#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৩]
” তোমার আঙুলের রিংটা কোথায় ফ্লুজি?”
চট করে আরশাদের চোখ মুখের পরিস্থিতি পালটে গেল।অস্থিরতা থেকে মোড় নিয়েছে তীব্র রাগের দিকে।
” কি হলো কথা বলছো না কেন জান?আমার দেওয়া রিংটা কোথায়?”
খুশবু ঠোঁট বাঁকালো।কে দিয়েছে তাকে রিং!এই আরশাদ ব্যাটাকে সে এবার প্রথম দেখেছে।
” ফ্লুজি তুমি জাননা ওই রিংটা কতটা এক্সপেন্সিভ ছিল আমি নিজের পছন্দে অর্ডার করেছিলাম।ডায়মন্ডের রিংটা তুমি এক মুহূর্তের জন্য হাত থেকে খুলতে না তাহলে এখন কোথায় সেই রিং?”
শেষ কথাটা প্রবল ক্রোধ নিয়ে ধমকের সুরে বললো আরশাদ।খুশবু ভয় পেল নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলে আরশাদ আরো বেশি রেগে গেল।খুশবুর গত বছর জন্মদিনে তার বাবা তাকে একটি ডায়মন্ডের রিং গিফট করেছিল কই আর তো কেউ তাকে ডায়মন্ডের কোন কিছু গিফট করেনি।খুশবুর হাতে একটি বেশ বড় স্বর্ণের রিং আছে সেটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশাদ।
“জান এই রিংটি কে দিয়েছে?”
“র..বা..মানে”
ভয়ে খুশবুর মুখ থেকে কথা বের হলো না।ওই শ্বেত চামড়ার যুবকটির রাগে রক্তিম মুখ দেখে সব কিছু যেন তার হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।বাদামি মনির চোখ জোড়া তার চোখ রেখেছে স্থিরতায় ।কিন্তু এটাতো স্থিরতা নয় সে কথা জানে খুশবু। কাল বৈশাখীর প্রবল ঝড় শুরুর আগের গুমুট পরিস্থিতিটাই যে আরশাদের চোখে মুখে।
” রোহান দিয়েছে তাই না জান?তোমার সো কল্ড হবু বর।”
চমকে গেল খুশবু।এই লোকটা কি করে জানে রোহানের কথা?রোহানের কথা মাথায় আসতে খুশবুর এবার ভীষণ কান্না পেল।এই মানুষটা তাকে কত্তটা ভালোবাসে তা বলে বোঝানো যাবে না,কিন্তু পরিস্থিতির স্রোত তাকে উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছে রোহানের ভালোবাসার প্রাপ্য মর্যাদা সে দিতেও পারলো না।
পিনপিনে নিরবতা ছেঁয়ে থাকা কক্ষে আচমকা হা হা শব্দে হেসে উঠে আরশাদ।তার হাসিতে গায়ে কাঁটা দিল খুশবুর।আরশাদ খুশবুর বাম হাতের ভাজে নিজের হাত মেলালো, ডান হাতের ভাজে হাত মিলিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরলো মেয়েটাকে।খুশবুর দু’হাত এখন আরশাদের নিকট বন্দি।আরশাদ বাঁকা হাসলো সে সাথে হাসলো তার বাদামি চোখ জোড়া।সে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল মেয়েটার মুখে পড়ে থাকা চুল।সকল কার্যক্রম ভীতু চোখে পরখ করছে খুশবু মনে মনে একটা কথাই ভাবছে কী করে মুক্তি পাবে এই বদ্ধ উন্মাদের হাত থেকে!
