#মায়াবিনী_(২)
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_৫২
___________________
আকাশে মেঘেদের আনাগোনা সময়ের তালে তালে যেনো বেড়েই চলেছে। কালো ভীষণ কালো করেছে আকাশ। চারপাশে ভীষণ ভাবে নিস্তব্ধতা, থাকবে নাই বা কেন গভীর রজনী যে। এই সময় তো সবাই ই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। জানালার পাশ ঘেঁষে সেই কালো আকাশের দিকে ই এক মনে তাকিয়ে আছে আরুহী।
আজ যে সেই কালো আকাশের মতোই তার মন টাও বড্ড ভার। শরীর টাও যুতসই না। হুটহাট মাথা চক্কর দিয়ে উঠে, মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে মাথা টায় আঘাত দিয়ে দু ভাগ করে ফেললে বোধ হয় আরাম পাওয়া যাবে। বিধাতার কাছে শুধু মাত্র আজকের রাত টাই ভিক্ষা চাচ্ছে সে মনে মনে। যেনো আজ সফল ভাবে নিজের কার্য সাধন করতে পারে, কাজ শেষ হলে নিজের যা হয় হবে তবুও কেউ তো আর বলতে আসবে না আরুহী চৌধুরী তার দায়িত্বে হেলা ফেলা করে! আরুহী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আকাশ থেকে নজর সরিয়ে বিছানায় ফেলল। ইসসস কি সুন্দর বাচ্চাদের মতো ডান হাত মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে আরুশ। আরুহী সুলতান কে একটা মেসেক দিয়ে সরে দাড়ালো জানালা থেকে। আরুহী ধীর পায়ে আরুশের দিকে এগুলো। আরুশের মাথার কাছে বসে এক ধ্যানে আরুশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
“আমার হৃদয় হৃৎপিণ্ডের চাইতেও অনেক গভীরে, রক্ত আর শিরা উপশিরারও অনেক গহীনে যে অস্পৃশ্য অবিনশ্বর রুহ আছে, সেই রুহবিন্দু থেকে তোমাকে ভালোবাসি। তোমার রুপ অবয়ব বা বয়স নয়, তোমার আত্মাটাকে ভালোবাসি।”
বলেই মুচকি হাসলো, আরুশের কপালে গাঢ় স্পর্শ দিয়ে আবারো বলল,
” ভীষণ ভালোবাসি প্রিয়, নিজের থেকে ও বেশি, আমাকে নিষ্ঠুর ভেবো না, পরিস্থিতির স্বীকার আমি, ভালোবাসি প্রিয়! ”
আরুহী উঠে দাঁড়ালো, চোখের পানি আলতো হাতে মুছে ঘড়ির দিকে তাকালো, ঘন্টার কাটা টিংটিং করে জানান দিচ্ছে ঘড়িতে সবে বারো টা বাজলো। কাবার্ড খুলে কালো রঙের পোশাক পরে তৈরি হলো আরুহী। দুটো রিভলবার আর দুটো নাইফ কোমড়ে গুজে এক পলক আরুশের দিকে তাকিয়ে দেখলো আরুশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আরুহী হাসলো, ভাগ্যিস ঘুমের ঔষধ টা পানির সাথে মিশিয়ে খাইয়েছিলে নয়তো এখন নিশ্চয়ই এতো শব্দে উঠে বসে থাকতো।
আরুহী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরুশের কপালে আরেকটা চুমু দিয়ে নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাড়ালো। মিনিট দুয়েক পরেই দরজার বাইরে পা চলার খসখসে শব্দ পেতেই আরুহী ঠোট এলিয়ে হাসলো। তার সেকেন্ড পাঁচেক পরেই আরুহী বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আরুহী রুম থেকে বের হতেই বাহির হতে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেলো আরুহী বুঝতে পারলো মিরাজ চলে গেছো। আরুহী দ্রুত নেমে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো সেই গাড়ি টির পিছনে পিছনে।
