#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
“এই তোমরা দুজন তো অনেক ব্রিলিয়ান্ট আমাকে একটু নেবে তোমাদের দলে।”
হুট করে সাগরিকার কথায় দুজনেই ওর দিকে তাকায়। মেহবিন আর রাইফা দু’জনেই ক্লাসের ফাস্ট আর সেকেন্ড গার্ল। রাইফা ফাস্ট আর মেহবিন সেকেন্ড। আর সাগরিকা নিম্নস্তরের প্রথম সারির ছাত্রী মানে টেনেটুনে পাশ এমন টাইপ। ওর কথায় রাইফা বলল,,
“আমাদের দলে নিলেই কি? তোমার গোবর মাথায় পদ্ম ফুটবে সাগরিকা?”
তখন মেহবিন বলল,,
“এসব কি ধরনের কথা রাই। আর শুনো সাগরিকা আমরা কোন দল করি না যে তুমি আমাদের দলে আসবে।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“আসলে আমি তো খুব একটা ভালো স্টুডেন্ট না। তোমরা দুজন যদি আমাকে একটু সাহায্য করতে তাহলে আমি পড়াশোনায় একটু আগাতে পারতাম।”
তখন রাইফা বলল,,
“পড়াশোনা নিয়ে সাহায্য করাই যায়। তবে হ্যা আমাদের মধ্যে একদম ঢোকার চেষ্টা করবে না।”
“তোমরা যে আমায় সাহায্য করবে এতেই খুশি। আমি তাহলে তোমাদের সিটে বসি?
মেহবিন বলল,,
“ঠিক আছে।”
এরপর থেকে সাগরিকা ওদের সাথে বসতো। কয়েকদিন পর সাগরিকা রাইফাদের বিল্ডিং এ রাইফাদের সামনের ফ্ল্যাটে ভাড়া উঠে। ওদের ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া হতো রাইফা আর সাগরিকার। দু’জনের বেশ ভাব ও হয়ে যায়। এভাবে প্রথম প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা এসে পরে সাগরিকা তো পারলে ওদের বাড়িই থাকে। পড়াশোনা দেখে রাইফাও কিছু বলে না সেই সাথে ওদের মায়েরাও না। ভালোই ভালোই পরীক্ষা টা হয়ে যায়। পরীক্ষায় মেহবিন ফাস্ট হয় রাইফা সেকেন্ড। সাগরিকাও অনেক ভালো নাম্বার পেয়ে খুশি। রাইফা ফাস্ট হতে পারে নি দেখে রাইফার একটু মন খারাপ হয় কারন ও ফাস্ট হলে ওর বাবা ওর পছন্দের একটা ঘড়ি দেবে।তবুও নিজের প্রানপ্রিয় বান্ধবী ফাস্ট হয়েছে এই খুশিতে মন খারাপ চলে যায়। রাইফা বলল,,
“এই মেহু তুই তো ফাস্ট হয়েছিস ট্রিট দে!”
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“চল কি খাবি বল? তিনশো টাকার ভেতরে যা খাবি তাই খাওয়াবো বাজেট এতটুকুই।”
“ধুরু কি বলিশ তিনশো টাকায় কি আর দুজনের পার্টি হবে তাই মন চায় সব খাবো আজ।”
“আরে বললাম তো বাজেট এতটুকুই আমি তো আর রোজগার করি না। পাপা যা দেয় তাই।”
“হুম হইছে চল তাহলে।”
তখন সাগরিকা এসে বলল,,
“এই যে জোরা কবুতর তোমাদের জন্য আমি এতো ভালো নাম্বার পেয়েছি বলে। আজ তোমাদের মন খুলে ট্রিট দেব।”
রাইফা খুশি হয়ে বলল,,
“তাই!”
