#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
পরদিন ,,
মুখরদের পরিবারের যাওয়ার কথা থাকলেও শেখ শাহেনশাহ কাউকে যেতে দেয় নি। তার বাড়ি এখন মেহমান দিয়ে ভর্তি। আজ বাড়িতে পিঠেপুলির উৎসব রেখেছে শেখ শাহেনশাহ। তাই সবাই আজ ও রয়েছে। সন্ধ্যার ট্রেন এ সবাই চলে যাবে। সবাই সকালের খাবার খেতে বসেছে তখন আরবাজ এলো। আরবাজের চোখমুখ দেখে মিশু বলল,,
“বাজপাখি তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন?”
আরবাজ মুচকি হেসে বলল,,
“নিজের জন্যই নিজের এই অবস্থা।”
তখন নাফিয়া বলল,,
‘মানে কিছু হয়েছে?”
“কাল রাতে একদম ঘুম হয় নি। একটা জানালা খোলা রেখেছিলাম সেটা দিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ঢুকেছিল ঘরে বারবার একই আওয়াজ করছিল। আমি উঠে খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। তাই না ঘুমানোর জন্য এই অবস্থা।”
আরবাজের কথা শুনে আর কেউ কিছু বললো না। সবাই খাওয়া শুরু করবে। তখন শেখ শাহনাওয়াজ এর ফোনটা বেজে উঠলো তিনি দেখলেন মেহবিন ফোন করেছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে ধরলেন মেহবিন বলল,,
‘একটু বাইরে আসুন দরকার আছে।”
তিনি খাবার না খেয়ে সবাইকে খেতে বলে উঠে তাড়াতাড়ি করে বাইরে এলেন। বাইরে এসেই দেখলেন মেহবিন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গিয়ে বললেন,,
“কিছু হয়েছে?”
“হুম আমার দুই লাখ টাকা ক্যাশ লাগবে বিকেলেই দিয়ে দেব। খুব জরুরী হাসপাতালে দিতে হবে নাহলে চাইতাম না এখন চেক ভাঙানোর সময় নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার কথাও শুনছিল না তারা বলেছে না হলেও অপারেশন এর আগে আশি হাজার দিতে হবে। যার জন্য একজনের অপারেশন ও করতে সমস্যা করছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু না করতে পারলে তাকে বাঁচাতে পারবো না। যার জন্য আমি বলে এসেছি তার অপারেশন করতে আমি এক ঘন্টার মধ্যে পুরো টাকা জোগাড় করে নিয়ে যাবো। পরের ওষুধ পত্র আর বাকি টাকাও তো দিতে হবে তাই একেবারে দুই লাখ নিয়ে যাচ্ছি। আপনার কাছে তো সবসময় ক্যাশ থাকে।তাই এসেছি।”
‘হুম আমিও জানি আপনি খুব প্রয়োজন না হলে আমার কাছে আসবেন না। তারওপর সেদিন যা হলো আপনি তো আমার ত্রিসীমানায় ও আসবেন না বলেছিলেন। তবুও আল্লাহ তায়ালা চায় আমরা একসাথে থাকি তাই একটা না একটা অলৌকিক ঘটিয়েই দিলেন আলহামদুলিল্লাহ।”
‘এসব রাখুন এখন টাকাগুলো দিন।”
‘হুম আমি এখনি নিয়ে আসছি।”
শেখ শাহনাওয়াজ তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরে গেলেন তারপর একটা ব্যাগে ভরে দুই লাখ টাকা নিয়ে এলেন। মেহবিন টাকাটা নিয়ে বলল,,
‘শুকরিয়া আপনাকে আসছি।”
“লোকটা কে? যার অপারেশন এর জন্য টাকা লাগবে?”
‘লোকটা কুদ্দুস আপনার বাড়িতে কাজ করে। ছেলের এঙ্গেজমেন্ট এর অনুষ্ঠানে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পরেছেন যে বাড়ির কাজের লোককে কেউ কয়েক ঘা ছুরি বসিয়ে কিছু জায়গায় জঘম করে মেরে ফেলতে চাইছিল সেটা টেরই পান নি।”
“কি কুদ্দুস এখন হাসপাতালে?”
