ্যেস করা উচিত ছিল।
-আমার ভাইয়ের নসিবেই তোমাদের মতো দুইজন বউ জুটেছিলো! একজন তো তাকে পিতা সুখই দিতে পারলো না! আরেকজন তো ভুলেই গিয়েছে আমার ভাই যে তার স্বামী! তোমাদের স্ত্রী হিসেবে কিছু দায়িত্বও তো আছে নাকি।

ছায়ার মুখ ছোট হয়ে যায়। উপমা তুলিকার কথা উপেক্ষা করে তুলিকার মেয়েকে নিয়ে খেলতে থাকে। তুলিকার রাগ হলো উপমার ওপর। রুক্ষ স্বরে বলল,
-তা উপমা আমার ভাই কী তোমার সাথে রাত কাটায় না? বিবাহের বেশ দিন তো হয়ে যাচ্ছে এবার সুসংবাদটাও শুনিও।
-ভাই ভাবীর গোপন কথা জানতে চান বড় বোন হিসেবে আপনার একটুও সরম করলো না বড় আপা?
থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলো তুলিকা। ছায়া মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। তুলিকা রাগ দেখিয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। ছায়া আর উপমা শব্দ করে হেসে উঠলো।

ছেলে পক্ষ আসার আগেই সোহরাব বাসায় আসে। জামাকাপড় পরিবর্তন করে নিচে নেমে আসে। ছায়া দোতালায় দাঁড়িয়ে নতুন প্রেমে পরা নাবালিকার মতো তাকিয়ে থাকে। সোহরাব হাতের আধুনিক ঘড়িতে সময় দেখে সদর দ্বারের পানে তাকায়। হটাৎ কী মনে করে তার দৃষ্টি যায় দোতালার বারান্দায়। চোখাচোখি হয়ে যায় দুইজনের। সাদা ব্লাউজ দিয়ে হাল্কা গোলাপি রঙের শাড়ী পরেছে ছায়া। অনেক বেশি শ্রী লাগছে তাকে। লাজেরাঙা হয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে ছায়া। মৃদু হাসলো সোহরাব।

চেঁচামেচি করতে করতে দৌড়ে আসে ইয়ামিন। সোহরাবের পিছনে লুকিয়ে দুষ্টামি কণ্ঠে বলল,
-ভাইজান ভাইজান আমাকে বাঁচান ভাবিজান থেকে।
ইয়ামিনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই তার পিছু পিছু ছুটে আসে উপমা। পরিহিত লাল শাড়ী ঘোমটা ধরে রেখেছে একহাত দিয়ে। তার কোলে তুলিকার মেয়ে তন্দ্রা। খুশিতে হাতে তালি দিয়ে খেলছে সে। উপমা সোহরাবকে খেয়াল করে না। ইয়ামিনকে ধরতে উদ্যত হবে তখনই সোহরাব ইয়ামিনকে নিজের কোলে তুলে নেয়। উপমা সোহরাবকে দেখে দু কদম পিছিয়ে যায়। মুখের হাসি নিভে যায়। ইয়ামিন সোহরাবের কোলে বসে ভেংচি কেটে বলল,
-এখন আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। তুমিও পারবে না ছোট ভাবিজান।
-ভাই আমার এভাবে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন কেনো? যদি পরে ব্যাথা পেতেন তাহলে আমাদের কী হতো!
