হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম Nusrat_Jahan_Bristy #পর্ব_১৬

0
843

#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_১৬

জাহিন অয়ন্তিকে বেডে রেখে আস্তে করে মাথাটা বালিশের উপরে রাখতে যাবে সাথে সাথে অয়ন্তি চোখ মেলে তাকায়। অয়ন্তিকে এভাবে চোখ মেলে তাকাতে দেখে জাহিন হকচকিয়ে উঠে। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে জাহিন অয়ন্তির মুখ পানে। মানে অয়ন্তি কি বাচ্চা নাকি যে বিছানায় শোয়াতেই ঘুম ভেঙে গেল। কত্তটা সাবধানতার সঙ্গে জাহিন অয়ন্তিকে শুইয়ে দিয়েছিল আর সেই মেয়ে কিনা এভাবে জেগে গেল। অন্য দিকে জাহিনকে অয়ন্তি নিজের এতটা কাছে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। দুই তিনটা বার চোখের পলক ফেলে বুঝার চেষ্টা করল নিজের অবস্থানটা কোথায়! অয়ন্তি যখন নিজের অবস্থান বুঝতে পারল তখনই তাড়াহুড়ো করে উঠতে নিলে জাহিনের কপালের সাথে নিজের কপাল বারি খায়। জাহিন মৃদু চিৎকার করে কপালে হাত রেখেই‌ বিছানাতে বসে পড়ে। অয়ন্তি জাহিনের আর্তনাদ শুনে অধৈর্য গলায় বলে।

“সরি সরি আমি বুঝতে পারি নি আপনার লেগে যাবে যে। আসলে হঠাৎ করে আপনাকে এভাবে দেখে।”

জাহিন অয়ন্তিকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “আমি ঠিক আছি অয়ন্তি এতটা উত্তেজিত হওয়ার কিছু হয় নি।”

অয়ন্তি অপরাধী গলায় বলে, “কিন্তু আপনার তো এখন মাথায় শিং গজাবে। সাথে আমারও গজাবে।”

অয়ন্তির বোকা বোকা কথা শুনে জাহিনের হাসতে ইচ্ছে করল। কিন্তু হাসিটা ধমন করে কপাল ঘষা অবস্থায় অয়ন্তির দিকে ফিরে প্রশ্ন করে, “তো শিং যাতে না গজায় তার জন্য কি করণীয়?”

“আবার ঠোকা মারতে হবে আপনার কপালে।”

জাহিন নিঃশব্দে হাসল। অয়ন্তির ফোলা মুখশ্রীর দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বলে, “আপনি কি বাচ্চা অয়ন্তি?”

জাহিনের মুখে আকস্মিক এমন কথা শুনে অয়ন্তি লজ্জা পেল। লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়। জাহিন পুনরায় বলে, “আপনাকে সোফা থেকে কোলে করে এনে বেডে যেই শুইয়ে দিলাম ওমনি আপনি বাচ্চাদের মতো জেগে গেলেন। মানে আমার কষ্টটা এভাবে বৃথা করে দিলেন।”

অয়ন্তি অবাক চোখে জাহিনের দিকে তাকাল। জাহিনের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন সে জেগে গিয়ে মস্ত বড়ো এক ভুল করে ফেলেছে। জাহিন তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আগে শাওয়ার নেওয়া দরকার। এই ময়লা কাপড় পড়ে আর থাকা যাচ্ছে না। কেমন জানি গা চুলকাচ্ছে। জাহিন নিজের প্রয়োজনীয় পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। অয়ন্তি তব্দা মেরে বসে রইল বিছানার উপরে। জাহিনের কপালে তো ঠোকা দেওয়া হল না এবার যদি সত্যি সত্যি শিং উঠে তখন কি হবে? খুব বাজে দেখা যাবে তখন হয়ত! না জাহিন ওয়াশরুম থেকে বের হোক তারপর জাহিনের কপালে সে ঠোকা দিবেই দিবে।

জাহিন প্রায় বিশ মিনিট পর শাওয়ার নিয়ে বের হল ওয়াশরুম থেকে। এবার একটু নিজেকে সতেজ লাগছে। জাহিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে অয়ন্তিকে জেগে থাকতে দেখে বলে।

“একি জেগে আছেন কেন এখনও? ঘুমিয়ে পড়ুন।”

অয়ন্তি আমতা আমতা করে বলে, “আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?”