মিরাজের গাড়ি ছুটে চলছে অবিরাম। ধীরে ধীরে গাড়ি টি শহুরে রাস্তা ছেড়ে গ্রাম্য রাস্তা ধরলো। মিনিট বিশেক পর ই মিরাজের গাড়ি টা এসে দাড়ালো একটা দোতলা বাংলোর সামনে।
আরুহী ভ্রু কুচকালো, এই দিকে যে এতো বড়ো বাংলো আছে কই আরুহী তো কখনো দেখে নি। তার অবশ্য কারণ ও আছে, এদিকে বহু বছর আসা হয় না তার।
মিরাজ বাংলো টায় ঢুকে পড়লো তার পিছনে ই আরুহী । তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে এখন এই মূহুর্তে ভেতরে ঢুকা সঠিক হবে না। আরুহী চুপচাপ অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে। বাংলোটার মধ্যে কিছু কিছু কামরায় বাতি দেখা যাচ্ছে আর কিছু বন্ধ।
হুট করেই বাংলোর সকল বাতি বন্ধ হয়ে গেলো। মেসেজের টুংটাং আওয়াজে সৎবিত ফিরলো আরুহীর। পকেটে হাত গুঁজে মোবাইল টা বের করলো, সাইলেন্ট করতে একটু ও খেয়াল ছিলো না ভাগ্যিস এখনো ভেতরে ঢুকে নাই। মোবাইল স্ক্রিলে মিরাজ ভাই নামটা দেখে আতকে উঠলো আরুহী, এই মূহুর্তে আরুহী মিরাজের নামটা আশা করে নি। দ্রুত মেসেজ অপশনে গিয়ে দেখলো,
” বনু যেখানে আছিস ওখান থেকে পশ্চিম দিকে চলে যা, একটা বড় বট গাছ আছে ওখান টাই সেফ থাকবি, আর গুনে গুনে ঠিক পনেরো মিনিট পর বাংলো তে প্রবেশ করবি, মিটিং টা পনেরো মিনিট পর শুরু হবে, আর একা একা বাহাদুরি করতে আসবি না কিন্তু, ওয়ারনিং করলাম তোকে আরু ”
আরুহী স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তার ঠিক পশ্চিমে তাকালো, সেখানে সত্যি সত্যি ই একটা পুরাতন বট গাছের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আরুহী সেদিকেই এগুলো। কিন্তু একটা খটকা থেকে ই গেলো। মিরাজ ভাই জানলো কি করে আরুহী এখানে আছে!
আরুহী বট গাছের গা ঘেঁষে বসে পড়লো, পুনরায় সকল বাতি আবারো জ্বলে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনে সময় টা দেখে নিলো একবার সাড়ে বারোটা বেজে মিনিটের কাটা টা আরেকটু সামনে এগিয়েছে। আরুহী মোবাইল টা সাইলেন্ট করে, সুলতান কে আরেকটা মেসেজ দিয়ে মোবাইল টা পুনরায় পকেটে পুরে নিলো।
কাটায় কাটায় ঠিক পনেরো মিনিট পর আরুহী উঠে দাঁড়ালো। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে পিছনে দিকটা ঘুরে দেখলো, ছাদে উঠার একটা পাইপ ছাড়া আর কিছু ই সুবিধা করতে পারলো সে। হাতের মোটা মোটা গ্লাভস খুলে পাইপ বেয়ে উপরে উঠা শুরু করলো, কিন্তু উঠে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো আফসোস ছাদের দরজা টা লাগানো। আরুহী সামনের দিকে গেলো, সদর দরজায় পাহারাদার দেখে খানিকটা সতর্কতার সাথে ছাদ থেকে ঠিক দোতলার বেলকনিতে নামলো, এসবে সে বেশ পটু, এর চেয়ে কত ভয়ংকর দালান টপকেছে! হাতের ধুলো গুলো আবারো ঝাড়লো। সতর্ক দৃষ্টিতে এক