নিশীভাতি #৪৬তম_পর্ব

0
654

#নিশীভাতি
#৪৬তম_পর্ব

ইলহার মুখখানা রক্তশূন্য। অকস্মাৎ খবরে কিছুটা নড়বড়ে হয়ে আছে ভেতরতা। খবরটি অত্যন্ত আনন্দের। কিন্তু আনন্দটা ঠিক উপলদ্ধি করতে পারছে না ইলহা। হয়তো প্রস্তুত ছিলো না তাই। তার হাতে একটি রিপোর্ট, সে মা হতে চলেছে। রিপোর্টটি ঘন্টা খানেক পূর্বেই পেয়েছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ বেশ খটকা লাগছিলো তার। মাসিক মিস হয়েছে প্রায় দু মাস। ব্যাপারটি প্রথমে আমলে না নিলেও, বেশ কয়েকদিন যাবৎ শরীরটা ভালো নয়। প্রায় দূর্বল লাগছে, খাবারে অরুচি হচ্ছে, বমি বমি ভাব– রাশাদ ব্যাপারটি নিয়ে বেশ উত্তেজিত হলে ইলহা তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠান্ডা করলো। কিন্তু মনের মধ্যে একটা খটকা লেগেই রইলো। তাই গতকাল হাসপাতালে এসেই ইউরিন এবং ব্লাড টেস্ট করালো। আজ সেই রিপোর্ট তার হাতে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পাওয়ায় স্বাভাবিক হতেই সময় লাগলো। যখন স্বাভাবিক হলো তখন মাথায় প্রথম এই চিন্তাটি আসলো তা হলো তারা কি সত্যি প্রস্তুত? ইলহা রাশাদের বিয়ের সময়কাল খুব কম। তার থেকেও যেটা মুখ্যম তা হল তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা। আয়ক্ষম ব্যক্তি বলতে ঘরে এখন রাশাদ এবং ইলহা। একা রাশাদের পক্ষে পাঁচটি প্রাণের ভরণপোষণ করাটা কতটা কষ্টের সেটা ইলহা জানে। এখন একজন সদস্য বাড়ছে। খরচ আরোও বাড়বে কিন্তু ইলহা এমন অবস্থায় কি সে প্রতিদিন এতোটা পথ জার্নি করে চাকরিটা করতে পারবে? রাশাদ কি সেটার অনুমতি দিবে? যদি না দেয় তবে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে ইলহার। তখন রাশাদের উপর চাপটা আবার বেড়ে যাবে। লোকটা সারদিন পরিশ্রম করে যেনো ঘরের কারোর অভাব না থাকে। সে প্রকাশ না করলেও তার চটি ক্ষয় হওয়া পরিশ্রমটি দৃষ্টি এড়ায় না ইলহার। দিন শেষে ক্লান্তশ্রান্ত মুখে মলিন হাসি আঁকিয়ে বলে,
“সব ঠিক আছে”

সবকিছু মিলিয়ে দ্বিধায় পড়লো ইলহা। তার ভেতরর তাদের প্রণয়ের অংশ বাড়ছে। ফলে ইলহা খুশি হতে চাচ্ছে, কিন্তু অবান্তর অর্থনৈতিক চিন্তাগুলো তাকে ভীত করছে। এরমাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন স্ক্রিনে রাশাদের নামটা ভেসে উঠলো৷ ইলহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটি রিসিভ করলো সে,
“হ্যালো”

ইলহার “হ্যালো” বলার সাথে সাথে অপাশের মানুষটি প্রশ্ন ছুড়লো,
“কিছু হয়েছে?”
“কেনো?”
“আপনার কণ্ঠ শুকনো লাগছে। সত্যি করে বলুন তো কি হয়েছে?”

রাশাদের কথাটা শোনামাত্র মৃদু হাসি অঙ্কিত হলো ইলহার ঠোঁটে। মানুষটিকে কিছু না বললেও কিভাবে যেনো সব বুঝে যায়। ইলহার দ্বিধার মেঘ কিছুটা হলেও সরে গেলো। উন্মোচিত হলো আশার কুসুম প্রভা। স্মিত স্বরে বললো,
“আপনাকে কিছু বলার আছে”
“কি?”
“ফোনে বললে আমি আপনার মুখভাব দেখতে পারবো না। তাই কথাটা আমি সামনাসামনি বলবো। আজ তাড়াতাড়ি আসবেন কেমন?”