মেহবিন কিছু বললো না। ওর আজকাল সাগরিকা কে ভিশন অদ্ভুত লাগে। ওর মনে হয় ও সব স্বার্থের জন্য করছে। মেহবিন বলল,,
“আজ আমাদের সময় হবে না তুমি বরং অন্য দিন দিও।”
তখন রাইফা গুঁতা মেরে ফিসফিস করে বলল,,
“আরে অফ যা এতোবড় ট্রিট মিছ দেওয়া যায় নাকি। আজ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হবে আমার বান্ধবী ফাস্ট হয়েছে। যদিও অন্যের টাকায় তোরটা কাল খাবো এখন চল।”
রাইফার জোরাজুরিতে ও আর কিছু করতে পারলো না। ওদের সাথে গেল আর বেশ ভালো একটা রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিল। সবশেষে রাইফার জন্য সাগরিকা একটা ঘড়ি দিল যেটা রাইফা কিনবে বলে ওর বাবার কাছে আবদার করেছিল তবে ঘড়িটা বেশ দামী তাই তার বাবা বলেছে পরীক্ষায় ফাস্ট হলে কিনে দেবে । কিন্তু ওতো ফাস্ট হয় নি।ঘড়িটা পেয়ে রাইফা খূ্শিতে লাফিয়ে উঠে। কিন্তু তা দেখে মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠে না। রাইফা খুশি হয়ে মেহবিনকে দেখাতে থাকে। সাগরিকা মেহবিন কে একটা কলম দেয় যদিও সেটা খুব দামী নয় তবে একটু ভালো ওটা দিয়ে বলল,,
“আসলে রাইফার ওটা পছন্দের এটা জানতাম তাই ওর জন্য ঘড়িটা এনেছি। তোমার পছন্দ জানি না তো তাই এই ছোট্ট উপহার।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“ধন্যবাদ।”
কিছুক্ষণ পর সাগরিকা ওদের রেখে চলে গেল। মেহবিন আর রাইফা একটা রিক্সায় উঠলো। রাইফার মুখে হাঁসি তা দেখে মেহবিন বলল,,
“আজ খুব খুশি তুই তাই না?”
“হুম খুব খুশি । তুই জানিস আমি ফাস্ট হইনি বলে খুব খারাপ লাগছিল কারন বাবা বলেছিল আমি ফাস্ট হলে এই ঘড়িটা কিনে দেবে। কিন্তু এখন ফাস্ট না হয়েও পেয়ে গেলাম খুশি হবো না বল তুই।”
“ওহ আচ্ছা।”
মেহবিন একটা ছোট চকলেট বক্স দিয়ে বলল,,
“নে এটা তোর জন্য কিনেছিলাম।”
“ও মাই আল্লাহ চকলেট। আজ তো আমার ঈদ লাগছে দোস্ত।”
বলেই মেহবিনের গালে একটা চুমু দিল। তা দেখে মেহবিন হাসলো। এই মেয়েটার পাগলামি ওর মুখে হাঁসি ফুটায়। এভাবেই চলতে লাগলো কিছুদিন হুট করেই মেহবিন বুঝতে পারলো রাইফা ওর সাথে আগের মতো থাকছে না। ওর সাথে থাকলেও সাগরিকার সাথে বেশি কথা বলছে । আসলে রাইফা আর সাগরিকা একই বিল্ডিং এ হওয়ায় নানা গল্প তারা স্কুলে এসে করে। এই জন্য মেহবিন একদিন ছুটির সময় বলল,,
“এই রাই আজ তুই আমার রিক্সায় বাড়ি যাবি।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“এই রাইফা তোমাকে আজ আন্টি তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে না। আমাদের সাথে মোটর সাইকেল এ চলো।”
তখন রাইফা বলল,,
“সরি মেহু আজ ওদের সাথেই যাই। মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।”
মেহবিন কিছু বললো না। ও নিজের মতো চলে গেল। দেখতে দেখতে দ্বিতীয় প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা এলো। রাইফা আর মেহবিন বেশ ভালোই পরীক্ষা দিল। এবার রাইফা ফাস্ট আর মেহু সেকেন্ড। এ নিয়ে মেহবিন একটুও মন খারাপ করলো না। ও রাইফা কে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানালো। রাই ও ভিশন খুশি। এই জন্য সে বলল কেক ট্রিট দেবে। রাই মেহবিনের সাথে সাগরিকাকেও নিল সেই সাথে আরো দুই তিনজন ক্লাসমেট। চকলেট কেক কাটতে দেখে সাগরিকা বলল তার ভিশন পছন্দের বলেই প্রথম পিচ টা রাইয়ের হাত থেকে সে খেয়ে নিল। ব্যাপারটাতে মেহবিন আর রাইফা দু’জনেই হতভম্ব গেল। রাইফা বলল,,