প্রশ্ন করে সোহরাব। ইয়ামিন দুঃখিত স্বরে বলল,
-দুঃখিত ভাইজান। আর করবো না।
-এইতো আমার লক্ষী ভাই।
ইয়ামিনের গালে চুমু দিয়ে নিচে নামিয়ে দেয় তাকে। উপমা চলে যেতে নেবে তখন সোহরাব বলে উঠলো,
-মেহমান যাওয়ার পর আপনার সাথে আমার কথা আছে। আমার কক্ষে আসবেন।
_______________________

ছেলে পক্ষ আসলো। সযত্নে তাঁদের গৃহে নিয়ে আসা হলো। খাতিরযত্নে কোনো কমতি রাখলো না। উপমা ছায়া কেউই তাঁদের সামনে গেলো না। তাহেরাকে নিচে আনা হলো। বেশ পছন্দ হলো তাঁদের মেয়েকে। ঠিক হলো আজ থেকে আটদিন পর ঘরোয়া ভাবে বিবাহ পড়ানো হবে তাঁদের। বেশি মানুষকে আমন্ত্রণ করা হবে না। পারিবারিক ভাবেই অনুষ্ঠিত হবে। দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেলো মেহমান।
উপমা নিজ কক্ষে শুয়ে ছিল। একজন ভৃত্য এসে তাকে বলল সোহরাব তাকে নিজ কামরায় ডেকেছে। বিছানা থেকে উঠে শাড়ী ঠিক করে দাঁড়ালো উপমা। মনকে কঠিন্য করে সোহরাবের কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। দরজার সামনে এসে ভিতরে প্রবেশ করতে তার মন উস্কখুস্ক করতে থাকে। মৃদু ঠোকা দিতেই ভিতর থেকে সোহরাবের ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেলো।
-ভিতরে আসুন।

উপমা মাথা নত করে ভিতরে ঢুকে। আগের থেকেই ছায়া আর সোহরাব উপস্থিত ছিল কক্ষে। নিজেকে অপ্রস্তুত মনে হলো উপমার। দু পা এগিয়ে গিয়ে বলল,
-আমাকে ডেকেছিলেন?
-হ্যাঁ।
সোহরাব একবার ছায়া তো একবার উপমার পানে তাকায়। প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর স্বরে বলল,
-আমার হতবুদ্ধির কারণে আজ আপনি আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে পরেছেন। এখন আপনার নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবনও আছে। আমি যাচ্ছি না আমার জন্য আপনার ভবিষ্যত নষ্ট হোক। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন আপনার ইচ্ছা জানতে চাই আমি।
উপমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ছায়া ভীত দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে আছে। সোহরাব পুনরায় বলল,
-আমি আপনাকে তালাক দিতে চাচ্ছি। তালাকের পর আপনি কোথায় থাকবেন, আপনি পড়াশোনা করবেন নাকি আরেকটা বিবাহ করবেন সবকিছু নিজ দায়িত্বে আমি সম্পূর্ণ করবো সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। এখন আপনি কী চাচ্ছেন?
উপমা মাথা নত রেখেই শান্ত স্বরে বলল,
-আমার মা আমাকে বহু বিবাহ অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের শিক্ষা দেয়নি। আপনাকে বিবাহের পূর্বেই আমি জেনেছি আপনার প্রথম স্ত্রী আছেন। সবটা জেনেই বিবাহে আবদ্ধ হয়েছি আমি। আমার তালাক চাই না। আব্বাজান যেভাবে তার দুই সহধর্মিনীকে সমান অধিকার দিয়ে থাকছেন আপনিও সেটাই করতে পারেন। তাছাড়াও আপা আপনার প্রথম স্ত্রী। তাকে একটু বেশি মর্যাদা দেওয়া হবেই আমার তাতে কোনোরূপ অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি তালাক চাই না।

উপমার কথায় মনে মনে প্রসন্ন হলো ছায়া। সে এই উত্তরই আশা করেছিল উপমার থেকে। সোহরাব কিঞ্চিৎ অবাক স্বরে বলল,
-আপনি সবটা জেনে শুনে বলছেন তো উপমা।
-অবশ্যই। তবে একটা কথা, আমি আপনার প্রথম স্ত্রীর মতো ততো ভালো আর চাপা স্বভাবের মেয়ে নই। কাজ কাজের জায়গায় স্ত্রী স্ত্রীর জায়গায়। স্ত্রীদের স্ত্রীয় অধিকার থেকে আপনি বঞ্চিত করতে পারবেন না। এটা মাথায় রাখবেন।
থমথমে উপমার সবটা কথা শুনলো সোহরাব। এই মেয়ের কাজের সাথে কথাও ধারালো। মনে মনে ভাবলো সে। উপমার কথায় তাল মিলিয়ে ছায়াও বলল,
-জমিদারদের দুইটা তিনটা স্ত্রী হবেই কিন্ত তাঁদের সবাইকে সমান অধিকার দিতে হয়। উপমাকে নিয়ে আমারও কোনো অসুবিধা নেই। বরং আমার মন বলছে আমার শেষ জীবনে উপমাকেই আমার ভীষণ প্রয়োজন হবে!
