কাব্যের_বিহঙ্গিনী #পর্ব_৪৪ #লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

0
535

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪৪
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন রাইফার দিকে তাকাতেই দেখলো ও অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে দেখে মেহবিন বলল,,

“তুই ঘুমাস নি?”

রাইফা বলল,,

‘ঘুমিয়েছিলাম কিন্তু হুট করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। তোর দিকে তাকাতেই একটা অদ্ভুত ইচ্ছে হচ্ছে।”

“কি ইচ্ছে?”

“আজ চাঁদ উঠেছে তাই না?”

মেহবিন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,,

‘হুম উঠেছে।”

“তোর কাঁধে মাথা রেখে চন্দ্রবিলাশ করতে ইচ্ছে করছে খুব। কে জানে হয়তো আর কোনদিন এই সুযোগটা পাবো কিনা?”

মেহবিন ওর দিকে তাকালো আর বলল,,

“কেন পারবি না এখনো অনেকটা সময় বাকি আছে তোর।”

‘কেন মিথ্যা বলছিস বলতো?আচ্ছা যাই হোক এখন পুরোনো কথা বাদ। এখন তুই বল আমার ইচ্ছেটা পূরন করবি কিনা?

মেহবিন বুঝতে পারলো ও একটু ভালো থাকতে চাইছে তাই কিছু বললো না। ও এগিয়ে গিয়ে আয়াতুল কুরসি আর তিন কুল পাঠ করে ফু দিল। নিজেও পড়লো নিজের জন্য তারপর বলল,,

“হাঁটতে পারবি?”

‘না হাঁটতে পারলে কি তুই কোলে নিবি? তখন তো ঠিকই এনেছিলি। আচ্ছা আমায় বল তুই এতো শক্তি পাস কোথায় বলতো। যদিও আমি মোটা না তবুও একটা ব্যাপার আছে তো?”

মেহবিন কিছু বললো না হেঁসে ওর হাতের ক্যানুলা থেকে স্যালাইন এর পাইপটা খুলে ফেলল তারপর ওকে কোলে নিল। হাঁটা ধরলো লিফট দিয়ে সোজা ছাদে চলে গেল। যদিও সবার যাওয়ার অনুমতি নেই তবে মেহবিনের আছে। রাত দশটা বেশ মানুষের আনাগোনা এখনো আছে। একজন মেয়ে আরেকজন মেয়েকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে সবাই ওদিকে তাকিয়ে ছিল তাতে মেহবিনের কি সে তার কাজ ঠিকই‌ করলো। ছাদে দু’টো বেঞ্চ রাখা উঠে তার একটাতে রাইকে বসিয়ে দিল।সাথে নিজেও বসলো মেহবিন একটু হাঁপিয়ে গেছে ও বড় বড় করে শ্বাস নিল। তারপর বলল,,

“নিন এবার মাথা রেখে চন্দ্রবিলাশ করুন ম্যাডাম। চাঁদটা যে আপনার দেখারই অপেক্ষায় ছিল আজ।”

রাইফা মুচকি হেসে মেহবিনের দিকে তাকালো। রাইফা মাথা রাখলো তারপর একটু চাঁদের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘এই চাঁদটাও কি অদ্ভুত মেহু প্রথম প্রথম দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে জীবনের কিছু স্মৃতি মনে করিয়ে অসহায় করে দেয়। মনে করিয়ে দেয় তার একাকীত্বতা।”

“কিছু কিছু জিনিসের একাকীত্বতাই তার সৌন্দর্য!”

“আমাদের বিচ্ছেদের কারন কি মেহু?’

মেহবিন রাইফার দিকে তাকালো। রাইফা নিজেও সোজা হয়ে বসে মেহবিনের দিকে তাকালো। মেহবিন মুচকি হাসলো আর বলল,,

“সেটা তো আমার থেকে ভালো তুই জানিস?”

‘তোকে বিশ্বাস না করে সেদিন সাগরিকাকে সঙ্গ দেওয়াই হয়তো কারন টা।”

মেহবিন হাসলো আর বলল,

“আচ্ছা সেসব তো পরের কথা আর আগের কথাগুলো বল তোকে সাগরিকার রাই ডাকা‌। ওর সাথে বেশি সময় কাটানো ওর সাথে বাড়ি ফেরা আমাকে একটাও ফোন না করা ওগুলো কি ছিল রাই?