“এই তুমি আগে কেকটা খেলে কেন ওটা তো সবসময় মেহুর জন্য ।”
“আরে রাই চিল এটা আর কি বড় ব্যাপার। তোকে বললাম না আমার চকলেট কেক ভিশন পছন্দের।তাই লোভ সামলাতে পারি নি। নে এখন তুই মেহবিন কে খাওয়া।”
মেহবিন সাগরিকার মুখে রাই শুনে থমকে গেল কারন রাই শুধু ঐ বলতো আর ওর বাবা মা। রাইকে অন্য কেউ রাই বললে রাই রেগে যেত। কিন্তু আজ কিছুই বলছে না। রাইফা মেহবিনের সামনে গিয়ে বলল,,
“সরি দোস্ত ঐ সাগরিকার জন্য তোকে প্রথমে খাওয়াতে পারলাম না।”
মেহবিন মুচকি হাসি ফুটিয়ে খেয়ে বলল,,
“ইটস ওকে।”
বলে রাইফাকেও খায়িয়ে দিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অন্যরকম যন্ত্রনা তৈরি হলো। কিন্তু ও বুঝতে দিল না কাউকে ভেতরে ভেতরে ও বুঝতে পারছে ওর রাই ওর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সবাই চলে গেল খেয়ে দেয়ে রাইফাও চলে গেল তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে বলে ।শুধু রয়ে গেল মেহবিন একা। ও অস্ফুট স্বরে বলল,,
“মানুষের জীবন কি অদ্ভুত তাইনা? কিছু জিনিস খুব অপছন্দের থাকা সত্বেও সৌজন্যতার খাতিরে হাঁসি মুখে সহ্য করতে হয়!”
কিছুদিন এভাবেই কেটে গেল টেস্ট পরীক্ষার পাঁচ দিন বাকি। এই কয়েকদিনে মেহবিন ঠিক বুঝে গেছে ও ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কে হারাতে চলেছে। রাইফা আগের মতো আর মেহবিনের সাথে থাকে না কথাও বলে না। তবে সাগরিকার সাথে তার বেশ ভাব । আজকাল মাঝে মাঝে মেহবিন মনে করে রাইফা ওর জন্য বিরক্তবোধ হচ্ছে। এসবই আনমনে ভাবছিল মেহবিন হুট করে রাইফা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,,
“তুই যদি আমার বান্ধবী না হতিস? তাহলে তোর গালে আমি কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতাম।”
হঠাৎ এ কথায় মেহবিন ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশে সাগরিকা কে দেখতে পেল। তা দেখে মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,
“আমি কি করেছি?”
রাইফা মেহবিনের সামনে একটা চিঠি রাখলো। মেহবিন পরে দেখলো তাতে ওদের ফিজিক্স এর স্যারের নামে প্রেমপত্র লেখা হয়েছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,
“এটা এটার জন্য কি হয়েছে?”
“এটা আমার ফিজিক্স এর অ্যাসাইনমেন্টের খাতার ভেতর এলো কি করে?”
“মানে কি?”
“মানে এটা আমার হাতের লেখা আর তুই ছাড়া আমার হাতের লেখা কেউ কপি করতে পারে না।”
“তো কি হয়েছে?”
“আমি তো লিখিনি তাহলে তুই তুই লিখেছিস এটা। আর আমার অ্যাসাইন্টমেন্টের ভেতরে রেখেছিস।”
এটা শুনে মেহবিন রেগে গেল আর বলল,,
“তুই এসব কি বলছিস? তুই কি পাগল হয়েছিস।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“এখন কিছু না জানার ভান ধরা হচ্ছে। তুমিই এটা রেখেছো যাতে স্যারের মনে রাইকে নিয়ে বিরুপ ধারনা হয় আর স্যার যাতে ওকে কম নাম্বার দেয়। প্রথম পরীক্ষায় তুমি ফাস্ট হয়েছিলে আর দ্বিতীয় পরীক্ষায় রাই হয়েছে যাতে টেস্ট পরীক্ষায় ও তুমি ফাস্ট হতে পারো তাই এসব করেছো তাই না। তুমি জানো এই নোংরা খেলার জন্য স্যার ওকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করেছে । সেই সাথে তো প্রিন্সিপাল স্যারের কাছেও নালিশ দিতে গিয়েছিল। আমরাই কতো অনুরোধ করে বলেছি এসব ভুল আরো কতোকিছু করে মাফ চেয়েছি। রাই তো দেখেই বুঝেছিল এটা তোমার হাতের লেখা তারপরও তোমার নাম বলেনি আর তুমি তার বন্ধুত্বের এই দাম দিলে ছিঃ!”