জাহিন কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলে, “হুম খেয়েছি আপনি খেয়েছেন?”

“হুমম খেয়েছি।”

জাহিন ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে বলে, “তাহলে শুয়ে পড়ুন।”

অয়ন্তি চোখ বন্ধ করে জোরে বলে উঠে, “বলচ্ছিলাম কি আপনি তো কপালে ঠোকা দিলেন না।”

অয়ন্তি কথাটা বলে আস্তে আস্তে চোখ মেলে জাহিনের দিকে তাকায়। জাহিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জাহিনের তাকানো দেখে বড্ড লজ্জা পেলো অয়ন্তি। লোকটা মাঝে মাঝে এভাবে তাকায় কেন তার দিকে? জাহিন হাতের টাওয়ালটা চেয়ারের উপরে রেখে এগিয়ে আসে বেডের দিকে। জাহিন অয়ন্তির মুখোমুখি হয়ে বসে। অয়ন্তি মাথা নিচু করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। জাহিন মুচকি হেসে নিজের কপালটা বাড়িয়ে অয়ন্তির কপালে আস্তে করে ঠোকা দিয়ে কৌতুকের স্বরে বলে।

“খুশি এবার। এখন আর শিং গজাবে না। যদিও এতে শিং গজায় না কপালে। কিন্তু আমার বোকাসোকা বউটা আবদার করল তাকে কি করে ফিরাই।”

অয়ন্তি বিস্মিত নয়নে জাহিনের দিকে তাকাল। কত্ত সুন্দর মিষ্টি করে তাকে বউ‌ ডাকল জাহিন। অয়ন্তি মনে মনে খুব খুশি হল। ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। কিন্তু পরক্ষণে দাদুর কথাটা মনে পড়তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয় যায় অয়ন্তির। জাহিন অয়ন্তির ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটা পরখ করে‌ ভ্রু কুঁচকে বলে।

“কি হয়েছে মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাশে করে‌‌ ফেললেন কেন? কিছুক্ষণ আগেও তো হাসি ছিল‌ ওই অধরকোণে।”

অয়ন্তি ধরা গলায় বলল, “আমার জন্যই আজকে আপনার এত বড় একটা ক্ষতি হল।”

জাহিন চোখ ছোট ছোট করে বলল, “মানে।”

“আমি সত্যিই একটা অপয়া। যেই বাড়িতেই যাই‌ সেই বাড়ির ক্ষতি করে ছাড়ি। এই বাড়িতে আসার পরপরেই এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সবাই ঠিকেই বলে আমি সত্যি অপয়া দাদুও ঠিকেই বলেছেন আমি একটা অপয়া।”

জাহিন অয়ন্তির কথা শুনে হতবাক হয়ে বলল, “মানে কে অপয়া বলল আপনাকে? দাদু…. দাদু আপনাকে অপয়া বলেছেন?”

অয়ন্তি আমতা আমতা করে বলে, “না মানে আসলে।”

জাহিন শক্ত গলায় বলে, “আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছি অয়ন্তি দাদু কি সত্যি অপয়া বলেছেন আজকের এই ঘটনাটার জন্য আপনাকে।”

অয়ন্তি নিচু গলায় বলে, “ওনি তো ঠিকেই বলেছেন।”

জাহিন ঘাড় ঘুরিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “এখানে আপনার অপয়া হওয়ার কথা উঠছে কোথা থেকে? এই দুর্ঘটনা আপনি‌ এই‌ বাড়িতে আসার আগেও ঘটতে পারত তখন কাকে অপয়া বলে গণ্য করা হত?”