“হুম সকাল বেলা আমার বাড়ির সামনের পাকা রাস্তায় পরেছিল। কেউ দেখে আমাকে জানায় প্রথমে ভেবেছিলাম মারা গেছে পরে দেখি হালকা হালকা পাল্স চলছে। ব্যাপারটা বেশি কেউ জানে না খুব সকালে ছিল তাই কয়েকজন ওখানে ছিল তাদের সবাইকেই বলেছি কাউকে না বলতে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে বলেছি ওকে কেউ মারতে চাইছিল মেরে ফেলতে পারে পরে কথাটা শুনেই সবাই রাজি হয়েছে। আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে ডাক্তার ছিল তিনি বলেছেন খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। কিন্তু টাকা জমা না দিতে পারলে নাকি করবেন না। কারন অপারেশন এর জন্য এটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটা রুলস উনি কিছু করতে পারবেন না। আমি বলেছি তার টাকা আমি আনছি এক এক ঘন্টার মধ্যে আপনারা ওনার অপারেশন শুরু করুন। আমার এক ঘন্টার মধ্যে টাকা দেওয়ার কথা বলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়েছে এতো সকালে ব্যাংক খোলা থাকবে না আর ব্যাংক আশেপাশেও নেই তাই বাধ্য হয়ে এখানে আসা।”
“তারমানে এখন কুদ্দুস?”
“তার অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। চিন্তা করবেন না তবে হ্যা এটা কিন্তু নিশাচর এর একটা কাজ। এখন কুদ্দুস এর মাধ্যমে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো । আমি যদি ভুল না হই তাহলে কুদ্দুস নিশাচর কে দেখে ফেলেছে। এই জন্যই ওর এই অবস্থা। বাড়ির কাউকে কুদ্দুস এর ব্যাপারটা জানাবেন না আপনি। আর এমন ভাব করবেন আপনিও কিছু জানেন না।”
‘হুম! আমি হাসপাতালে আসছি।
‘ ভুলেও এখন এই বোকামী করবেন না। আমি দেখে নেব ফোনে তার আপডেট দেব। আসছি আর হ্যা বিকেলে আমি নিজেই আসবো টাকাটা ফেরত দিতে।’
“আপনার টাকা ফেরত দিতে হবে না।”
‘আপনি আমায় ভালোভাবেই চেনেন তাই কথা বলে লাভ নেই।”
বলেই মেহবিন চলে গেল। এখনো অনেকটা সময় আছে তাই পুরো ব্যাপারটা বলে গেল তাকে। শেখ শাহনাওয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আরিফা জামান বললেন,,
“এতো সকালে এতোগুলো টাকা নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?”
