#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৪]
” কোন শর্ত আমি মানতে পারবো না আরশাদ।”
” না মানলে কী করার এখানে থাকো তবে।”
” দম থাকলে আপনি আমার শর্ত মেনে দেখান।”
আরশাদ ভ্রু কুচকালো শ্লেষ হেসে এগিয়ে এলো তার ফ্লুজির কাছে।
” তুমি কি শর্ত দেবে আমায় প্রিটি গার্ল?”
” আপনার শর্তে কোথাও আমার মতামত আছে?বললাম আমি ফ্লুজি নয় তারপরেও…
আচমকা আরশাদ ধমক দিল।তার ধমকে কেঁপে উঠলো খুশবু।কথা বলার নিস্বন যেন তার ফুরিয়ে গেছে।
” নাটকটা দয়া করে বন্ধ করো।আমাকে আর শাস্তি দিও না।আমাদের কি সম্পর্ক আজ কিসে পরিনত হলো বুঝতে পারছো তুমি?”
” আপনি আমার জীবনটা যে পাটায় ফেলে পিষে দিচ্ছেন সেটা কি বুঝতে পারছেন না?”
” যদি সুন্দর জীবন চাও আমার হাত ধরে উঠে এসো সব পাবে সব।আর যদি আমাকে ঠেলে দু’কদম এগিয়ে যেতে চাও আই সোয়্যার ধ্বংস তোমার অনিবার্য।”
খুশবু হাসলো তার এখন আর এই আরশাদ লোকটাকে ভয় লাগছে না।না একটুও না।ভালোবাসার মরিচিকায় ছুটে লোকটা সদূর ইতালি থেকে বাংলাদেশে এসেছে।কত্ত বড় বোকা এই লোকটা, তোর জন্য কি মেয়ের অভাব হয়েছে?তুই সুন্দর হ্যান্ডসাম ক্রাশ বয়, তুই যাবি আমেরিকা কানাডা লন্ডন যেখানে খুশি যা তুই কেন বাংলাদেশে এসে আমাকে শূলে চড়াবি।
” আমার জান কি ভাবছো?”
আরশাদের কথায় চমকে উঠে খুশবু।ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে বসলো বিছানায়।
” আমরা চিরকুট গেম খেলবো।আপনার চারটে শর্ত চিরকুটে লেখা থাকবে।আমার চারটা শর্ত চিরকুটে লেখা থাকবে।সেই শর্তনামা আটটা চিরকুটের সাথে চারটা খালি কাগজের চিরকুট থাকবে।টোটাল বারোটা চিরকুট।খেলার নিয়ম চিরকুট গুলো এলোমেলো করে দেওয়া হবে সেখান থেকে প্রথম চয়েজ আপনি করবেন।আমরা দুইবার করে মোট চারটা কাগজ তুলবো।
যদি আপনার একটা শর্ত উঠে যায় তবে সেটা আমি মানতে বাধ্য।আমার শর্ত উঠলে আপনি মানতে বাধ্য।”
” যদি সাদা কাগজ উঠে?”
” তাহলে আপনি প্রথম বারে হেরে গেছেন।না শর্ত মানতে পারবেন, না শর্ত দিতে পারবেন।”
আরশাদ দেরি করলো না সে সম্মতি জানালো খুশবুর কথায়।নিজ হাতে সবটা চিরকুট লিখলো খুশবু।একটা বাটিতে রেখে সব চিরকুট এলোমেলো করে ধরলো আরশাদের কাছে।আরশাদ ভয় নিয়ে তুললো একটি চিরকুট।চিরকুট খুলতেই একগাল হাসে সে।
” খুচবুকে টিন চাপ্তা চময় দিওয়া হপে।এরপর…. ”
আরশাদ তার ভাঙা বাংলায় সম্পূর্ণ কথা উচ্চারণ করার আগে কাগজটা ছিনিয়ে নিল খুশবু।চিরকুটের লেখা পড়ে মেয়েটার বেহাল দশা।প্রথম দানে কি না আরশাদের শর্ত! সে বিড়বিড় করে আবার পড়লো,
” খুশবুকে তিন সাপ্তাহ সময় দেওয়া হবে এরপর আরশাদের যে কোন শর্ত সে মানতে বাধ্য।”
” মাই প্রিটি গার্ল মানবে তো সব শর্ত?”