সব শুনে মেহবিন স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর নিজের ভেতরে খুব অনুশোচনা হচ্ছিল এই কারনে যে ওর খারাপ সময়ে ওর পাশে থাকতে পারে নি। তবে ওর অভিযোগ আনা শুনে ও ঠান্ডা মাথায় বলল,,
“তুই আমাকে ক’বছর ধরে চিনিস রাই?”
হুট করে এমন প্রশ্নে রাই চমকে উঠলো। তখন সাগরিকা বলল,,
“তুমি এসব কি বলছো নিশ্চয়ই কথা ঘুরাতে চাইছো।”
মেহবিন এবার রেগে বলল,,
“ইডিয়ট আমি তোমায় নয় রাইকে জিজ্ঞেস করেছি।”
একথা শুনে রাই বলল,
“তুই ওকে ইডিয়ট বলছিস কেন?’
“আমার উত্তর আগে দে তুই?”
“তার আগে তুই বল তুই ওকে ইডিয়ট বললি কেন? ও কি বলেছে তোকে ওতো যা দেখেছে তাই বলেছে।”
মেহবিন রাইয়ের খুব কাছাকাছি চলে গেল ওর চোখে চোখ রেখে বলল,,
“আমায় বিশ্বাস করিস রাই?”
রাই বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলো না। অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,,
“আগে নিজের থেকেও বেশি করতাম। কিন্তু এগুলো দেখে করতে পারছি না।”
মেহবিন চিঠির দিকে তাকিয়ে ওর মুখে মুচকি হাসি ফুটলো তা দেখে সবাই অবাক হলো। রাই নিজেও ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। মেহবিন কোনদিকে না তাকিয়ে চিঠিটা নিয়ে ফিজিক্স স্যারের রুমে গেল। কি যেন বলল তাকে তারপর বেরিয়ে এলো কিছুক্ষণ পর স্যার ক্লাসে এসে রাইকে সবার সামনে সরি বলল আর যাওয়ার আগে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তোমার ভাগ্য খুব ভালো যে তুমি মেহবিনের মতো বান্ধবী পেয়েছো।”
কথাটা শুনেই রাইফার চোখ ছলছল করে উঠলো। স্যার যেতেই মেহবিন বলল,,
“আমার জন্য সব হয়েছিল না। নে আমিই সল্ভ করে দিলাম। এবার হ্যাপি।”
বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। পরে রাইফা গেল স্যারের কাছে জানতে চাইলো মেহবিন কি বলেছে। বলে সে বলল সে এসে জানালো তুমি এই কাজ করোনি কেউ তোমাকে খারাপ বানানোর জন্য এসব করেছে । আমরা বিশ্বাস করিনি পরে ও বলল ও নিজেও তোমার হাতের লেখা নকল করতে পারে। এই বলে কিছুটা লিখলো তবে চিঠিতে এমন কিছু জিনিস ছিল তা তোমাদের দুজনের কারোটাই মিল ছিল না। এটা ও প্রুভ করে দিয়ে গেল আর বুঝিয়েও দিল তাই বুঝতে পারলাম ওটা কেউ ইচ্ছে করে তোমার নামে করেছে। সব শুনে রাইফা কেঁদে উঠলো ও মেহবিনকে খুঁজতে লাগলো একটা সময় পেয়েও গেল ও ওকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। আর বলল,,
“সরি রে আমি আজ বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার সব সমস্যার সমাধান তুই। প্রথমে সাগরিকার কথা কানে না নিয়ে যদি তোর সাথে কথা বলতাম তাহলে কোন সমস্যাই হতো না। আই এম রেইলি সরি।”
মেহবিন তো আর এক কথায়ই কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার পাত্রী নয়। ও কিছু না বলে বাড়ি চলে গেল। এদিকে সাগরিকা এসে ন্যাকা কান্না করতে লাগলো। রাইফা গলে গেল। দুদিন ধরে রাইফা মেহবিনের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু মেহবিন বলছে না। আজ ক্লাসের শেষদিন তাই আজ সে মেহবিনের জন্য চকলেট আর ফুল নিয়ে এলো আজ রাগ ভাঙিয়েই ছাড়বে। কিন্তু স্কুলে এসেই দেখলো মেহবিন সাগরিকাকে পরপর দু’টো থাপ্পড় মারলো। তা দেখে রাই দৌড়ে ওখানে চলে গেল মেহবিন আরেকটা থাপ্পড় মারবে এমন সময় রাই হাত ধরে ফেলল আর বলল,,
“কি করছিস তুই পাগল হয়ে গেছিস? ওকে মারছিস কেন?