হুট করে প্রশ্নটা করায় তিনি একটু চমকালেও পরে নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন,,
‘তুমি দেখেছো আমি টাকা নিয়েছি। আমার সবকিছু নজরে রাখো তুমি।”
‘না ব্যাপারটা তেমন নয় আপনাকে ঘরে যেতে দেখে আমিও গিয়েছিলাম তখনি দেখেছিলাম। এতোগুলো টাকা লাখ খানেক তো হবেই। ”
তখন পেছন থেকে সায়িদ বলল,,
‘আমি তো কাকাকে দেখলাম ডক্টর মেহবিন কে একটা ব্যাগ দিতে। ব্যাগের মধ্যে টাকা ছিল বুঝি।”
ব্যস হয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ সায়িদের দিকে তাকালেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,
“সবার প্রশ্নের আগে আমিই জবাব দিচ্ছি। একটা ইমার্জেন্সি কাজে ডাক্তারের দুই লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি আমার থেকে ধার নিলেন বিকেলেই ফেরত দিয়ে যাবেন।”
কথাটা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। বাদ যায়নি মুখরের পরিবার তারাও অবাক হয়ে গেছে। হুট করে তখন শেখ আমজাদ বললেন,,
“ভাইয়া তুমি এক কথায়ই মেয়েটাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে দিলে। এটা কিরকম কথা যদি,,
তখন শেখ শাহনাওয়াজ তাকে না বলতে দিয়ে বললেন,,
‘মানুষ চেনার ক্ষমতা আমার আছে। সে তো বলেছে বিকেলে দিয়ে দেবে আগে বিকেল হোক তারপর না হয় কথাগুলো বলিস। আগেই এই অহেতুক কথা বলে লাভ নেই। তাছাড়া কারো সম্পর্কে না জেনে কথাও বলতে নেই। বিকেলের আগে তার সম্পর্কে আমি কোন কথাই শুনছি না।”
তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“দুদিন আগেও যে তোর পোলারে বিনা কারনে মারলো। তারে তুই টাহা দিয়া সাহায্য করতাছোস শাহ কিরম বাপ তুই।”
শেখ শাহনাওয়াজ মুচকি হেসে বললেন,,
“সত্যিই বাবা কিরকম বাপ আমি। আমার সন্তান আঘাত পায় কারো দ্বারা তবুও আমি কিছু করতে পারিনি।”
বলেই তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে এদিকে ওনার কথার মনে কেউ বুঝতেই পারলো না। আরবাজ আর মিশু ছাড়া। দুপুরে মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ কে ফোন করে জানালো অপারেশন সাকসেসফুল। তবে অবস্থা খুব একটা ভালো না তবুও আশা আছে সুস্থ হয়ে উঠবে। সব শুনে শেখ শাহনাওয়াজ একটু স্বস্তি পেলেন। শেখ শাহনাওয়াজ কাউকেই কিছু বললেন না সকালের দিকে আরিফা জামান খোঁজ করেছিল ওনার উনি বলেছেন ও নাকি ছুটিতে গেছে। এই নিয়ে আরিফা জামান রাগারাগী করলেও শেখ শাহনাওয়াজ একটা টু শব্দ ও করেন নি। বিকেল সাড়ে চারটা সকলে মেহবিনের বিষয় নিয়েই কথা বলছে। মুখরের পরিবার সবাই মুখরকে জিজ্ঞেস করেছিল কিসের জন্য মেহবিন টাকা নিয়েছে মুখর জানিয়েছে সে কিছু জানে না। তারা আজ সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যাবে শেখ শাহেনশাহ তাদের কথা শুনে আজ আর না করেনি। বিকেলে সবাই ড্রয়িংরুমে কথা বলছিল হুট করে শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“কিরে শাহ বিকাল তো হইয়া আইলো কো তোর ডাক্তার কো?”
তখন পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,,
“সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব শেখ শাহেনশাহ আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল বুঝি। হুট করে আমার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে দেখি।”
মেহবিনের কথায় সকলেই পেছনে তাকায়। মেহবিন মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ব্যান্ডেজটা নেই খুলে রেখে এসেছে। তাই হাতের দিকে তেমন কারো নজর পরলো না। মেহবিন কে দেখে শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“আসলে,”
“আসলে নকলে ছাড়ুন চেয়ারম্যান সাহেব এদিকে আসুন তো!”
শেখ শাহনাওয়াজ উঠে মেহবিনের সামনে এলেন মেহবিন টাকাগুলো ব্যাগ থেকে বের করে উনার দিকে এগিয়ে দিলেন। তখন শেখ আমজাদ বলল,,
“ভাইয়া ভালো করে গুনে নাও।”
শেখ শাহনাওয়াজ মুচকি হেসে বললেন,,
“আমি যখন টাকা ওনাকে দিয়েছিলাম তখন উনি গুনে নেয় নি। তাহলে আমার ও দরকার নেই গুনার। তাছাড়া আমি ওনাকে বিশ্বাস করি।”
তখন মিশু এসে বলল,,
“ফুল তুই আমার সাথে আয়?”