খুশবু আরশাদের হাতের দিকে তাকালো ছেলেটা সব ভিডিও করে রাখছে বলা তো যায় না খুশবু যদি তার শর্ত ভাঙে।
এবার পালা খুশবুর মেয়েটা অনেক ভেবে চিনতে চিরকুট তুলতে চিরকুটটা খুলে যেন সে আশাহত হলো।চিরকুটে লেখা ছিল, “পরিবারকে মানিয়ে খুশবু আরশাদকে বিয়ে করবে।”
আরশাদ পুনরায় হাসলো দুদিক থেকেই সে জিতে গেছে।তৃতীয় বার চিরকুট তুললো আরশাদ সেখানে কিছুই লেখা নেই অর্থাৎ সাদা কাগজ।চতুর্থবার চিরকুট তুললো খুশবু।চিরকুটের লেখা দেখে চকচক করে উঠে মেয়েটার দু’চোখ।
” আজ খুশবুকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।”
আরশাদের কোন হেলদোল হলো না।কারন আরশাদের বড় শর্ত ছিল খুশবুকে পাওয়া যা ইতিমধ্যে সে পেয়ে গেছে।
.
নতুন জামা পড়ে নিজেকে আয়নায় দেখছে খুশবু।আজ তার খুশির দিন শুধু খুশির দিন নয় মহা খুশির দিন।ঝটপট তৈরি হয়ে চুলগুলো উপরে তুলে বাঁধতে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে সে।তার গলায় থাকা কালসিটে দাগ বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।আনজুমের সাথে চোখাচোখি হয়ে ভীষণ লজ্জায় পড়ে খুশবু।আনজুম এসেছিল তাকে সাহায্য করতে।
দরজায় এসে উপস্থিত হয় আরশাদ।আরশাদকে দেখে আনজুম দ্রুত বেরিয়ে যায় কক্ষ ছেড়ে।
” আমার জান তোমাকে এত প্রাণবন্ত লাগছে কেন?নিশ্চয়ই আমাদের বিয়ের শর্ত দেখে।”
” আর কিছু বলবেন?”
” ইয়েস।এখানে একটা সই চাই জান।”
” কিসের সই?কোন মতলবে এসেছেন এখানে?”
খুশবুর সন্দিহান দৃষ্টির অগোচরে ফিচেল হাসলো আরশাদ।হাতে থাকা কাগজটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে।খুশবু বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়লো কাগজটা।
এখানে লেখা এতদিন সে আরশাদ ইহসানের বাড়িতে ছিল এবং এই সম্পর্কে বৃত্তান্ত।অহেতুক একটা কাগজে সই করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল খুশবু।
” এটার জন্যেও আবার স্ট্যাম্প লাগে অদ্ভুত লোক আপনি।আরেকটা স্ট্যাম্প আনুন আমি যে আপনার মাথা ফাটিয়েছি নির্দ্বিধায় সই করে দেব।”
” এত স্ট্যাম্প দিয়ে কি হবে জান?একদম বিয়ের স্ট্যাম্প এনে দি।”
” যত্তসব..”
মনে মনে যত রকম গা লি জানে সবটা গা লি আরশাদের জন্য উজার করে ঢেলে দিল খুশবু।আরশাদের চোখ যায় খুশবুর গলায়।তার অতি ভালোবাসা যখন রাগে রূপ নেয় তখনি তার ফ্লুজিকে আঘাত দিয়ে বসে।আরশাদ তার ফ্লুজিকে কাছে আনলো।কালসিটে দাগটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বাঁকা হেসে বলে,
” তোমার হবু বর রোহানকে এই দাগটা দেখাবে আশা করি তোমাকে বিয়ে করার স্বাদ এক নিমিষে তার মাথা থেকে চলে যাবে।”
” অসভ্য লোক।”
” আমি আরো অসভ্যতা করতে চাই।কিন্তু সুযোগের অপেক্ষা।”
.
