– দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া কী খুবই জঘন্য কাজ? আমি কী তাহলে ভয়ংকর কোনো পাপ করেছি? মানুষ নিজ স্বার্থের জন্য তো বহু পাপেই লিপ্ত হয় আমিও নাহয় তাঁদের দলেই রয়ে গেলাম!
মনে মনে উক্ত উক্তিটি বলল বিছানায় বসে থাকা নারী মূর্তি। কাঁচা ফুলে সজ্জিত কামরায় মোমের ক্ষীণ আলোয় লাল কারুকাজ করা দোপাট্টার আড়ালে এক নমণীয় মুখশ্রী ভেসে উঠেছে। হাঁটুভেঙে মাথা নিচু করে বসে আছে বিছানায়। দুনিয়ার যাবতীয় চিন্তা জানো তার মস্তিকে খেলছে! বেশ কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে নবস্বামীর অপেক্ষায়। তবুও করো আসার নামগন্ধও নেই! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে মাথার দোপাট্টা সরিয়ে ফেলে রমণী। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে কামরার সবগুলো মোম নিভিয়ে দেয়। মুহূর্তেই আঁধারে ঢেকে যায় সর্বত্ব। পশ্চিম পাশের জালানা দিয়ে আসা উজ্জল চাঁদের আলোর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বিছানায় শুয়ে পরে সে। এক দৃষ্টিতে মাথার ওপর চলন্ত বৈদুতিক পাখার পানে তাকিয়ে ভাবতে থাকে নিজের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা।
– আমি উপমা। আমি এবং আমার মা এই গ্রামেই থাকি। আমার বাবা মারা গিয়েছে আরো বছরখানেক আগে। আমার মা গ্রামেরই একটি স্কুলের শিক্ষিকা। এই স্বার্থপর দুনিয়ায় মা ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই। আজ আমার বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে। এটাকে বিবাহ নয় শুধু চুক্তি বলে হয়তো! আমার থেকে তাঁদের চাওয়া পাওয়া শুধু তাঁদের বংশধর তারা পুত্রবধূ চায় না। শুনেছি গ্রামের জমিদার নাকি আমার শশুর। অনেক নামডাক তার! ভীষণ ভালো মানুষ তাই সবাই অনেক শ্রদ্ধা করেন তাকে। আমার শাশুড়ি গ্রাম্য মেলায় প্রথম আমাকে দেখেছিলেন কিছুদিন আগে। তার মনে ধরে আমাকে তাই তো পরেরদিনই আমাদের বাসায় আমার জন্য বিবাহের প্রস্তাব দেন। আমার মা রাজি ছিলেন না। তার মেয়ে কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হোক এটা কোনো ভাবেই মা মানতে পারছিলেন না। আমার মা আবার অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। তার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার কি হবে এইসব ভেবে শেষে উপায় না পেয়ে বিবাহের পিঁড়িতে বসতে হলো আমায়। স্বামী নামক মানুষটিকে আমি এখন পর্যন্ত দেখিনি। সত্যি বলতে দেখার ইচ্ছে প্রসনও করছি না। আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে এই অন্দরমহলে পা রেখেছি ভাবতেই কেমন জানো অস্থিরতা কাজ করছে।হয়তো আমিই একমাত্র নারী যে নিজ ইচ্ছায় নিজের বাকি জীবন কুরবান করে দিয়েছে! আমার সতীন, আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রীকে এক পলক দেখার ভীষণ ইচ্ছে আমার।
ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে ঢোলে পরে উপমা। বেনুনী করা কেশগুচ্ছ বিছানার এক পাশে পরে থাকে অবহেলায়। লাল পাড়ের সাদা শাড়ী অন্ধকার রাজ্যেও জানো চাঁদের আলোর মতো কিরণ ছড়াচ্ছে। হতেও পারে এই আঁধার উপমা নামক রমণীর জীবন থেকে সকল আঁধারকে সাথে করে নিয়ে যাবে! দিয়ে যাবে এক আলোকৃতময় প্রভাত!