মিশুর আগমনে টাকার টপিক ঢাকা পরে গেল। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“কোথায় যাবো?”
“তুই জানিস আমি পিঠে বানিয়েছি। তোর জন্য নিয়ে যেতাম কিন্তু তুই আমাদের বাড়িতে এলি।”
তখন মুনিয়া বলল,,
“মেহবিন আপু মিশু আপু সত্যি পিঠা বানিয়েছে। তবে সেগুলো তুমি খেতে পারবে কিনা জানা নেই।”
“একদম আমার পিঠে নিয়ে কিছু বলবি না মুনিয়া। ফুল তুই খাবি না চল না একটু টেস্ট করে দ্যাখ কেমন হয়েছে। তুই জানিস আমার পিঠে দেখে কেউ টেস্ট ও করেনি। শুধু বাজপাখি ছাড়া কিন্তু বাজপাখি তো কিছু বললোই না।”
তখন নিসা বলল,,
“আরবাজ ভাইয়ার তোমার পিঠে খেয়ে মুখ বন্ধ হয়ে গেছে তাই কিছু বলে নি।”
মিশু একটা ইনোসেন্ট ফেস করে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“ফুল তুই খাবি না।”
মেহবিন একবার সবার দিকে তাকালো তারপর মিশুর দিকে ও বুঝতে পারলো মিশু ইচ্ছে করে এসব করছে ওকে খাওয়ানোর জন্য। যাতে ও খায় এই জন্য নিজে বানিয়েছে। মেহবিন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর কিছু বলবে এমন সময় তখন আরিফা জামান বললেন,,
“আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে তোমার ফুল কিছু খেয়েছে যে আজ খাবে? তুমি বানালেই কি আর না বানালেই কি?
এই কথা শুনে মিশু কোমরে হাত দিয়ে বলল,,
“এতোদিন না খেলে কি হবে। আজ তো ওর ফুল ওর জন্য পিঠে বানিয়েছে ও নিশ্চয়ই খাবে। তাই না ফুল? আর ফুল যদি না খায় তাহলে আমিও খাবো না।
বলেই মিশু দাঁত কেলালো। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
“ঠিক আছে খাবো তবে অল্প।
মিশু ইয়াহু বলে লাফিয়ে উঠলো। মিশু ওর হাত ধরে ড্রাইনিং টেবিলে বসালো । মিশু কিচেন থেকে পাটিসাপটা আর ভাপাপিঠা নিয়ে এলো। এই দুটোই মিশু বানিয়েছে। তবে একটার চেহারাও সঠিক হয়নি। মেহবিন একবার পিঠার দিকে তাকালো আবার মিশুর দিকে। মিশু ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে একটা পাটিসপটা ধরে মুখে পুরে দিল। মেহবিন কামর দিল ও বুঝতে পারলো চেহারা ভালো না হলে কি হবে স্বাদ ঠিকই আছে। অন্যদের পারেনা দেখানোর জন্য চেহারা এরকম। মেহবিন বলল,,
“ভালো হয়েছে ফুল বাকিটা আমি নিজেই খেতে পারবো। আচ্ছা ফুল রাইফা উনি কোথায় আসার পর তো দেখলাম না।”
“রাইফার শরীরটা বেশি ভালো না তাই ঘরেই আছে।”
“ওহ আচ্ছা।”
তখন মুনিয়া বলল,,
“মেহবিন আপু বলো তো কেমন খেতে? না মানে আমরাও একটু টেস্ট করতাম।”
মেহবিন মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তোমরা না খেলে দারুন কিছু মিস করবে মুনিয়া।”