অয়ন্তি চুপ মেরে বসে রইল। ভুল জায়াগতে ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। জাহিন রেগে গেছে বুঝতে পারছে। কিন্তু সে তো অপয়া ছোট বেলা থেকেই তার জীবনের সাথে জড়িয়ে নানা দুর্ঘটনা ঘটে এসেছে। জন্মের সময় মাকে হারাল, কিন্তু মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হল না তাকে। মায়ের‌ মতো‌ আগলে রেখেছে মামনি তাকে ছোট বেলা থেকে। কিন্তু তার জন্মের কয়েক বছর পরেই তার দাদি‌ মারা গেল তাকে বাঁচাতে গিয়ে। এসব ভেবেই অয়ন্তির কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল।

জাহিন অয়ন্তির দিকে তাকাতেই থমকে যায় অয়ন্তির চোখের কোণে জল দেখে। জাহিন চোখ বন্ধ করে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা অয়ন্তির চোখের পানি মুছে দেয়। অয়ন্তি জাহিনের দিকে তাকিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে জলটা মুছে নেয়। জাহিন গলা খাকারি দিয়ে বলে।

“আপনি জানেন অয়ন্তি আপনার নামের অর্থ কি?”

অয়ন্তি মাথা নাড়িয়ে না বুঝায়। জাহিন পুনরায় বলে, “ভাগ্যবান। অয়ন্তি নামের অর্থ ভাগ্যবান। সেই ভাগ্যবান নামের মেয়েটি কি করে অপয়া হতে পারে বলুন। তাই প্লিজ কারো মুখে এমন কথা শুনে নিজেকে পীড়া দিবেন না। আমি জানি না আপনার অতিত জীবনে কি ঘটেছে বা কে কি বলেছে? কিন্তু আমি চাই আপনার বর্তমান জীবনটা সুখের হোন। একটা হাসি খুশিময় জীবন হোক। কেউ অপয়া হয়ে জন্ম নেয় না অয়ন্তি। মানুষ তাকে অপয়া বলে হেয় করে। তাই এসব চিন্তা ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন অনেক রাত হয়েছে। আর দাদুর হয়ে আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।”

অয়ন্তি উত্তেজিত হয়ে বলে, “এ মা কি বলছেন এসব আপনি? আমি দাদু কথায় কিচ্ছু মনে করি নি।”

“আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ুন তাহলে।”

অয়ন্তি ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়িয়ে শুয়ে পড়ে। জাহিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মাথাটা খুব ধরেছে একটা কফি খাওয়া দরকার। কিন্তু এত রাতে কে কফি করে দিবে? বাড়ির কাজের লোকেরা হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই নিজেকেই করতে হবে কফি। জাহিন রুম থেকে বের হতে নিবে ওমনি অয়ন্তি শুয়া থেকে উঠে বসে বলে।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“কফি বানাতে।”

“কফি।”

কথাটা বিড়বিড় করে বলে অয়ন্তি বিছানা থেকে নেমে বলে, “আমি করে আনছি আপনি বসুন।”

“না না আমি করে নিতে‌ পারব।”

“আপনি বসুন আমি করে‌ আনছি।”

জাহিন মনে মনে ভাবল কাজের লোক‌ জেগে নেই তো কি হয়েছে বউ তো জেগে আছে আজ না হয় নতুন বউয়ের হাতে কফি খাওয়া যাক। জাহিন মুদৃ হেসে বলে, “ঠিক আছে আপনি করে নিয়ে আসুন তবে চিনি এক চামচ দিবেন এর বেশি নয়।”

“আচ্ছা।”

অয়ন্তি কফি বানাতে কিচেনে চলে যায়। জাহিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দেড়টা বেজে গেছে। জাহিন ল্যাপটপ ব্যাগ থেকে বের করের সোফায় গিয়ে বসে। অয়ন্তি দশ মিনিট পর জাহিনের জন্য এক মগ কফি করে নিয়ে ফিরল।

“এই যে নিন।”

জাহিন অয়ন্তির কাছ থেকে কফির মগটা নিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”

অয়ন্তি দাঁড়িয়ে রইল গেল না জাহিনের সম্মুখ থেকে। জাহিন অয়ন্তির দিকে ফিরে বলল, “কি?”