“সেগুলো করাই আমার ভুল ছিল। ওকে রাই বলাতে কিছু বলি নি ও মায়ের সামনে একদিন বলেছিল আমরা তো বন্ধু তাহলে ও তো রাই বলে ডাকতেই পারে । মা বলেছিল কেন নয় তাই কিছু বলিনি। তবে ওর সাথে কথা বলা ও নিজেই কথা দিয়ে ব্যস্ত রাখতো। আর বাড়িতেও তেমনই সবসময় চিপকে থাকতো আমি সৌজন্যতার খাতিরে কিছুই করতে পারতাম না। ”

“ভুল বললি রাই? একটা মানুষ চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকে না। তখন ওর নতুন নতুন জিনিস তোকে মুগ্ধ করতো‌। তোকে মাঝে মাঝে গিফট করতো এটা তোর ভালো লাগতো‌ । ওর প্রতি তোর সফট কর্নার তৈরি হয়েছিল। সবথেকে বড় কথা কিছু সময়ের জন্য হলেও আমার থেকে ওর সঙ্গ তোর ভালো লাগতো। তাই তুই ওর সাথে থাকতি। আমি তোকে ভালোভাবেই চিনি রাই আমাকে দয়া করে কোন এক্সিউজ দিস না।”

সব শুনে রাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো। এই মেয়েটা এখনো ওকে ভালো মতো চেনে।

“আমি তোকে বিশ্বাস করি মেহু?”

মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। তা দেখে রাইফা বলল,,

“তুই ভাবছিস অবিশ্বাসের জন্য বিচ্ছেদ হয়েছে কিন্তু আমার কাছে তা অভিমানের জন্য। সেদিন সেসব কথা শুনে অনেক রাগ হয়েছিল কিন্তু আমি পুরোপুরি তোকে অবিশ্বাস করিনি। আমি মনে মনে কতোবার ধোঁকাবাজ বলার জন্য মাফ চেয়েছি তুই ভাবতেও পারবি না। আমি মনে মনে শুধু বলতাম প্লিজ মেহু তুই একবার আমার সাথে কথা বল একবার আমার কাছে আয় আমি তোকে আবার আমার বন্ধু করে নেব। কিন্তু তুই করলি না আমার অভিমানের পাহাড় বাড়তে লাগলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম সত্যিই তুই করেছিস নাহলে এতো দিনে তুই আমার কাছে ফিরে আসতি। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম তুই না আসলে আমিও যাবো না তবে তুই একবার এসে সব বললে আমি আবার তোর কাছে চলে যাবো। সেই জন্য তোকে ইগনোর করে দেখিয়ে দেখিয়ে সাগরিকার সাথে কথা বলতাম সেই ঘটনার পর। যাতে তুই রেগে গিয়ে সব প্রমান করে দিস কিন্তু সেসব কিছুই করলি না। তবুও আমি অপেক্ষায় ছিলাম তুই আয় আর সবকিছু মিথ্যে প্রমান করে দে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার বন্ধুর ব্যক্তিত্ব কে,সে কাউকে মানাবে না। যারা তার জীবনে থাকবে তাকে বিশ্বাস ভরসা করেই থাকতে হবে সে কাউকে ফেরাবে না মানাবে না। আর আমি এটাও জানতাম আমি যদি তোর কাছে যাই তাহলে তুই আমায় আগলে নিবি। আর এখানেই সবথেকে বড় ভুল করে বসি অভিমানে তোর কাছে না গিয়ে আমি তোর থেকে দূরে সরে গেলাম।