“তাই নাকি তাহলে তো টেস্ট করতেই হয়।”
বলেই মুনিয়া এলো একটা পাটিসাপটা মুখে দিয়ে বলল,,
“মেহবিন আপু সত্যি বলেছো তুমি। এটা তো মা কাকিদের থেকেও বেশি মজার হয়েছে।”
মিশু হাসলো । তখন মেহবিন বলল,,
“এই যে মিশুর বাজপাখি মিশুকে বলেন নি কেন? তার পিঠে এতো মজা হয়েছে।”
হুট করে আরবাজকে ডাকায় আরবাজ হকচকিয়ে উঠলো। ও মেহবিনের দিকে তাকালো। ওর চোখ ছলছল করে উঠলো তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে হাঁসি ফুটিয়ে বলল,,
“এতো মজার হয়েছে যে আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। তাই তো কিছু বলিনি।”
মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। তারপর ভাপাপিঠা একটু নিয়ে খেলা খেতেই ও বুঝতে পারলো ছোটবেলায় যেমনটা খেতে চাইতো বেশি নারকেল দিয়ে তেমনটাই বানিয়েছে মিশু।ও মিশুর দিকে তাকালো মিশু হেঁসে বলল,,
“পছন্দ হয়েছে ফুল।”
“হুম।”
বলেই মেহবিন খেতে লাগলো। শেখ শাহনাওয়াজ এর মুখে তৃপ্তির হাঁসি। তখনি মেহবিনের ফোন এলো আননোন নাম্বার থেকে। মেহবিন ফোন উঠাবে তখন মিশু বলল উঠাতে হবে না। মেহবিন বলল ইমার্জেন্সি কিছু হতে পারে। মিশু বলল ও খেতে থাক স্পিকারে দিলেই তো হয়। মেহবিন তাই করলো ফোন ধরে কিছু বলবে তার আগে ওপাশ থেকে বললো,,
“কেউ একজন বলেছিল ‘যদি একশো বছর পরেও তুই আমার কাছে আসিস আর আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলেও সব ছেড়েছুড়ে আমি তোকে আগলে নেব।”
কথাটা শুনে মেহবিনের খাওয়া থেমে যায়। ও তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে বলল,,
‘রাই!”
তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেল তবুও একটা টু শব্দ করলো না। শেখ বাড়ির সবাই ভাবলো হয়তো ইন্ডিয়ার রাই। মেহবিন স্পিকার অফ করে দিল। তারপর বলল,,
‘রাই!”
‘কতো বছর পর এই নামটা তোর মুখ থেকে শুনতে পেলাম। জানিস আমার সবসময় মনে হতো আমি মরার আগে তোর সাথে দেখা করতে পারবো না। কিন্তু ভাবিই নি আল্লাহ তায়ালা আমাকে এতো বড় উপহার দিয়ে দেবে। তুই জানিস আমি না তোকে খুব মিস করি। শুধু মনে হয় তুই থাকলে আমার সাথে এসব হতো না। সবসময় কার মতো আমার মেহু আমার জীবনের সব সমস্যা সল্ভ করে দিতো। আমি ভালো নেই মেহু? তোর রাই কতোদিন হলো মনখুলে হাসে না। ওরা তোর রাইয়ের মুখের হাঁসি কেড়ে নিয়েছে? আর এখন তো তোর রাইকেও।
মেহবিন উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,
“কি হয়েছে তোর? কোথায় তুই?”