অয়ন্তি ঢোক গিলে বলল, “খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে?”

জাহিন কিছু না বলে গরম কফির মগে চুমুক দেয়। অয়ন্তির আগ্রহের সহিত জাহিনের মুখপানে তাকিয়ে রইল। জাহিন মাথা নাড়িয়ে বলল, “ভালো হয়েছে।”

অয়ন্তি প্রত্যুত্তরে মিষ্টি একটা হাসি দিল। জাহিন পুনরায় বলল, “শুয়ে পড়ুন এবার। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।”

অয়ন্তি চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ে। জাহিনও কফিটা শেষ করে শুয়ে পড়ে। ঘুমানো প্রয়োজন এবার সারা দিনের ধকলে শরীরটা এবার বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

_______

ভোরের আলো ফুটেছে ভুবন জুড়ে। চারিদিকে সূর্যের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সকালের সিগ্ধ বাতাসে জানালায় ঝুলে থাকা সাদা পর্দাগুলা‌ দোল খাচ্ছে নিজের আপন মনে। জাহিনের ঘুম ছুটে গেল নিজের পায়ে কারোর পায়ের ধাক্কা লাগাতে। ভ্রু কুঁচকে আধখোলা চোখে তাকাল। তাকাতেই ঝাপসা চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ঘুমন্ত নারীর চেহারা। জাহিন আবারো চোখ বন্ধ করে নিয়ে সম্পূর্ণ চোখ খুলে তাকাল।‌ অয়ন্তি ঘুমিয়ে আছে এক হাত থুতনির নিচে রেখে। চুল খোলা থাকার কারণে চুলগুলা এলোমেলো‌ ভাবে বালিশে ছড়িয়ে আছে। ঘুমন্ত অয়ন্তির ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ জাহিনের কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। জাহিন মুচকি হেসে বাম হাতটা নিজের মাথার নিচে রেখে অয়ন্তির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।‌ অয়ন্তির গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে জাহিনের বক্ষস্থলে। জাহিন আস্তে করে ডান হাতটা এগিয়ে নিয়ে অয়ন্তির কপোলে পড়ে থাকা চুলগুলা‌ আলতো হাতে সরিয়ে দেয়। কিন্তু হাতটা নিজের কাছে না ফিরিয়ে এনে অয়ন্তির কপোলের উপরে আস্তে করে রাখল।‌ নাম না জানা এক অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে জাহিনের মনে। হৃদস্পন্দনের গতি ভারি হচ্ছে। তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটি তার স্ত্রী তার অর্ধাঙ্গিনী। যে কোনো দিন কল্পনাও করে নি সেটা ঘটে গেল তার জীবনের সাথে। জাহিন আনমনেই নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা অয়ন্তির গালে স্লাইড করল। জাহিনের স্পর্শ পেয়ে ঘুমের মাঝেই অয়ন্তি‌ ভ্রু কুঁচকে নেয়। জাহিন তা দেখে দ্রুত অয়ন্তির গাল থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। এদিকে‌ অয়ন্তির ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখে‌ মেলে‌ জাহিনের দিকে তাকায়। জাহিনও কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকায়। জাহিনের চোখে চোখ পড়াতে অয়ন্তি‌ হকচকিয়ে উঠে চোখ সরিয়ে নেয়। জাহিন গলা খাকারি দিয়ে উঠে বসে। অয়ন্তিও শুয়া থেকে উঠে গায়ে থাকা শাড়িটা পরিপাটি করে নেয়। এর মাঝে জাহিনের ফোন বেজে উঠে। জাহিন ফোন নিয়ে দেখে শারাফ কল করেছে। জাহিন ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলে বেলকনিতে চলে যায়।