পলক বেলকনিটা দেখে নিলো, সাইড ঘেঁষে বেলকনির সাথে লাগাওয়া জানালা দিয়ে রুমের ভেতরে উকি দিলো, একটা বডিগার্ড ছাড়া কিছুই নজরে এলো না, আরুহী সুলতান কে মেসেজ টাইপ করে সেন্ড করতেই দু সেকেন্ডের মাথায় সকল বিদ্যুত চলে গেলো। আরুহী বাঁকা হেসে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো, পকেটে থাকা ক্লোরোফোম এর বোতল থেকে রুমালে কিছুটা নিয়ে পিছনে থেকে গিয়ে বডিগার্ড এর নাকে চেপে ধরতেই গার্ড তৎক্ষনাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলো। আরুহী মুচকি হেসে বডিগার্ড কে অতিক্রম করলো, বেচারা কাল সকালের আগে উঠবে না।
আরুহী সামনে এগুতেই একটা ঘর থেকে গোঙানির আওয়াজ শুনতেই চমকে উঠলো। দরজা ঠেলতে ই আওয়াজ প্রখর হলো, হুট করেই সকল বাতি চলে আসতেই আরুহী সামনে তাকিয়ে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো তার।
সামনে তাকিয়ে দেখে মিরাজ কে চেয়ারের সাথে মোটা লোহার দড়ি দিয়ে তালা বদ্ধ করে রেখেছে। মুখ বাধা কাপড় দিয়ে। আরুহীকে দেখা মাত্র ই মিরাজ মাথা দিয়ে বারবার মানা করছে সামনে এগুতে, তবুও আরুহী দু পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু তো একটা ঘাপলা আছেই নয়তো মিরাজ মানা করছে কেন, কিছু খচখচানি আওয়াজ টা মন দিয়ে শুনলো বাঁকা হেসে সামনে এগুতেই শরীর টা হালকা কাত করতেই আরুহীর পাশ ঘেঁষে গুলিটা জানলার কাঁচের গায়ে গিয়ে আঘাত করলো।
আরুহী সেকেন্ডের মাথায় পিছনে না ঘুরেই বুলেট ছুড়লো পাল্টা। আর সেই বুলেট গিয়ে লাগলো আক্রমণ কারীর ঠিক ডান বাহুতে। আরুহী বাঁকা হেসে পিছনে ঘুরে তাকালো,
” এতো কাঁচা খেল কেও খেলে নাকি! খেলার আগে জানতে হয় না খেলোয়াড় কে? কিছু তো জেনে আসবে! ”
আফসোসের স্বরে কথা টা বলেই পুনরায় এগুলো মিরাজের দিকে। মিরাজ আবারো মাথা নাড়িয়ে আসতে মানা করছে। আরুহী থামলো, রিভলবার চালিয়ে তালা তে শ্যুট করতেই স্ব শব্দে তালা ভেঙে গেলো। মুক্ত হলো মিরাজের হাতের বাধন। মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিয়ে বলল,
” সামনে আগাস না আরু, বোম আছে ”
আরুহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আক্রমন কারী চলে গেছে কিন্তু কোথায় গেলো বুঝতে পারছে না।
সামনে কি বিপদ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?
_________________
আরুশ গভীর ঘুমের মাঝে ই পাশে হাত ফেলতেই জায়গাটা খালি মনে হলো, পিটপিট করে চোখ খুলে পাশে তাকাতেই আরুহীকে পেলো না সে। ঘুমের জন্য চোখ খুলে রাখাও দায়। ডোজ টা কাজ করেছে ঠিক কিন্তু তাকে তেমন একটা কাবু করতে পারে নি। এতো পরিমান আর এতো পাওয়ার ফুল ঘুমের ঔষধ সে খেয়েছে এখন আর ওসবে এখন তেমন কিছু ই হয় না।
আরুশ উঠে বসলো, হাত দিয়ে চোখ দুটো কচলে আশেপাশে তাকিয়ে আরুহীকে খুজলো, ওয়াসরুমের লাইট বন্ধ মানে সেখানেও নেই। গেলো কোথায়? মন টাও কেমন কু ডাকছে, বিপদ হয় নি তো!