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এই একটা কারনেই তুই আজ এখানে? যদি সত্যি সত্যি আমায় অবিশ্বাস করতি তাহলে তুই এখানে তো দূর মরে যাওয়ার আগে আমার দেখাটাও পেতি না। আমি তো তোর চোখ দেখেই বুঝতাম তুই কি চাইছিস তবে এবার আমার অভিমান ছিল তোর ওপর যে তুই আমার জন্য সবার সামনে বলতে পারলি না যে আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে চিনি তোদের ঠুনকো কাউয়ার কথায় আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে অবিশ্বাস করি না। আমার অভিমান এ আরেকটু ঘি ঢেলে তুই আমার জন্য আনা ফুল চকলেট ওকে দিলি। তবে থেকেই আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করি আমি নিজ থেকে তোকে মানাবো না। আমিও ভাবতাম আর মনে মনে বলতাম ফিরে আয় রাই আমার গলা জড়িয়ে ধরে একবার বল আমি তোকে বিশ্বাস করি সেদিন যা ছিল সব ভুল ছিল। যদি তুই একবার বলতি আমি তোকে আগলে নিতাম কিন্তু তুই বললি না। আমি ভেবেছিলাম এবার আমি নয় সব তুই বের করবি কিন্তু তুই তো কিছুই করলি না সব সবসময় এর জন্য আমার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলি।

রাইফা হেঁসে বলল,,

“তুই আমার পথ চেয়েছিলি আর আমি তোর যার জন্য আমাদের এই বিচ্ছেদ। ”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এটাই আজকাল কার একটা বড় সমস্যা। আমরা ভাবি আমরা কেন এগিয়ে যাবো আমাদের ইগো হার্ট হবে অপরজন আসুক তাহলেই আমরা সম্পর্ক ঠিক করে নেব। ঠিক এই কারনেই দুজন দুজনের দিক থেকে এগোয় না যার দরুন এই বিচ্ছেদ। যদি একজন এগুতো তাহলেই কিন্তু সম্পর্ক টা থেকে যেত।কিন্তু মিসেস রাইফা আফনূর আপনি আপনার এই অভিমানের আর অপেক্ষার দরুন তৃতীয় ব্যক্তিকে জিতিয়ে দিয়েছেন।

“মাফ করে দে মেহু। লাস্ট পরীক্ষার দিন তুই চলে যাওয়ার পর আমি দুঃখী মনে বাড়ি ফিরি। বিকেলে ছাদে উঠে দেখি সাগরিকা আর একটা ছেলে আমাদের নিয়ে কথা বলছে আমাদের ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে সেদিনের সেই চিঠি সেই ছেলেটা লিখেছিল আর লাস্ট ক্লাসের দিন যারা সাগরিকার সাথে তোর নামে বলেছিল তাদের ওরা পাঁচশ টাকা করে একেকজন কে দিয়ে বলিয়ে ছিল যাতে আমি তোকে অবিশ্বাস করি । আর আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভেঙে যায়। সব কিছু শুনে আমার পায়ের নিচ মাটি চলে যায়। আমি যার জন্য তোকে দায়ী করতাম সেটা ছিল ওরা। আমি সব অভিমান ভুলে দৌড়ে নিচে এসে মায়ের কাছে বলে তোদের বাড়ি গেলাম গিয়ে দেখি তালা তোরা নেই চলে গেছিস। তুই জানিস না মেহু সেদিন চিৎকার করে আমি কেদেছিলাম তোর বাড়ির সামনে আমি আমার একটু অভিমানের দরুন তোকে হাড়িয়ে ফেললাম। নিজের কাছে নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল। এরপর আমি আর কাউকে বন্ধু বানাইনি মেহু আমার জীবনে তুই ছাড়া আর কোন বন্ধু নেই মেহু।

রাইয়ের চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মেহবিন তা মুছে দিল। তারপর মুচকি হেসে বলল,,

“তারপর তারপর কি হয়েছিল সাগরিকার কিছু কি হয়েছিল?”

“বাড়ি গিয়ে দেখি আঙ্কেল ইচ্ছে মতো সাগরিকা কে পেটাচ্ছে। সাগরিকা চিৎকার করছে আর কাঁদছে।আমি তো থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি নিজেই নিয়ত করেছিলাম দু’টো থাপ্পড় হলেও ওকে মারবো। পরে জানতে পারলাম ও একটা ছেলের সাথে লিপ কিস করছিল আর সেটা কেউ ছবি তুলে ওর বাবাকে পাঠিয়েছে এই জন্য পেটাচ্ছে। বাড়ির মানসম্মান ভুলে এসব করেছে দেখে। সেটা আবার মুহুর্তেই পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে পরেছে সবাই ছি ছি করছিল। শেষে বাধ্য হয়ে পরের দিন ওরা এলাকা ছাড়লো।”

মেহবিন এবার একটু জোরেই হাসলো আর বলল,,

“বাহ কেয়া সিন হে!! ইস মিস্টার আলম সেদিন বাসা না চেন্জ করলে এই দৃশ্যটা দেখতে পেতাম।”

“এক মিনিট এক মিনিট তুই বললি সাগরিকার কি হয়েছিল তার মানে তুই?”

