#নিশীভাতি
#৪১তম_পর্ব
“বেশ, লুকোচুরিহীন সম্পর্কটির শুভারম্ভ করা যাক তবে”
হুমায়রার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো। ফাইজানের ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। স্বতঃস্ফূর্ত, অকৃত্রিম হাসি। ভরাট গলায় শুধালো,
“তাহলে প্রশ্রয় দিচ্ছো?”
“আপনার কবে থেকে প্রশ্রয়ের প্রয়োজন?”
হুমায়রার প্রশ্নের উত্তর দিলো না ফাইজান। বরং সশব্দে হাসলো। তীব্র নিস্তব্ধতা খানখান হলো সেই দূর্বোধ্য হাসিতে। বাঁকা চাঁদটাও আড়ালে তাদের দেখছে। নিজেকে আড়াল থেকে মুক্ত করে পূর্ণ আলোকমায়ায় রাঙ্গালো দিঘীর পানি। সেই অলীকতায় নিমীলিত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে ফাইজান। চোখের ভাষাটা ভিন্ন। হুমায়রা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। বুকটা কাঁপছে। ফাইজানের চোখের মাদকতা বলে দিচ্ছে নিষিদ্ধ আকাঙ্খার উপাখ্যান।
****
ঘরে প্রবেশ করতেই হুমায়রাকে পেছন থেকে শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো ফাইজান। শীতল হাতজোড়া শক্ত করে চেপে ধরলো কোমড়ের অস্থি। কাঁধে ঠেকালো মাথা। তপ্ত নিঃশ্বাস চামড়া চিরলো। অধৈর্য স্বরে শুধালো,
“সংবরণ শব্দটি কতটা কঠিন তোমাকে না পেলে জানতাম না। কতবার এই ধৈর্য্যের কাছে হোচট খেয়েছে, কতবার নিজের কথাকে ক্ষতবিক্ষত করে তোমাকে চেয়েছি আমি নিজেও জানি না”
হুমায়রাকে নিজের পানে ঘুরালো। তার লজ্জায় মুদিত নয়নে উষ্ণ অধর ছোয়ালো। কেঁপে উঠলো কিশোরী। ঘন হলো তার নিঃশ্বাস। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বইলো। কথাগুলো বাস্পায়িত হলো প্রবল আবেগে। স্বামীর সোহাগ পূর্বে কেবল অন্য নারীর কাছেই শোনা হয়েছে। আজ তা অনুভব করার পালা। ফাইজানের নিরেট মুখশ্রীর ভাব আজ ভিন্ন। কোমল, নিখাঁদ চাহনীতে মোহ। হুমায়রাকে একান্ত ভাবে কাছে পাবার মোহ। হুমায়রার নত মুখখানা দু হাতে তুললো। কোমল স্বরে ডাকলো,
“হুমায়রা”
অদ্ভুত, অব্যক্ত অনুভূতি হলো হুমায়রার। ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের প্রমোদনে নেতিয়ে উঠলো চিত্ত। ভার ছাড়লো শরীর। ব্যাকুল নয়ন বহু কষ্টে তুললো। সামনের সুঠাম দেহী পুরুষের অসংযত নয়নের ধারে আহত হলো আবার। ফাইজানের রুক্ষ্ম আঙ্গুলের ডগা তখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো কোমল গালে। মৃদু কণ্ঠে শুধালো,
“আগুণ কি শুধু একপাশেই জ্বলছে?”