রাই কাঁশতে লাগলো আর তারপর বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল,,
“আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে মেহু। মনে হচ্ছে আমি মারা যাবো মেহু। তবে শেষবার তোকে ভিশন দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি তোকে ভিশন ভালোবাসি মেহু। তোর সাথে যা করেছি তার জন্য আমাকে মাফ করে দিস মেহু। আমি তোকে খুব ভালোবাসি।
“কিছু হবে না তোর আমি এখনি আসছি।”
বলেই মেহবিন দৌড় দিয়ে সিঁড়ি উঠতে লাগলো। সবাই প্রথমে অবাক হলেও ওকে উঠতে দেখে সবাই ওর পেছনে গেল। মেহবিন ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল রাইফা বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে আর বিছানায় ছটফট করছে । মেহবিন জোরে “রাই” বলে ওকে জরিয়ে ধরলো। ওর হাতের অবস্থা খারাপ তবুও ওর নিজের দিকে খেয়াল নেই। ওকে দেখেই রাই ওকে আঁকড়ে ধরলো। ও বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে তা দেখে মেহবিন ওকে কোলে তুলে নিল। রোগা পাতলা শরীরকে ওঠাতে ওর কোন সমস্যা হলো না। সবাই ঘরে ঢুকবে এমন সময় সবাই দেখলো মেহবিন ও ওকে কোলে নিয়ে বের হচ্ছে আর একটা কথা বলছে,,
“তোর কিছু হবে না রাই। তোর মেহু আছে সবসময়কার মতো এইবার ও সব ঠিক করে দেবে। তোর মেহু তোকে কিছু হতে দেবে না।”
মেহবিন কারো দিকে না তাকিয়ে কষ্ট হলেও সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। ওকে রাইফাকে কোলে নিতে দেখে সবাই চমকে উঠলো। মেহবিন বলল,,
” প্লিজ কেউ গাড়ি বের করুন। রাইকে এখনি হাসপাতালে নিতে হবে।”
রাইকে মেহবিনের কোলে দেখেই আরবাজ আর মুখর গাড়ি বের করেছে। মেহবিন কারো তোয়াক্কা না করে ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ওর সাথে মিশু মুনিয়া ওরা দুজন ও উঠলো। গাড়ি গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। বাকিরা তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইল সবথেকে বেশি সায়িদ। শেখ শাহনাওয়াজ সায়িদ কে রওনা দিলেন অন্য গাড়ি করে। মেহবিন শক্ত করে রাইফাকে জরিয়ে ধরলো। রাইফাও মেহবিনের কোলে গটিশুটি মেরে রইলো শ্বাসকষ্ট অনেকটাই কমেছে। তবে রাস্তাতেই রাইফা অজ্ঞান হয়ে গেল। মেহবিন হাসপাতালে গিয়েই রাইফার চিকিৎসা শুরু করলো। হাতের অবস্থা ভালো নয় তাই একটা কাপড় পেঁচিয়ে নিল। সবকিছু এখন নরমাল মেহবিন কিছু রিপোর্ট করতে দিল ওগুলো আসলেই কিছু বলতে পারবে। মেহবিন বের হলো ও বেরুতেই দেখলো পুরো শেখ পরিবার দাঁড়িয়ে আছে সেই সাথে মুখরদের পরিবার ও শুধু বাদ আছিয়া খাতুন মিসেস আছলাম আর শেখ শাহেনশাহ আর আরিফ জামানের পরিবার। মেহবিন সবাইকে সাইড করে চলে আসতে নিল তখন সায়িদ বলল,,
“কি হয়েছে রাইফার?”
মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,
‘আপতত অজ্ঞান হয়েছে আর কিছু না।”
‘আমরা রাইফাকে এই সরকারি হাসপাতালে রাখবো না। আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”
‘রাইকে এখানে আমি এনেছি। আমি বুঝবো আমার রাইকে কোথায় কিভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে।”
“তোমার রাই?”
“হ্যা আমার রাই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার রাই। এখানে কি করতে এসেছেন আপনারা এতোদিন তো আপনাদের বাড়ি ছিল দুদিন অজ্ঞান ও হয়ে গিয়েছিল। একটা ডক্টর দেখাতে পারলেন না আপনারা কেউ। আর এখন এসেছেন আদিখ্যেতা দেখাতে। কি দেখতে এসেছেন ও মারা গেছে কি না।”
‘আপনি এভাবে আমার সাথে কথা বলছেন কেন? আমি তো বলেছিলাম ওকে যেতে ও যায় নি।”
‘শুধু বললেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না করে দেখাতে হয়। আপনারা এখান থেকে চলে যান রাইয়ের জন্য যা ভালো হয় সেটা আমি দেখে নেব। ওর জন্য এখানে কারো থাকার দরকার নেই।”
তখন শেখ আমজাদ বললেন,,
“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমরাও ডাক্তার?”