মেহবিন হেঁসে মাথা নাড়িয়ে বলল,,

“আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙে দিল আর আমি ওকে ছাড়বো নাকি। আমাকে তো ভালো করেই চিনিস আমার সাথে কেউ অন্যায় করলে আমি অবশ্যই তাকে শাস্তি দিই।”

এবার রাইফাও হাসলো একটু পর বলল,,

“আচ্ছা এইসবে সাগরিকার কি স্বার্থ ছিল। ও কিসের জন্য আমাদের এতো সুন্দর সম্পর্ক টা নষ্ট করলো?

“তোর তোদের এলাকার এক নামধারী নেতার ছেলে শফিক কে মনে আছে রাই? যে ছেলেটা তোকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিল আর অসভ্যতা করেছিল বলে আমি মেরে ওর বাবার কাছে বিচার দিয়েছিলাম।”

“হুম মনে আছে তো? এই সবের সাথে এটার কি সম্পর্ক?”

“সেই ছেলেটাকে সাগরিকা পছন্দ করতো।”

“ওয়াক থু ঐ মেয়ের এইরকম থার্ড ক্লাস পুলাপাইন পছন্দ।”

রাইয়ের কথায় মেহবিন হাসলো আর বলল,,

“যে যেরকম তার চয়েজ তো সেরকমই হবে। সেই ছেলেটাকে ও জানায় ওর মনের কথা‌। পরে সেই ছেলেটা আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভাঙার কথা বলে। যদি ভাঙতে পারে তবেই ও রাজি হবে। আমি না থাকলে তুই কিছুই না। তাই আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভাঙার জন্য ওকে পাঠায়। কিন্তু মেয়েটা ছেলেটার জন্য এতটাই পাগল যে এই কাজটাও করে ফেলল যেদিন আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভাঙলো সেদিন ছেলেটা খুশি মনে ওর সাথে রিলেশন এ জড়িয়েছে। এমন কি?”

রাইফা ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তা দেখে ও বলল,,

“না কিছু না?”

“এই কি তারপর বল?”

“না ওসব বড় মাইনষের কথা তোর শোনা লাগবে না?”

রাইফা ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকায়। আর বলে “তুই বলবি?”

“তাদের ওষ্ঠদয়ের মিলনায়তন ও হয়েছিল।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। এইডা কি কইলি তুই ধুর ধুর ঐ রহম একটা মাইয়ার লগে আমি আছিলাম তোরে দেখাইয়া দেখাইয়া আবার হাত ও ধরছি। আল্লাহ মাফ করো। একে তো হারাম রিলেশনশিপ তারপর আবার কঠিন যেনা। আল্লাহ এর থেকে সবাইকে রহম করুন।

“সাগরিকা এক বছর আগে মারা গেছে রাই?”

হুট করে এমন কথায় রাই থমকে গেল। আর বলল,

“কি কিভাবে? আর তুই জানলি কিভাবে?”

‘আমি আগে যে হাসপাতালে ছিলাম সেই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ব্লাড ক্যান্সার হয়েছিল। আমাকে দেখে চিনতে পেরে আমার কাছে সবকিছুর জন্য মাফ চায়। শেষে এটাও বলেছিল ওর পাপের জন্যই নাকি ওর এই অবস্থা। আমি আর কিছু বলিনি।”

সব শুনে রাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর বলল,,

“আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না এটাই তার প্রমান?”

