তুমিময়_প্রাপ্তি🍁 #পর্ব_৩৩ #মেহরিন_রিম

0
219

#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৩
#মেহরিন_রিম
_সরি সরি একটু দেড়ি হয়ে গেলো। অনেক্ষন ধরে ওয়েট করছো তাইনা?

মুখে হাসি নিয়ে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো ফাইজা। নদীর পাশেই একটা বেঞ্চে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো পূর্ন। ফাইজার কণ্ঠ শুনে চোখ খুলল সে,ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই তার হৃদয়ে এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো।
ফাইজা কখনোই সেভাবে সাজগোজ করেনা,আজও করেনি। আকাশি রঙের সেলোয়ার কামিজ এর সঙ্গে হালকা লিপস্টিক আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ। এই সাধারণ রূপেও যেন ফাইজাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে পূর্ণর কাছে।
পূর্ণ তার দৃষ্টি সরিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
_তেমন দেড়ি হয়নি, বসো।

ফাইজা মুখের উপর চলে আসা চুলগুলো কানের পিছনে গুজে পূর্ণর পাশে এসে বসলো। তবুও তাদের মাঝে অনেক দূরত্ব,দুজনে বেঞ্চের দুই প্রান্তে বসে আছে। পূর্ণ আবারো একনজর তাকালো ফাইজার দিকে,ঠোঁটের কোণে তার মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। প্রফুল্ল মনে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখ সরিয়ে নিলো পূর্ণ,আজকেই ফাইজাকে কেন এত খুশি থাকতে হবে? তাকে এমন আনন্দিত দেখে ভেবে আসা সব কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে পূর্ণর। তবে কঠিন হতেই হবে,ফাইজা তার প্রতি আরো দূর্বল হয়ে যাওয়ার আগে তাকে আটকাতে হবে। যেই স্বপ্নের কোনো ভবিষ্যৎ নেই,সেই স্বপ্ন বুনে কষ্ট পেতে দেওয়া যাবেনা ফাইজাকে।

বড় নিঃশ্বাস নিয়ে পূর্ণ ফাইজার দিকে তাকিয়ে বললো,
_চা খাবে?

ফাইজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_হুম..কি?

_চা…চা খাবে?

_কিন্তু তুমিতো চা খাওনা..

পূর্ণ স্মিত হেসে বললো,
_খেলাম একদিন।

ফাইজা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। পূর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_বসো তুমি,আমি নিয়ে আসছি।

কিছুটা দূড়ে একটা গাছের নিচে ফ্লাক্স নিয়ে বসে চা বিক্রি করছিলো একজন বৃদ্ধ লোক। তার কাছ থেকেই দু’কাপ লালচা নিয়ে বেঞ্চে এসে বসলো পূর্ণ। একটা কাপ ফাইজার দিকে বারিয়ে দিতেই সে কাপটা নিয়ে “থ্যাংক ইউ” বললো।
অতঃপর আবারো নিরবতা। যায়গাটা বেশ নির্জন,কোনো শব্দ নেই চারপাশে। মাঝেমধ্যে কয়েকজন বাচ্চা এসে ছোটাছুটি করছে। নিরবতার মাঝেই তাদের চায়ের কাপটা খালি হলো। ফাইজা ওয়ান টাইম কাপটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে পূর্ণর দিকে তাকালো। তার হাতে বা বেঞ্চে কোনো বই বা ব্যাগ না দেখে বললো,
_বইটা আনোনি?

হাতে থাকা কাপটা ফেলে দিয়ে ফাইজার দিকে তাকালো পূর্ণ। ছোট করে উত্তর দিনো,
_উম হু..

ফাইজা অবাক হয়ে বললো,
_কেন?

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পূর্ণ। উঠে দাড়িয়ে ফাইজার সামনে এসে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে থমথমে গলায় বললো,
_কারণ আমি তোমাকে এখন যেই কথাগুলো বলবো,তা শোনার পর তুমি আমার থেকে বইটা নেবেনা।

ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা ধীরেধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো ফাইজার। পূর্ণ জীভ দিয়ে নিজের ঠোট ভিজিয়ে বললো,
_ফাইজা আমি জানি তুমি কেনো হুট করে এতটা বদলে গেছো,তবে আমি তোমার মাঝে এই বদল টা চাইনা। তাই তোমাকে কিছু কথা বলা খুব প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

কিছুটা থামলো পুর্ণ। ফাইজার দিকে তাকিয়ে কথা বলাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার জন্য। তাই উল্টো ঘুড়ে নদীর দিকে মুখ করে দাড়ালো পূর্ন। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবারো বললো,
_সেদিন আমার কপাল কি করে কেটেছিল যানো?