আরশাদ তার ফ্লুজির গলায় নাক ঘেষে পুণরায় মুখ তুললো।
” ফ্লুজি আমার জান তোমার এই ভীতু মুখটা আমায় ভীষণ টানে।তুমি কি জানো না,গোটা তুমিটা আমার।তোমার অধিপত্যি বিস্তারকারী একমাত্র আমি।”
আরশাদ মুখ ডুবালো খুশবুর গলায়।একেকটা উত্তপ্ত ছোঁয়ায় কেঁপে উঠছিল খুশবু।আদরের ছোঁয়া ক্রমশ যেন রাগে ক্ষোভে পরিনত হচ্ছিল।আরশাদ তার ফ্লুজির চামড়া পিষে দিল দাঁতে চেপে।ব্যথা কেঁদে উঠলো তার ফ্লুজি।নিজেকে ছাড়াতে চেয়েও শক্ত দেহের আদলে থেকে সে কিছুই করতে পারলো না।খুশবুর ছটফটানো দেখে মুখ তুলে তাকালো আরশাদ।চোখাচোখি হলো দুজনের।বাদামি চোখ জোড়া কেমন নেশাতুর দৃষ্টি তাকিয়ে আছে এই চোখের ভাষা বুঝতে পারে না খুশবু।আচমকা খুশবুর শুষ্ক ঠোঁটে চুমু খেল আরশাদ একে একে ছড়িয়ে গেল বিস্তার গালে।বাম হাতের সাহায্যে খুশবুর হাত থেকে রোহানের দেওয়া রিংটি বের করলো আরশাদ।দু’আঙুলের সাহায্যে রিংটা চেপে বাঁকা করে ছুড়ে ফেলে উদ্দেশ্যেহীন।
” এই আঙুলি একমাত্র আমার রিং থাকবে।যদি না থাকে এই আঙুল আর তোমার সঙ্গে থাকবে না ফ্লুজি।”
নিজের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে আরশাদকে সরিয়ে দিল খুশবু।রাগে রিরি করছে তার শরীর।
” কী ভাবেন নিজেকে?আর কতবার বলবো আমি ফ্লুজি নই।সেই মেয়ে আমি নই।আমার নাম খুশবু শুনতে পারছেন আমার নাম খুশবু।”
” খুচবু!”
বড্ড কষ্টে উচ্চারণ করলো আরশাদ।নিজের নামের এমন বিকৃতি উচ্চারণ দেখে পুনরায় দাঁতে দাঁত চাপলো খুশবু।
“খুচবু নয় খুশবু।”
” হোয়াট এভার।নামে কি আসে যায়?পরিচয় হওয়ার পর থেকে কম নামে নিজের পরিচয় দাওনি জান।একবার বললে টুবা,লাস্ট বার বললে টাচনোভা।”
” টুবা মানে!টাচনোভা মানে?এগুলা কারো নাম হয়?”
” নামে কি আসে যায়?তুমি আমার ফ্লুজি আমার শখের ফ্লুজি তুমি।”
” এই শুনুন আমি ফ্লুজি নই।আপনার গার্লফ্রেন্ডকে আপনি খুঁজে নিন প্রয়োজনে আমি খুঁজে দিব।”
আরশাদ হা হা শব্দে হেসে উঠলো।তার ওয়ালেট খুলে একটি মেয়ের ছবি দেখালো যাকে দেখতে হুবহু খুশবুর মতো।মেয়েটার গলা অবধি ছবি তোলা।ছবিটি দেখার পর ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে পড়লো সে।যোজন বিয়োজন করে কোন কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
” এই মেয়েটা আমার মতো দেখতে কিন্তু এই মেয়েটা আমি নই বিশ্বাস করুন।”
” আর কোন কথা নয় জান।তুমি রেস্ট করো।”
খুশবু রেগে গেল।সোফার সামনে থাকা টেবিল থেকে একটি ফুলদানি নিয়ে মাথায় ছুড়লো আরশাদের।
” কে তোর জান?তোর অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি আর নয়।”
” ফ্লুজি ক্লাম ডাউন।”
” ফ্লুজি মাই ফুট।”
খুশবু ধাক্কা দিল আরশাদকে ছেলেটার মাথা ফে টে গলগল র ক্ত ধরছে।খুশবু পালিয়ে যেতে দরজা খুলতে চাইলো কিন্তু তার আর দরজা খোলা হলো না।বাইরে থেকে কেউ দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।অনেকবার করাঘাত করলো সে কিন্তু ফলাফল শূন্য।আরশাদ রক্তাক্ত স্থানে হাত রেখে চাপা হাসলো।ক্রমশ এগিয়ে গেল তার ফ্লুজির কাছে।