‘তুই ভালো নেই কেন রাই? আমি সবকিছু শুনতে চাই।আমি এও জানি তুই অনেককিছুই জানিস।”

রাই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“সেইসব বলতেই তোকে এখানে নিয়ে আসা আমার একটু খোলা আকাশ আর একজন মানুষ দরকার ছিল যাকে আমি সব বলতে পারবো। আমার ভিশন দমবন্ধ লাগে। বোধহয় কত যুগ ধরে আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিই না।

রাইফা মেহবিনের কাঁধে মাথা রাখলো তারপর হাত জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলতে শুরু করল,,

“পড়াশোনা শেষ বাবা বিয়ের কথা কথা ভাবছিল। তখন শেখ পরিবার থেকে আমার জন্য প্রপোজাল যায়। এতো ভালো পরিবার ডাক্তার ছেলে দেখে সবাই রাজি হয়ে যায়। আমিও সায়িদের সাথে কথা বলে মনে হয় ভালোই তবুও কোথাও একটা কিন্তু রয়ে যায়। আমি ওকে পুরোপুরি ভাবে ভরসা করে বিয়ে করতে পারছিলাম না। কিন্তু মা বাবা রাজি বিধায় আমি কিছু বলি নি। আমিও রাজি হয়ে যাই। সবকিছু ঠিকঠাক বিয়েটাও হয়ে গেল আমি নিজেকে মানালাম। বাসর ঘরে ঢুকেই আমি দেখলাম সেখানে নুপুর বসে আছে।

“ডক্টর নুপুর?”

“হুম! ডক্টর নুপুর সে আমায় জানালো ওর আর সায়িদ রিলেশনে আছে। কিছুক্ষণ পর সায়িদ ও ঢুকলো ওকে দেখে বোঝা গেল ও নুপুরকে আশা করেনি। ওর দিকে তাকিয়ে সায়িদ ও ওদের ব্যাপারে জানালো। পরে আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম তাহলে বিয়েটা করলো কেন? সে জানালো বাবা কাকারা ওপরে নাকি বলতে পারেনি। দুজনে মিলে আমায় শাসাচ্ছিল আমি যেন কাউকে কিছু না বলি। আমি কি বলবো আমার ভেতর থেকে কোন আওয়াজই বের হচ্ছিল না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তখন সায়িদ আমাকে বলল আমি যেন ওর ওপর কোন আশা না রাখি আর কাউকে যদি কিছু বলি তাহলে নাকি বাবার ব্যবসা ডুবিয়ে দেবে একটা ভিডিও দেখালো যেখানে আমার বাবার সব ডকুমেন্ট এর ফাইল। আর বলল আমার পরিবার কে শেষ করে ফেলবে। আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি বলি কিছু বলবো না। তখন নুপুর ওকে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিয়ে গেল এই মানুষটি আমার। এসব দেখে আমার একটুও সহ্য হচ্ছিল না
আমি তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে চলে যাই আমি সেদিন চিৎকার করে কেঁদে ছিলাম তবে মুখে কাপড় দিয়ে যাতে আওয়াজ বাইরে না যায়।”

মেহবিন নিজের কাঁধে তরল কিছু অনুভব করলো ও বুঝতে পারল রাইফা কাঁদছে। ও একহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আবার রাইফা বলল,,