অয়ন্তি দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সাড়ে আটটা বেজে গেছে আর সে এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঝটপট ফ্রেশ হয় হয়ে নিচে চলে যায়। কিন্তু নিচে নামতেই সোফায় বসা রোকেয়া বানু ঝাঁঝালো গলায় বলেন।

“এই তো নতুন বউ চলে এসেছে। তা নতুন বউ ঘুম ভাঙলো‌ আপনার। এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে তো সংসার এক্কেবারে রসাতলে‌ চলে যাবে। আমাদের বেলায় বাপু এত বেলা করে‌ ঘুমুতে পারতাম না।”

শাশুরি মায়ের এমন কথা শুনে জোহরা বেগম স্বামীর পাতে পরোটা আর তরকারি দিয়ে এসে বলেন, “মা আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। সবে তো সংসার জীবনে পা রাখল। অয়ন্তি মা জাহিন উঠেছে ঘুম থেকে।”

অয়ন্তি নিচু গলায় বলে, “জি মা উঠেছেন।”

“আচ্ছা তুমি এখানে আসো।”

ওমনি রোকেয়া বানু বলেন, “আরে দাঁড়াও। নাত বউ আমার জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আসো তো। বলতে পারো এটা তোমার পরীক্ষা। দেখি কেমন চা বানাও তুমি?”

অয়ন্তি চুপচাপ কিচেনে চলে যায় দাদি শাশুরির জন্য চা বানাতে। চা অয়ন্তি ভালোই বানায়। কিন্তু এখন ভয় হচ্ছে না জানি আবার দাদু কি বলে উঠেন? এমন সময় জাহিন নিচে নামে শার্টের হাত গুটাতে গুটাতে। নাতিকে দেখে রোকেয়া বানু আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলেন।

“এই তো আমার মানিক চলে‌ এসেছে। কেমন আছো দাদু ভাই?”

জাহিন হাসিমুখে দাদুর পাশে গিয়ে বসে বলে, “ভাল আছি দাদু। আপনি ভাল আছেন?”

“খুব ভাল আছি। তোমাদের দেখে আরো ভাল হয়ে গেলাম।”

“দাদাভাই কই?”

“দাদাভাই ঘরে শুয়ে আছেন।”

“খাওয়া দাওয়া করেছেন?”

“হ্যাঁ করেছি। এবার নাত বউয়ের হাতে চা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। তা আমার আরেক মানিক কোথায় সে কি এখনও ঘুমাচ্ছে?”

এমন সময় নুহাশ সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে বলে, “না দাদু এই তো চলে এসেছি আমি।”

নুহাশ গিয়ে দাদুর অন্য পাশে বসে। এই দুই নাতি হচ্ছে ওনার চোখের মনি। অন্য তিন নাতিকে ভালোবাসেন কিন্তু এই দুজনকে একটু বেশিই ভালোবাসেন। রিহানের জন্য অনেক বার হায় হুতাশ করেছেন কিন্তু কি আর করার চাইলেই তো‌ আর রিহানকে আনা যাবে না। জোহরা বেগম দুই ছেলেকে ডাক দিয়ে খেতে বলেন।

অয়ন্তিও একটু পর চা নিয়ে আসে। রুনা আক্তার একটু সাহায্য করেছে অয়ন্তিকে। অয়ন্তি কাঁপা কাঁপা হাতে দাদুকে চা দিয়ে চলে যেতে নিবে ওমনি রোকেয়া বানু কড়া গলায় বলেন, “দাঁড়াও যাচ্ছো কোথায়?”

দাদুর এমন কড়া গলায় কথা বলতে শুনে জাহিন খাওয়া থামিয়ে দেয়। জাহিনের সাথে অন্যরা চুপ হয়ে যায় আবার কিছু বলবে নাকি মেয়েটাকে? অয়ন্তি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চা যদি পছন্দ না হয় তাহলে কি হবে এবার? রোকেয়া বানু চায়ে‌র কাপে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন।

“বাহ নাত বউ তো চা খুব ভাল বানায়। আজ থেকে আমার চা বানিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা কিন্তু তোমাকে দিলাম। কি পারবে তো দায়িত্ব পালন করতে?”