আরুশ বিছানা ছেড়ে নামতেই লাইট জালালো, টি টেবিলের উপর চোখ পড়লো তার। ওখানে কিছু রাখা দেখতেই এগিয়ে গেলো সেদিকে।
একটা রিপোর্ট আর তার উপর একটা সাদা কাগজে কিছু লিখা। আরুশ ভ্র কুঁচকে সেটি হাতে তুলে নিলো, সাদা রঙের কাগজ টা তুলে ভাজ খুলতেই স্পষ্ট হলো আরুহীর হাতের লেখা,
” তোমার সাথে হয়তো আমার পথচলা এতোটুকুই! বিধাতা মাঝে মাঝে বড্ড পাষাণ হয়ে পরে জানো তো! এই যে দেখো না, আমার এতোদিনের এতো শখের, এতো যত্নে গড়ে তোলা ভালোবাসার কাছ থেকে আমাকেই কেড়ে নিতে চাচ্ছে। এটা কি ঠিক বলো? আমার কি কষ্ট হয় না? এই যে দেখো না আমার বুকের বা পাশ টা কেমন অসহ্যকর ব্যথা হচ্ছে! কেমন যেনো দম বন্ধ লাগছে! বড্ড অসহায় লাগছে আজ নিজেকে। আমার তো স্বপ্ন ছিল অনেক। প্রতিদিন তোমার বুকে মাথা রেখে দিনের সুচনা করবো। তোমার কোলে মাথা রেখে রুপকথার গল্প শোনাবো। আমি বলব তুমি শুনবে! উহুম তোমাকে বলতে হবে না, আমিই বলব। কই সেই স্বপ্ন তো স্বপ্ন ই রয়ে গেলো। তোমার সাথে আমার অনেক টা পথ চলা বাকি ছিলো আরুশ ভাই কিন্তু নিষ্ঠুর বিধাতা তা আর হতে দিলো কই!
তবুও কোন আফসোস নেই জানো তো! না আছে কোন অভিযোগ! আমি হয়তো তোমার জন্য কল্যানকর ছিলাম না তাই হয়তো বিধাতা আমাকেই সরিয়ে ফেলল। তুমি কিন্তু একদম মন খারাপ করবে না! আমি তো সবসময় তোমার পাশে থাকবো। তুমি প্রতিদিন সময় করে একটু বারান্দায় এসো! আমি ওই আকাশ থেকে তোমায় এক পলক দেখবো। চোখের তৃষ্ণা মিটাবো! তোমাকে শুধু এই জন্মে কেন শত জন্মেও মন প্রান দিয়ে ভালোবাসলেও আমার মনপুত হবে না। তবুও ভালেবাসবো তোমায়, ভালেবাসতাম তোমায়, ভালোবাসি তোমায়!
আমায় মিথ্যা বাদী ভেবো না আরুশ ভাই! তুমি রিপোর্ট দেখতে চেয়েছিলে আমি তা দেইনি, আমি চাই নি তুমি রিপোর্ট টা আমার সামনে দেখো তাই আজ যাওয়ার আগে তোমাকে দিয়ে গেলাম, জানি না আজ স্পট থেকে বেঁচে ফিরতে পারবো কি না, বেঁচে ফিরলেও যে আমার বাচার চান্স নেই। তাই তোমার থেকে শেষ বিদায় টা নিয়ে গেলাম,
ভালো থেকো ভালোবাসা!
তোমার একমাত্র বউ
আরুহী চৌধুরী ”
আরুশ কাঁপা কাঁপা হাতে রিপোর্ট টা বের করলো,
আরুশের হাত কাঁপছে। মাথা টা কেমন ভার ভার লাগছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, বুকের বা পাশ টা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে আজ। এতো বড়ো সত্যি আরুহী লুকালো! তার আরুহী এতো দিন এতো কষ্ট সহ্য করেছে ভাবতেই কেমন দম বন্ধ লাগছে তার।
কি হবে তবে আরুহীর? সত্যি ই কি সে নিখুঁত ভালোবাসা থেকে বিদায় নেবে?
চলবে…
[ আজকের পর্বটা কেমন লাগলো জানাবেন কিন্তু, আর মাত্র কয়েকটা পরীক্ষা আছে দোয়া করবেন রসায়ন পরীক্ষার জন্য! ]