মেহবিন রেগে বলল,,
“সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কর?”
“কি হয়েছে সাগরিকা?”
তখন সাগরিকা বলল,,
“মেহবিন স্কুলের সবাইকে বলছিল তুই নাকি মেহবিনের টা দেখে দেখে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করিস। তোর নাকি কোন যোগ্যতা নেই ওর রেজাল্ট এর সমান করার। আবার ও সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তোর নাকি কোন বড় ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক আছে সে তোকে প্রশ্নপত্রের ব্যাপারে হেল্প করে । এটা শুনে আমি প্রতিবাদ করতেই ও আমায় থাপ্পড় মারলো।”
সব শুনে রাই মেহবিনের দিকে তাকালো মেহবিন শান্ত চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রাই বলল,,
“এসব সত্যি মেহবিন?”
তখন সাগরিকা বলল,,
“তোর বিশ্বাস না হয় ওদের জিজ্ঞেস কর?”
সাগরিকার সাথে থাকা সবাই বলল সাগরিকা সত্যি কথা বলছে। রাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো ও মেহবিনের কাছে গিয়ে বলল,,
“মেহু এসব কি?”
“সেদিন তোকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুই আমায় বিশ্বাস করিস কি না তোর মনে হয় আমি এসব করবো। আমি ওকে এই কারনেই থাপ্পড় মেরেছিলাম কারন চিঠিটা ও রেখেছিল।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“এখন আমার ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। তাছাড়া আমি ওর মতো কোনদিন লিখতেই পারবো না। আমার হাতের লেখা ওতো সুন্দর নাকি। সবথেকে বড় কথা আমি তোমার মতো বন্ধুরূপী শত্রু নই আমি সত্যি সত্যি রাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী। আচ্ছা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না রাই আমি তোকে প্রমান দিচ্ছি।
সাগরিকা খাতা বের করে রাইয়ের মতো লেখার চেষ্টা করলো হলো না। তখন সাগরিকা মেহবিন কে নিয়ে বলতে লাগলো তখন কিছুজন সাগরিকার সাথে তাল মেলালো। সব শুনে রাইফা বলল,,
“আমি ভাবতেও পারিনি মেহু তুই আমার নামে এসব বলে বেড়াবী। তোকে বন্ধু ভাবতেই আমার কেমন যেন লাগছে।
মেহবিন কিছুই বললো যে ওকে বিশ্বাস করেনা তার কাছে নিজের সম্পর্কে সে কিছু সাফাই দেবে না। তখন সাগরিকা বলল,,
“মেহবিন আমার নামে ওসব বলল আমাদের দুজনের মাঝে সম্পর্ক নষ্ট করতে। এই মেহবিন একদম আমাদের দুজনের মাঝে আসবে না।
তখন মেহবিন উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলো আর বলল,,
“তোমাদের মাঝে বাহ বেশ ফানি তো । আমি তোমাদের মাঝে আসছি না তুমি আমাদের মাঝে এসে পরেছো। এতো সুন্দর একটা বন্ধুত্ব কতো সহজেই না ভেঙে দিলে তুমি। এই জন্য তোমাকে স্যালুট দেওয়া উচিত। কি সুন্দর জোরা কবুতর কে ভেঙে দিল এক কাক অরফে কাউয়া।”