খুশবু তৈরি হয়ে যখন কক্ষ থেকে বের হলো আশেপাশের পরিবেশ দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।টানা কয়েকদিন একটা কক্ষে ছিল সে।এই বাড়ির কোন কিছুই সে যানে না।রাজ প্রাসাদের ন্যায় সাজানো একটি বাড়ি।দেয়ালে বড় করে দুটো ছবি টাঙানো আছে।একজন হাস্যজ্বল বাঙালি নারীর ছবি তার পাশের জন দেখতে ঠিক আরশাদের মতো।বলা চলে হুবহু আরশাদ শুধু ছবির মানুষটা বয়সের ভারে চামড়া কুচকেছে অন্যজন তাগড়া যুবক।খুশবুর অবাক চাহনি দেখে আরশাদ বলে,
” তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি🔥।”
” বাজে বকবেন না।”
” আর তো তিন সাপ্তাহ এরপর তুমি আর আমি মিলে সুইটহানি হয়ে যাব ফ্লুজি।”
খুশবু বিরক্ত নিয়ে ছুটে চললো সামনের দিকে।আনজুম দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে তাকে দেখে মিষ্টি হাসলো খুশবু।
” এই বাড়িটা আমার বাবা আমার মাকে গিফট করেছে।বাংলাদেশে আমাদের থাকা না হলেও এই বাড়িটার দেখাশোনার জন্য আলাদা লোক রাখা আছে।তোমাকেও একটা বাড়ি গিফট করবো ফ্লুজি।”
” প্রয়োজন নেই আমার।এর থেকে ভালো আমাকে নিস্তার দিন।”
” কি বললে বুঝলাম না।”
আরশাদ ভ্রু কুচকালো সে নিস্তারের অর্থ বুঝলো না।
.
বাহারুল হকের শারিরীক অবস্থা কিছুটা উন্নতির পথে।অসুস্থ স্বামিকে নিয়ে বেশ বেগ পোহাতে হলো না আনিমার। তার ভাইয়েরা অর্থাৎ খুশবুর মামারা যথা সাধ্য সময় দিচ্ছেন তাদের।যেকোন প্রয়োজনে না চাইতে তারা এসে হাজির।বাহারুল হকের হঠাৎ অসুস্থতার মূল কারণ আকস্মিক তিনি উত্তেজিত হয়ে যান।
শুক্রবার বিয়ের দিন দুপুরে বর যাত্রী বের হওয়ার আগে রোহানদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় রোহানের প্রেমিকা।মেয়েটা অতিথি ভরা বাড়িতে বেশ সিনক্রিয়েট করছিল।মেয়েটা শেষ পর্যায়ে বারবার হুমকি দিয়েছে যে করে এই বিয়ে সে ভাঙবে।
রোহানের বাবা মা সেদিন সবার সামনে ছেলেটাকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও প্রকৃত পক্ষে তারাও জানতো এই মেয়ের সাথে রোহানের সম্পর্ক আছে।
এসব কথা যখনি বাহারুল হক খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তখনি তিনি ভীষণ রেগে যান।কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বুকের ব্যথায় তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
রোহান আজ আবার বাহারুল হককে দেখতে এসেছে।কেভিনের সামনে রোহানকে দেখে ভীষণ রেগে যান অনিমা।
” এখানে কেন এসেছো?আর কী ক্ষতি করতে চাও আমাদের?”
” আন্টি প্লিজ মানুষ মাত্র ভুল হয়।আমিও ভুল করেছি।
“আমার মেয়েটার ক্ষতি তোমার মাধ্যমেই হয়েছে রোহান।আমার মেয়ে নিখোঁজ আজ এতটা দিন,তুমি তার খোঁজ এনে দিতে পেরেছো?তোমার সেই প্রেমিকা কোথায়?তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
” আপনারা পুলিশকে তার কাজ চালিয়ে যেতে দিন।”
” চুপ থাকো।দূর হও আমার সামনে থেকে।আমার মেয়ের গায়ে যে কালি মাখালে মানসম্মান সবটাই ডুবলো আমাদের।”
” খুশবু এই মুহূর্তে এসে যদি দাঁড়ায় আমি তাকে এক্ষুনি বিয়ে করবো।আমার পরিবারের বাইরে গিয়ে হলেও আমি তাকে বিয়ে করবো।”
” কিন্তু আমি আমার মেয়েকে তোমার কাছে বিয়ে দেব না।কখনোই না।প্রয়োজনে ওর বিয়ে না হলে না হবে তবুও তোমার কাছে মেয়ে দেব না।এখান থেকে যাও রোহান।সিকিউরিটিকে ডেকে বের করতে চাইছি না।”
রোহান দাঁড়ালো না।এতটা অপমানের ভার নেওয়ার সহ্য ক্ষমতা তার নেই।
.
