রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৩| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
657

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বিভাসিত নীলিমা পতনোন্মুখ। কৃষ্ণ মেঘের আড়ম্বর ছেয়ে আছে সর্বত্র। বাতাবরণ ক্রমশ শীতল। ঘরের ফাঁকফোকর থেকে আসা দৈবাৎ হাওয়ায় কুপির শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ ভূমি প্রদীপের শিখা হাতের আড়াল করল৷ বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস থামার নাম গন্ধও নিচ্ছে না। উপরে ঝুরঝুরে টিনের সঙ্গে বড়ো কাগজ শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিলেন মহুয়া৷ ভাগ্যিস আজ মনে করে কাগজ খানা এনেছিলেন তা নাহলে সারারাত ভেজা শীতল মেঝেতে ঘুমোতে হত মা মেয়েকে। এশারের নামায আদায়ের পর মহুয়া মেয়ের লম্বা কেশগুচ্ছে তেল লাগিয়ে বিনুনি গেঁথে দিলেন। কুপিতে খুব বেশি তেল নেই৷ ঘরেও আর কেরোসিন তেল অবশিষ্ট নেই। যা ছিল সবটা নিংড়ে কুপিতে ঢেলেছিল ভূমি। একবার কুপি নিভে গেলে আর জ্বালানো সম্ভব না৷ ভূমি তার মাকে বলল‚

“আম্মা ঘরে তো আর কেরোসিন নেই— সলতে জ্বলবে কী করে?”

“আজ আর কেরোসিন আনা যাবে না৷ মা মেয়েতে মিলে দুটো ভাত খেয়ে শুয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব আজ৷”

“আচ্ছা আম্মা আমি ভাত বাড়ছি।”

ভাতের পাতিল থেকে দুজনের জন্য ভাত বেড়ে নিয়ে এলো ভূমি। সেই সঙ্গে বিকেলে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গোশতের তরকারি একটু গরম করে নিল সে। অনেকদিন পর গরম ভাতের সঙ্গে গোশত খাবে। ভাবতে খুশি খুশি লাগতে তার৷ তরকারি গরম করার ফাঁকে একটা পেঁয়াজ আর দুটো কাঁচামরিচও নিল সে। সঙ্গে লেবু হলে মন্দ হত না। কিন্তু বাড়িতে যে লেবু নেই৷ গাছে দুটো ছিল— কে যেন চুরি করেছে।

দোদুল্যমান তপ্তকিরনে মা মেয়েতে মিলে আয়েশ করে রাতের খাবার খেল৷ মহুয়া বাসন গুলো সরিয়ে রাখলেন। মেঝেতে মাদুর‚ কাঁথা আর বালিশ বিছিয়ে ফেলেছে ভূমি। ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুত সে। কুপিতে এখনো যৎকিঞ্চিৎ পরিমাণ তেল রয়েছে। মশারী টানিয়ে ভূমি শুয়ে পড়ল। মহুয়া কুপি নিভিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন।

প্রত্যুষের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল ভূমির৷ ফজরের নামায আদায় করে মা মেয়েতে মিলে আবারও শুয়েছিল। বেলা এখন গড়াচ্ছে। পাশে তাকিয়ে দেখল তার মা এখনো ঘুমোচ্ছে। প্রত্যেকটা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় উনাকে। শুধুমাত্র ভূমিকে একটু ভালো রাখার আশায় কত পরিশ্রমই না করতে হয়! এই সমস্ত ভাবতে ভাবতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ভূমি৷ টিন আর জানালার ফাঁকফোকর থেকে আলো এসে ঘরে প্রবেশ করছে৷ মশারীর ভেতর থেকে বের হয়ে গেল ভূমি। দুয়ার খুলতেই সাঁই বেগে আলো এসে প্রবেশ করল। মুহূর্তেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেল ছোট্টো কুঠরি জুড়ে। বেরিয়ে গিয়ে মুরগী রাখার খুপরির দুয়ার খুলে‚ কয়েকটা খুদ ছিটিয়ে দিল সে। সকাল হলেই এরা খাবার খাওয়ার জন্য পাগল করে দেয়৷ সবগুলোই ভূমির খুন ন্যাওটা। বিশেষ করে বাচ্চাগুলো। মাঝে মাঝে তো কাঁধে উঠে বসে সবগুলোতে। মহুয়া এখনো ঘুমচ্ছেন। ভূমি গিয়ে তার মাকে ডাকল। মহুয়া উঠে যেতেই সে বিছানা মাদুর জায়গারটা জায়গায় গুছিয়ে রাখল। চট করে ঘর‚ বারান্দা আর উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ফেলল ভূমি৷ মহুয়া এতক্ষণে হাত মুখে ধুয়ে নিয়েছেন৷ কিছুক্ষণ পরেই উনাকে কাজে যেতে হবে৷ ভূমি বাটিতে করে কয়েকটা শুকনো মুড়ি বের করে দিল তার মাকে৷