-ঠিক আছে। আপনাদের কথাই রইলো। আমি যেহেতু আজই শহরে ফিরে যাবো তাই আপনার মনের কথা জেনে নিলাম উপমা। এখন তাহলে আসতে পারেন।
উপমা আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।

বিকাল থেকে কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হয়েছে। আশেপাশে গাছগাছালি ভয়ংকর ভাবে নড়ছে বাতাসে।দূর থেকে দেখলে মনে হবে আরেকটু হলেই বিশাল গাছগুলো ভেঙে পরবে। বিছানায় বসে দোয়াদুরুত পড়ছিলো তুলসী। আলাউদ্দিন কক্ষে প্রবেশ করে চিন্তিত হয়ে কিছু একটা খুঁজে চলছে। তুলসী আড়চোখে তাকিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে,
-কিছু খুঁজছেন?
-না। তুমি তোমার কাজ করো আমার কাজে নাক গলাতে এসো না।
-আমাকে বলুন আমি খুঁজে দেই।
রেগে যায় আলাউদ্দিন। চাঁপা স্বরে গর্জন করে বলল,
-মহিলা মানুষদের পুরুষের কাজে বা হাত না ঢুকালে হয় না নাকি! নিজের কাজ করো তুমি।
বিরক্তে মুখ বাঁকায় তুলসী স্বামীর এইসব বাণী তার নিত্যদিনের অভ্যাস এখন। তাই গায়ে লাগতে না দিয়ে আবারও বলল,
-তাহেরাকে বিবাহ দিচ্ছেন আপনার বন্ধুর ছেলের সাথে। যদি সে পুত্রও আপনার মতো হয় তাহলে যে আমার মেয়েটার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হয়ে আলাউদ্দিন তুলসীর দু’গাল চেপে ধরে নিজের বলিষ্ঠ হাত ধারা। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
-তোর মতো ছোটোলোক রে বিবাহ করে আমি কোনো বা’লটাও পাইনি সেখানে তোর মেয়ের রাজ কপাল আমার বন্ধুর ছেলের বউ হবে। আর যখন বিপদে পরি তখন আমার এই গোয়েন্দা বন্ধুই আমার কাজে আসেন। যদি তার সাথে আত্মীয় সম্পর্ক হয়ে যায় তাহলে আমার আর চিন্তাই নাই।
-ঐরকম দুর্নীতি কাজ করবেনই কেনো বিপদে পরবেনই বা কেনো? নিজ স্বার্থের জন্য আমার মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট করিয়েন না। পায়ে ধরি আপনের।
-মা”গীর জীর মুখ এখন বেশি চলছে দেখছি!কে রে পুত্রকে দুইটা বিবাহ করে, গৃহে দুইটা বউ এনে সাহস বেড়ে গিয়েছে নাকি?
