#নিশীভাতি
#৪৭তম_পর্ব
“হুমায়রা?”
পেছনে চাইতেই থমকে গেলো হুমায়রা। তার বিস্ময় বাড়িয়ে যুবাইদা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। হুমায়রা স্তব্ধ হয়ে রইলো। হতভম্ব চেয়ে রইলো যুবাইদার দিকে। তার মুখশ্রী হাসিহাসি। হুমায়রা মুখে অগণিত চুমু আকলো সে। যা হুমায়রাকে আরোও অবাক করলো। যে যুবাইদাকে সে চিনে সে তাকে পছন্দ করে না। সর্বদা অবজ্ঞা এবং অবহেলাই যুবাইদা থেকে পেয়েছে সে। অথচ সেই যুবাইদার সাথে আজকের যুবাইদাকে মেলাতে পারছে না হুমায়রা। যুবাইদা হাসি হাসি কন্ঠে শুধালো,
“কেমন আছোসছোস রে মা?”
হুমায়রা উত্তর দিলো না। শুন্য দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইলো। যুবাইদা হুমায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“কত্ত হুন্দর হইয়্যা গেছোস! তোরে এইহানে দেখুম হপ্নেও চিন্তা করি নাই! কেমন আছে আব্বা- আম্মা? আর রাশাদ ওয় কেমন আছে? আর তোর বাপ! হের কি অবস্থা?”
“কি চাই আপনার?”
হুমায়রার থমথমে প্রশ্নে যুবাইদা ধাক্কা খেলো। এতোসময়ে ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা হাসিটা মিলিয়ে গেলো। অপরাধবোধের তীব্র ছায়া উঁকি দিলো তার শুভ্র মুখখানায়। দৃষ্টি নত হলো। মলিন হেসে বললো,
“কি চামু আর! হুট কইরা তোরে দেইখ্যা নিজেরে আটকাইতে পারি নাই। তোরা আমার উপর রাইগ্যা আছোস তাই না? কামডাই আমি এমন করিছি!”
হুমায়রার হাতজোড়া ধরেই অনুশোচনার বৃষ্টি টপটপ করে পড়তে লাগলো যুবাইদার চোখ থেকে। ঠোঁট চেপে কান্না দমানোর বৃথা চেষ্টা করলো সে। আজ তার স্পর্শেও মমতা অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু এই অনুভূতিগুলো মেকি নাকি স্বচ্ছ বুঝতে পারলো না হুমায়রা। হাতটা ছাড়িয়ে দিলো সে। গম্ভীর কন্ঠে শুধালো,
“ভালোই আছেন দেখছি। তাহলে পুরোনো কথা বলে কি লাভ! যেহেতু পিছুটান ছিড়ে একবার চলে গেছেন সেহেতু এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই”
“আমি জানি, কইলেও তুই বিশ্বাস করবি না আমার কতা। কিন্তু আমি ভালা নাই রে মা। একদম ভালা নাই। প্রত্যেকটা সময় জ্বলছি খালি! যখন মনে হইছে নিজের কামডার কথা, তখনই লজ্জা, হরমে মইরে যাতি মন চাইছে”
“হাসালেন!”
ভৎসনার স্বরে কথাটা বললো হুমায়রা। তার চোখে মুখে তীব্র ঘৃণার ছাপ। তার বিরক্ত লাগছে। রাগে গা কাঁপছে। হুমায়রার সচারাচর রাগ হয় না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সে নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখে। অথচ আজ যেন সব লাগামছাড়া হতে যাচ্ছে। অনুভূতিগুলো তীব্র বিস্ফোরণ ঘটাতে চাইছে। তীব্র স্বরে শুধালো,
“নিজের সুখের লোভে আমাদের জীবনে ঝড় তুলে তো চলে গিয়েছিলেন, তাহলে কেনো অসুখী থাকার মিথ্যে নাটক করছেন? কিসের লজ্জা, কিসের শরম! আমার বিয়ের দিন সকালে অন্য মানুষের হাত ধরে পালিয়ে যাবার সময় তো মনে ছিলো না আপনার। আপনি সুখী হতে চেয়েছিলেন। একটি বার কি ভেবেছিলেন! ভেবেছিলেন আপনার একটা কাজে আমাদের জীবনটা কেমন হবে! দাদা, ভাইজান, দাদীকে কতটা অপমানিত হতে হয়েছে। এখন লজ্জা, শরমের কথা বলছেন!”