অয়ন্তি হাফ ছেড়ে বাঁচল। বাকিরাও মনে মনে খুব খুশি হল। যাক তাহলে একটু মনে ধরেছে অয়ন্তিকে। অয়ন্তি মুচকি হেসে বলে, “জি পারব।”

কিন্তু রোকেয়া বানু আবার শক্ত গলায় বলেন, “ঠিক আছে যাও এবার।”

_______

আজমল শেখ খেতে খেতে ছেলেকে বলেন, “জাহিন তোমার একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করেছি আমি।”

জাহিন ভ্রু কুঁচকে বলে, “হঠাৎ।”

“গতকালকের এত বড় একটা ক্ষতি হয়েছে এর ক্ষতিপূরণ করতে হবে নাকি। তোমার এই রাজনীতি করা আমার পছন্দ নয় কিন্তু আমার ছেলের নামে বদনাম যাতে না হয় তার ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে নাকি।”

“কিন্তু বাবা আমি তো টাকা চাই নি শুধু শুধু….।”

আজমল শেখ জাহিনকে থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “চুপচাপ খেয়ে নিজের কাজে যাও।”

জাহিন আর একটা কথাও বলল না। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ এবার যে যার কর্মস্থলে চলে গেল। আহান আর জারা দাঁড়িয়ে আছে কাইফের জন্য। কাইফ এখনও আসে নি আর তাদের স্কুল, কলেজেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় নুহাশ বের হয়। নুহাশকে দেখাও না দেখার ভান করল জারা। নুহাশ এক পলক জারার দিকে তাকিয়ে গ্যারেজের দিকে চলে গেল। নুহাশের পেছন পেছন আহানও দৌঁড়ে গিয়ে বলে।

“নুহাশ ভাইয়া আজকে আমাদের স্কুলে একটু পৌঁছে দিবে।”

“ঠিক আছে তাহলে গাড়িতে উঠো।”

“না না গাড়িতে নয় তোমার বাইকের করে।”

“বাইকে করে না না একদম না।”

“প্লিজ নুহাশ ভাইয়া এই আবদারটা রাখো আমার।”

এমন সময় কাইফ তাড়াহুড়ো পায়ে আসে। কাইফকে‌ দেখে জারা চিৎকার করে বলে, “এই‌ আহান চল কাইফ ভাই চলে এসেছে।”

আহানও চিৎকার করে বলে, “না আমি আজকে বাইকে করে যাব।”

“আহান বেশি ভাব না ধরে জলদি চল।”

“না আমি আজকে বাইকে যাব।”

এমন সময় জাহিন আসে আর জারাকে বলে, “কি হয়েছে?”

জারা কিছু বলার আগেই আহান দৌঁড়ে এসে জাহিনকে বলে, “ভাইয়া‌ আজকে স্কুলে বাইকে করে যাই আমরা।”

“বাইকে।”

“হুমম প্লিজ প্লিজ শুধু আজকের দিনটা।”

“আচ্ছা ঠিক আছে বাইকে করেই যাও আজকে।”

আহান খুশি হয়ে বলে, “ইয়াহু আজকে আমি হাওয়া খেতে খেতে যাব।”

আহানের কথা শুনে জাহিন মুচকি হাসে। কিন্তু জারা রেগে বলে, “তুই বাইকে যা আমি গাড়িতে গেলাম।”

আহান বোনের হাত ধরে বলে, “প্লিজ আপু এমন করো না চলো না নুহাশ ভাইয়া খুব ভাল বাইক চালায়।”

“সে যতই ভাল বাইক চালাক আমি যাব না।”

জাহিন গম্ভীর গলায় বোনকে বলে, “রাস্তা তো একটাই আজকে না হয় বাইকেই গেলি তাতে ক্ষতি কি?”