এ কথা শুনে সাগরিকা রেগে বলল,,
“এই মেহবিন মুখ সামলে কথা বল। নাহলে তোর মুখ আমি ভেঙে দেব।”
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“এই মেহবিন কে আঘাত করা এতো সহজ নয়। যেখানে এতোকিছুর পরেও রাই নিজেই আমার কিছু করতে পারলো না সেখানে তুই কি করবি।”
মেহবিনের কথার মানে রাই বুঝলো আর বলল,,
“আমি তোকে এই কারনেই আঘাত করি নি কারন আমি তোকে নিজের বান্ধবী মনে করি। আমার এখন তোকে দেখে ভাবতেও ঘৃনা হচ্ছে তুই আমার বান্ধবী।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“তাহলে ভেঙে দে না বন্ধুত্ব। ট্রাস্ট মি আমি কিছুই বলবো না।”
মেহবিনের মুচকি হাসির বলা কথাটা রাইয়ের মনে ঝড় তুলল। ও ব্যাগ থেকে ফুল আর চকলেট বের করলো আর বলল,,
“এসব এনেছিলাম তোর রাগ ভাঙাবো বলে কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম এসব তুই ডিজার্ভ করিস না।”
“ওহ আচ্ছা আমি করি না। তো কে করে ঐ সাগরিকা?”
রাই ওর দিকে অশ্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,,
“হ্যা ঐ ডিজার্ভ করে । তোর মতো ধোঁকাবাজ নয়।
বলেই রাই সবকিছু সাগরিকাকে দিয়ে দিল। মেহবিন দেখলো সাগরিকার মুখে অদ্ভুত ক্রুর হাঁসি। সবাই চলে গেল শুধু রইলো মেহবিন। মেহবিনের মুখে অদ্ভুত হাসি। ও ব্যাগ থেকে দু’টো দামি কলম আর ডায়রি বের করলো যা ও আজ রাইফাকে দেবে বলে এনেছিল। ও ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে বলল,,
“যখন সাগরিকা নামক মেয়েটা আমাদের কাছে আসে তখনই বুঝেছিলাম যে কিছু একটা হবে। কিন্তু বুঝতে পারি নি আমাদের সম্পর্কই শেষ করে ফেলবে। যবে থেকে তুই আমাকে বাদ দিয়ে ওর সাথে বেশি কথা বলতে লাগলি তবে থেকেই বুঝতে পারছিলাম তুই আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস যেদিন রেস্টুরেন্টে তোকে ও রাই বলে সম্বোধন করলো কিন্তু তুই কিছু বললি না সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তুই নিজেও ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। সম্পর্ক কখনো তৃতীয় ব্যক্তির কারনে নষ্ট হয় না, সম্পর্ক তো নষ্ট হয় তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য। আর তুই সেটা দিচ্ছিলিস। দিন যাচ্ছে তুই কেন আমাকে ভুলেই যাচ্ছিস মানে সম্পর্ক অসুস্থ হয়ে পরছে তৃতীয় কারো আগমনে অথচ তুই বুঝতেই পারছিস না। কি অদ্ভুত তাইনা তৃতীয় একজন তোর গালে এতো জোরে থাপ্পর মেরে গেল তুই বুঝতেই পারলি না। আমি তো খুব করে বুঝতে পারছিলাম তোর আর আমার বিচ্ছেদ খুব নিকটে অথচ তুই কিছু আচই করতে পারছিস না। মানে তোর এই আমি কাউকে পেছনে ফেলে আসা তোর জীবনে কোন ইফেক্টই পরছে না। তুই এই কয়েকমাস ভেবে দেখতো একটু আমাকে কতটুকু সময় দিয়েছিস যে মেয়েটা আমাকে বন্ধের দিন তিনবার করে ফোন দিতো সেই মেয়েটা সেই ঘটনার আগের তিন মাস যাবৎ আমাকে ফোনই দেয় না কি অদ্ভুত তাইনা।