তুলসী আর কিছু বলতে পারলো না। কারণ সে জানে বেশিকিছু বলতে গেলেই জুলুম শুরু। আলাউদ্দিন ছেড়ে দেয় তুলসীকে। পাঞ্জাবী ঠিক করে বলল,
-তোর যোগ্য স্থান হলো আমার পায়ের তলানিতে সেটা ভুলে যাস না। মুখে মুখে তর্ক করবি একদম মুখ ভেঙে দেবো।
_______________________
প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সোহরাব আর শহরে যেতে পারেনি। রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু কাগজপত্র দেখছিলো সে। সোহরাব খাওয়া শেষে কক্ষে আসার পূর্বে ছায়াকে বলেছিলো তার জন্য একটু আদার চা করে নিয়ে আসতে। এই প্রথম সোহরাব তার কাছে কিছু আবদার করলো। মনের মাধুর্য মিশিয়ে চা তৈরি করে নিয়ে আসেন ছায়া। মনের ভুলে সোহরাবের বিনা অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে ফেলে সে। সোহরাব কাগজ থেকে মুখ তুলে ছায়ার পানে তাকায়। ছায়া এগিয়ে এসে নিম্ন স্বরে বলল,
-ক্ষমা করবেন অনুমতি না নিয়েই এসে পরলাম।
-অসুবিধা নেই।
চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে ছায়া বলল,
-আপনার চা।
সোহরাব কাপটা নিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। ছায়া না দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সোহরাব নরম গলায় বলল,
-যদি আপত্তি না থাকে কিছুসময় আমার সাথে কাটাতে পারেন।
বুক ধকধক করে উঠলো ছায়ার। এলোমেলো হয়ে গেলো মস্তিক। নিজের আত্মসম্মানকে কিনারে রেখে বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে পরলো। হাত পা তিরতির করে কাঁপছে ছায়ার যেটা সোহরাব ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে। হাতের কাগজ দেখিয়ে বলে,
-আমার একটা রোগীর ক্যান্সার ধরা পরেছিল। তাকে পরীক্ষা করতে বলেছিলাম এটা তারই ফলাফল।
ছায়া নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছে না। তার একবার সরমে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে, নিজের আত্মসম্মানের কথা ভেবে এখানে থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে আবার সোহরাব তাকে কেনো এতো উপেক্ষা করে সেটা ভেবে সোহরাবকে ইচ্ছে মতো মারতেও মন চাচ্ছে। মনের সকল ভাবনা মনেই রেখে কাঁপাকাঁপি কণ্ঠে বলল,
-ওহ! আপনি কী মেয়ে মানুষেরও চিকিৎসা করেন?
-একজন ডাক্তারের কাছে কোনো নর-নারী নেই। সকলেই শুধুমাত্র রোগী।
-বুঝলাম। একজন ডাক্তার হওয়ার জন্যে তো আপনাকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। কিভাবে এতো পড়াশোনা করলেন? আমার তো পড়াশোনার প শুনলেও বিরক্ত লাগতো।
ছায়ার প্রশ্নে শব্দ করে হেসে ফেলে সোহরাব। ছায়ার নিজেকে বেকুব বলে মনে হলো। কিন্তু যখনই সোহরাবের স্বচ্ছ হাসিতে নজর পরলো মুগ্ধতায় ভরে উঠলো তার মন। বেহায়া চিত্ত ভিতর থেকে বলে উঠলো, “এই হাসি মিশ্রিত মুখটি দেখতে দেখতেই যেনো আমার জীবন শেষ হয়ে যায়।”
সোহরাব কোনোরকম হাসি থামিয়ে স্থির হয়ে বসে। মুখে গম্ভীর্যতা এনে বলল,
-আমার ছোটকাল থেকেই পড়াশোনার প্রতি এক অন্যরকম ভালোবাসা। আমার অনেক বেশি প্রিয় এক ব্যক্তির স্বপ্ন ছিল আমাকে তার মতোই ডাক্তার বানাবে। অতঃপর বড় হলাম তার স্বপ্ন পূরণই হয়ে উঠলো আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। ভালো লাগে আমার অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা দিতে।
-বাহ্! কে ছিল সেই প্রিয় ব্যক্তি?
-ছিলেন, ছিল আজীবন আমার মনে সে থাকবে।
ছায়া ভাবুক হয়ে বলল,
-ওহ আচ্ছা।
-জী। আপনিও যে এইরকম নির্বোধ প্রশ্ন করতে পারেন আমার ভাবনার বাহিরে ছিল!