যুবাইদা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অথচ হুমায়রার কষ্ট হচ্ছে না। বরং কুঠুরি বদ্ধ থাকা প্রশ্নগুলোর প্রকাশে হৃদয়খানা হালকা লাগছে। হুমায়রা আর দাঁড়ালো না। যাবার জন্য তৎপর হলো। ঠিক তখনই যুবাইদা বলে উঠলো,
“আমি সুখের লাইগ্যা পালাই নাই রে মা, আমি পালাইছিলাম বাঁচার জন্য।”
কথাটা শোনামাত্রই হুমায়রা দাঁড়িয়ে গেলো। বিমূঢ় নয়নে চাইলো। যুবাইদা এখনো কাঁদছে। হুমায়রার হাতখানা কাঁপা হাতে ধরলো সে। দলা পাকানো স্বরে বললো,
“দম বন্ধ হইয়্যা গেছিলো। তোর বাপের অত্যাচারে আমি শ্বাস লইবার মারতেছিলাম না। আমার যত গয়না, টেহা ছেলো সব ওয় জুয়োতে উড়াইছে। তার পরও যদি একটু ভালোবাসতো। কি পাষানের মতো মারতো আমারে। সেইদিনও একই কাম করিছিলো। ওর লোভ ছেলো তোর গয়নার উপর। আমি ওইডি নিতে দেই নাই বইল্যা কি মাইর। তারপর কইছে, যদি আমি বেশি কতা কই হক্কলরে কইয়্যা দিবে….”
কথাটা বলেই থেমে গেলো যুবাইদার হুশ ফিরলো। নিষিদ্ধ এবং গোপনীয় কিছু ফাঁস হয়ে যাবার ভয় পরিলক্ষিত হলো। হুমায়রা শুধালো,
“কি বলে দিবে আব্বা?”
“কিছু না”
“যা বলছিলেন তা শেষ করুন। আমি জানতে চাই আপনি কেনো পালিয়েছেন!”
যুবাইদা তার শুষ্ক ঠোঁটখানা সিক্ত করলো। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“কাওছারের মাইরে অতিষ্ট হইয়্যা পালাইছি আমি”
“পালানোর জন্য আমার বিয়ের দিনকে বাছলেন তাই তো। আমার বিয়ের জন্য গড়ানো গহনা শুদ্ধ! দারুণ! আসলে কি জানেন! আমার মনে না অনেক প্রশ্ন ছিলো। জানার আকাঙ্খা ছিলো। আপনি আমাকে এতোটা ঘৃণা করেন কেন? আমার প্রতি এতোটা ক্ষোভ কেনো আপনার? কিন্তু আজ যখন আপনাকে এতো মাস পর সামনে দেখছি আমার কিচ্ছু জানতে ইচ্ছে করছে না। বরং আমার আপনার সাথে কথা বলতেও বিরক্ত লাগছে। আমি জানি না, এতোমাস পর কেনো আপনি এতো ভালো আচারণ করছেন! কিন্তু আমার জীবনে সত্যি আপনার প্রয়োজন নেই। আপনি সুখে থাকুন। আপনার নতুন সঙ্গীকে নিয়ে”
“আমি কহনো তোরে ঘেন্না করি নাই রে হুমায়রা। বিশ্বাস যা। আমি তোরে ঘেন্না করি নাই”
হুমায়রা দাঁড়ালো না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। পাজোড়া অসাড় হয়ে আসছে। বুকটা ভারী হয়ে আছে নিগূঢ় বিষাদমেঘে। কখন সেই বিষাদমেঘ গলে অশ্রুবর্ষণ হবে জানা নেই। তবে এখান থেকে প্রস্থান করাই শ্রেয়। যুবাইদা কাঁদছে। হুমায়রা একবারও ফিরে চাইলো না। কারণ নিজেকে চিনে সে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার লোভে দূর্বল হয়ে যাবে সে। তখন আবার বোকা।হয়ে ঠকে যাবে।