সাত বছরের সম্পর্ক আমাদের। দুজন দুজনকে খুব ভালোমতো চিনি তবুও মনে হচ্ছে কোথাও কমতি ছিল। তাই তো আজ তুই আমায় অবিশ্বাস করলি। তুই তো বলতি আমাদের কেউ ভাঙতে পারবে না। অথচ কত ছোট্ট কারনেই না তুই সম্পর্ক ভেঙে দিলি। হয়তো অন্য কেউ হলে সে সাফাই দিতো কিন্তু আমি তো অন্যদের মতো নই। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে সম্পর্ক রাখা বোকাদের কাজ। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস হলো চেনা মানুষের অচেনা রুপ যা তৃতীয় ব্যক্তির কারনে হয়ে থাকে। আর আজ তা আমার চোখের সামনে।
এইটুকু বলেই মেহবিন ক্লাসে গেল। ওখানে গিয়ে দেখলো রাইফা কাঁদছে আর সাগরিকা ওকে আগলে রেখেছে কিন্তু মুখে অদ্ভুত হাঁসি। মেহবিন কিছু বললো না অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসে পরলো। সেদিনের মতো সবাই ক্লাস করে চলে গেল।অথচ এই শেষ দিন নিয়ে দুই বান্ধবীর কতো প্ল্যান ছিল। অতঃপর পরীক্ষা শুরু হলো দু’জনের চোখাচোখি হলো কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বললো না। মেহবিন শান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো আর রাইফা সাগরিকার সাথে গল্প করতো চলাফেরা করতো ওকে ইগনোর করে। এমন একটা ভাব ওর জীবনে মেহবিন নামের কেউ নেই। সবগুলো পরীক্ষা এভাবেই দিল। রেজাল্ট ও প্রায় সেম সেমই করলো। রাইফাই বেশি পেল বরং একটু। এটা নিয়ে সাগরিকা মেহবিন কে নিয়ে অনেক কথা বলল রাইফাও সেদিন তাল দিল। মেহবিন একটা টু শব্দ করে নি সেদিন। ও তো শুধু দেখছিল চোখের সামনে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড এর ও কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে। দুজনে একজনের কাছেই কোচিং করতো কিন্তু ওদের দেখে মনে হতো কোন নিরব যুদ্ধ চলছে। এভাবেই চলে এলো এস এস সি পরীক্ষা। দুজনেই সিট আগে পিছে কিন্তু ওদের মাঝে মনে হয় কতো মাইলের দূরত্ব। ওদের দুজনকে এভাবে পরীক্ষা দিতে দেখে স্যার ম্যাডামের কতো প্রশংসা পেয়েছে। দেখতে দেখতে সবগুলো পরীক্ষা শেষ হলো আজ লাস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর মেহবিন রাইফাকে ডাকলো।
“মিস রাইফা আফনূর একটু শুনবেন? আজকের পর থেকে এই মেয়েটা আপনাকে আর ডিস্টার্ভ করবে না। কারন আপনার সঙ্গ সে ডিজার্ভ করে না।”
এতোদিন পর প্রানপ্রিয় বান্ধবীর ডাকে রাইফা না চাইতেও দাঁড়িয়ে পরলো মেহবিন রাইফার সামনে দাঁড়ালো তার মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে তুলল আর বলল,,
“পরীক্ষা কেমন হলো আপনার?”