উত্তর দিলোনা ফাইজা। পূর্ণ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো সামনে তাকিয়ে বললো,
_ঐ এলাকাটা খুব একটা ভালো নয়। দিনের আলো সরে গেলেই রাতের আধারে ওখানে শুরু হয় অনৈতিক কাজ। মাদকদ্রব্য সাপ্লাই এর একটা গ্যাং ছিলো ওরা, অনেকদিন ধরে খোজ চালিয়ে ফাইনালি তাদের গোডাউন এর খোজ পেয়েছিলাম। সেদিন ওদের ধরার কোনো প্ল্যান ছিলোনা, আমি জাস্ট লাস্ট বারের মতো সিওর হতে গিয়েছিলাম। ব্যাস, কোনভাবে খবর পেয়ে আমার উপর অ্যাটাক করার প্ল্যান করে তারা। আমার পরিচয় জানতে পেরে যায়, আর সেই অনুযায়ী কাজ করে। লোকজন থাকেনা সেখানে খুব একটা,কিন্তু দলের কোনো লোক তোমাকে ঐদিকে আসতে দেখে নিয়েছিল। তাই আমার দিকে পাথর ছুড়ে মেরে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। ওরা ধরাও পরেছে, তবে তাদের মধ্যে এক দুজন তখনো বাইরে ছিল। ওদের আমার উপর অনেক রাগ,এর আগেও একবার ওদের ব্যাবসা নষ্ট করেছিলাম। তাই প্রতিশোধ নিতে আমার উপর যেকোনো সময় হামলা করতে পারতো। সেইজন্যই দু’তিনদিন আমাকে পালিয়েও থাকতে হয়েছিল। ভাগ্য ভালো,তারাও খুব জলদিই ধরা পড়ে যায়।

ফাইজা এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে পূর্ণর কথা শুনছিল। পুর্ন এবার তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলে,
_ভাবছো তো,তোমাকে কেন বলছি এসব?

ফাইজার দিকে তাকিয়ে পূর্ণ আবারো বলতে লাগলো,
_জাস্ট একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলাম আমার লাইফ এর। এটা কিছুই না, এরচেয়ে অনেক বেশি রিস্ক নিয়েও আমায় চলতে হয় মাঝেমধ্যে। আমার পরিচয়, আমার কাজ সম্পর্কে কেউ খুব বেশি অবগত নয়। তবে যারা জানতে পেরে যায়,তারা প্রতিনিয়ত ই আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পূর্ণ,তারপর আবারো বললো,
_আদৃত তোমাকে কথাগুলো অন্যভাবে বলেছে আমি সেটাও জানি। আর তাই তোমাকে কথাগুলো জানানো দরকার ছিলো।

ফাইজা এবার উঠে দাঁড়ালো। পূর্ণর চোখে চোখ রেখে বললো,
_এখন সবটা স্পষ্টভাবেই শুনলাম। তো,আর কিছু বলবে?

_আর কিছু বলবো মানে? ফাইজা তুমি আমার কথাগুলো এখনো বুঝতে পারছো না। দিনের অর্ধেক সময় রিভলভার নিয়ে থাকতে হয় আমাকে। লাইফ রিস্ক নিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। আমার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই ফাইজা, তুমি বুঝতে পারছো এগুলো?

_হুম বুঝতে পারছি,তো?

_যেখানে আমার নিজের ই লাইফের কোনো গ্যারিন্টি নেই, সেখানে আমি অন্য কারোর জীবনের সাথে নিজেকে কি করে জড়াবো বলতে পারো?

_কি চাও তুমি?