লজ্জায় উত্তর দেওয়া দায় ঠেকলো। এমন বিমোহিত স্বর বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে দিলো। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে তো লজ্জাকে পরিত্যাগ করতে হবে। হুমায়রা উত্তর দিতে পারলো না। তার গোলাপের ন্যায় ওষ্ঠ কাঁপছে। সেই কম্পন নিষিদ্ধ আকাঙ্খার জন্ম দিলো বত্রিশ বছরের পুরুষের হৃদয়ে। উত্তরের অপেক্ষা করলো না। পোঁড়া ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়ায় দখল করলো কিশোরীর নরম ওষ্ঠ। মুহূর্তের আবেশে ভার ছেরে দিলো কিশোরী। ফাইজান নরম শরীরটাকে আলগোছে কোলে তুলে নিলো। ভালোবাসার তরঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হলো সব জড়তা, সংকোচ। হুমায়রা ফাইজানের গলা জড়য়ে ধরলো তার উষ্ণ ছোঁয়া নিজেকে সমর্পণ করলো বিনা দ্বিধায়। রাতের প্রগাঢ়তার সাথে ভালোবাসাও দৃঢ় হলো। প্রশ্রয়ের ঢেউ উম্মাদনায় পরিণত হলো। মাটির দেওয়ালগুলো সাক্ষী হলো সেই উম্মাদনায়। হুমায়রার চোখ থেকে সুখের অশ্রু গড়ালো। বিবস্ত্র পিঠ খামছে ধরলো পরম সোহাগে। এতোকালের প্রতীক্ষার দেওয়াল ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায় অকৃত্রিম প্রণয়ে।
*****
ফোনের কর্কশ ধ্বনিতে ঘুম বিঘ্ন হুয় ফাইজানের। চোখজোড়া খুলে বহু কষ্টে। একপাশ বা পাশে তাকায়। ছোট পেলব শরীরখানা লেপ্টে আছে তার সাথে। আনমনেই পোঁড়া ঠোঁটে উকি দেয় প্রশান্তির ছোঁয়া। সেই প্রশান্তি গুড়িয়ে দেয় আবার ফোনের কর্কশ শব্দ। বিরক্তি দিয়ে ফোনটা ধরে সে। ওপাশ থেকে নাদিমের কণ্ঠ শুনতে পায়। কিছু সময় মৌন থাকে। চোখে মুখের ভাব বদল হয়। তীক্ষ্ণ গাম্ভীর্য এসে ঠাঁই নেয়। ভরাট গলায় উত্তর দেয়,
“আমি কাল সকালেই আসছি। ফরিদ ভাইকে বলো আফসানের চিকিৎসার খরচ ফান্ড থেকে দিতে”
বলেই ফোন কেটে দিলো সে। চোখে ধারালো দৃষ্টি। মস্তিষ্কের কোষে ছক কষলো। সেই সময় নড়ে চড়ে উঠলো কিশোরী। তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বরে শুধালো,
“কি হয়েছে?”
কিশোরী দুধেল শরীরের প্রতিটি অংশে নিজের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলো ফাইজান। ক্লান্ত শরীরটা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি উঁকি দিলো। নরম ঠোঁট খানায় চুমু একে বললো,
“ঘুম হয়েছে? নাকি আরেকটু ঘুমাবে? আমার আপত্তি নেই। ভোর হতে অনেক দেরী। কম ধকল যায় নি তোমার উপর”
কথাটা শুনতেই চোখ বিস্ফারিত হলো। তন্দ্রায় বুদ কোষগুলো এক ঝটকায় সতেজ হয়ে গেলো। সেই সাথে নিদারুণ লজ্জায় একাকার হয়ে গেলো হুমায়রা। মুখ লুকালো উদাম প্রশস্থ বুকে। দলা পাকানো স্বরে বললো,
“আপনি খুব খারাপ”
“খারাপ তো হলাম ই না। এতেই খারাপের তকমা দিলে?”
“আরো বাকি আছে বুঝি?”
মুখখানা তুলে চোখ বড় বড় করে শুধালো হুমায়রা। ফাইজানের ঠোঁটে দূর্বোধ্য হাসি। উত্তর না দিয়ে নরম ঠোঁটজোড়াকে দখল করলো পুণরায়। উষ্ণ চুম্বনের আচ্ছন্নতা কাটলো যখন ভোরের প্রথম কিরণ চিরলো নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতা।
*****
বটির ধারে খচখচ করে কাটা পড়ছ ফুলকপি। ভাপা পিঠার ধোঁয়ায় গমগম করছে রান্নাঘর। ইলহা চুলোর তাপ কমালো। জামাই এর আপ্পায়নে কমনি রাখবেন না। আতিয়া খাতুন উঠেছেন ভোর চারটায়। ভোরের আলো তখনও উঁকি দেয় নি। রান্না ঘরের চুলো তখন থেকেই জ্বলছে। এলাহি আয়োজন আজ। যতই অভাব হোক জামাইকে তার ঘুণাক্ষরেও টের পাইতে দেওয়া যাবে না। সদ্য স্নান সেড়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো হুমায়রা। ভেজা চুল থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে শীতল জলকণা। লাজে রঞ্জিত হয়ে আছে পেলব মুখশ্রী। আতিয়া খাতুনের নজর পড়তেই তিনি শুধালেন,
“জামাই উঠিছে নি বু?”
