#নিশীভাতি
#৪৩তম_পর্ব
হুমায়রা যখন আশপাশে দেখলো তখন মানুষের হট্টগোল। আর রাস্তার পাশে অচেতন পড়ে আছে চামেলী। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে তার শরীর থেকে। আর কালো গাড়ির চাকাটা তাকে পিষে সজোড়ে ছুটে চলে গেলো দৃষ্টির ওপাড়ে। রাজপথ রক্তাক্ত। হুমায়রা স্তব্ধ হয়ে রইলো। শিরশির করে উঠলো দেহজুড়ে। রক্তাক্ত চামেলী তার সম্মুখে শায়িত। হাসি খুশি মেয়েটাকে এভাবে নিথর দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো। ও বেঁচে আছে তো? উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেলো না হুমায়রা। হামাগুড়ি দিয়ে কাছে গেলো। আগলে ধরলো রক্তাক্ত শরীরটা। উষ্ণ রক্তে ভিজে গেলো হুমায়রার সাদা জামা। কোলে নিয়ে ডাকলো প্রাণপণে,
“চামেলী আপা, চামেলী আপা”
সদা কথার ঝুড়ি নিয়ে থাকা চামেলী, আজ নিশ্চুপ। “ভাবীসাব, ভাবীসাব” করতে করতে মুখে ফেনা তুলে দেওয়া মেয়েটি আজ সাড়া দিচ্ছে না। হুমায়রা চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হলো। ছোট্ট বুকখানা ডুবলো নোনা বিষাদে। উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে লাগলো,
“কেউ আমার চামেলী আপাকে সাহায্য করুন। ও মরে যাবে। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে৷ কেউ সাহায্য করুন দয়া করে”
রাজপথে লোকের ভিড়, তারমাঝে তীব্র আর্তনাদ, অক্লান্ত হাহাকার। চামেলী বাঁচতে তো!
*****
করিডোরের সোফাতে বসে আছে হুমায়রা। বিধ্বস্ত মুখখানা শুকিয়ে গেছে। দৃষ্টি উদ্ভান্ত, এলোমেলো। চামেলীর রক্তগুলো শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। রাস্তার কিছু মানুষের সাহায্যে বড় হাসপাতালে আনা হয়েছে। ইমার্জেন্সি থেকেই অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয়েছে তাকে। অপারেশনের সময় বন্ড সই নেওয়া হয়েছে। সই টা করেছে হুমায়রা। হাত কাঁপছিলো তখন। বারবার চামেলীর হাস্যজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠছিলো ওই সাদা কাগজে। মেয়েটি নিজের জীবনটা বিসর্জন দিয়েছে ওর মা এবং ছোট ভাই এর জন্য। আজ হুমায়রার দায়িত্বহীন, বেখেয়ালী আচারণের জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে সে। আর ওই সাহসী মেয়েটি একবারও নিজের কথা ভাবলোই না। হুমায়রাকে বাঁচানোর ঝাপ দিলো। তার যে একটা পরিবার আছে ভাবলোই না। চামেলীর কিছু হলে তাদের কি হবে! নিজের উপর প্রচন্ড ক্রোধ হচ্ছে হুমায়রার। কি ভেবে রাস্তায় ছুটেছিলো! আম্মা তাকে দেখলে জড়িয়ে ধরবে। না পাওয়া আদরের বর্ষণ করবে! কেনো করেছিলো সে! যুবাইদা তো ডাকটাও শুনলো না। যদি শুনতোও তাহলে কি হতো! সে প্রশ্ন করতো? কি প্রশ্ন করতো? কেমন আছে? এখানে কি করছে? এতোদিন কোথায় ছিলো? সে কেনো ওই পরিবার ছেড়ে পালিয়েছে? যার সাথে পালিয়েছে সে কোথায়? যদি সে অন্য পুরুষকে ভালোইবাসে তাহলে এতো ঘৃণ্য পন্থা কেনো অবলম্বন করলো? কেনো তার গহনাগুলোও ছাড় দেয় নি? কেনো হুনায়রার বিয়ের দিনই পালিয়েছিলো? কেনো হুমায়রাকে সে এতো ঘৃণা করে? কেনো হুমায়রা তার ভালোবাসা পায় নি? কেনো? কেনো? কতগুলো কেনো? এই কেনোর উত্তরগুলো কি দিতো যুবাইদা? যে মানুষটির কাছে কখনোই হুমায়রার গুরুত্ব কখনোই ছিলো না, সর্বদা ঘৃণার দৃষ্টি তার প্রাপ্য। সেই মানুষটির কি দায় পড়েছে হুমায়রার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। সে তো সুখে আছে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলেছে। কি সুন্দর একটা শাড়ি পড়েছে। কাওছারের ঘরে অসম্মান, লা/থি, গু/তা ছাড়া তো কখনোই কিছু পায় নি সে। তাহলে কেনো পালাবে না। হুমায়রাকে মেনে নিতে হবে যুবাইদার কাছে এখন পরিবারের মুল্য নেই। সে সব ছেড়েছে। তাই আম্মার জন্য এই পাগলামীগুলো খুব বেমানান। যে মানুষটির সাথে নাড়ীর টান থাকা সত্ত্বেও সে কখনোই তাকে আগলে ধরে নি সেই মানুষটার জন্য পাগলামীর কারণে আজ চামেলী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে। অথচ এই মেয়েটির সাথে কোনো রক্তের টান নেই হুমায়রা। পরিবার হয়তো এটাকেই বলে।