” মাই গার্ল এক ভুল আমি আর করবো না।তোমার উষ্কানিতে ঝামেলা করে ব্রেকাপ করেছি তোমার সব চিহ্ন নিজের থেকে মুছিয়ে নিয়েছি।কিন্তু সবশেষে আমি অনুভব করছি তোমায় ছাড়া আমি ভালো নেই,ভালো থাকবো না।আমার তোমাকে চাই ফ্লুজি।তোমাকে সামনা সামনি দেখে আরো গলে গেছি।প্লিজ জান সামলে যাও।”
” ফ্লুজি ফ্লুজি ফ্লুজি।বললাম তো আমি ফ্লুজি নই।খু ন করে ফেলবো ছেড়ে দিন আমাকে।”
খুশবু মেঝে থেকে একটি ভাঙা ফুলদানির টুকরো নিলো আর তা দেখে আরশাদ বাঁকা হাসলো।ক্রমশ এগিয়ে আসতে আসতে সে বলে,
” কিল মি জান।”
আরশাদের অভয়ে বড্ড বেশি ঘাবড়ে গেল মেয়েটা।আচমকা ফোন বেজে উঠলো আরশাদের।পকেট থেকে ফোন বের করতে ফোন ছিনিয়ে নিলো খুশবু।RONI নামে সেভ করা নাম্বার থেকে ফোন আসছে আরশাদ দ্রুত খুশবুর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।দুজনের টানাহ্যাঁচড়ায় ফোনটা কেটে গেল।খুশবু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আরশাদকে বার বার ফোন আনলক করার চেষ্টা করলো সে।তখনি ফোনে একটি মেসেজ আসে সেই মেসেজটি পাঠিয়েছে রনি।
” গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার আছে স্যার।আপনার ফ্লুজি অর্থাৎ ম্যাডামের বাবা বাহারুল হক উনাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে।মেয়ের শোকে উনার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।আমার মনে হলো এই কথাটা আপনাকে জানানো উচিত।”
হাতের ফোনটি আরশাদের দিকে ছুড়ে মারলো খুশবু।তীব্র ক্রোধ নিয়ে আরশাদের শার্টের কলার চেপে বলে,
” আমার বাবা আমার বাবা….”
খুশবুর দম ফুরিয়ে এলো সাথে ফুরিয়ে এলো তার নিস্বান।দেয়ালে পিঠ ঠেকে চুপ চাপ বসে রইলো গুটিয়ে।
মেয়েটার আচরনে আরশাদ অবাক হলো দ্রুত মেসেজটি পড়ে বুঝতে পারলো তার ফ্লুজির কি হয়েছে।
” বাবার কাছে যাবে জান?”
” যাবো যাবো।আমি ছাড়া আমার বাবার কেউ নেই বিশ্বাস করুন কেউ না।প্লিজ আরশাদ আমাকে মুক্তিদিন।”
আরশাদ কিঞ্চিৎ হাসলো।খুশবুর চোখের জল মুছে দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো কপালে।
” যাবে তো জান।তার আগে আমার শর্ত মানতে হবে কিছু কথা শুনতে হবে।”
” আপনার সব শর্ত আমি মানবো।”
” তবে এখন গুডগার্লের মতো বসে থাকো।এই যে মাথা ফাটিয়েছো আগে চিকিৎসা করিয়ে আসি।”
খুশবু সত্যি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো সে একটুও নড়লো না।
.
আরশাদের কপালে তিনটে সেলাই লেগেছে।বাংলাদেশে তার পরিচিত গুটি কয়েকজন মানুষ আছে।নানার বাড়িতে নানা নানু নেই তারা মা রা গেছেন বহু আগে।নানার বাড়িতে দুই মামার বসবাস।বাংলাদেশে আসার পর থেকে তারা বারবার ফোন করে যাচ্ছে কবে যাবে আরশাদ।আরশাদ ফ্লুজির ঝামেলা না মিটিয়ে একদমি নড়বে না।ব্যথার ওষুধ খেয়ে কফি হাতে বারান্দায় বসে আরশাদ।ছোট ভাই ‘আরিব’কে বারবার ফোন করছে অথচ ছেলেটা ফোন তুলছে না।দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আরিব ফোন তুলে আরশাদের মেজাজ তখন বেজায় গরম।
” আরিব হোয়াট ইজ দিস?”
” সরি ব্রো ঘুমে ছিলাম।”
আরশাদ ইতালিয়ান ভাষায় গা লি দিল আরিবকে।তা শুনে হাসলো আরিব
বদমেজাজি ভাইয়ের গা লি শোনা নতুন কিছু নয়।
” তোমার ফ্লুজি কোথায়?”