__________________
অন্ধকারে আচ্ছন্ন পুরো অন্দরমহল। দক্ষিণ দিক থেকে গুনগুন এক ভোতিক শব্দ ভেসে আসছে। জানো কোনো অশুভ আত্মা নিজের বহুদিনের কষ্ট উজাড় করছেন! সুবিশাল কামরায় এলোমেলো অবস্থায় জমিনে হাঁটুমুড়ে বসে আছে এক ব্যক্তি। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিটি হলো এক নারী মূর্তি। জমিনে ছড়িয়ে আছে কেশমুঠি ও গায়ে জড়ানো শাড়ীর আঁচল। নিঃশাস আটকে যাচ্ছে কান্নার কারণে তবুও থামার নাম নেই। এক সময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মৃদু স্বরে বিড়বিড় করে বলে,
– কেনো আমার সাথে এমন করলেন খোদা? কার ক্ষতি করেছিলাম আমি? কোন দোষের এত বড় শাস্তি আমাকে দিলেন? আমি যে সহ্য করতে পারছি না দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তাকে আমি ভালোবাসি আর কেউ জানুক বা না জানুক আপনি তো জানেন? সে আমাকে কেনো কোনোদিনও ভালোবাসলো না? এতদিন তাও সে শুধু আমার ছিল সেটা ভেবেই আমি ভীষণ সুখী ছিলাম কেনো আমার সুখ ছিনিয়ে নিলেন আপনি?
আঁখিজোড়া বন্ধ করে বড় বড় নিঃশাস নিতে থাকে রমণী। কান্না গুলো তীব্র ধাক্কা দিচ্ছে বুকে। হাত পা শিরশির করছে। বেশিক্ষন বসে থাকতে পারলো না সে। সহসা জমিনে মাথা এলিয়ে দিলো। আঁখিজোড়া বন্ধ রেখেই ফুঁফাতে ফুঁফাতে বলল,
– আপনার জীবনে এক কেনো হাজারো নারী আসলেও আমার ভালোবাসার এক বিন্দুও তারা বাসতে পারবে না সোহরাব মির্জা। আপনি আমার জীবনের শ্রেষ্ট প্রিয় আর আমি আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ অপ্রিয়! হ্যাঁ, আমিই সেই নারী যে নিজের অজান্তেই এক সুদর্শন পুরুষের প্রেমে উম্মাদ হয়ে ত্যাগ করেছি নিজের জীবনের সর্বসুখ।
_________________
গ্রামের অভ্যন্তরে জমিদার সালাউদ্দিন মির্জা তার সহ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ছেলে মেয়ে মিলিয়ে ছয় সন্তানের পিতা সে। প্রথম স্ত্রী তুলসী। তার গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে চার মেয়ে ও এক পুত্র। তুলিকা মির্জা, সোহরাব মির্জা, তাহসিয়া মির্জা , তাহেরা মির্জা , সাইফা মির্জা। তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাইয়েরা এক ছেলে সন্তানের মাতা। ইয়ামিন মির্জা তার নাম। ক্ষমতাবান ও রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ সালাউদ্দিন। নিজ কর্ম ও নিজ দায়িত্বের প্রতি দৃঢ় কঠোর সে। তার ক্ষমতার কাছে পরিবার পরিজন সব কিছুই জানো তুচ্ছ! একমাত্র আদরের পুত্র সোহরাব মির্জা তার কাছে পুরো দুনিয়া সমতুল্য। মেয়ে সন্তানের পর অধয্য হয়ে পরে সালাউদ্দিন ঠিক তখনই জন্ম হয় সোহরাবের। অত্যাধিক আদর দিয়ে নিজ মতো করে গড়ে তুলেছেন পুত্রকে। সালাউদ্দিনের এক ভাই ও এক বোন আছে। ভাই আলাউদ্দিন মির্জা। দুই মেয়ে তার। রোমানা আর রুমকি। বোন তারিনাকে শহরে বিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু ভাইদের অতি আদরে বেশিরভাগ সময়ে বাবার বাসায়ই থাকেন। এক পুত্র তার। বাহির থেকে দেখতে জমিদার বাড়ি যেমন সুখী পরিবার ভিতর থেকেও জানো এক সত্যি সুখী পরিবার। হয়তো শুধু অসুখী ছায়া আর তুলসী মির্জা!