“এরকম ডাক্তার হয়ে কি লাভ যদি নিজেদের লোকের কাজেই না আসে। আমি আপনাদের এতো কথা বলছি কেন? আমার তো আপনাদের ওপর কোন দায় নেই।”
বলেই মেহবিন ওখান থেকে আসতে নিল তখন মুখর বলল,,
“আপনার হাত থেকে রক্ত পরছে ?”
মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“এসব তো কিছুই নয় তবে,,
এইটুকু বলে ও নিজের কেবিনে চলে গেল। মেহবিন কেবিনে গিয়ে ওর টেবিলে রাখা সবকিছু ফেলে দিল। ওর ভিশন রাগ হচ্ছে কিন্তু কার ওপর শেখ পরিবারের ওপর নাকি রাইফার ওপর নাকি নিজের ওপর। ও চেয়ারে বসে মাথা ধরে পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে করতে লাগলো।
অতীত,,
আলম আহমেদ মেহবিন কে নতুন স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। মেহবিন কোন বাচ্চার মিশতো না। একা একা থাকতো কারো সাথে কথা বলতো না। এভাবেই ক্লাস টু থেকে ক্লাস থ্রি তে উঠলো। হুট করে একদিন একটা মেয়ে বলল,,
“এই তুমি কথা বলতে পারো না?”
মেহবিন কিছু লিখছিলো কারো কথায় ও মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। মেহবিন কিছু বলছে না দেখে মেয়েটা আবার বলল,,
“সত্যি তুমি কথা বলতে পারো না।”
মেহবিন এবার বলল,,
“পারি!”
“তাহলে কথা বলো না কেন?”
‘এমনি।”
“আমার নাম রাইফা আফনূর। তুমি আমার বন্ধু হবে। আমি না চকলেট খেতে খুব ভালোবাসি তোমায় চকলেট দেব।”
“লাগবে না।”
“হবে না আমার বন্ধু?”
“না।”
“কেন হবে না?”
“এমনিই!”
রাইফা উদাস হয়ে চলে গেল। নিজের বেঞ্চ এ বসলো তখন দুজন বাচ্চা রাইফাকে মারতে লাগলো কারন ওরা রাইফার কালারিং কলম চেয়েছিল কিন্তু ও দেয় নি। মেহবিন তা দেখে ওখানে গিয়ে ঐ দুটো বাচ্চাকে সরিয়ে দিল। আবার এগুতে এলে ও বলল ওকে যদি মারে নাহলে ম্যাডামের কাছে বিচার দেবে। বাচ্চা দুটো ভয় পেয়ে ওখান থেকে চলে গেল। তারপর মেহবিন বলল,,
“তুমি এতো বোকা কেন? তোমাকে মারছিল আর তুমি কিছু না করে মার খাচ্ছিলে?”
রাইফা বলল,,
‘আমি তো মারতে পারি না। এই তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাও না। তাহলে ওরা আমাকে আর মারবে না শুধু ওরা না তুমি থাকলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। তোমার অনেক বুদ্ধি তাই তো ম্যাডামের কাছে বিচার দেওয়ার কথা বলে ওদের ভাগিয়ে দিলে।”
মেহবিন কিছু না বলে ওখান থেকে চলে গেল। সেদিনের পর রাইফা মেহবিনের পেছনে পরলো প্রতিদিন এসে ওর সাথে বসতো অনেক কথা বলতো । প্রায় দুই মাস পর রাইফা মেহবিনের বন্ধু হতে পারলো। এরপর থেকেই শুরু হয় রাইফা আর মেহবিনের বন্ধুত্ব। সময়ের সাথে ওরা হয়ে ওঠে একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড। তাদের জোরা কবুতর বলে সব স্যার ম্যাডামরা ডাকতেন। ওদের দুজনকে সবাই ওদের বন্ধুত্বের জন্য চিনতো। ক্লাস টেন এ উঠার পর এই জোরা কবুতরের মধ্যে এক কাউয়া আসে নাম তার সাগরিকা।
~চলবে,,