” আছে।”
” সে কি সব স্বীকার করেছে?নাকি এখনো না চেনার ভান করে আছে।”
” সে আমাকে চেনে না।ফ্লুজির এমন নাটক করার মানে কি আরিব।”
” ফ্লুজি তোমাকে ভালোবেসেছিল কিন্তু তোমার রাগারাগি গা/লা/গা/লি শুনে মেয়েটা ব্রেকাপ করলো।তুমিও জেদ করে তার সমস্ত ছবি,মেসেজ,জমানো স্মৃতি মুছে দিলে।দুজনের মাঝে দুরত্ব তৈরি হলো হয়তো বা ব্রেকাপের সময়টাতে ফ্লুজি মুভ অন করেছে।সে নতুন জীবন সঙ্গী এনেছে জীবনে,তাই তো তোমাকে ইগ্নোর করছে ব্রো।”
” আমি ছাড়া ফ্লুজির জীবনে আর কোন অপশন থাকবে না।আমি তার জীবনের সব!সব মানে সব।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা কোট ম্যারেজ করবো ফ্লুজির দুরত্ব আমি আর মানতে পারছি না।”
” গ্রেড নিউজ ব্রো।এটাই ভালো হবে।”
” তোমরা সবাই বাংলাদেশে আসতে পারবে?”
” আমার আর মায়ের কাগজ পত্র সব রেডি যাস্ট টিকেট কাটবো।তবে বাবা গ্র্যানি আসতে পারবে না বাবা এলে গ্র্যানি একা হয়ে পড়বেন।”
“ওকে নো প্রবলেম।তোমরা দুজন আসো যত দ্রুত সম্ভব।”
.
আরশাদ খুশবুকে যেভাবে রেখে গেছে ঠিক সেভাবেই বসে আছে খুশবু।কোন সন্দেহ নেই মেয়েটা এক চুলো নড়েছে।থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে।অশ্রুপাতে দু’গাল ভিজে টইটম্বুর।
” ফ্লুজি আমার জান।”
ফ্লুজি মাথা তুলে তাকালো।আরশাদের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে মন থেকে একটুও খারাপ লাগা কাজ করলো না তার।আরশাদ তার ফ্লুজির নরম গালে হাত ছোঁয়ালো অশ্রু মুছে টেনে আনলো তার কাছে।
” এতটা ভেঙে পড়ে না জান।”
” আমি বাবার কাছে কখন যাব?”
” তোমার কাছে তিনটা শর্ত রাখলাম।এই তিনটা শর্ত তোমার আগামী কয়েক ঘন্টা এবং ভবিষ্যৎ এ প্রভাব ফেলবে।এমকি পালটে যাবে তোমার জীবন।”
” কী শর্ত?”
” শর্ত ১: তোমার জীবনে তোমার পরিবার থাকবে তোমার প্রিয় মানুষরা থাকবে সাথে আমিও থাকবো তোমার প্রাণেশ্বর হিসেবে।
শর্ত ২: তোমার জীবনে আমি থাকবো না..
আরশাদ কথা শেষ করার আগে খুশবু সানন্দে বলে,
” শর্ত ২,হ্যা শর্ত ২ মানবো আমি।”
খুশবুর বোকামিতে আরশাদ হেসে ফেললো।
” আগে পুরো কথা শুনো আমার জান।
শর্ত ২: তোমার জীবনে আমি থাকবো না, তোমার পরিবারের কেউ থাকবে না কেউ না।তোমার কোন প্রিয় মানুষের অস্তিত্ব তোমার জীবনে থাকবে না।তোমার সাথে কি ঘটবে আমি আসলেই জানিনা।”
শর্ত ৩: তুমি তোমার হবু বর রোহানকে এখন ফোন করবে এবং বলবে তুমি তোমার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছো।বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সে তোমার সাথে ইন্টিমেট হয়েছে কিন্তু এখন তোমার প্রেমিক তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে।এই মুহূর্তে এসে তুমি রোহানকে বিয়ে করতে চাও।এসব বলার পর রোহান যদি তোমাকে সত্যি বিয়ে করতে চায় তবে আমি তোমার জীবন থেকে সরে যাব ফ্লুজি।আর যদি রোহান তোমায় না মেনে নেয় তবে তুমি আমার হয়ে থাকবে।
আমি যা বলবো তাই তোমাকে শুনতে হবে করতে হবে।আমি মানে আমি তোমার জীবনে শুধুই আমি।
এক নিষ্ঠুর প্রহেলিকায় বেঁধে গেছে মেয়েটার জীবন।আরশাদ উঠে দাঁড়ালো আয়নায় নিজেকে দেখে তার ফ্লুজির উদ্দেশ্যে বলে,
” প্রিটি গার্ল সিদ্ধান্ত তোমার কাছে কী করবে তুমি?”
__চলবে…..
🍂আপনাদের কী মনে হয় ফ্লুজি কোন শর্তটা গ্রহণ করবে?