ছায়া একটু লজ্জা পেলো। মনে মনে বলল,”আপনার এই অমায়িক হাসির জন্য আমি শতবার নির্বোধ হতেও রাজি অপ্রিয় জনাব। দুঃখিত আমার প্রিয় জনাব যে কখনই আমার অপ্রিয় হতেই পারে না। ”

সোহরাব আড়চোখে তাকালো ছায়ার পানে। কথার ফাঁকে অজান্তেই তার বার বার দৃষ্টিপাত হচ্ছে ছায়ার সাথে। মনে এক অস্থিরতা কাজ করছে। সব কিছুর উর্ধে সেও তো একজন পুরুষ। নিদিষ্ট একটা চাহিদা তো তারও আছে। কতকাল নিজের পুরুষত্বকে দমিয়ে রাখবে সে।
সোহরাবের বেসামাল দৃষ্টি দেখে গলা শুকিয়ে যায় ছায়ার। বেশিক্ষন সেই দৃষ্টির পানে তাকিয়ে থাকলে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বসবে সে। কম্পিত কণ্ঠে ছায়া বলল,
-আমি তাহলে এখন আসি।
ছায়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সামনে এক পা বাড়াবে পিছন থেকে সোহরাব তার একহাত চেপে ধরে। ছায়া বড় বড় নিঃশাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। পিছনে না ফিরেই ভয়াত কণ্ঠে বলল,
-আটকাবেন না আমাকে। আর বেশিক্ষন থাকলেই যে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
-স্বামীর সনিকটে আসায় যদি সর্বনাশ হয় তাহলে একটু সর্বনাশ নাহয় করলেন।

আজ আর ছায়া পারলো না সোহরাবকে ফিরিয়ে দিতে। বেহায়া মন হার মেনে নিলো। এক পা ও নড়লো না জায়গা থেকে। অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে এভাবে পেয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি ছায়া। বাহিরে ঝড়ের ভয়ংকর তান্ডব ভিতরে দু নর-নারীর নিঃশাসের। এক পর্যায় চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরলো ছায়ার। এতো দুঃখের পরও এই সুখটুকু যে তার নসিব হয়েছে এতেই সে নিজেকে ভাগ্যবতী বলে গণ্য করছে।
_______________________
অন্যদিকে রাত্রির আঁধারে বড় ঘোমটা দিয়ে বের হয়েছে উপমা। তার উদ্দেশ্যে সেই বদ্ধ কক্ষ। ভারী পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঙ্ক্ষিত কক্ষের দ্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে একটি চাবির গুচ্ছ। তুলসীর শাড়ীর আঁচল থেকে অতি কৌশলে চাবিরগুচ্ছ চুরি করেছিলেন তিনি। একে একে সবকয়টা চাবি দিয়ে তালা খোলার প্রয়াস করতে থাকে। বারান্দায় শেষ কিনারে বিশাল বড় একটি জানালা। বাহিরে ঝড়োয়া বাতাস, বজ্রপাত হচ্ছে। চারদিক আলোকিত করে বিজলি চমকাচ্ছে। একসময় একটি চাবি দিয়ে খুলে যায় তালা। চমৎকার হাসি ফুটে উঠে উপমার মুখে। যেই চাবি ধারা তালা খুলেছে সেটা শব্দ করে চুমু দেয়। অনেক বছর ধরে দরজা লাগিয়ে রাখার ফলস্বরূপ খোলার সময় অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতেই শব্দ করে খুলে যায় দরজা। ধুলোবালিতে কেশে উঠে উপমা। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে সামনে তাকায়। অন্ধকারে কিছুই নজরে পরলো না তার। মনের কোনে অজানা ভয়ও করছে তার। হাতে করে একটা মোম আর দিয়াশলাই নিয়ে এসেছিলো সে। খানিকটা সময় নিয়ে মোম ধরিয়ে মৃদু আলোয় ভিতরে পা রাখে। কেমন এক গন্ধ উপমার নাকে এসে বারি খেলো। জঘন্য গন্ধ! মোমের ক্ষীণ আলোয় উপমা স্পষ্ট দেখতে পেলো সোহরাবের কক্ষের মতোই এই কক্ষ। কক্ষের প্রত্যেকটি রাজকীয় আসবাবপত্রের ওপর ধুলো জমে আছে। এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলো। পুরো কক্ষে নজর বুলাতে যেয়ে তার আঁখিজোড়া আটকে যায় দুইটি দেয়ালচিত্রে। কম্পিত পা’জোড়া এগিয়ে নিয়ে যায় সেদিকে। প্রথম চিত্রে দেখা যাচ্ছে অনেক সদস্য নিয়ে একটা পারিবারিক ছবি। এতগুলো মুখের মধ্যে কয়েকটা মুখ উপমার কাছে চেনা মনে হলো। আলাউদ্দিন, তার ছোটভাই আর তুলসী এই তিনজনকে। ছবিটা যেসময় তোলা হয়েছে সেইসময় তারা বয়স্ক ছিলেন না মধ্যম ছিলেন। নিচে দাঁড়ানো পাঁচজন বাচ্চাকে দেখতে পেলো উপমা। তিনজন মেয়ে দুইজন ছেলে। একজন মেয়ে সবার বড় তারপর দুই ছেলে বাকি দুই মেয়ে একই সমান। উপমা হাত বাড়িয়ে চিত্রে উপস্থিত একজনকে স্পর্শ করলো। আঙুল ধুলোয় মেখে যায় তার। ওষ্ঠজোড়া থেমে থেমে কাঁপছে। কখন যে উপমার চোখ দিয়ে অশ্রুপাত শুরু হয়েছে সে নিজেও জানে না।
পাশ ফিরে দ্বিতীয় চিত্রে চোখ বুলায়। একটি সুখী পরিবার দেখতে পায় সে। স্বামী স্ত্রী আর তাঁদের দুই সন্তান। নিজেকে শক্ত রাখতে পারলো না উপমা। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে বড় নিঃশাস নেয়।কক্ষের সাথে লাগানো একটি ছোট বারান্দাও আছে উপমার জানা মতে। মোমের আলোয় ধীর পায়ে আগে বাড়তে নিবে আচমকা পিছন থেকে এক হাত তার মুখ চেপে ধরে। উপমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো। কৌশলে নিজ পা ব্যবহার করে লোকটার পায়ে লাত্থি দেয়। উপমাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে যায় লোকটা। মোম ততক্ষনে জমিনে পরে নিভে গিয়েছে। অজ্ঞাত লোকটা পুনরায় এগিয়ে এসে উপমার গলা চেপে ধরে নিজের দুই হাত দিয়ে। মাথার ঘোমটা সরে যায় উপমার। জানালা দিয়ে আসা বজ্রপাতের ক্ষীণ আলোয় উপমা দেখতে পায় সামনের জন আর কেউ নয় আলাউদ্দিনের ছোট ভাই সালাউদ্দিন।

মুহূর্তেই উপমা হিংস্র হয়ে উঠলো। শাড়ী ধরে পা দিয়ে লাত্থি দিলো সালাউদ্দিনের বুক বরাবর। ছিটকে পরে যায় সালাউদ্দিন। উপমার হিংস্র রূপ দেখে তার চোখে ভেসে উঠে অতীতের কিছু চিত্র। সেই হিংস্র চাহনি, সেই তেজি মুখশ্রী! অন্ধকারে হাতিয়ে আক্রমণ করার জন্য কিছু খুঁজতে থাকে উপমা। সালাউদ্দিন হো হো করে হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে বিকৃত মুখে চেঁচিয়ে বলে,
-মা”গী তোরে আমি ঐদিন কইছি না আমাগো বাড়ির ঝামেল্লা থেকা দূরে থাকবি!এতো বড় কলিজা কে তোর? মরার ভয় নাই তোর মনে?
-মরার ভয় তো আপনার নেই দেখছি!সেদিন রাত্রে আমি বলেছিলাম আমার বিষয় কিছু জানার চেষ্টা করবেন না। যেইদিন আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন সেদিনই আমার হাতে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত।
সালাউদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে উপমার চুলের মুঠি চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কুৎসিত ভঙ্গিতে বলল,
-বে”শ্যা মা”গীর জী কী ভাবছিলি তুই লুকাইয়া জমিদার গৃহে ঢুকবি আমরা কেউ তোরে চিনুম না। আমি জাইন্না গেছি তুই কে! এখনই আমি ভাইজানরে যাইয়া কইয়া দিমু। সোহরাবরে বানাইয়া কমু তুই আমাগো শত্রুর দলের মানুষ। তারপর দেখবি ওরা তোরে কী করে।
উপমা হাসলো। ভয়ংকর শব্দে করে হাসলো। জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো সালাউদ্দিনকে। একজন মহিলার মধ্যে এতো শক্তি কিভাবে আসলো!ভীত হয়ে পরলো সালাউদ্দিন তবুও প্রকাশ করলো না। অসুরের শক্তি অনুভব করলো উপমা নিজের মধ্যে। বিজলি চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সেই আলোয় উপমা কক্ষের খোলা বারান্দায় চলে গেলো দৌড়ে। মনে মনে ভয়ংকর খেলায় মেতেছে সে। সালাউদ্দিন উপমাকে ধরতে তার পিছু পিছু যায়। বারান্দায় কোনো ঘেরাও নেই। এখান থেকে ঠিক নিচে মাটির ভূমি।গাছপালা দিয়ে ভরা। সালাউদ্দিন তেড়ে এসে বলতে থাকে,
-মায়ের মতো হুদাই নিজের কষ্ট বারাইস না। ভাইজান তোকে ছাড়বে না।
উপমা কিছুই বলল। পাশেই একটা কাঠের তৈরি চেয়ার রাখা ছিল। সালাউদ্দিন তার নিকট আসতেই কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যে হিংস্রতায় গর্জে চেয়ার তুলে সেটা দিয়ে বারি মারে সালাউদ্দিনের মাথায়। নিজের মনের রাগ, শরীরের বল প্রয়োগ করে আঘাত করায় সালাউদ্দিন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে অসাবধানতায় বারান্দা দিয়ে নিচে পরে যায়।

বৃষ্টির তেজ আরো বেড়ে গেলো। উপমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো কয়েক ফোঁটা। পলকহীন নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো উপমা। পৌঁশাচিক আনন্দ অনুভব করলো সে। অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে শুধু দানব আকৃতির গাছগুলো ছাড়া। এলোমেলো কোঁকড়ানো কেশ পিঠ বুকে এসে ছড়িয়ে পরছে। আঁচল নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাওয়ায় ধুলছে কেশরাশি। বিধ্বস্ত উপমাকে এখন যে কেউ দেখলেই ভয় পেয়ে যাবে। সর্বাক্ষণ মাথায় ঘোমটা পরা কোমল নারীর এইরকম বীভৎস রূপও হয় সেটা ভাবার বাহিরে! বর্ষণের সাথে তাল মিলিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো উপমা।
-আম্মা।
অঝোরে কেঁদে উঠলো সে। বর্ষণের শব্দে ক্রন্দনধ্বনি চাঁপা পরে গেলো। বিড়বিড় করে উপমা বলল,
-যে প্রতিশোধের আগুনে আমি দিনরাত পুড়ছি সেই আগুনে একে একে সবাইকে পোড়াবো আমি। আজ থেকে শুরু হলো আমার র’ক্তের খেলা। নির্বোধ সালাউদ্দিন মির্জা! এই হাত কত শয়তানের প্রাণ নিয়েছে আর তুমি এসেছিলে এই আমি কে মারতে! তুমি তোমার পাপের শাস্তি পেয়ে গিয়েছো এবার তোমার আপনজনদের পালা। হুমাশা যে পর্যন্ত নিজে না চাইবে সে পর্যন্ত কারো সাধ্য নেই তার পরিচয় জানার।

>>>চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here