রাশাদ মৃদু হাসলো। গাঢ় গলায় বললো,
“আমি অপেক্ষায় থাকলাম কিন্তু”
“অপেক্ষার ফলটি খুব মিষ্টি হয়”

*******

আয়নার সম্মুখে তৈরি হচ্ছে ফাইজান। শপথ গ্রহণের সময় চলে এসেছে। আজ রাতে শপথ গ্রহণ হবে। আগামী সপ্তাহ দুয়েক সে ঢাকাতেই থাকবে। হুমায়রা আয়নার মধ্য দিয়ে স্বামীকে দেখছে৷ মানুষটিকে ছাড়া আগামী দু সপ্তাহ তাকে থালতে হবে। ব্যাপারটি কিছুদিন আগেও এতোটা পীড়াদায়ক ছিলো না। কিন্তু আজ মন আকাশে মেঘমেদুরের ঘনঘটা চলছে। মানুষটিকে দৃষ্টির বাহিরে যেতে দিতে মন চাইছে না। ব্যাপারটি হাস্যকরও খানেকটা। কিন্তু নিতান্ত সত্য। মুজিব কোটের বোতামটা লাগাতে লাগাতে ফাইজান আড়চোখে একবার হুমায়রার মানে চাইলো। সকাল থেকে মেয়েটির মুখখানায় আষাঢ়িয়া মেঘ জমেছে। হাসিখানাও কৃত্রিম। ব্যাপারটি বিচিত্র লাগছে ফাইজানের। কারণ মেয়েটি তার ব্যাপারে এতোকাল কেবলই ছিলো নির্লিপ্ত। মেয়েটি আদোপি তাকে ভালোবাসে কি না ব্যাপারটি নিয়ে সন্দিহান সে। তবুও তাকে নিজের বিছানো মায়াজালে আটকে রাখতে চায়। তার ধারণা এই নির্বিকার নারীর হৃদয়ে তার স্থান এক না এক সময় হবেই। আয়নার ভেতর থেকেই স্মিত স্বরে শুধালো,
“তোমার কি বাড়ির জন্য মন খারাপ হচ্ছে?”

কথাটা শোনামাত্র চকিত হল হুমায়রা। অবাক স্বরে বললো,
“না তো”
“তাহলে মুখের ঘন্টায় বারোটা কেনো বেজে আছে?”

হুমায়রা এবার চুপ করে রইলো। ফাইজান জানে মেয়েটি খুব কথা বলে না। তাই নিজ থেকেই বললো,
“আমি তোমার ভাইজানকে বলে দিবো, যেনো তোমাকে ওখানে নিয়ে যায়। একা যাবার চেষ্টা করো না। পারলে মাকেও নিয়ে যেতে পারো। টেস্ট পরীক্ষা তো আগামী সপ্তাহে! একেবারেই বইখাতা নিয়ে যেও কেমন?”

কথাটা বলেই দরজার দিকে পা বাড়াতেই হাতার ঈষৎ অংশ টেনে ধরলো হুমায়রা, মৃদু স্বরে বললো,
“আপনাকে যেতেই হবে তাই না?”

কথাটার মাঝে এক অদ্ভুত মায়া ছিলো। ফাইজান নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। নিউরণের আন্দোলন পুনরায় সচল হয়েছে যেনো। রক্তকণার গতি তরান্বিত হয়েছে। কি তুলতুলে আবদার! এমন আবদার করলে কি তাকে ছেড়ে যাবার ইচ্ছে হয়! ফাইজানের পা থেমে গেলো। এক বিচিত্র আনন্দ হচ্ছে। হুমায়রার মুখোমুখি হয়ে মাথাটা ঠেকালো ঠিক হুমায়রার কাঁধে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো কিছুক্ষণ। দুটো মানব-মানবীর মাঝে কোনো কথা হলো না। অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে বললো,
“আমি যে জনগণের প্রতিনিধি, আমি চাইলেও আমার পুরোটা সময় আমি তোমাকে দিতে পারবো না। তবে এটুকু প্রতিশ্রুতি দিবো, আমার হৃদয়ের মালকিন শুধুই তুমি থাকবে। আমি খুব দ্রুত ফিরবো। তুমি চিন্তা করো না। আমার হুমায়রাকে দেখে রাখবে। সেবারের মতো পাগলামি করবে না”
“আপনিও আমার নেতাসাহেবকে দেখে রাখবেন। আমি তাকে অক্ষত চাই”

ফাইজানের ঠোঁটে প্রসস্থ হলো মিষ্টি হাসি। মাথাখানা তুলে উষ্ণ চুমু আঁকলো হুমায়রার কপালে। তারপর বের হলো নিজ গন্তব্যে। হুমায়রা ছাদ থেকে দেখলো তার চলে যাওয়া। একটা সময় গাড়িটা দৃষ্টির বাহিরে চলে গেলো। হুমায়রা খেয়াল করলো তার স্বচ্ছ চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। এক ফোঁটা গড়িয়েও পড়লো। সে মানুষটির প্রেমে পড়ে নি, সে ফাইজানে আসক্ত হয়েছে। এ এক তীব্র আসক্তি। নেশার আসক্তির ছেড়ে ভয়ংকর এই আসক্তি। এটা মায়ার আসক্তি। এই আসক্তি কাটানো অসম্ভব।

*****

চামেলী অবস্থা তুলনামূলক ভালো। ধীর গতিতে হলেও সে সেরে উঠছে। একটু একটু করে সে সুস্থ হচ্ছে। এখন কথা বলতে পারে। শরীফা এবং হুমায়রা গেলো তাকে ভিজিটিং আওয়ারে দেখতে এসেছে। ডাক্তার বলেছে,
“এক সপ্তাহ হাসপাতালেই থাকুক”

হুমায়রা নিজ হাতে স্যুপ আর ঝাউ রেধে এনেছে। চামেলী হাসপাতালের খাবার খেতে পারে না। তার ভাষায়,
“তেল নাই, নুন নাই। মাটি না ভাত বুজাই যায় না”

হুমায়রা তাকে নিজ হাতেই খাইয়ে দিলো। চামেলী খুশি দেখে কে। তার চিকিৎসার কোনো ঘাটতি রাখে নি ফাইজান। সব দিক থেকে সবরকম সুযোগ সুবিধা। চামেলীর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খেতে খেতে বললো,
“আম্মা, আমি আমরণ আপনের ঘরে ভাবীসাবের আন্ডারে কাম করাম। আমার জীবন বাঁছাইছেন আপনারা”
“আমরা কিছুই করি নি রে চামেলী। তোর ঋণ পরিশোধ করার সাধ্যও আমাদের নেই। তুই যা করেছিস ক’জন করে? আমরা সারাটা জীবন তোর কৃতজ্ঞ থাকবো রে”

নরম গলায় শরীফা কথাটা বললো। চামেলী দাঁত বের করে হাসলো। তারপর বললো,
“কি যে কন আম্মা। এইডা তো আমার দায়িত্ব ছেলো”
“না চামেলী আপু, কারোর জন্য নিজের জীবনের পরোয়া না করা দায়িত্ব মোটেই নয়। তুমি যা করেছো তা করাটা এতো সোজা নয়। তুমি সত্যি খুব সাহসী। নয়তো…”
“ভাবী সাব, তোমারে আমার খুব ভালা লাগে। আমার চোক্ষের সামনে তোমারে কেউ বারি মাইরে যাইবো গা আর আমি দেহুম তা কেমনে হয়। তুমি আমার আপন লোক”

হুমায়রা মৃদু হাসলো। গভীর গলায় বললো,
“তাহলে তুমি কি আমাদের পর? নিজেই আপন বলছো, আবার নিজেই বলছো কৃতজ্ঞতার কথা। তোমার জন্য এগুলো করা আমাদের গুরুদায়িত্ব”
“হেহেহে, ভাবীসাবের লগে তক্ক করে যায় না। হেব্বি বুদ্ধি”
“হয়েছে এবার খাও তো। এতো কথা বলো না”

শরীফা সম্মতি জানালো। বললো,
“তাইলে বোঝ, নেতার বউ এর সাথে যুক্তিতে পারবি না”

******

ফাইজানের সাথে কথা হচ্ছে না। তার ফোনটা বন্ধ ছিলো। বেশ ক’বার চেষ্টা করেছে কিন্তু যোগাযোগ করতে পারে নি। হাসপাতাল থেকে সরাসরি কোচিং এ এসেছে হুমায়রা। শরীফা তাকে নামিয়ে বাসায় চলে গিয়েছে। কিন্তু ক্লাসেও মন বসে নি। পুরোটা সময় তার মস্তিষ্ক জুড়ে সেই মানুষটি ঘুরে বেড়িয়েছে। ক্লাস থেকে বের হবার সাথে সাথেই তাকে পুনরায় ফোন করেছে। কিন্তু সে ফোন ধরে নি। ফলে না পেরে ফরিদকে ফোন করলো হুমায়রা। ফরিদ ফোন ধরতেই ব্যস্ত বললো,
“ভাবী, আমি আপনাকে পড়ে ফোন দিচ্ছি। এখানে অনেক চাপ। ফাইজান ঠিক আছে। শপথের প্রস্তুতি চলছে”

বলেই ফোন কেটে দিলো সে। হুমায়রা কিছু বলার সুযোগও পেলো না। এর মধ্যেই পেছন থেকে চিরচেনা একটি কন্ঠ ভেসে এলো,
“হুমায়রা?”

পেছনে চাইতেই থমকে গেলো হুমায়রা। তার বিস্ময় বাড়িয়ে যুবাইদা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here