জারা নাক ফুলিয়ে মনে মনে বলে, “অনেক ক্ষতি।”

জাহিন নুহাশের কাছ থেকে নিজের গাড়ির চাবি নিয়ে বলে, “আমি চলে যাচ্ছি তুই তোর বাইকে করে ওদের পৌঁছে দিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসিস।”

“আচ্ছা ভাই।”

জাহিন চলে যায়। নুহাশ কাজের লোককে দিয়ে বাইকের চাবি আনিয়ে নেয়। আহান নাচতে নাচতে বাইকের সামনে বসে। কিন্তু বাধ সাধলো জারা। গাল ফুলিয়ে দু হাত বুকের উপরে বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। নুহাশ কোমল গলায় বলে।

“আহান যখন এত করে বলছে তাহলে চলো।”

জারা নাক ফুলিয়ে নুহাশের পেছনে গিয়ে বসে কিন্তু মাঝখানে অনেকটা দূরত্ব রেখে। নুহাশের কাঁধে পর্যন্ত হাত রাখে নি জারা। নুহাশ বাইকের লুকিং গ্লাসে জারার প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে বলে।

“আমাকে ধরো বসো না হলে পড়ে যাবে।”

জারা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “এত চিন্তা করতে হবে না আমাকে নিয়ে। তাড়াতাড়ি বাইক স্টার্ট দাও দেরি হচ্ছে আমার।”

কিন্তু বিড়বিড় করে বলে, “আমাকে নিয়ে চিন্তা করলে এভাবে আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিতে না। আর এখন আসছো‌ দরদ‌ দেখাতে।”

নুহাশ স্পষ্ট শুনতে পেল জারার কথাটা কিন্তু কিছু বলল না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বাইক স্টার্ট দিল। কিন্তু জারা একটি বারের জন্যও নুহাশের কাঁধ ধরল না। নুহাশের বড্ড ইগোতে লাগল এতে কিন্তু এর শোধ ও তুলবে। জারার কলেজের আগে আহানের স্কুল পড়ে। নুহাশ আহানকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রাওয়ানা দেয় জারার কলেজের উদ্দেশ্যে মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা। এই পনেরো মিনিটের মাঝেই যা করার করতে হবে নুহাশকে। নুহাশ মনে মনে পণ করে যদি জারাকে তার কাঁধ না ধরিয়েছে তাহলে তার নাম নুহাশ রহমান নয়। নুহাশ হঠাৎ করে বাইকের গতি বাড়িয়ে ফেলে। কিন্তু তাতেও জারা নুহাশের কাঁধ ধরল। এবার নুহাশ ফুল স্পিডে বাইক ছাড়ল। তাতে জারা ভয় পেয়ে দু হাত দিয়ে নুহাশের দু কাঁধ আঁকড়ে ধরে বলে।

“আরে এত জোরে চালাচ্ছো কেন? পাগল হয়ে গেলে নাকি? আস্তে চালাও এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো। ইচ্ছে করে এটা করছো তুমি তাই না। এর ফল কিন্তু ভাল হবে না বলে দিলাম।”

পনেরো মিনিটের রাস্তা নুহাশ পাঁচ মিনিটে পাড় করল। যদিও শেষের দিকে বাইকের স্পিড একটু কমিয়ে ছিল। জারা কলেজের সামনে আসতেই বাইক থেকে নেমে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে রেগে বলে।

“কাজটা একদম ঠিক করলে না কিন্তু তুমি।”

নুহাশ ভাবলেশহীন হয়ে বলে, “তোমার ক্লাসের দেরি হচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি ভেতরে যাও। আর তোমার দেরি হচ্ছে দেখেই আমি এতটা জোরে চালিয়েছি।”

কথাটা বলেই নুহাশ চলে যায়। জারা কথা বলার কোনো সুযোগেই পেলো না। জারার কটমট চোখে নুহাশের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। এর প্রতিশোধ ও না নিয়েছে তাহলে ওর নাম শেখ জারা নয়।

#চলবে_______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here