*****
রাশাদ ফিরলো আজ তাড়াতাড়ি। মিঠুর উপর সব দায়িত্ব দিয়ে নয়টার মধ্যেই ঘরে ফিরলো সে। কলপাড়ে হাত মুখ ধুয়েই ছুটলো ঘরে। ইলহার ফোন রাখার পর থেকেই মনটা আকুপাকু করছে। ইলহা কি বলবে সেটা জানার কৌতুহলে তার মন বিচলিত। ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো ইলহা বিছানায় বসে আছে। মেয়েটি আজ শাড়ি পড়েছে। গোলাপি রঙ্গের শাড়ি। শাড়িটা রাশাদ তাকে মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলো। মেয়েটি শাড়িটি পেয়ে বেশ খুশি হয়েছিলো। সযত্নে তুলে রেখেছিলো আলমারীতে। রাশাদ শুধালে বলেছিলো,
“এটা তোলা থাক। বিশেষ দিনে পড়বো”
তবে কি আজ বিশেষ দিন। রাশাদ বড় বড় পা ফেলে তার কাছে গেলো। হাটু গেড়ে ইলহার সম্মুখে বসলো সে। অস্থির স্বরে বললো,
“বলুন, কি কথা?”
রাশাদ হাপাচ্ছে। তার হৃদস্পন্দন তীব্র। ইলহা হেসে বললো,
“এতো অস্থিরতা!”
“আহ! বলুন না কি কথা?”
“দাঁড়ান”
বলেই সে বালিশের নিচ থেকে একজোড়া ছোট্ট কাপড়ের জুতো বের করলো। জুতোগুলো খুব ই ছোট্ট। রাশাদের সম্মুখে জুতোজোড়া রেখে বললো,
“প্রস্তুত হয়ে নিন, ইনশাআল্লাহ খুব জলদি এই জুতোজোড়া ঘরময় ঘুরবে”
রাশাদ নির্নিমেষ চোখে চেয়ে আছে। তার মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। আড়ষ্ট গলায় বললো,
“আমাদের?”
“হ্যা, আমাদের”
মুহূর্তেই ইলহা জড়িয়ে ধরলো রাশাদ। সে কাঁদছে। সেই অশ্রুতে ভিজে গেলো ইলহার কাঁধ। ঘরময় নিস্তব্ধ নীরবতা। সেই নীরবতাকে চিরলো উষ্ণ চুম্বন। ইলহার ভেজা ঠোঁটে চুমু একে বললো,
“আমি আরোও পরিশ্রম করবো ইলহা। দেখবেন, সে গর্ব করে বলবে আমি তার বাবা”
“তার এটা সৌভাগ্য যে আপনি তার বাবা। আমি জানি আপনি তার শ্রেষ্ঠ বাবা হবেন”
রাশাদ বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। এই কান্না আনন্দের, এই কান্না পরিতৃপ্তির। ইলহার চোখও ছলছল করছে। এই অভিব্যক্তিটি যেনো তার সকল দ্বিধার মেঘ চিরে কুসুমপ্রভা ছড়িয়ে দিলো।
***
কালচে আকাশে এক রত্তি চাঁদ কালো মেঘের আঁড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। কিশলয়ের মতো কাঁপছে পেলব দেহ হিমবাতাসে। চুলগুলো দিশেহারার মতো উড়ছে। মন আকাশে মেঘ জমেছে, গর্জন করছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। খরা পড়েছে দু আঁখিতে। ফাইজানের পাঞ্জাবীটি দু হাতে জড়িয়ে রেখেছে হুমায়রা। তার গন্ধ লেগে আছে তাতে। মানুষটি থাকলে তার বুকে মুখ গুজে থাকতো। সে আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে রাখতো। হয়তো দুটো কথা বলতে পারতো। কিন্তু সে নেই। যুবাইদার কথাগুলো তীব্র আঘাত করেছে মনপৃষ্টে। তাকে তো ক্ষমা করে দিয়েছে, তবুও কেনো এই পিছুটান! এর মাঝেই ফোনটা কর্কশ স্বরে বেজে উঠলো। এক মুহূর্ত নষ্ট না করেই ফোনটি ধরলো হুমায়রা,
“হ্যালো?”