“না উনি ঘুমাচ্ছেন”
“আচ্ছা, তাইলে তুমি বউয়ের লগে হাত লাগাও। আমি তোমার দাদারে নাস্তাখান দিয়া আসি”
হুমায়রা মাথা দোলালো। আতিয়া খাতুন চলে গেলেন। হুমায়রা ইলহাকে সাহায্য করার জন্য তার পাশে বসলো। চুল খোলা থাকলেও গলঃদেশের টকটকে লাল দাগটা নজর এড়ালো না ইলহার। মুচকি হেসে বললো,
“কাহিনীর বেগ তবে বাড়লো ননদিনী?”
ইলহার কথায় লজ্জায় মিশে যাবার যোগাঢ় হলো হুমায়রার। মনে মনে বেশ গালমন্দ করলো ফাইজানকে। মানুষটির জ্ঞান কখনো হবে না। আমতা আমতা করে বললো,
“ম…মশার কামড়”
“মশার উপদ্রব বেড়েছে না, তোমার ভাইজানকে বলবো ধুপের ব্যাবস্থা করতে”
হুমায়রা আর কথা খুজে পেলো না। লজ্জায় শুভ্র গালজোড়া রক্তিম হয়ে উঠলো। ইলহা হাসি দমিয়ে বললো,
“আমার কাছে এসো, মশার কামড় লুকানোর ব্যাবস্থা করে দিবো”
হুমায়রা মাথা নাড়ালো। তার লালচে মুখখানা এখনো নত। পালাতে পারলেই যেনো বাঁচে। নাস্তা তৈরি হলে ইলহা বললো,
“যাও তোমার মশাকে ডেকে আনো। নাস্তা তৈরি”
“ভাবী তুমিও না”
বলেই ছুটে বের হলো হুমায়রা। ইলহার চোখে মুখে প্রসন্নতা। রাশাদের অহেতুক চিন্তার অবসান হবে এবার।
ঘরে যেতেই দেখলো ফাইজান ফোনে কথা বলছে। তার মুখখানা গম্ভীর, দৃষ্টি প্রখর, ধারালো। সকালেও সে চিন্তিত ছিলো। কিছু কি খুব বাজে হয়েছে? হুমায়রা অপেক্ষা করলো ফাইজানের কথা শেষ হবার। ফোন রাখতেই শুধালো,
“কিছু হয়েছে?”
কিশোরীর উদ্বিগ্ন মুখখানা দেখতেই ধারালো মুখবিবর কোমল হলো। কাছে এসে তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললো,
“কিছু হয় নি”
“তাহলে এতো চিন্তিত কেনো লাগছে আপনাকে?”
ফাইজান নিঃশব্দে হাসলো। তার বউ এর বয়স কম হলেও সে বিচক্ষণ। তাই লুকালেও খুব একটা লাভ নেই। ফলে স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“আমাদের আজ রাতেই ফিরতে হবে। আমার খুব কাছের একটা ছোট ভাই হাসপাতালে ভর্তি”
“সে কি? কি হয়েছে তার?”
“দুর্বৃত্তের আক্রমণ। ভোটের আগে এমন দু একটা মারপিট হয়। ভেতরে ভেতরে ঝামেলা দেখা যায়। এটাও তেমন ই। তাই আমি তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারছি না। আজ সন্ধ্যাতেই ফিরতে হবে আমাদের”
“বেশ। আমি তাহলে দাদীকে জানিয়ে দিবো”
“রাগ করো নি তো?”
