ফ্লুজি #অনুপ্রভা_মেহেরিন [পর্ব ৮ ]

0
450

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৮ ]

” বিয়ের এই কাগজ পত্র আমি এগুলো তৈরি করেছি ভয় দেখিয়ে ফ্লুজিকে দমন করবো বলে।”

” কিন্তু আঙ্কেল হঠাৎ বিয়েতে রাজি হতে গেলেন কেন?”

” নিশ্চয়ই ব্রেন ওয়াশ করেছে।”

আরশাদের ফোনে পুনরায় খুশবুর কল এলো।ফোন তুলতে অপরপাশ থেকে ভেসে এলো অনিমার গলা।

” আমি খুশবুর মা বলছি।”

” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।ভালো আছেন?”

“খুশবুর সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”

অনিমার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর আরশাদকে বুঝিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই তাদের সম্পর্কের কথা অনিমা জানতে পেরে রেগে গেছে।

” কথা বলছো না কেন?খুশবুর আর তোমার কিসের সম্পর্ক?”

” আমাদের সেই সম্পর্ক যার জন্য আমি ভীনদেশ ছেড়ে এখানে এসেছি।আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।”

” এতই সহজ!এখন তো আমার মনে হচ্ছে সেচ্ছায় তোমরা দুজন মিলে বিয়ে ভেঙেছো।”

” ব্যপারটা কিন্তু তা নয় আন্টি।আমরা কেউ বিয়ে ভাঙিনি।সেদিন বিপদে পড়ে আপনার মেয়ে আমার কাছে এসেছে।”

আরশাদ সত্যের মাঝে মিথ্যা মিশিয়ে দিল।অনিমা বেশ অবাক হলেন তার অগোচরে এতকিছু চলছে।

” আমার মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে?”

” তাকে জিজ্ঞেস করুন আমাকে বিয়ে করতে সে রাজি।”

অনিমা খুশবুর পানে তাকালেন।তার মেয়ে এতটা সেয়ানা কবে হয়েছে।

” বেশ তোমার যদি দম থাকে তাহলে তুমি তোমার পরিবার নিয়ে আসবে।তিনদিন পর ঘরোয়া ভাবে রোহানের সাথে খুশবুর বিয়ে।তোমার হাতে আর কতটা সময় আছে আশা করি বুঝতে পারছো?”

আরশাদ ভড়কে গেল।রাগ জেদ ভয় সব মিশিয়ে তার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে।এত ঝুট ঝামেলা সে কেন করলো?সব শেষে যদি ফ্লুজি তার না হয় তবে কারো নিস্তার রইবে না একদম কারো না।

বসার ঘর থেকে অনেকক্ষণ যাবৎ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল।কে কাঁদছে সেটাই তো বুঝতে পারলো না খুশবু।উৎসক হয়ে দেখতে যাবে এমন সময় তার হাত ধরেন অনিমা।

” কোথায় যাচ্ছিস?”

” কে কাঁদছে আম্মু?”

” রোহানের মা।গড়াগড়ি করে কেঁদে তোর বাপের মাথা ধুয়ে দিয়েছে।তিনি এখন কথা দিয়ে বসেছেন মেয়ে নাকি রোহানের হাতেই দেবেন।”

” সে কি কথা।সত্যি কাঁদছে?”

” আরে নাটক।আমি এক নারী হয়ে আরেক নারীর নাটক বুঝবো না?তোর নিখোঁজ নিয়ে কম কথা শুনায়নি আমাকে, আমি নাকি নষ্ট মেয়ে পেটে ধরেছি তাহলে তার ছেলে কী?তুই জানিস না তোর মামা একটু আগে আমাকে ফোন করে বারণ করেছে রোহানদের সাথে যেন কোন সম্পর্ক পুনরায় না গড়ি।তোর বাবা ওনার চোখের পানি দেখে গলে গেছে।”

খুশবু পড়লো বিপাকে।সুন্দর সাজানো জীবনে কি এক অশান্তির ঝড় এসে তাকে উলটে পালটে দিচ্ছে।অনিমা খুশবুকে টেনে বসালেন খাটে।সন্দিহান নজর বুলিয়ে বলেন,

” আরশাদের সাথে কবে থেকে সম্পর্ক হয়েছে তোর?”

আরশাদ তাকে যে অনিশ্চয়তার দুয়ারে দাঁড় করিয়েছে এসব কী অনিমাকে বলা যায়?আরশাদ তার ফ্লুজিকে ভালোবাসে অথচ সে ফ্লুজি নয়।খুশবুর মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আরশাদের মানসিক সমস্যা।কিন্তু গত রাতে আরিব যেভাবে বললো সেভাবে মনে হচ্ছে খুশবুর নিজের মাথায় সমস্যা।তারা দুই ভাই ফ্লুজি ফ্লুজি করে তার কানের পোকা বের করে ছেড়েছে।অনিমার জহুরি চাহনি খুশবুর ভয় বাড়ালো।

” আম্মু আমি উনাকে অল্প স্বল্প চিনতাম অনলাইনের মাধ্যমে।উনি আমাকে পছন্দ করতেন আমি সেসব পাত্তা দিতাম না।কিন্তু আমার বিয়ের কথা শুনে তিনি দেশে আসেন যখন আমি বিপদে পড়ি ভাগ্যক্রমে উনার গাড়ির সামনেই পড়ি।”

” তুই ছেলেটাকে পছন্দ করিস?”

” হুম।”

খুশবু মায়ের সামনে প্রতিটা কথা সাজিয়ে মিথ্যা বললো।এর আগে পরিবারের সাথে কখনো এতটা মিথ্যা বলা হয়নি তার।হবে কী করে?খুশবুর তেমন কোন বন্ধু নেই যাদের সাথে ঘুরতে যেতে পরিবারের কাছে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলা লাগবে।এক্সট্রা ক্লাসের নাম করে বন্ধুদের সাথে চিল করবে।বন্ধুর জন্মদিনের কথা বলে প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরতে যাবে।

আরশাদের ফাঁদে পড়ে এক অনিশ্চয়তার জীবনে ঝুঁকে গিয়েছে সে।কে এই আরশাদ?বাস্তবতায় মানুষটা কেমন?আচ্ছা আরশাদ যখন জানতে পারবে সে তার ফ্লুজি নয় তখন কী ছুড়ে ফেলে দেবে তাকে?গভীর মৃত্যু খাদের কাছে হাটছে খুশবু একবার পা পিছলে গেলে সবটা এলোমেলো।তবে তো তার মৃত্যু নিশ্চিত।
.
কাচের দেয়াল গলিয়ে ভরা দুপুরের ব্যস্তময় শহরটা চোখে পড়তে আরশাদের চোখে চোখ রাখে খুশবু।ছেলেটাকে তাকে কিছুক্ষণ আগে বলেছে সেভাবে আছো বেরিয়ে আসো গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।খুশবু জামা পালটে বেরিয়ে গেল।মুখে তেমন কোন প্রসাধনী ব্যবহার করলো না।ব্যাগে পুরে নিয়েছিল সবকিছু।টুকটাক যা সাজার গাড়িতে বসে সাজলো সে।আরশাদ আড়চোখে বারবার দেখছিল খুশবুকে কিভাবে কোন স্টেপের পর কোন স্টেপ করছে।ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে নিলে আরশাদ বাঁধা দিয়ে বলে,

” আমি চুমু খাওয়ার পর তোমার ঠোঁটটা যেমন রক্তিমা কুণ্ডলী পাকায় ঠিক সেই রঙটা তোমাকে বেশি মানায়।”

খুশবুর দু’কান কেমন ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো।লজ্জায় ভারি হলো দু’গাল।

দুপুরের সময়টাতে বাসা থেকে কেউ খেয়ে বের হলো না বিধায় আরশাদ আগে খাবার অর্ডার করলো।দুজনে বসেছে পাশাপাশি।খুশবুর অপ্রস্তুত ভাবটা বোঝা যাচ্ছে না তবে কি খুশবুর জড়তা ভাবটা কেটেছে?আরশাদ একটা স্ট্যাম্প এগিয়ে দিল খুশবুর নিকট,তাতে চোখ বুলিয়ে হতভম্ব মেয়েটা।তার শরীর কাঁপছে গলা শুকিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।

” আরশাদ আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন।”

” সরি জান।”

” মিথ্যাবাদী এই কাগজের কোন মূল্য নেই আমার কাছে।আরশাদ বিয়েটা ছেলে খেলা নয়।”

” আমার কাছে এটা তোমাকে কাছে রাখার দলিল।এখন হয়তো তা আর কাজে লাগবে না।মম ডেড গ্র‍্যানি সবাই সম্মতি দিয়েছেন।যদি তোমার বাবা সময় দেন তবে সবাই একমাসের মধ্যে দেশে আসবে।আর আজ সন্ধ্যায় বড় মামা যাবেন তোমার বাবার কাছে।ছোট মামা দেশের বাইরে তাই যেতে পারবেন না।তোমার বাবা যখন জানতে চাইবেন তুমি কি চাও তখন কী বলবে?নিশ্চয়ই বলবে বাবা যা চান তাই হবে।

” আমি কি বলবো তা আমার ভাবনায় আছে আরশাদ।”

” আমি তোমাকে চেয়ে এতদূর এসেছি আমাকে তুমি খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না।”

” গলায় তরবারি নিয়ে আমি আপনাকে মেনে নিয়েছি।আদৌ জানি না আপনার মনে কি চলছে।যদি আপনি মিথ্যা হন তবে ওই তরবারি সত্য হয়ে যাবে।এক টানে আমার জীবনের ইতি ঘটবে।”

” চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখতে পারো।এই আরশাদ ইহসান কখনো তোমাকে ঠকানো তো দূরের কথা অমর্যাদা করবে না।”

” আপনিও আমাকে বিশ্বাস করুন।আমি আপনার ফ্লুজি না আমি ভিন্ন আরেক মেয়ে।”

আরশাদ শ্লেষ হাসলো।হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল খুশবুর গাল।

” আমি জানি তুমি ফ্লুজি নও।ফ্লুজি তো আমার দেওয়া এক নাম।যে নামে ভালোবেসে ডাকি তোমায়।ফ্লুজি মানে কী জানো?ফ্লুজি মানে সুন্দরী।তুমি ফুটন্ত ফুলের ন্যায় সুন্দর আমার কাছে।”

” আরশাদ আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন না।”

” তুমি আমাকে বুঝতে চাইছো না ফ্লুজি।আমরা অতীতটা ভুলে যাই গত কয়েকদিনের কথা ভাবি।তুমিই আমার ফ্লুজি।দীর্ঘ এই জীবনে কখনো কাউকে নিজ থেকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরিনি।অথচ দেখো তোমার কাছে আমি নির্লজ্জ বেহাইয়া।বারবার তোমার কাছে ছুটে যাই।সত্য মিথ্যার আড়ালে তুমি আমার শুরু তুমি শেষ।তুমি আমার সাথে থাকলেই হবে,এই জীবনে আর কেউ না আসুক কাউকে লাগবে না।”

অর্ডার করা খাবার চলে এসেছে আরশাদ চুপ হয়ে গেল।তার ফ্লুজির কোন ভাব আবেগ বোঝা যাচ্ছে না।হাতের স্ট্যাম্পটি দুমড়ে মুচড়ে ধরলো আরশাদ।

” আমার জান প্লিজ কোন গন্ডোগোল করো না।তোমাকে আমার দরকার।”

” জেদে পড়ে বিয়ে করছেন তাই তো?”

” ছোট বেলা থেকে আমার শখ কম।পছন্দের জিনিস কম।চাওয়া পাওয়া অল্প স্বল্প।কিন্তু আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি নিজের করেছি।আর তুমি তো ভালোবাসা আমার আবেগের বিষয় এই ব্যপারে কোন কম্প্রোমাইজ আমি করতে পারবো না জান।”

খুশবু মুখে তালা লাগায়।সে জানে বিয়েটা তার আরশাদের সাথে হবে।হতেই হবে।আরশাদের সাথে যদি বিয়ে না হয় তবে খুশবু নিজেই মানসিক পীড়নে মরে যাবে অপরদিকে খুশবু যদি আরশাদের না হয় তবে আরশাদ তার বাকি খেল দেখাবে।
.

মাগরিবের নামায শেষে নাস্তা করতে বসেছেন বাহারুল হক।খুশবুর আতঙ্কিত মুখটা তিনি বার বার পরখ করছেন।বিয়ে সম্পর্কে মেয়েকে তিনি কিছুই বলেননি।অনিমা ভীষণ রেগে আছেন তার কাজের ধরণে বোঝা যাচ্ছে তিনি কতটা রেগে।নেহা নুহাকে কোলে নিয়ে টুকটাক কাজ এগিয়ে দিচ্ছে।অনিমা নেহা এবং খুশবু এই তিন মানবীর মনে চলছে একই কথা কখন আরশাদ আসবে তার গার্জিয়ান নিয়ে।কিয়ৎক্ষণ আগে শামীম ফোন করে নেহাকে জানিয়েছেন মোশারফ ভাই তার সাথে আলোচনা করেছেন আরশাদ এবং খুশবুর বিয়ে সম্পর্কে।শামীম মন থেকে চায় আরশাদের সঙ্গে খুশবুর বিয়ে হোক।জেনে শুনে ভালো পাত্র হাত ছাড়া করার কোন মানে নেই।

ডোর বেলের শব্দে খুশবুর মন ছলকে উঠে।কে এসেছে?নিশ্চয়ই আরশাদ।নেহা দ্রুত দরজা খুলে মোশারফ হোসাইন তার স্ত্রী,আরশাদ এবং আরিবকে দেখতে পায়।তার সঙ্গ নিয়ে এসেছে শামীম।অনিমার হাসি প্রশস্ত হয় তিনি সকলকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান।বাহারুল হক কিঞ্চিৎ অবাক হলেন বিনা দাওয়াতে এরা কেন এসেছেন?মোশারফ হোসেন একজন ব্যস্ত মানুষ বেশ সম্মানীয় ব্যক্তি উনি।কিন্তু হঠাৎ বাহারুল হকের বাড়িতে কেন এলো?

খুশবু নুহাকে কোলে নিয়ে দ্রুত চলে যায় নিজের রুমে।বাহারুল হক সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলেন অনিমা সবার জন্য নাস্তার আয়োজন করেন।দুই পরিবারের মাঝে বেশ ভালোই আড্ডা চলছিল।আরশাদের মামি অনিমার উদ্দেশ্যে সকলের সামনে বলেন,

” আপনার ঘরে তো একটাই লক্ষ্মী তিনি কই?দেখতে পারছি না যে।”

অনিমা খুশবুকে ডাকলো মেয়েটা ভয় নিয়ে এসে উপস্থিত হলো সবার সামনে।আরশাদ আড় চোখে একবার দেখে তার নজর সরালো।কেটে গেছে আরো কিছুটা সময় খুশবু চলে যেতে মোশারফ হোসেন খুশবুর জন্য প্রস্তাব রাখে।কিন্তু তার বিনয় প্রস্তাবে ফিরিয়ে দিলেন বাহারুল হক।শামীম ভীষণ অপ্রস্তুত হলেন বাহারুল হক কি করে পারছেন এই বোকামি কাজটা করতে।সবার যুক্তি সবার চাওয়া পাওয়ার দাম দিলেন না বাহারুল হক।তিনি তার কথা এবং যুক্তিতে সচল রইলেন।তিনি এক কথায় বলে দিলেন মেয়ের বিয়ে রোহানের সাথেই হবে।

আরশাদ খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পাত্র নয়।বাহারুল হক যখন নিজের কক্ষে ফিরে গেলেন তখন সে অনিমার উদ্দেশ্যে বলে,

” আমি দম নিয়ে এসেছি, প্রস্তাব রেখেছি আন্টি।আপনারা আমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিলেও আমার হাত কিন্তু আমি পূর্ণ করতে পারবো।”

” তোমার আঙ্কেলকে আমি বোঝাবো।আমরা সবাই রাজি তিনি আর কতক্ষণ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে আমিও দেখবো।”

আরশাদের পরিবার বেরিয়ে গেল।আরশাদ বুঝতে পারলো তার ফ্লুজি এখন ভয়ে আছে নিশ্চয়ই তার পরিবারে এখন যু দ্ধ যাবে।পকেট থেকে দ্রুত ফোন বের করলো আরশাদ।ফ্লুজিকে মেসেজ করলো তৎক্ষনাৎ।

“আমার জান ভয় পাবে না।আমি আছি তো।জাস্ট একবার ফোন দিয়ে বলবে বের হও তোমার সঙ্গে যাব,দেখবে এই বান্দা হাজির।”

” বাবা তার জেদে অনড়।সবার নিয়তিতে সবটা নেই আরশাদ।”

” তোমার নিয়তিতে আমার স্থান হোক। শত ঝড় ঝাপটা স্রোতের বিপরীতেও তোমার শেষ ঠিকানা আমার গন্তব্যে হোক।”

__চলবে…..
গ্রুপ অনুপ্রভার বৈঠকখানা – Onuprova Meherin 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here