“ঘন্টাখানেক কান্না করে বের হলাম। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হলাম তারপর সোফায় ঘুমিয়ে পরলাম। আর সায়িদ এলোমেলো ভাবে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। তার দিকে তাকিয়েই বলতে ইচ্ছে করলো সে আমার সাথে এমন কেন করলো। পরের দিন জানতে পারলাম বিদেশে যেতে হবে সায়িদের ডক্টর রিলেটেড কাজের জন্য। ও বলল চুপচাপ মেনে নিতে। এদিকে নুপুর ওকে যেতে দিতে চাইলো না। ও বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাকে নিয়ে বিদেশে গেল। প্রথম প্রথম ভালো ব্যবহারই করছিল আমি বললাম বিয়ে যেহেতু হয়েছে মানিয়ে নিতে কিছু ইসালামিক পরকীয়ার বিষয়েও বললাম ও বলল ওনাকি নুপুরকে ধোঁকা দিতে পারবে না যতোই হারাম রিলেশনশিপ হোক । ওনার ভালোবাসা দেখে আমিও মুগ্ধ হতে লাগলাম তবে ঐ যে হারাম ইজ হারাম। এই জন্য বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে লাগলাম। কিন্তু কাজ হলো না। আমিও হাল ছেড়ে দিলাম। এভাবেই একমাস পার হয়ে গেল। আমি এক ঘরে ঘুমাতাম ও এক ঘরে। রোজ নিয়ম করে নুপুরের সাথে কথা বলতো নুপুরই ফোন দিতো মুলত। একদিন খাবার খাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমার শরীরটা ভার ছেড়ে দিচ্ছে । আমি কোন রকমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। সকালে উঠে দেখি আমি এলোমেলো আর সায়িদ আমার পাশে। আর এটা সায়িদের ঘর। যা ঘটার রাতেই ঘটে গেছে। সকালে উঠে সায়িদ এমন একটা ভান করলো আমি গিয়েছি ওর রুমে। কিন্তু আমার মনে ছিল আমি আমার রুমেই শুয়ে ছিলাম। আমাকে নানা কথা বলতে লাগলো আমি নাকি ওর কাছে গিয়েছি ও পুরুষ মানুষ ঘুমের ঘোরে নুপুরকে ভেবে এসব করে ফেলেছে মানে আমারই দোষ। নিজের ওপরেই সেদিন নিজের ঘৃনা লাগছিল। এভাবেই চার পাঁচ দিন গেল আমি ওর মুখোমুখি হলাম না। সেদিন রাতে সায়িদই ডাকে যা হওয়ার হয়ে গেছে আমরা তো হাজবেন্ড ওয়াইফ বৈধতা আছে নিজেকে ছোট ভাবার কারন নেই আরো কতো কিছু। আমি কিছুই বলি নি একসাথে খাবার খেতে বললে আমিও খেলাম। কিন্তু খাবার খেয়ে উঠতেই দেখি আমার নিজের ওপর কোন কন্ট্রোল নেই। গলা শুকিয়ে আসছে হাত পা অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে।তখন সায়িদ এসে আমাকে কোলে নিয়ে বলল সেদিন তুমি অজ্ঞান অবস্থায় অনেক আনন্দ লেগেছিল ভাবলাম অজ্ঞান অবস্থায়ই এতটা আনন্দ তাহলে সজ্ঞানে থাকলে না জানি কি পেতাম। বলেই বিছানায় ফেলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো আর আমি কিছুই করতে পারলাম না। সেদিন কতটা অসহায় ছিলাম তোকে বোঝাতেও পারবো না মেহু।

রাইফা জোরেই কেঁদে উঠলো। মেহবিন রাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রাইফা বলল,,

“কি ভাগ্য আমার নিজের স্বামীর কাছেই ধর্ষিত হলাম আমি মেহু ! কারন ওটায় তো আমার সম্মতি ছিল না আমাকে ওষুধ খায়িয়ে জোর করেই করেছে তাহলে তো ওটা ধর্ষণই বলে তাই না।”

মেহবিনের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঐ সায়িদকে শেষ করে ফেলতে। ও মনে মনে কিছু একটা ভেবেও ফেলল। তখন রাইফা বলল,,

“এভাবেই ও কতোবার জোর করে শাসিয়ে আমাকে ধর্ষণ করেছে তার হিসেব নেই। তখন তো আরেকটা ভয় ছিল। ও নিজের বউয়ের ভিডিও বানিয়েছিল। আমি মুখ খুললেই নাকি ও ওগুলো ভাইরাল করে দেবে। আর নুপুরকে তো জানতেই দেওয়া যাবে না। ও আমাকে বিদেশ থাকতে কি কি যেন ওষুধ খাওয়াতো জোর করে। যার জন্য বাচ্চা ও হবে না । আবার কয়েকবার শরীরে কিসের ইনজেকশন পুশ করতো আমি বুঝতেই পারতাম না ওর আমার সাথে ঠিক কি করতে চাইছে। বিদেশে ঐ ছয়মাসে নুপুর ও গিয়েছিল দুইবার ঐ দুইবারে নুপুর ও ওর সাথে শারীরিক মেলামেশা করতো। আমি ওখান থেকেই জানলাম সায়িদ আর নুপুর আগে বিদেশে এক জায়গায়ই পড়াশোনা করতো আর ওরা লিভ ইন এ ছিল। পড়াশোনা করতো আগে তখন ও সে এরকমই ছিল। এসব নুপুরই জানায়।আমার নিজের ওপরই নিজের রাগ হতো যে এই রকম মানুষের সাথে আমার জীবন জড়িয়ে গেছে। একদিন মাথা ঘুরে পরে যাই সায়িদ বাসায় ছিল না। আমাকে কাজের লোক হাসপাতালে নিয়ে যায় ওখানে গিয়ে টেস্ট করাতেই ব্রেন টিউমার ধরা পরে। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি অন্তত মরে গেলে এসব থেকে বেঁচে যাবো।তাই তো সব জেনেও আমি কিছু করতাম না ডাক্তার দেখাতাম না। নিজে সম্পূর্ণ চেষ্টা করতাম যাতে কেউ না বুঝতে পারে আমি অসুস্থ।