রাইফা মুচকি হেঁসে বলল,,
“আপনারটা না দেখে দিলে তো আমি ভালো রেজাল্ট করতেই পারতাম না তাই না। সেই হিসেবে বলতে পারি বেশ ভালো হয়েছে ইনশাআল্লাহ রেজাল্ট আপনার থেকে ভালোই আসবে।”
“ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আপনার মনের সকল আশা পুরন করুক।”
কথাটা শুনে রাইফা থমকে গেল ও ভাবেও নি মেহবিন ওর সাথে এভাবে কথা বলবে। ও কিছু বলবে তার আগে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
‘আমরাও একটা সময় অনেক কথা বলতাম, একসাথে কতো সময় কাটাতাম। তাহলে আমাদের সাথে তেমন কি হয়েছে যে আজ হাজার মাইলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।”
মেহবিনের কথা শুনে রাইফাও বলল,,
“তখন তো আর জানতাম না নিজের সবথেকে প্রিয় বান্ধবী ধোঁকা দিয়ে দেবে।”
মেহবিন আবারও মুচকি হাসলো আর বলল,,
“আমাকে সবথেকে ভালো তুই চিনতিস যদি তোর মনে হয় আমি তোকে ধোঁকা দিয়েছি। তাহলে হয়তো সত্যিই দিয়েছি।”
মেহবিনের এইটুকু শুনে রাইফা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মেহবিনের মুচকি হাসি বরাবরই রাইফাকে মুগ্ধ করে কিন্তু আজ অদ্ভূত যন্ত্রনা দিচ্ছে। ওর চোখ ছলছল করে উঠলো ও বলল,,
‘হয়তো আমি তোকে সবথেকে ভালো চিনতাম কিন্তু আমি ধোঁকাবাজ মেহবিন কে চিনি না। আমি চিনি না তাকে। আর এই ধোঁকাবাজের সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না।
‘সেদিনের পর কোন সম্পর্ক ছিল বুঝি। উঁহু ছিল না কোন সম্পর্ক। তাই তো আজ আপনি সম্মধোন করতে হচ্ছে।
“এই সবকিছুর জন্য তুই দায়ী।”
“মানুষ বরাবরই স্বার্থপর এটা আমার মা বলেছিল একদিন। তবে আমার মা এটাও বলেছিল নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবে যাতে কেউ তোমাকে স্বার্থপরতার কাজে না লাগাতে পারে। ”
রাইফা অবাক হয়ে বলল ,,,
“মানে কি?”
মেহবিন মুচকি হেঁসে আবার বলল,,
“আমি একটা রিয়ালাইজ করেছি জানিস সেটা হলো ‘বন্ধুত্বের সম্পর্ক যতো গভীরই হোক না কেন? যখন সেই বন্ধুত্বে তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকে পরে তখন তার বন্ধুত্বের বিশ্বাস আর তৃতীয় ব্যক্তির মাঝে সবসময় তৃতীয় ব্যক্তিরই জিত হয়।”
এটা শুধু বন্ধু্ত্ব নয় যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়।সেদিন কি যেন বলছিলি আমাকে তোর বন্ধু ভাবতে ঘৃনা হচ্ছে তাই না। তবে আমার কিন্তু এতো সুন্দর বন্ধুত্ব সম্পর্কটার ওপর ঘৃনা আসছে না কিন্তু সহ্য ও হচ্ছে না। আমি চাইতাম যুগের পর যুগ চলে যাক তবুও আমাদের বন্ধুত্ব যাতে নষ্ট না হোক। তোকে আমি আমার হয়ে কোন সাফাই দেব না। তবে একটা কথা মনে রাখিস একটা সম্পর্ক নষ্ট করতে অনেকের দরকার হয় না একজনই যথেষ্ট। তবে হ্যা আরেকটা কথা ‘একশো বছর পরেও যদি তুই আমার কাছে আসিস আর আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলেও সব ছেড়েছুড়ে আমি তোকে আগলে নেব।’ যাই হোক অনেক কথা বললাম নিজের খেয়াল রাখিস আসছি হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না আমাদের।
মেহবিন হেঁটে চলল সামনের দিকে। রাইফা মেহবিনের কথার কিছুই বুঝতে পারলো না। কারন ওর সবকিছু গোলমেলে লাগছে। তবুও বলল,
“মেহু আমার কথাটা শোন?”
মেহবিন পেছনে ফিরে মুচকি হেঁসে বলল,,
“বিচ্ছেদ মানেই সবসময় অসমাপ্ত নয়, কখনো কখনো বিচ্ছেদ মানে এক সুন্দর সমাপ্তি!”
~আজরিনা জ্যামি
~চলবে,,
বিঃদ্রঃরাত নয়টার দিকে বোনাস পার্ট দেব। কালকে তেমন কোন মন্তব্য পাইনি তবে কতোজন বললেন মন ভরেনি। কিন্তু আপনাদের কমেন্ট দেখে আমারও মন ভরেনি আমি হতাশ।