এর মাঝেই ঝড়ের মতো প্রবেশ করলো ফাইজান। তার অবস্থা বিক্ষিপ্ত। চোখজোড়া অস্থির। হুমায়রার ফোন পেতেই ছুটে এসেছে সে। আগামীকাল ভোট। অথচ সে সব ছেড়ে এখানে ছুটে এসেছে। হুমায়রাকে দেখতেই শান্ত হলো দৃষ্টি। সামনে দাঁড়ালো হুমায়রার। হুমায়রা মাথা তুলে ম্লান দৃষ্টিতে তাকালো ফাইজানের পানে। চোখজোড়া থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু হলো। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“চা…চামেলী আপা!”
বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। ফাইজান হাটু গেড়ে বসলো তার সামনে। বাহুবদ্ধনে আবদ্ধ করলো কিশোরীকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্ত স্বরে বললো,
“চামেলী সুস্থ হয়ে যাবে। ওর কিছু হবে না”
কিন্তু শান্ত হলো না হুমায়রা। অপরাধবোধ তাকে কুড়ে খাচ্ছে। বিলাপ করে বলতে লাগলো,
“সব আমার জন্য, সব আমার জন্য। চামেলী আপা আমার জন্য আজ…”
“হুশ, শান্ত হও। চামেলী খুব সাহসী মেয়ে। ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না।”
হুমায়রা কাঁদছে অঝরে। ফুঁপিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ফাইজান তাকে আগলে ধরে বসে আছে। চামেলী তার বাসায় যখন এসেছে তখন তার বয়স কতই বা হবে। গোলগাল মুখ, বোকা বোকা হাসি, কথার উপর কথা আর ঘাসফড়িং এর মতো চাঞ্চল্য। ফাইজান তার সাথে খুব একটা কথা কখনোই বলতো না। কিন্তু চামেলী মেয়েটি তার অপছন্দের কাতারে কখনোই পড়ে নি। বরং মাকে সর্বদা যত্ন করার জন্য সে বেতনের থেকেও বেশি টাকা চামেলীকে দিতো। মেয়েটি তার বিশ্বস্ত। এতো রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা হয়, সে কখনোই সেটা দুকান করে না। সর্বদা চোখ, মুখ, কান বন্ধ থাকে। মেয়েটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতিও। গরীব, নিয়তির হাতে পরাজিত হলেও চামেলী মেয়েটি তার বাড়ির একটি স্তম্ভ ছিলো। আজ তাকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে দেখা কখনোই কাম্য নয় ফাইজানের। সে ডাক্তারকে বলেছে,
“যা চিকিৎসা প্রয়োজন সব করুন। টাকার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই”
সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ঠিক সে মুহূর্তেই ডাক্তার বেড়িয়ে এলো। টানা চারঘন্টা অপারেশন চলেছে। ডাক্তার এসে ম্লান স্বরে বললেন,
“ফাইজান সাহেব, অপারেশন কমপ্লিট। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এখন জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছু বলতে পারছি না। উনাকে পোস্ট অপারেটিভ আইসিউ তে শিফট করেছি। প্রে ফর হার”
ফাইজান ধন্যবাদ জানালো। যারা রক্ত দিয়েছে তারা এতোটা সময় বসে ছিলো। এখন হুমায়রার কান্না থেমেছে। শরীরটা হালকা হয়ে এসেছে। দৃষ্টি এখনো এলোমেলো। ফাইজান রক্তদাতাদের বিদায় দিয়ে হুমায়রার জন্য একটি বিস্কিটের প্যাকেট আর কফি নিয়ে এলো। হুমায়রার খেতে ইচ্ছে করছে না। ফাইজান জোর করে বললো,
“কিছু না খেলে আরোও খারাও লাগবে। ডাক্তার তো বললো তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে”
হুমায়রা অবশেষে খেলো। একটা বিস্কিটও গলা থেকে নামছে না। কফিতে চুমুক দিতেই ফাইজান তাকে শুধালো,
“এবার বলতো হয়েছিলো কি?”