মেহবিন আজ নিজেকে অসহায় বোধ করলো। ওর ভেতরে অদ্ভুত যন্ত্রনা হচ্ছে। রাইফা ভাবছে মরে গেলেই এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। ভাবতেই ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। রাইফা আবার বলল,,

তারপর দেশে এলাম নুপুরের জন্য সায়িদ আমার সাথে মিশতে পারতো না। দুজনে মিলে কি করতো কে জানে। প্রায়ই সায়িদ গেস্ট রুম সবার থেকে লুকিয়ে ওর কাছে থাকতো আরবাজ ভাইয়ার বিয়ের কথা বলতেই আমি ভয় পেয়ে যাই। এদের দুজনের প্ল্যান ছিল নুপুরকে এবাড়িতে পার্মানেন্ট আনার। ওর সাথে আরবাজ ভাইয়ার বিয়ে দুজনের পরকীয়া করতে সুবিধা হবে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আরবাজ ভাইয়ার জন্য বিয়েটা হয় না। সেদিন দু’জনে জোর করে ধরে আমাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আজ সকালে জানতে পারলাম দু’জনে কথা বলছিল আমি লুকিয়ে তাদের কথা শুনছিলাম তারা আমার শরীরে কিডনি ড্যামেজ হওয়ার ওষুধ দিয়েছে। আমাকে মেরে ফেলার জন্যই এই প্ল্যান। অন্য ভাবে মেরে ফেললে কেউ সন্দেহ করতে পারে আর যদি এভাবে মারা যাই তাহলে কেউ সন্দেহ করবে না। কারনটা হবে আমার দু’টো কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। সব শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। বিকেল বেলা খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার মনে হচ্ছিল আর কাউকে না বলতে পারলেও আমি তোকে সব বলতে পারি। তোকে ভিশন দেখতেও ইচ্ছে করছিল তাই ফোন দিয়েছিলাম তোকে।

সব শুনে মেহবিন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রাইফা কে শক্ত করে ধরে বসে রইলো‌। তখন কাঁদলেও এখন রাইফা শান্ত। মেহবিন কিছু বললো না কিছুক্ষণ পর রাইফার দিকে তাকাতেই দেখলো ও ঘুমিয়ে পরেছে। মেহবিন রাইফার কপালে চুমু দিয়ে বলল,,

“তোর কিছু হবে না রাই আমি তো আছি। ইনশাআল্লাহ ঠিক তুই সুস্থ হয়ে যাবি। কষ্ট পাস না রাই তোকে যারা কষ্ট দিয়েছে তারা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পাবে। আমি করবো সেই ব্যবস্থা।

মেহবিন রাইফাকে কোলে তুলে নিয়ে এসে কেবিনে শুয়িয়ে দিল। এবার মেহবিনের কষ্ট হলো বেশ। তবুও ও কিছু মনে করলো না। ও কাউকে ফোন দিয়ে বলল,,

‘ডক্টর সায়িদ আর আর ডক্টর নুপুরকে তোলার ব্যবস্থা করো কালকের মধ্যে। তাদের শাস্তির সময় ঘনিয়ে এসেছে। কালকে রাতেই তাদের শাস্তি প্রদান করা হবে।”

~চলবে,,

বিঃদ্রঃ আজ আর আমি কিছুই বলবো না। কিছু ঘটনা লাঞ্চিত, নিন্দনীয় ,অবাঞ্চিত আছে তবে এটা গল্পের এবং কিছু বাস্তবতার খাতিরেই দেওয়া নচেৎ দিতাম না। ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।”

পিক ক্রেডিট: আহি পাখি 🥰 (শুকরিয়া আহি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here