আরশাদের গাড়ি এসে থামলো হসপিটালের সামনে।সারাটা সময় আরশাদ গম্ভীর হয়ে ছিল অথচ খুশবু চাতকপাখির ন্যায় ছটফট করেছে কখন ফিরবে তার নীড়ে।খুশবু গাড়ি থেকে দ্রুত নামতে নিলে আরশাদ তার হাত ধরে ফেলে।ছেলেটার চোখে মুখে বিষন্নতার বর্ষণ।
” চলে যাচ্ছ যাও।দেখা আবার হবে হতেই হবে।”
” যদি না হয়।”
” তুমি এমনটা করবে না ফ্লুজি।তুমি আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এতটা দূর এসেছো।আমি বোকা কারন আমি তোমার প্রতি দূর্বল।যারা ভালোবেসে পিচলে যায় তারাই হয়তো সবচেয়ে বড় বোকা তাই না ফ্লুজি?”
” আমি কি করে জানবো আমি তো কাউকে ভালোবাসিনি।যে তিন সাপ্তাহ সময় আমি পেয়েছি সেই তিন সাপ্তাহের মাঝে আপনার সত্যিকারের ফ্লুজিকে আমি খুঁজে দেব।”
খুশবুর বোকা বোকা কথায় শ্লেষ হাসলো আরশাদ।কোলে থাকা প্যাকেটটি খুশবুর হাতে দিয়ে বলে,
” এখানে একটা নতুন ফোন আছে তোমার আগে সিম আছে।তোমার আগের ফোনটা ভেঙে গেছিলো তাই নতুন ফোন দিলাম।”
” লাগবে না ধন্যবাদ।”
“যেহেতু ফোনটা আমার কারনে ভেঙেছে সেহেতু লাগবেই।যাও বের হও আমার গাড়ি থেকে।”
শেষ কথাটা ধমকের সুরে বললো আরশাদ।খুশবু ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো তার পানে।কি অদ্ভুত লোক রে বাবা।যেখানে সারাক্ষণ তার কাছ ঘেষে থাকে সেখানে এখন তাকে বের করে দিচ্ছে।খুশবু গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল হসপিটালের দিকে হঠাৎ পেছন থেকে ছুটে আসে আরশাদ।ছেলেটা পুনরায় গাড়ির কাছে টেনে আনে খুশবুকে।একটি স্ট্যাম্প এনে ধরলো খুশবুর সামনে।
” এখানে সই করো জান।”
” এটা কিসের কাগজ?”
” তোমাকে যে সেফলি পৌঁছে দিলাম তার প্রমান কি?নাও সই করো।”
খুশবু বিরক্ত হলো।বাবা মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য তার ভেতরটা কতটা যে ছটফট করছে এই আরশাদ বুঝবে কী?কাগজটা ভাজ করে আরশাদ গাড়ির ডেকিতে ধরলো।কাগজটাতে খুশবু দ্রুত সই করে প্রস্থান করলো।
.
বাহারুল হকের কেভিন খুঁজতে মোটেও দেরি হলো না খুশবুর।আরশাদ তাকে বলেই দিয়েছে কত তলার কয় নাম্বার কেভিনে আছে তার বাবা।খুশবুকে দেখে অনিমা খুব বেশি অবাক হলেন না কারণ তিনি আগেই জানতেন খুশবু আসছে।মেয়েকে জড়িয়ে অনিমার আহাজারি বাড়লো।এলোমেলো চুমু খেল মেয়ের কপালে।অনিমা দরজার দিকে চোখে বুলিয়ে বলে,
” আরশাদ আসেনি তোর সাথে?”
খুশবু যখন কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছিল তখনি অনিমার একটি প্রশ্নে তার দম যেন বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো।মা কি করে জানলেন আরশাদের কথা?
চলবে____