হুমায়রা সময় নিলো। গুছিয়ে ধীরে ধীরে সবটা বললো। কিন্তু হুমায়রা বেখেয়ালী হয়ে রাস্তায় ছুটছিলো কথাটা শুনতেই ফাইজানের মুখখানা বদলে গেলো। ভরাট গলায় শুধালো,
“তুমি রাস্তায় ছুটছিলে?”
হুমায়রা মাথা নত করলো। ফাইজান আবার শুধালো কঠিন স্বরে,
“কেনো?”
“আম্মাকে দেখেছিলাম”
“কোন আম্মা?”
“আমার আম্মা”
“যিনি পালিয়ে গেছেন অন্যের হাত ধরে?”
হুমায়রা মাথা দোলালো। ফাইজানের বেশ রাগ হলো। তার চোয়াল শক্ত হলো। মাথার রগ দপদপ করছে। মেয়েটি কি উন্মাদ! কিছু বলতে যাবে ঠিক তখন ই হুমায়রা বললো,
“কিন্তু ওই কালো গাড়িটা ইচ্ছে করে রাস্তার কোন ঘেষে যাচ্ছিলো। সে চাইলেই ব্রেক করতে পারতো”
হুমায়রার কথাটা শুনতেই থেমে গেলো ফাইজান। গাড়ি বিষয়ক কোনো প্রশ্নই সে করে নি। কিছুক্ষণ মৌন থেকে শুধালো,
“নাম্বার দেখেছিলে?”
না হুমায়রা নাম্বার দেখে নি। তবে রাস্তার একটি মানুষ নাম্বারটা টুকে রেখেছেন। তাই সেই নাম্বারটা দিয়েছে হুমায়রাকে। হুমায়রার স্মরণশক্তি প্রখর। তাই নাম্বারটা বললো সে। ফাইজান সাথে সাথেই একটা ফোন ঘোরালো,
“একটা গাড়ির খোঁজ নিতে হবে”
******
কালামের ডাক উঠান থেকে কানে আসছে। কাওছার তখন ঘুমিয়ে ছিলো। আজ বেশ কবজি ডুবিয়ে খেয়েছে সে। বিকালের সূর্য হেলে পড়তেই কালামের কর্কশ কন্ঠ কানে আসছে। কাওছার উঠলো না। চেচাচ্ছে চেচাক। কিন্তু আতিয়ার ডাকে বিরক্ত হয়ে সে বেরিয়ে এলো। কালাম তাকে দেখতেই তার কাছে ছুটে এলো। প্রশ্নের বাণ প্রস্তুত,
“মোর পোলার চাকরির খবর কি?”
কাওছার একটু থম মারলো। ঘুম্নত মস্তিষ্ক এবার জাগ্রত হলো। আতিয়া খাতুন এখনো দাঁড়িয়ে আছেন বিধায় সে কালামকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। কালাম ঘরে ঢুকতেই তার হাত ছাড়ালো। খানিকটা অধৈর্য হয়ে কইলো,
“কাওছার ভাই, মুই মোর জমি বন্দক থুইয়্যা টেহা দিছি। তুমি কইছিলা, তোমার জামাই আমার পোলারে চাকরি দেবে”
কাওছারের গলা শুকালো। ফাইজান তাকে নিশ্চিত কোনো আশ্বাস দেয় নি। কিন্তু এটা কালামকে জানানো যাবে না। কারণ সেই টাকা কবে শেষ। সকলের আড়ালে, সে জুয়োতে আবার টাকা ব্যয় করা শুরু করেছে। তাই কালামকে বললো,
“কালাম, হুন। আজকের বাজারে কি ওই কয় টেহায় চিনি গলে! আরোও টেহা লাগবে। তুই আমারে আর দু লাখ টেহা দে”…….
চলবে
(গল্পটা একটু ছোট হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আগামী পর্ব বেশ বড় আসবে)
মুশফিকা রহমান মৈথি
৪২তম পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/5kJKMrxEDSDwThWS/?mibextid=oFDknk