“এখনো জেগে আছো?”
হুমায়রা চুপ করে রইলো। ওপাশেও নীরবতা। কতটা সময় এমন কাটলো কেউ জানে না। বলার অনেক কিছু থাকলেও বলা হলো না কিছুই। শুধু নীরবতাই ছিলো। অবশেষে সেই নীরবতা চিরলো ফাইজানের গাঢ় স্বর,
“শত শব্দের ভান্ডার জমে আছে। তবুও নিঃশ্বাসের শব্দে আকন্ঠ ডুবে থাকতে মন্দ লাগছে না”
“কবে ফিরবেন?”
“কাজ শেষ হয় নি”
“অহ”
“আমাকে বুঝি চোখে হারাচ্ছো?”
“কে বলেছে?”
“স্বীকার করো রমনী, তুমি আমাকে মিস করছো। আমার জন্য জন্য ব্যাকুল হয়ে আছো!”
হুমায়রা হৃদস্পন্দন তীব্র হলো। ভীষণ লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো। মানুষটির মুখে লাগাম নেই। তবে সে মিথ্যে বলছে না। কিন্তু স্বীকার গেলে তো হেরে যাবে। ফলে মৃদু স্বরে বললো,
“সেটা আপনার মস্তিষ্কের ভ্রান্ত ধারণা”
“উহু এটা আমার মনের অবস্থা। তুমি আমার মিষ্টি অভ্যাস হয়ে গেছো হুমায়রা। ইচ্ছে করছে আঠারো বছরের কিশোরের মতো সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসি। আগে জানলে আমার লাগেজব্যাগে তোমাকে নিয়ে আসতাম। অন্তত নির্ঘুম রাত তো কাটতো না”
“আমি বুঝি শুধু ঘুমের মাধ্যম?”
“উহু, আমার বাঁচার মাধ্যম”
“মিথ্যুক”
“সত্যি!”
রাতটা গাঢ় হলো। দুই প্রান্তের মানব-মানবীর লিপ্ত রইলো একে অপরের মাঝে৷ শব্দরা একটা সময় ফুরিয়ে গেলো। তবুও ফোন কাটলো না। অন্তত মানুষটির নিঃশ্বাসে তো ডুবে থাকতে পারছে। দেখতে দেখতে সূর্যের প্রথম কিরণ ধরনী ছুলো কিন্তু ফোনের লাইনটা কাটলো না।
******
“কাওছার! ওই কাওছার। বের হ এক্কনি”
বাহিরে লোকের সমাবেশ। সকলের মিলিত স্বরে ঘুম ভাঙ্গলো রাশাদের। শুক্রবার বিধায় আজ দোকান বন্ধ। বাসায় একটু বিশ্রাম নেবার পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু বাহিরের চিৎকারে তা সম্ভব নয়। গায়ে একটি শার্ট জড়িয়েই বেরিয়ে এলো সে। তাকে দেখেই অভিযোগের সুর তুললো কালাম,
“রাশাইদ্দা, তোর বাপরে ক আমার টেহা দিতি…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
৪৬তম পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/uJDboFeYQD2N2rzR/?mibextid=Nif5oz