“আমি এতোটাও অবুঝ নই। আমি জানি আপনার কত কষ্ট হয়েছে আসতে। প্রথমেই বলেছিলাম আমি একাই আসি। আপনি দিলেন না”
হুমায়রার কথাটা শুনে দুরত্ব ঘোচালো ফাইজান৷ খুব কাছে টেনে নিয়ে কোমল স্বরে বললো,
“তাহলে গতকালের তুমিবিভোর রাতটা পাওয়া হতো না”
কথাটি শুনতেই লজ্জা ঘিরে ধরলো হুমায়রাকে। বুকটা কম্পিত হলো প্রচন্ডভাবে। লাজুক স্বরে উত্তর দিলো,
“অসভ্য”
****
বিকেলের কমলাটে সূর্যকিরণে রঞ্জিত হয়ে আছে দীঘির স্বচ্ছ পানি। কলেজের বান্ধবীদের সাথে গল্পে মশগুলো হুমায়রা। কত মাস পর দেখা। বিকালের সময় তাদের আগমণ। ফাইজান মামা বাড়ি গিয়েছে বিধায় তাদের সাথে বেড়িয়েছে হুমায়রা। আবার শ্বশুরবাড়ি গেলে পরীক্ষার আগে আসা হবে না। ফাইজান যে মানুষ দেখা গেলো পরীক্ষার সময় সে বাড়ি থেকে কলেজ যাওয়া আসা করালো। কি ভরসা! তাই এই মুহূর্তটা হাতছাড়া করতে চাইলো না হুমায়রা। কত শত গল্পের জন্ম হলো দীঘির জ্বলে। বান্ধবীদের সকলের গল্পের নায়িকা আজ হুমায়রা। নেতার সাথে বিয়ে ব্যাপারটাই তাদের আলোচনা মূলবস্তু। হুমায়রা একসময় বিরক্ত হলো,
“তোদের কি আর কিছু জানার নেই?”
“না নেই, শহরের আকাশ বাতাস তো আর মঙ্গলগ্রহের না”
বলেই সকলে হাসতে লাগলো। হুমায়রা বিরক্তি টেনে বললো,
“তাহলে থাক। আমি যাই। আযান দিবে। উনি চলে আসলে রওনা দিবো”
বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। বান্ধবীদের থেকে বিদায় নিয়েই পা বাড়ালো বাড়ির পথে। ধানের জমির মাঝের আইল দিয়ে যেতে হবে। লোকের ভীড় এখানে কম। বহুদিন শহুরে পাথুরে পরিবেশে এখন গ্রামের নির্জনতায় ঝিমিয়ে আসছে শরীর। এর মাঝেই হঠাৎ পা আটকে গেলো। হঠাৎ দেখায় চমকালো হুমায়রা। আমান তার দিকে চেয়ে আছে। মানুষটির সাথে বিয়ের পর একদফাই দেখা হয়েছিলো। হুমায়রা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। এগুতে গেলেই পথরোধ করলো আমান। আজ সে মাতাল নয়। বরংচ স্বাভাবিক। খুব স্বাভাবিক স্বরে শুধালো,
“ভালো আছো হুমায়রা?”
হুমায়রা একবার চাইলো। পশ্চিমে সুর্য লুটিয়ে পড়েছে। আধারে ঝিঝি পোকার দল মিছিলে বেড়িয়েছে। আকাশের কমলা বর্ণ শুচে কিচকিচে তমসা নামছে ধীর পায়ে। হুমায়রা নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“ভালো”
বলেই সামনে পা বাড়ালো সে। সাথে সাথে শক্ত করে হাতটা টেনে ধরলো আমান। তার চোখজোড়ায় পোড়া যন্ত্রণার অনলে দাউদাউ করছে যেন। হুমায়রা হতবিহ্বল হলো। চমকে শুধালো,
“হাত ধরেছো কেনো আমান ভাই? ছাড়ো”
আমান হাতটা ছাড়লো না। বরং আরোও শক্ত করে ধরলো। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো হুমায়রা৷ আমান তখন শীতল স্বরে বললো,
“প্রথমবার খু/ন করতেই ভয়, একবার তা হয়ে গেলেই ভয় কেটে যায়। তোমার বরকে বলো, আমার কিন্তু ভয় কেটে গেছে”……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি