#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৫
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
রাইয়ের কথায় সবাই ভুত দেখার মতো মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। কারন এতোদিন তো তারা অন্য কিছুই শুনেছিল। কেউ কিছু বলবে তার আগে মেহবিন বলল,,
“আমার পার্সোনাল বিষয়ে আপনারা না ঢুকলে খুশি হবো। আমি যেভাবেই আমার লাইফ লিড করি না কেন? তাতে আপনাদের কিছু যায় আসে না। আর আমি চাইও না আমাকে আমার জীবনের যাপনের ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করুক। তাই দয়া করে প্রশ্ন করবেন না আর করলেও আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
একথা শুনে রাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মেহবিনের দিকে। তবে এই মুহূর্তে চুপ থাকাই ভালো তাই কোন কথা বললো না। বাকিরা আর কি বলবে মেহবিনের কথা শুনেই মুখ বন্ধ। তখন মেহবিন বলল,,
“কার কি হয়েছে এ বাড়িতে?”
তখন আরিফা জামান বললেন,,
“আসলে নুপুরের মায়ের একটা কিডনি অকেজো ধরা পরেছে সেটারই অপারেশন এর জন্য ওনাকে ডাকা।
“এটা তো ডক্টর নুপুরই করতে পারতেন ? তিনিও তো এই বিষয়ের ডক্টর।
তখন নুপুরের মা বলল,,
“আমার মেয়ে করবে কিভাবে শুনেই তো আমার মেয়েটা আধমরা হয়েছে একটু পর পর কাঁদছে। যদি আমার কিছু হয়ে যায় সেই জন্যই তো আরবাজের সাথে আমার মেয়েটার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো হলো না।”
মেহবিন নুপুরের দিকে তাকালো দুঃখের কিছুর ছিটেফোঁটাও দেখতছ পেল না মেহবিন। ও বলল,,
“ওহ আচ্ছা। চিন্তা করবেন না রাই খুব ভালো ডক্টর ইনশাআল্লাহ আপনার অপারেশন সাকসেসফুল হবে।”
“ও যে বলল তুমি ওর থেকেও ভালো তাহলে তুমিই করো না।”
“আমি ভালো এর মানে এই নয় যে রাই খারাপ। ওকে সেই সুদূর ইন্ডিয়া থেকে এখানে এনেছেন। আর এখন ভালো পেয়ে গেলেন দেখে ওর কোন মুল্য নেই নাকি। ডেকে এনে অপমান করা বলে এটাকে।”
তখন রাই মেহবিনের হাত ধরে বলল,,
“ধুর আমি কিছুই মনে করিনি। উনারা করাক না তোকে দিয়ে এতে আমি খুশিই আছি।”
“তুই চুপ থাক।”
“যার যার প্রাপ্য মর্যাদা তার পাওয়া উচিৎ। পৃথিবীতে এতো ডাক্তার থাকতে তোকেই কেন সিলেক্ট করলো সেটাও তো ভালোর কথা শুনেছে বলে তাই। আর এখানে এসে তুই বললি আমি ভালো ওমনে আমার কাছে করাতে চাইছে। এটাতে তোর সম্মানহানি হচ্ছে না নাকি। মানুষ কে তার সঠিক মর্যাদা দিতে শিখুন মিসেস ( নুপুরের মা)।”
তখন নুপুরের মা বলল,,
“আমি সেটা মিন করে বলি নি। নিজেকে নিয়ে ভিশন টেনশনে আছি ভয় হচ্ছে তাই আমায় মাফ করে দিন। আমার অপারেশন রাই মালিকই করবেন।”
“হুম বুঝলাম। যাই হোক আসছি আমি।
তখন রাই বলল,,
“আরে দাঁড়া আমিও যাবো তো তোর সাথে!”
“তোর না ফ্লাইট আছে।”
“ক্যানসেল করে দিয়েছি তোর কাছে থাকবো দুদিন।”
“কি!”
“হ্যা এখন কথা না বলে চল তোর বাড়ি।”
“তুই এখন ইন্ডিয়া তোর বাড়ি যাবি আমি রাখবো না তোকে।”
“আমি থাকবো।”
“এখানে কিন্তু তোর ইলাহী রুম নেই সাথে এই আবহাওয়ার সাথে তুই কমফোর্টেবল হবি না। অসুস্থ হয়ে পরবি আমি চাই না দুদিন এখানে থাকতে গিয়ে দশদিন বিছানায় পরে থাকিস।”
“আরে কিছু হবে না তুই আছিস না আমার ডাক্তার বন্ধু।”
“রাখবো না তোকে তাছাড়া দাদান দিদান চিন্তা করবে না।”
“আরে কেউ কিছু করবে না দাড়া ফোন দিচ্ছি বুড়োবুড়িকে।”
“রাই!”
“সরি সরি দাদান দিদান কে।”
রাই ফোন দিল মেহবিনের কথা শুনেই তারা রাজি সাথে বলল ওর কাছে দিতে। মেহবিন ফোন ধরে সালাম দিল ওর রাইয়ের দাদা দাদি রাইয়ের থেকেও বেশি ড্রামাবাজ এখন বলছে তারাও নাকি আসবে। তা শুনে মেহবিন বলল,,
“তোমরা কি রাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাগল হলে নাকি। তোমাদের আসতে হবে না তোমার নাতজামাই পেয়ে গেলে আমিই চলে যাবো তোমাদের ওখানে।”
কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিল মেহবিন তখন রাই ভ্রু নাচিয়ে বলল,,
“এবার এবার!
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“হুম চলুন এখন!”
শেখ পরিবার বলবে কি ওদের দিকেই এতোক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। রাই আর মেহবিন বের হবে। তখন রাইফা বলল,,
“আপনারা দুজন কি বেস্ট ফ্রেন্ড?”
তখন রাই পেছনে ফিরে হেঁসে বলল,,
“না বেস্ট ফ্রেন্ড না কারন মেহবিন বেস্ট ফ্রেন্ড নামক শব্দটাকে সহ্য করতে পারে না। তবে আমাদের সম্পর্কের নাম দেওয়া যেতে বন্ধু কম বোন বেশি।”
মেহবিন পেছনে ঘুরলো না ঘুরলে হয়তো দেখতে পেত অন্য কিছু। মেহবিন যাচ্ছে দেখে রাই ও পেছনে দৌড় দিল। বাকিরা শুধু দেখেই গেল। তবে সবার মনেই প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু করতে পারলো না। রাইফা শান্ত চোখে মেহবিন কে যেতে দেখল তারপর সে নিজেও আস্তে আস্তে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। নুপুরের বাবার এই অবস্থায় নুপুরের মা অসুস্থ তাই ওনাকে এখানে আনা হয়েছে। এখানেই থাকবে এখন থেকে কিছুদিন। থাকাটা যাতে পার্মানেন্ট হয় এই জন্য মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অবশ্য মেয়েও দুই পায়ে রাজি।
______________
“ডাক্তার তুমি আবার এই আপদ টারে পাইলা কই?”
তাজেলের কথা শুনে মেহবিন ওর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো। তখন রাই বলল,,
“এই তুমি আমাকে আপদ বলছো কেন?”
“আপদ কওয়া ভুল হইছে তোমারে বিপদ কওয়া দরকার আছিল।”
“কি হয়েছে নেত্রী সে কি করেছে?”
“কি করে নাই আমি কুলসুম রাস্তায় হাঁটতে ছিলাম। হেয় গাড়ি থামাইয়া জিগাইলো চেয়ারম্যান বাড়ি কোন দিকে আমরা কইয়া দিলাম আর হেয় যাইয়া আমাগো রাস্তার ধারে রান্দার জন্যে বাদাইল বাইর করুম দেইখা কাটা কলা গাছ রাস্তায় উঠাইছিলাম উনি গাড়ি নিয়া যাওয়ার সময় ধাক্কা মাইরা আবার নিচে ফালাই দিছে আর হেইডা একদম ঝোড়ে গিয়া পরছে। আমি আর কুলসুম ঐডা নিচ থেইকা উডাইয়া দা আনবার গেছিলাম বাড়ি আর ঐডাই নেওয়ার জন্য আসতেছিলাম। হেয় আইসা আমাগো সব কষ্ট বিফলে দিছে।
তখন মেহবিন রাইয়ের দিকে তাকালো তখন রাই বলল,,
“আমার দিকে তাকাস কেন? আমি কি গাড়ি চালাইছি নাকি গাড়ি তো ড্রাইভার চালাইতে লাগছিল। আর কলা গাছের সময় আরেকটা গাড়ি যাচ্ছিল তাই সাইড দিয়ে যাওয়ার সময় লেগে গেছে হয়তো।”
“তুমি কোন কথা কইবা না তুমি গাড়িতে আছিলা মানে দোষ তোমার ।”
“আচ্ছা সরি।”
“তোমার সরিতে কি এহন কলা গাছ হাইটা আমার কোলে আসবো।”
তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো আর বলল,,
“বাদ দাও ও কিছু করে নি নেত্রী। কাল আমার বাড়ির পেছন থেকে তোমায় কলা গাছ কেটে বাধাল বের করে দেব।”
“কাল তো কাটা লাগবো আইজ কাটা আছিল ওই রাস্তার নিচে কাকা কাটছিল।”
“সমস্যা নেই কাল আমি কেটে দেব।”
“আইচ্ছা। দাদি কয়দিন ধইরা বাদাইল বাদাইল করতেছে। হের নাকি বাদাইল ভাজা খাইতে মন চাইছে।”
“এখন তো সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে নাহলে আজই কেটে দিতাম।”
“সমস্যা নাই।”
“হুম এখন গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাও আর মাগরিবের নামাজ পড়ে পরতে বসো।”
“আইচ্ছা কিন্তু ইডা কিরা হেইডা তো কইলা না?”
“ওর নাম রাই আমার বন্ধু আমার সাথে দু’দিন থাকবে।”
কথাটা শুনে তাজেল এমন লুক দিল যেন ওর চোখ বলছে আমার ভালোবাসায় তুই ভাগ বসাইতে আইছোস তোরে আমি ছাড়ুম না। তাজেল মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আইচ্ছা। তাইলে আমি গেলাম।”
“হুম!”
তাজেল চলে গেল যেতে যেতে পেছনেও তাকালো দুই তিন বার। ও যেতেই রাই বলল,
“ও কে?”
“ওর নাম তাজেল আমি নেত্রী বলি।”
“কেন?”
“সে বিরাট কাহিনী ভেতরে চল।”
“বাধাল কি? মেয়েটা বার বার বলছিল।”
“কলা গাছের ভেতরে থাকে সাদা রঙের শক্ত কাল দেখাবো তোকে। অনেক খোসা ছাড়িয়ে তারপর ভেতরে পাওয়া যায়।”
“ওহ আচ্ছা!”
মেহবিন ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ওকে এক সেট থ্রিপিস দিয়ে বলল ফ্রেস হয়ে নিতে। রাই ফ্রেস হয়ে বের হতেই দেখলো মেহবিন কফি চকলেট আর নুডুলস এক ট্রে তে সাজিয়ে রেখেছে। দেখেই রাইয়ের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল।কারন এই তিনটা জিনিসই ওর পছন্দের। ও গিয়ে বলল,,
‘এহসাব মেরে লিয়ে?’
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
‘নেহি পারোসি কি স্যাহিলি কে লিয়ে।”
‘ইটস্ মিনস মেরে লিয়ে।”
‘ঐ তোর হিন্দি বাদ দে আর চুপচাপ খেয়ে নে।”
“হুম দোস্ত খুব ক্ষুদা লাগছে।”
ও বিছানায় বাবু হয়ে বসে নুডুলসের বাটিটা হাতে নিয়ে আয়েস করে খেতে লাগল আর বলল,,
“এই জিনিসটাই বিগত দেড় বছর আমি খুব মিস করেছি ইয়ার।”
“আমিও মিস করেছি তোর এই ঢং।”
‘হ হইছে এখন জিজুকে কল দাও। এইবার জিজুরে না দেখে আমি দেশে যাইতেছি না।”
‘সে এখানেই আছে কল দিলেই চলে আসবে এতো চিন্তা করতে হবে না। কালকে বিকালে দেখা করিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ।”
‘হুম এখন তুই খাবি নাকি নুডুলস?”
“না আমি কফি খাচ্ছি এই ঠিক আছে। এখন আর কিছু খাবো না।”
‘আইচ্ছা।”
তার কয়েকমিনিট মাগরিবের আজান দিল। মেহবিন ওযু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিল। ওরা এসে গল্প করতে লাগলো। মেহবিন আর রাই ক্লাসমেট সেই সাথে রাইদের দাদাদাদির বাসায় পেং গেস্ট থাকতো। রাইয়ের মা বাবা নেই দাদাদাদির কাছেই মানুষ। উনাদের বিদেশেও একটা বাড়ি আছে কিন্তু পৈত্রিক বাড়ি ইন্ডিয়ায়। রাইয়ের পড়াশোনার জন্য ওখানেই তিনজনে গিয়েছিল। ছেলে বউমার মৃত্যুর পর দাদাদাদির বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল রাই তাই ওকে কখনো কাছছাড়া করেন না তারা। মেহবিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল যেদিন ও সবকিছু জানলো। যদিও প্রথমে মেহবিন রাইয়ের সাথে সম্পর্ক করতে চায় নি কারন ও বন্ধু বানাতে চায় না। মেহবিন পড়াশোনা ছাড়া রুম থেকেই বের হতো না। অবশ্য মাঝে মাঝে ওর দাদা দাদির সাথে গল্প করতো। কিন্তু রাইকে তেমন একটা সুযোগ দিতো না। রাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারপর বন্ধু হয়েছে। বন্ধু না হওয়ার আরেকটা কারন ওর নাম রাই। আর ও বেস্ট ফ্রেন্ড নামক শব্দটাকে পছন্দ করে না। অতঃপর আস্তে আস্তে রাই হয়ে উঠে মেহবিনের হাসির কারন। যতো ফালতু কাজ আছে সবগুলো করে মেহবিন কে হাসাতো। অতঃপর মেহবিন ওকে জানায় ওরা কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড নামক শব্দটাকে ইউজ করতে পারবে না। অতঃপর মেহবিন কিছু ঘটনা বলে। রাই তারপর থেকে ঐ শব্দটার ব্যবহার করে না। দুই বান্ধবী অনেক গল্প করলো তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল সকাল তাজেল হাজির হাতে বড় একটা দা নিয়ে। মেহবিন সকালে রাইকেও উঠিয়েছে যদিও রাইয়েই একটু অসুবিধা হচ্ছিলো এখানে খাপখায়িয়ে নিতে। তবুও সে সামলে নিয়েছে তাছাড়া মেহবিন তো আছে। তাজেলের হাতে দা দেখে রাই বলল,,
“তুমি দা হাতে কি করছো?”
তাজেল একটা দাঁত কেলানি দিয়ে বলল,,
‘তোমার ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করুম তো তাই নিয়া আইছি।”
তাজেলের কথা শুনে রাই মেহবিনের পেছনে গিয়ে ওর হাত ধরলো। তা দেখে তাজেল খিলখিল করে হাসলো আর মেহবিন মুচকি হাসলো। তাজেল হাঁসি থামিয়ে বলল,,
“ডাক্তার তোমার বন্ধু তো বুকদা। এই দাও দিয়া কি হেতির গলা কাটা যাইবো ঠিকমতো পোসই লাগবো না।বাদাইল বাইর করুম হের লাইগা এইডা আনছি।”
রাই পেছন থেকে বের হয়ে বলল,,
‘আগে বলবে না হুদাই আমাকে ভয় দেখাইলা।”
“তুমি এই বাচ্চা পুলাপাইন দেইখা ডরাইবা তা কি আমি জানি নাকি। ডাক্তার এহন নও আবার রানবো এহন।”
মেহবিন বাড়ির পেছনে গিয়ে একটা কলাগাছ কাটলো। ওপর থেকে কলা গাছের খোসা ছাড়ালো তখন তাজেল বলল বাকিটা সে ছাড়াবে। কিন্তু পারলো না অনেক শক্ত তাই মেহবিন ওকে খোসা ছাড়িয়ে বাধাল বের করে দিল। অতঃপর তাজেল বাড়ি চলে গেল। আজ শনিবার তাই মেহবিনের হাসপাতাল নেই। ও রাইকে নিয়ে পুরো গ্ৰাম ঘুরলো সাথে তাজেলকেও নিল। রাইয়ের অভ্যাস মেহবিনের সাথে বের হলে ওর হাত ধরে হাঁটবে। এদিকে তাজেলের ও সেইম। রাইকে হাত ধরতে দেখে তাজেলের মন চাইলো এখনি ওকে গিলে ফেলতে মেহবিন কে বলল,,
‘ডাক্তার আমার পাও বিষ করতেছে আমারে একটু কোলে নেও তো।”
তাজেলের কথায় মেহবিন ওর দিকে তাকালো। তাজেল অদ্ভুত ভাবে রাইয়ের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো আমাদের নেত্রীর জেলাসি। মেহবিন ভেবে পায়না এই মেয়েটা এমন কেন সে মেহবিনের ভাগ কাউকে দিতে রাজি নয়। মেহবিন হেঁসে ফেললো তাজেল দুই হাত উঁচু করে বলল,,
“নিবা না নাকি? না নিলে কইয়া দেও আমি বাড়ি যাইগা আস্তে আস্তে।”
মেহবিন হেঁসে ওকে কোলে নিল। এদিকে বেচারা রাই কি হলো কিছু বুঝতে পারলো না। কিছুদূর যাওয়ার পর তাজেল বুঝলো মেহবিনের একটু কষ্ট হচ্ছে তাই ও বলল,,
‘ডাক্তারের বন্ধু এহন তুমি নেও ডাক্তারের কষ্ট হইতেছে।”
তা শুনে রাই বলল,,
“আমার নিজেরই হাঁটতে কষ্ট হয় তোমাকে কোলে নিয়ে কিভাবে হাটবো আমি?”
“হ তাও ঠিক। তুমি যে চিকনা আমারে নিলে তোমার হাড্ডি মরমর কইরা ভাইঙ্গা পরবো। ডাক্তার আমারে নামাই দেও পায়ে বিষ কইমা গেছে।”
মেহবিন হেঁসে ওকে নামিয়ে দিল। এদিকে রাই তাজেলের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। ওকে এত বড় একটা কথা বলল। ও কিছু বলবে তার আগে মুখর এলো মাস্ক পরে মেহবিন ওর সাথে রাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিল। এক ফাকে মাস্ক খুলে চেহারাটাও দেখিয়ে দিল। কিছুক্ষণ কথা বলে মুখর চলে গেল। মেহবিনরাও বাড়ি ফিরে এলো। রাতে রাইকে মেহবিন তাজেলের ব্যাপারে জানালো তা শুনে রাই হাসলো আর খুশিও হলো এরকম মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। পরের দিন সকালে রাই চলে যাবে কারন এখানে ও মানিয়ে নিতে পারছে না। শহর হলেও একটা কথা ছিল এটা গ্ৰাম মেহবিনই পাঠাচ্ছে ওকে ও আরো তিন-চার দিন থাকতে চাইছিল একেবারে অপারেশন করে যেতে চাইছিল। যাওয়ার আগে তাজেলের গাল টেনে বললো মেহুর থেকেও তাজেলের কর্মকাণ্ড ও বেশি মিস করবে। সাথে এটাও বলল এভাবেই মেহবিন কে ভালোবেসো। রাই চলে গেল পাঁচ দিন বাদে আবার আসবে বাংলাদেশে নুপুরের মায়ের অপারেশন করতে। আরবাজদের হাসপাতালে।
_______________
আরবাজ বসে আছে পুরো শাহরিয়ার পরিবারের সামনে পাশে মুখর। একটু আগেই সে জানিয়েছে নাফিয়ার ব্যাপারে সবাই অবাক হলেও পরে আরবাজের পরিবার আর আরবাজ কে দেখে রাজি হয়েছে কারন সবাই আরবাজকে খুব ভালোভাবেই চেনে। মুখর মাহফুজ শাহরিয়ার কে আগেই বলেছে আরবাজ সব জেনেই এই প্রস্তাব দিয়েছে তাই তিনি কিছু বলেন নি। তবে ব্যাপারটা নাফিয়া জানে না। তখন হুট করে নাফিয়া বলল,,
“আমি ওনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই।”
আরবাজ নাফিয়ার সাথে ছাদে গেল। ওখানে গিয়ে নাফিয়া বলল,,,
‘দেখুন আপনি হয়তো আমার ব্যাপারে না জেনেই এই প্রস্তাব দিয়েছেন?”
তখন আরবাজ বলল,,
“আমি সবটা জানি মিস নাফিয়া।”
আরবাজের কথা শুনে নাফিয়া ওর দিকে তাকালো। আর বলল,,
‘তবুও আপনি প্রস্তাব দিলেন?’
আরবাজ হেঁসে বলল,,
“পৃথিবীতে বাচ্চাই সবকিছু নয়। সবথেকে বড় জিনিস টা কি জানেন মানসিক প্রশান্তি আর যদি থাকে পছন্দের মানুষটি তাহলে তো কথাই নেই।”
নাফিয়া সেদিনের ছেলেটার কথা ভাবলো সে কি বলেছিল আর আরবাজ কি বলছে। ও বলল,,
‘যদি একটা সময় মনে হয় বাচ্চাটাও একটা বড় ফ্যাক্ট।”
তুমি কিন্তু বাচ্চাটাকে বড় করে দেখছো কিন্তু আমি না। সবথেকে বড় কথা নাফিয়া একটা মানুষ সবদিক দিয়েই পারফেক্ট নয়। তবুও যদি বলো বাচ্চার কথা তাহলে বলবো এখানে ২% চান্স রয়েছে। অনেক সময় ০.৯৯% এও অনেক কিছু হয়ে যায় আর এখানে ২% আছে। তুমি জানো নাফিয়া বহু নবী নিঃসন্তান ছিলেন। হজরত জাকারিয়া (আ.) বার্ধক্য পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। তাছাড়া আল কুরআন এ সন্তান লাভের জন্য বিশেষ দোয়া রয়েছে। ইনশাআল্লাহ দুজন মিলে আমরা সেগুলো আমল করবো। হযরত মরিয়ম (আ) তিনি তার সময়ে যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ আসে তার জন্য তখন তিনি এই বিশেষ দোয়া করেছিলেন,
‘রব্বি হাবলি মিল্লাদুনকা জুররিয়্যাতান ত্বইয়্যিবাতান, ইন্নাকা সামিউ’দ দুআ।
অর্থ : হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা কবুলকারী।’
(সুরা : আল ইমরান, আয়াত : ৩৮)
হজরত ইবরাহিম (আ.) একসময় নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করেছেন—
‘রব্বি হাবলি মিনাস সলেহিন।
অর্থ: হে আমার প্রভু! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করো।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০০)।
উত্তম নেক জীবনসঙ্গী ও সন্তানের জন্য আল কুরআন এ দোয়া রয়েছে।
“রব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্বুররতা আ’ইয়্যুন ওয়াজাআলনা লিল মুত্তাক্বীনা ইমামা”। (সূরা ফুরকান:৭৪)
“অর্থ: ইয়া আল্লাহ আপনি আমাকে এমন স্বামী/স্ত্রী এবং সন্তান দান করুন যাদের দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।আর আপনি আমাকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন”
মহান আল্লাহ সময়ের মাধ্যমে তাঁর বহু নৈকট্যশীল বান্দাকে সন্তান নামক নিয়ামত না দিয়েও পরীক্ষা করেছেন, তাঁরা যথারীতি উত্তীর্ণও হয়েছেন। হজরত জাকারিয়া (আ) স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন, অনেক ধৈর্য ও দোয়ার পর মহান আল্লাহ শেষ বয়সে একজন সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আইয়ুব (আ) অনেক সন্তান-সন্ততি দিয়ে আবার তাদের কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। ইবরাহিম (আ) এর জীবনী থেকে জানা যায়, তাঁদেরও অনেক বছর নিঃসন্তান রাখা হয়েছিল। এমন অনেক উদাহরণ ইসলামে পাওয়া যাবে। তাই সন্তান না হলে হতাশ হওয়ার কারন নেই। (এখানে কিছু কথা সংগৃহীত)
সব শুনে নাফিয়া আরবাজের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। এই মানুষটা কতো করে ওকে চায় সেটা ওর কথার ধরনেই বুঝতে পারছে নাফিয়া। যেখানে কিনা ওকেই বিয়ে করার জন্য অন্যকে মানানো উচিত। সেখানে একজন ওর সমস্যার জন্যই ওকে মানাচ্ছে। ও অবাক হয়েই অস্ফুট স্বরে বলল,,
“ভালোবাসেন আমাকে?”
আরবাজ মুচকি হেঁসে বলল,,
‘ভালোবাসি কিনা জানিনা তবে তোমাকে আমার উত্তম জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। হয়তো ভালোবাসি বলেই পেতে চাই। তাই তো অনুভূতি খারাপ দিকে যাওয়ার আগে হালালভাবে তোমায় পেতে চাইছি।”
‘আমাকে পেয়ে কখনো আফসোস করবেন না তো। ভাববেন না আমার থেকে অন্য কাউকে পেলে ভালো হতো একটা সন্তান প্রাপ্ত হতো।
আরবাজ মুচকি হেঁসে বলল,,
“লেখিকা আজরিনা জ্যামির ছোট্ট একটা লেখা আছে,,
“প্রাপ্তি আর তৃপ্তির মাঝে বিস্তর ফারাক। সব প্রাপ্তি তৃপ্তি দেয় না। আবার জীবনের সব ইচ্ছে প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয় না।”
এই কথাটার মানে হলো আমরা কিন্তু সব প্রাপ্তিতে তৃপ্তি হতে পারি না। যেখানে তুমি প্রাপ্তিতে নেই সেখানে তৃপ্তি পাবো কিভাবে। আর জীবনের সব ইচ্ছে কিন্তু সত্যিই আমাদের জীবনে প্রাপ্তির খাতায় হয়না । কিন্তু আমি আমার এই ইচ্ছেকে প্রাপ্তির খাতায় যোগ করতে চাই।”
সব শুনে নাফিয়ার মুখে হাঁসি ফুটে উঠল ও বলল,,
“আমি রাজি।”
“অতঃপর দুলহান তাহলে রাজি হলো আমার।”
আরবাজের কথায় নাফিয়ার হাঁসিটা যেন আরো প্রসারিত হলো। আরবাজ হেঁসে নিচে চলে গেল। নাফিয়াও গেল। নাফিয়া আসলে মাহফুজ শাহরিয়ার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন বিয়ের জন্য সে জানালো তারও আপত্তি নেই। আরবাজ আসলে মুখর বলল,,
‘কি বলল নাফি?”
‘যা বলার তাই বললো তোকে বলবো কেন? আমাদের পার্সোনাল কথা।”
‘এখন পার্সোনাল কথা হয়ে গেল।”
‘হুম!”
আরবাজ সবার উদ্দেশ্যে একটা কথা বলল,,
‘আংকেল আমি আপনাদের আরো একটা কথা বলতে চাই।”
মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,
“হ্যা বলো বাবা।”
‘আংকেল আমি চাই নাফিয়ার সমস্যার কথা আমার বাড়ির কেউ না জানুক।”
‘এটা কি করে হয় পরে জানতে পারলে ওনারা কষ্ট পাবেন সেই সাথে আমাদের এবং নাফিয়ার প্রতি উনাদের বিরুপ ধারনা হতে পারে। তাছাড়া এটা একপ্রকার ধোঁকা দেওয়াও বলা যায়।
‘ধোঁকা তখন হতো যখন আমি জানতাম না। নাফিয়ার সাথে আমার জীবন জুড়তে যাচ্ছে তাই আমি জানাটাই যথেষ্ট নয় কি। আর বাকি সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দেন। তারা কখনো নাফিয়ার সমস্যার কথা জানবেন না। সবথেকে বড় কথা আমার ওপর বিশ্বাস করুন যাই হয়ে যাক না কেন আমি ওর হাত ছাড়ছি না।”
আরবাজের কথা শুনে সবার মুখে প্রশান্তি ছেয়ে গেল মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন আরবাজ যা চায় তাই হবে। তিনি এটাও বলল মাহফুজ শাহরিয়ার অসুস্থ থাকার কারনে আলভির বিয়েটা এখনো হয় নি। এখন বাড়ির মেয়ে ছেলের বিয়েটা একসাথে ও দেওয়া উচিত হবে কি না। যদি আরবাজের পরিবার রাজি থাকে তাহলে বিয়ে বউভাত কোন রিসোর্ট এ গিয়ে করা যাবে। আরবাজ বলল এ বিষয়ে ওর পরিবারের সাথে কথা বলতে। আরবাজ কথা শেষ করে চলে গেল মুখর কে নিয়ে ও ও ফিরবে আরবাজের সাথে।
________________
নুপুরের মায়ের অপারেশন সাকসেসফুল হলো। সেই ফাকে সবাই নাফিয়াদের বাড়ি গিয়ে সব ফাইনাল করতে গেল। সবার নাফিয়াকে অনেক পছন্দ হলো সেই সাথে পরিবার ও। তবে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে শেখ শাহেনশাহ এতে বেকে বসলেন বিয়েটা তার বাড়িতেই হবে কোন রিসোর্ট এ না কারন তার নাতির বিয়েতে পুরো মহুয়াপর খাবে। আর ধুমধাম করে দেবে নাতির বিয়ে দেবে। এ কথা শুনে আলভি বলল নাফিয়ার বিয়েটাই তাহলে আগে দিতে। ওদেরটা নয় পরে দেওয়া যাবে ও নিজেও নাফির বিয়েতে মজা করতে চায়। এ কথা শুনে মাহফুজ শাহরিয়ার বাঁধ সাধলো এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে এক খরচেই দুই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আছলাম আর মাহফুজ শাহরিয়ার। আলভির বিয়েটা দেরি হচ্ছে তাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটাও তারা জানালেন পরে সব শুনে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন আলভির বিয়েটা সেরে ফেলতে আর আরবাজ আর নাফিয়ার এখন এঙ্গেজমেন্ট করে রাখুক পরে বিয়ের অনুষ্ঠান করা যাবে। কথাটা শুনে সবাই রাজি হলো। অতঃপর দশদিন পর আরবাজ আর নাফিয়ার এঙ্গেজমেন্ট। শেখ শাহেনশাহ চান তার বাড়িতেই হবে। তারমধ্যে তারাও ঘুরে আসুক মেয়ের কোথায় বিয়ে হচ্ছে। শাহরিয়ার পরিবার রাজি হলো এতে। অতঃপর দশ দিন পর আরবাজ আর নাফিয়ার এঙ্গেজমেন্ট ঠিক করা হলো। রাতে মেহরব চৌধুরী কে সব জানালে তিনি আছলাম আর মাহফুজ শাহরিয়ার মিলে বিশদিন পর আলভি আর মাইশার বিয়ের ডেট ফিক্সড করলেন।
_____________
রাতে বাড়ি ফিরে সবাইকে নিয়ে বসে শেখ শাহনাওয়াজ আরবাজকে বললেন,,
“আরবাজ তোমার নানাবাড়ি বলা উচিৎ নয় কি?”
তখন আরিফা জামান বললেন,,
‘আবার তাদের কেন?”
তখন আরবাজ বলল,,
‘বড়মা তাদের জানার অধিকার আছে তাদের বাড়ির মেয়ের ছেলের বিয়ে হচ্ছে এবং বিয়ে কোথায় আর কার সাথে হচ্ছে।”
অনেকদিন পর বড়মা শুনে আরিফা জামানের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আরবাজ তাকে সহজে ডাকে না। তবে আজ কেন? ডেকে কি বুঝিয়ে দিল তার সাথে ওর সম্পর্ক কি। আরিফা জামান নিজেকে সামলিয়ে বললেন,,
“না আমি বলতে চাইছিলাম অনেক বছর ধরে তো তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই তাই বলছিলাম।”
তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
‘অনেক বছর নেই তো কি হয়েছে? এখন হবে হাজার হোক তারা আমাদের আত্মীয়। আর তাদের বাড়ির মেয়ের ছেলের বিয়ে সম্পর্কে তাদের মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে।”
তখন আরিফা জামান কষ্টমিশ্রিত হেঁসে বললেন,,
‘হুম বলুন তাদের সমস্যা নেই। তাদের বরঞ্চ দুদিন আগে আসতে বলুন।”
বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন। তখন মিশু বলল,,
“আমাদের মামাবাড়ি আছে বাবা? কই কখনো নো তো বলোনি। আগে বললে আমিও মামাবাড়ি বেড়াতে যেতাম কতো কত মজা করতাম। আরিফ মামা তো আমাদের বাড়িতেই থাকে তাই আমি ভেবেছিলাম আমাদের মামাবাড়ি নেই।”
তখন আরবাজ বলল,,
‘আমাদের মামাবাড়ি আছে মিশু আর মামাও আছে আরেকজন।”
‘বাহ দুইটা মামা?”
‘হুম দুইটা মামা।”
‘আমাদের মায়েদের মতো কিন্তু এক মা তো নেই বাজপাখি। এক মা তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এখন শুধু মামনি আছে।
~চলবে,,
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। এখানে যারা ভাববেন রাইকে শুধু শুধু গল্পে আনা হয়েছে এমন টা কিন্তু নয় শুধু শুধু আনা হয় নি তা মন দিয়ে পরলেই বুঝতে পারবেন। আরেকটা কথা কাল হালকার ওপর ঝাপসা রহস্যের অনেক কিছুই উৎঘাটন হতেপারে রেডি থাইকেন।