ভোরের আলো ফুটতেই হৈচৈ লেগে পড়েছে জমিদার বাড়িতে। রসইকক্ষে রান্নার জড়তর। বাড়ির আনাচে কানাচে পরিষ্কার করতে নেমেছে গুঁটি দুইয়েক ভৃত্য। জমিদার বাড়ির বউরা নিজ হাতে রান্না করতে পছন্দ করেন। তাঁদের মতে খাবারের স্বাদ তখনই দ্বিগুন হয় যখন বাড়ির কর্তিরা নিজ হাতে রান্না করে। এখন রসইকক্ষে নাস্তার আয়োজন করছেন তুলসী ও আলাউদ্দিনের স্ত্রী মিনা। বাড়ির বাহিরে রাজ্যত্ব জমিদারের আর বাড়ির ভিতরে রাজত্ব তাঁদের। সংসারের প্রত্যেকটা কাজ তুলসী মির্জার হুকুমেই সম্পূর্ণ হয়।
-তুলি গরম পানির কলসিটা এগিয়ে দে। বাড়ির আরো সদস্য কোথায়? বেলা পরে যাচ্ছে অথচ এক এক নয়াব-জাদিদের ঘুম ভাঙ্গে না নাকি!
রনরণে কণ্ঠে কথাটা বলে তুলসী। কঠোর মুখভঙ্গি করে আটা মতছে আর কিছু একটা বিড়বিড় করছে। তুলি ও ফাতুসি বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক। দুইজনই কম বয়সী। রসইকক্ষের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব তাঁদের। তুলি কাঁচুমাচু হয়ে এক কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস হচ্ছে না তার। ফাতুসি আবার চঞ্চল স্বভাবের। জমিনে বসে সবজি কাঁটতে কাঁটতে এক ফাঁকে বলে উঠে,
-ছোডু মুখে বড়ো কথা কিছু মনে কইরেন না আম্মাজান কিন্তু ভাবিজান আর ফুবুজান তো প্রতিদিনই মেল্লা দেরি কইরা উডে! হেরা চায় আফনেরেই বান্দী বানাইয়া কাম করাইতে।
কথা শেষ করে জিভ কামড় দিয়ে উঠে ফাতুসি। কি বলে ফেললো নিজের কপাল নিজেরই চাপড় দিতে ইচ্ছে করছে তার। তুলসী কিছুক্ষন চুপচাপ থাকলো। পরমুহূর্তে শাসানো কণ্ঠে বলল,
-তুই মুখ বন্ধ রাখ ফাতু। আমার কাজে সাহায্য কর মাথায় বিষ ঢুকাতে না। আর তুলি বড় বউরে ডেকে আন।
-আইচ্ছা আম্মাজান।
তুলি তাড়াহুড়া করে রসইকক্ষ থেকে বের হতে যাবে আচমকা কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে যায়। সামনে না দেখে কোমর ধরে বিলাপ স্বরে বলে,
-ওমাআ গো! আমার কোমর ভাইঙ্গা গেলো গো! আম্মাজান আমি আর দাঁড়াইতে পারবাম না গো। মইরা গেলাম গো!
তুলসী সহ উপস্থিত সকলে বিরক্ত হলো। ধমকের স্বরে তুলসী বলল,
-নাটক বন্ধ করে উঠে দাঁড়া।
তুলি চট করে আঁখিজোড়া খুলে ফেলে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে দেখে দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়ায়। মুখে হাঁসি ফুঁটিয়ে বলে,
-আফনেরেই ডাকবার গেতাছিলাম ভাবিজান।
প্রতিউত্তরে ছায়া অর্থাৎ সোহরাব মির্জার প্রথম স্ত্রী কিছু বলল না। উনুন থেকে গরম পানির কলসি অতি সাবধানে জমিনে নামিয়ে রাখলো। মাথা থেকে আঁচল সরে যাওয়ায় সেটা পুনরায় ঠিক করে তুলসীর সাথে রুটি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরল। তুলসী আড়চোখে ছায়ার পানে তাকায়। ধবধবে মুখশ্রী ফুঁলে আছে। আঁখিজোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হয়তো রাতে কান্না করেছে! কাজের ফাঁকে ছায়া গম্ভীর কণ্ঠস্বরে তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– গরম পানির কলসিটা তোর বড় ভাইজানের কক্ষে দিয়ে আয়।
-প্রতিদিন না আফনে দিয়া আহেন ভাবিজান আইজ আমি যামু!
বেখেয়ালি কথাটা বলে ফেলে তুলি। ছায়া কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করল না। পুনরায় একই কণ্ঠে বলল,
-যেটা বলেছি সেটা কর।
-আইচ্ছা।
তুলি যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তার আগেই রুটি ভাজতে ভাজতে তুলসী বলে,
-আসার সময় তোর ছোট ভাবিকে নিচে আসতে বলিস।
-ছোডু ভাবি? ওহ হো! আইচ্ছা ডাইকা দিমু নে।
বড় ভাইজানের কক্ষে কলসি দিয়ে এসে তুলি ছোট ভাবি অর্থাৎ উপমাকে যে কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায়। খানিকটা বিরক্ত হয়ে কক্ষের দরজায় বারি দেয়। দুই তিনবার বারি দেওয়ার পর দরজা খুলে যায়। কক্ষে প্রবেশ করে তুলির সর্বপ্রথম নজর পরে ফুলে সজ্জিত অগোছালো বিছানার ওপর। বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উপমা। সাদা রঙের লাল পাড়ের শাড়ীটা এলোমেলো হয়ে অর্ধেক জমিনে পরে আছে। তুলি মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে উপমার স্মুখীন দাঁড়ায়। উপমাকে তার অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছে। গ্রামে সাধারণত এতো লম্বা মেয়ে কমই দেখা যায়। গালে হাত দিয়ে ভাবুক স্বরে বলল,
-আফনে তাইলে বড় ভাইজানের ছোডু গিন্নি?
উপমা নিঃশব্দে শুধু তাকিয়ে থাকল তুলির পানে। কতই বা বয়স হবে মেয়েটির? হয়তো ষোলো কী সতেরো কিন্তু আচরণ মুরুব্বিদের মতো!
-কী হইলো কন আফনেই কী ছোডু ভাবি?
-আপনার নাম কী?
-আমার নাম হইলো তুলি। আফনে আমারে তুই বইলাই বুলাইতে পারেন।
-ঠিক আছে।
-আফনের শাশুড়ি আফনেরে তৈয়ার হইয়া নিচে গেতে কইসে।
উপমা হালকা মাথা নাড়ালো। কিছু বলতে চেয়েও দ্বিধায় বলতে পারছে না। তুলি উপমার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-কিসু কইবেন? কিসু লাগবো আফনের?
-আমাকে পড়ার জন্য একটা শাড়ীর ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?
তুলি জানো অবাক হলো উপমার কথায়। বিস্মিত নয়নে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আলমিরার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,
-ওইটার ভিতরে জামা আছে।
-ওহ! ঠিক আছে।
তুলি চলে যায়। উপমা ধীর পায়ে আলমিরা খুলে সবুজ রঙের একটি শাড়ী নিয়ে পরে নেয়। কিন্তু এখন মুখ কিভাবে ধোঁত করবে! কামরায় কোনো গোসলখানা নেই। ভোর সকালে জানালা দিয়ে সে মহলের বাহিরে একটা বাঁধানো পুকুর দেখেছিল। কিছু সংখ্যক মহিলা কাজ করছিল। হয়তো সেখানে যেয়েই মুখ ধুতে হবে। উপমা বড় একটি নিঃশাস নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পরে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বিশাল বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির স্মুখীন এসে দাঁড়ায়। শাড়ীর কুচি ধরে এক পা দু পা করে নিচে নামছে। উপমার জানা মতে এই বাড়ির সদস্য সংখ্যা অনেক তবুও এতো নির্জন নীরব কেনো?
শেষ সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামার পূর্বেই তুলসী ছুটে আসে উপমার কাছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক পরোক্ষ করে শান্ত স্বরে বলে,
-আমার সাথে এসো ছোট বউ।
উপমা মাথা নাড়িয়ে টু-শব্দ না করে তুলসীর পিছু পিছু চলতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে উপমার পানে তাকায় তুলসী। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে জিগ্যেস করে,
-তোমার স্বামী কাল রাতে তোমার কক্ষে গিয়েছিল কী?
-না।
উপমার উত্তর শুনে নিরাশ হলো তুলসী। বাড়িতে বাঁধানো দুটি পুকুর। একটায় মহিলাদের গোসলের ব্যবস্থা করা আরেকটায় পুরুষদের। পুকুর পাড়ে আসতেই মাথা তুলে সামনে তাকায় উপমা। তুলসী আদেশ স্বরে বলে,
-জমিদার বাড়ির মেয়ে বউরা এখানে গোসল করে। এখন তুমি মুখ হাত ধুঁয়ে রসইকক্ষে এসে আমাকে সাহায্য করো।
-জি।
-আমাকে সবাই আম্মাজান বলে ডাকে তুমি ও সেটাই বলো।
-ঠিক আছে আম্মাজান।
তুলসী চলে যায়। পা থেকে জুতোজোড়া খুলে নরম পায়ে ঘাটে যায় উপমা। আশেপাশে তাকিয়ে মাথা থেকে আঁচল সরিয়ে ফেলে। পানির দিকে হালকা ঝুঁকে বসে। দুই হাতের মুঠো ভরে পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে, হাত-পা ও ধুয়ে নেয়। আঁচল টেনে মুখশ্রী মুছে নেয়। মসলিন কাপড়ের শাড়ী পরিহিত সে। হাতে এক জোড়া স্বর্ণের ভারী বালা। বিয়ের দিন তুলসী তাকে এই বালা সহ পাথরের নাকফুল দিয়েছিল। কিছুক্ষন হাতের বালায় চোখ বুলিয়ে সামনে এগোয়। বড় ঘোমটা দিয়ে অন্দরের ভিতরে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে ছুটে আসে দুইজন অচেনা মেয়ে। উপমা আন্দাজ করল একটি মেয়ে তার বয়সী আরেকজন দশ বারো বছরের হবে। দুইজনের চোখ মুখে চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়ছে জানো! রমণী জড়িয়ে ধরে উপমাকে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
– আসসালামু ওলাইকুম ছোট ভাবিজান।
– ওলাইকুম আসসালাম।
– আমি আপনের তিননম্বর ননদ। আমাকে তাহেরা বলে ডাকতে পারেন আর ও হলো ছোট আব্বার মেয়ে আপনের আরেক ননদ রোমানা।
উপমা ওপর নিচ মাথা নাড়ালো। তাহেরা উপমার থুতনি ধরে মাথা উঁচু করে পুরো মুখে নজর বুলিয়ে প্রশংসনীয় কণ্ঠে বলে,
– মাশাআল্লাহ! আমার আম্মাজানের পছন্দ আছে বলতে হবে!
উপমা কিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে পারল না। উপমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাহেরা তার হাত ধরে টেনে রসইকক্ষে নিয়ে যায়। একটার পর একটা কথা বলছে সে। উপমা ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে। এতো জলদি কেউ কিভাবে একজন অচেনা মানুষের সাথে এতো মিশে যায়!
রসইকক্ষে পা রাখতেই তুলসী আড়চোখে উপমার দিকে তাকায়। তাহেরা উপমাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। উপমা মাথা উঁচু করে লক্ষ্য করল কয়েকজন নারী মিলে কাজ করছে একসাথে। তার শাশুড়ির সাথে দুইজন মধ্যবয়স্ক মহিলা রুটি বানাচ্ছে আর একজন ভাঁজছে, দুইজন রমণী জমিনে বসে সবজি কাটছে, আরেকজন রমণী মাংস রান্না করছে যেটার সুবাসে রসইকক্ষ মৌ মৌ করছে!
-ছোট বউ এসো। আজ রসইকক্ষে তোমার প্রথমদিন তাই দুপুরের রান্নাটা সম্পূর্ণ তুমি রাঁধবে।
শাশুড়ির কথায় ধেন ভাঙে উপমার। দ্রুত পায়ে তুলসীর কাছে এগিয়ে যায়। মৃদু স্বরে বলল,
-ঠিক আছে আম্মাজান।
তুলসীর মুখে হাসি ফুটে। রসইকক্ষে উপস্থিত সকলের সাথে উপমার পরিচয় করিয়ে দেয় শুধু ছায়া বাদে। অতঃপর ছায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
-বড় বউ আমি চাই ছোট বউকে তুমি তোমার অবিকল বানাবে। ও এই বাড়িতে নতুন! বাড়ির নিয়মকানুন সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিবে তাকে।
-জি আম্মাজান।
উপমা বুঝতে পারে এই রমণী তার সতীন। নিস্পলক কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল সেদিকে। রান্নাবান্না শেষ হলে সকলে ব্যস্ত হয়ে পরে খাবার টেবিলে খাবার সাজাতে। উপমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে। একে একে বাড়ির পুরুষদের আগমন ঘটলো। বড় ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকালো বাড়ির বউরা।
উঁচ্চালম্বা বলিষ্ঠ দেহের মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ বসতেই তার সাথে বাকি পুরুষরাও বসে পরে। স্বাস্থবান, আধো পাঁকা চুল, মুখে গম্ভীর ভাব ইনি হলেন উপমার শশুর সালাউদ্দিন মির্জা। পাশেই বসা তার ছোট ভাই আলাউদ্দিন। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে পুরুষদের খাওয়া হলে তারপর মহিলারা নিজ নিজ খাওয়া শেষ করেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব ঠুকিয়ে তাহেরা উপমাকে তার কামরায় নিয়ে যায়। কামরা ভর্তি মানুষ দেখে বিচলিত হয়ে পরে উপমা। তাহেরা তাকে ধরে বিছানার এক পাশে বসিয়ে দেয়। সকলে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে উপমার দিকে। একজন তো বলে উঠলো,
-আমাদের ছোট ভাবিজান অনেক সুন্দরী!
-চুপ করো ইয়ামিন ভাই।
তাহেরার কথায় মুখে আঙুল দিয়ে চুপটি করে বসে থাকে ইয়ামিন নামের ছোট বালক। তাহেরা একে একে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় উপমাকে। তুলিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে সে এখন তার শশুরবাড়িতে আছেন। তাহসিয়া একটু অন্য ধাঁচের মানুষ। পরিবারের সকলের অমতে গিয়ে শহরে থেকে ডাক্তারি পড়ছে সে। তাহেরা মেটিক পাস করে আর পড়াশোনা করেনি। সাইফা ও রোমানা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ইয়ামিন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আর রুমকি এখনও ছোট তাই পড়াশোনা করে না। তাছাড়াও তাঁদের পরিবারে কে কে আছে সেটাও বলে তাহেরা। উপমা প্রথমে একটু অস্বস্তি অনুভব করলেও ধীরে ধীরে তার সবাইকে ভীষণ ভালো লাগে। তাহেরা খুব জলদিই তার সখি হয়ে উঠে। সবার বিষয় জানার পরও উপমার একবারও ইচ্ছে জাগলো না স্বামীর নামক মানুষটির বিষয় কিছু জানার। সকালে নাস্তা করার সময়ে দেখেনি তাকে। তাহেরা কথায় কথায় একসময় বলে,
-ছোট ভাবিজান ভাইজানের সাথে দেখা হয়েছে আপনের?
উপমা খানিক সময় নিয়ে দুপাশে মাথা নারায়। তাহেরা বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে বলল,
-কি বলেন! কাল যাকে বিবাহ করলেন আজও তাকে দেখলেন না?
উপমা কথা পরিবর্তন করে তারা দেখিয়ে বলে,
-আমাকে আম্মাজান দুপুরের রান্নার দায়িত্ব দিয়েছে তাহেরা আপা আমি নাহয় এখন আসি।
-ঠিক আছে। আর আমাকে শুধু তাহেরা বলবেন। আপা আমার বড় দুইজনকে বলিয়েন ভাবিজান।
উপমা স্মিত হেসে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। আঁচল দিয়ে ভালো মতো মাথা ঢেকে সামনে এগোয়। এতো বড় মহলের মতো বাড়ি কোন দিক রেখে কোন দিন যাবে ভেবে পায় না উপমা। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই অসাবধানতার কারণে শাড়ীর সাথে পা লেগে জমিনে পরে যেতে নেয় সে। কোনোরকম দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেয়।
পিছনে ফিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে খুশি হয়ে বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। কত লজ্জাজনক বেপার! কারো চোখে পরলে সরমে মরে যেতে হতো ভেবেই সামনে তাকায় উপমা। ক্ষণেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় তার। মুহূর্তেই কয়েক পলক ফেলে পুনরায় তাকায়। অচেনা একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে উপমার থেকে ঠিক সাত হাত দূরে। গাঢ় দৃষ্টি তার উপমাতেই নিবদ্ধ। রুদ্ধদার অবস্থা জানো! উপমা আর দাঁড়ালো না। শাড়ীর আঁচল ধরে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মুখ গোমড়া করে বিরক্তের উঁচু সীমায় পৌঁছে উপমা মনে মনে বলল,
-কেমন নির্লজ্জ পুরুষ বাবা! একজন অচেনা বেগানা নারীর পানে কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকে! কী ভয়ংকর চাহনি তার! স্রষ্টা এইরকম পুরুষের স্মুখীন আর আমাকে নিও না দোয়েয়া করে।
<<<চলবে? #অপ্রিয়_জনাব #Mehek_Enayya(লেখিকা) #সূচনা_পর্ব