পূর্ণ অবাক হয়ে তাকালো ফাইজার দিকে। এরপর থমথমে গলায় বললো,
_ফাইজা তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে, তুমি অনেক ভালো ছেলে পাবে জীবনে। আমার কথা ভেবে নিজের জীবনটা নষ্ট করোনা, তুমি যা চাও তা কখনো সম্ভব হবে না।

_হয়ে গেছে তোমার কথা বলা?

পুর্ন কোনো উত্তর দিলোনা। ফাইজা তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো,
_একটা কথা জানো কি? মুখে না বললেও,তুই আমায় বড্ড বেশি ভালোবাসো।

পুর্ণ অবাক চোখে তাকালো ফাইজার দিকে। ফাইজা পূর্ণর চোখে চোখ রেখে বললো,
_হ্যা, ভালোবাসো তুমি আমায়। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসো। নাহলে আজকে এখানে দাঁড়িয়ে যে কথাগুলো বলছো,সেগুলো কখনো বলতে পারতে না। তোমার সব কথাই বুঝলাম আমি, কিন্তু আমায় একটা কথা বলতো। তোমার প্রফেশন এ যে বাকি লোকগুলো আছে,তাদের কি কোনো লাইফ রিস্ক নেই? অবশ্যই আছে, কিন্তু এর কারণে কি তারা সারাজীবন একা থেকেছে? থাকেনি,কিন্তু তুমি একা থাকতে চাইছো। কারণ এটাই যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি জীবনে কষ্ট পাই এটা তুমি চাওনা।

কথাগুলো ঠিক ই বলেছে ফাইজা। পূর্ণ তার কথায় বারে বারে শুধু অবাকই হচ্ছে,ফাইজা কি করে এতকিছু বুঝে ফেললো?

_কিন্তু তুমি এটা বুঝতেই পারলে না যে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে হবো যদি তুমি আমার সঙ্গে থাকো। সেদিন অতো মানুষের সামনে আমাকে অপমান করলে, যানো আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। তোমাকে ঘৃণা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তারপরেও আমি তোমাকেই ভালোবেসে গেছি, তোমায় কখনো পাবোনা জেনেই ভালোবেসেছি। আর আদৃত ভাইয়া যখন আমাকে তোমার ওভাবে চলে যাওয়ার কারণ বললো, তারপর থেকে ভালোবাসাটা আরো বেড়ে গেছে। নতুন করে তোমায় পাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম আমি,আর তুমি কতো সহজে বলে দিলে নতুন করে জীবন গুছিয়ে নিতে!

কঠিন গলায় কথাগুলো বলা শুরু করলেও এখন গলা আটকে আসছে ফাইজার। থেমে গিয়ে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করে বললো,
_তবে তুমি যা চাও তাই হবে, আমি আর কখনো তোমায় নিজের করে পাওয়ার আশা করবোনা পুর্ণ। কিন্তু আমার ভালোবাসাকে অপমান করার অধিকার তোমার নেই। আমি তোমায় গোপনেই ভালোবাসবো,বাধা দিতে পারবেনা তুমি।

তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো ফাইজা। পুর্ণর দিকে তাকিয়ে বললো,
_গোপনেও মন উজাড় করে ভালোবাসা যায়, তবে সেটা প্রকাশের জন্য সময় প্রয়োজন। কি ভাগ্য আমার, সেই সময় সুযোগ কোনোটাই পেলাম না।

_ফাইজা আমি..

ফাইজা হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো পূর্ণকে। মুচকি হেসে বললো,
_থাক আর কিছু বলতে হবেনা। চিন্তা নেই,আমি নিজে থেকে আর তোমার সামনে আসবোনা। ভালো থেকো..

পিছনে ফিরে তাকালোনা ফাইজা,হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে দ্রুতপায়ে স্থান ত্যাগ করলো সে। আর পূর্ন? সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো একই স্থানে। কানের কাছে একটা কথাই বাজছে,”আমি নিজে থেকে আর তোমার সামনে আসবোনা”। এটাই তো চেয়েছিল পূর্ণ,তবে কেন এতটা কষ্ট হচ্ছে তার! কিছুই করার নেই, এই কষ্ট সে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে।

#চলবে

[কমেন্ট করতে কিপটামি করলে আমিও আর বড় পর্ব দিবোনা।:)
হ্যাপি রিডিং।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here