বিশাল বড়ো মোড়ল বাড়ি। সেই জমিদার প্রথার সময়কার বাড়ি এটা৷ অনিন্দ্যনগরের সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী হচ্ছেন শাহাদাৎ মোড়ল। বর্তমান সময়ে উনিই মোড়ল বাড়ির মাথা৷ বাড়িটা কোনো রাজপ্রাসাদের থেকে কম না৷ এই বাড়িতেই একজন সাধারণ পরিচারিকার কাজ করেন মহুয়া৷ বাড়ির মানুষগুলোও অসম্ভব ভালো৷ অনেক বছর ধরে তিনি এখানে কাজ করছেন৷ বিপদে আপদে সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন শাহাদাৎ মোড়ল। একবার ভূমির প্রচণ্ড জ্বর ছিল। চিকিৎসা করানোর মতো টাকা মহুয়ার কাছে ছিল না। জ্বর ক্রমশ কাবু করছিল মেয়েটাকে। অসহায় হয়ে গ্রামের অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন মহুয়া। কিন্তু কারো কাছ থেকে সাহায্য পাননি৷ ছোটো বেলা থেকেই মেয়েটাকে সবাই অবহেলা কিছুই দেয়নি। সেখানে শাহাদাৎ মোড়ল নিজে থেকে চিকিৎসার সকল খরচ দিয়েছিলেন। মেয়েটার সেই জ্বরে টাইফয়েড হয়েছিল৷ টাইফয়েডের জন্য সমানে চুল উঠে যেত। চুল উঠে যাওয়া নিয়ে মেয়ের সে কী কান্না! ডাক্তারকে বলে তিনটা ডোজ দেওয়া হয়েছিল ভূমিকে৷ এরপর আর কখনো টাইফয়েড হয়নি ভূমির।

বিস্তীর্ণ বৈঠকখানা ঝাড়ু দিচ্ছে মহুয়া৷ সামনে বড়ো বালতিতে পানি নেওয়া৷ ঝাড়ু দেওয়া শেষ হলেই মুছে ফেলবে। কাজের মাঝেই শাহাদাৎ মোড়লের স্ত্রী নাজমা এলেন। মহুয়াকে ডেকে বললেন‚

“মহুয়া অতিথিশালা একটু ভালো করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখ। আমি নতুন চাদর বের করে দেব‚ একটু বিছিয়ে দিয়ো। আর হ্যাঁ আজ রান্নাবান্নার কাজ একটু বেশি। আজ বাড়িতে মেহমান আসছে ঢাকা থেকে৷ সেখানকার এমপি ‘সেহরিশ আরশান প্রলয়’ আর উনার ছোটো ভাই মান্যগণ্য ডাক্তার ‘তাসরিফ ইফরাদ অর্পণ’ আসছে। ওদের সঙ্গে আরশও আসছে। আরশ আর অর্পণ ঢাকায় একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। সেই থেকেই ওদের বন্ধুত্ব।”

একটু থামলেন নাজমা। এবার মহুয়া জিজ্ঞেস করল‚

“কী কী কাজ করতে হবে আমাকে বলে দিন ভাবি‚ আমি রান্না করে রাখব!”

“তোমার ভাইজান আর মন্টুকে দিয়ে অনেক বাজার করিয়েছেন৷ অবশ্য সব কে’টেই আনা হয়েছে৷ তোমার একটা কাজ অন্তত কমেছে। আচ্ছা শোন! দেশি মুরগী ঝাল ঝাল করে রান্না করবে। বড়ো রুই মাছ ভাজা‚ গোরুর গোশত ভুনা‚ পোলাও আর জর্দা রাঁধবে।”

“আচ্ছা ভাবি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব কাজ খুব যত্নসহকারে করব।”

“এই জন্যই তোমার উপর আমার এত আস্থা।”

একটু থেমে নাজমা আবারও বললেন‚ “ওহ হ্যাঁ আরেকটা কথা— ভূমির জন্য আজ ভালো কিছু খাবার নিয়ে যেও। শুধু তরকারি না— পোলাও‚ জর্দা সঙ্গে করে নিয়ে যেও।”

নাজমার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল মহুয়ার। যেখানে উনার মেয়েকে প্রত্যেকটা মানুষ অবহেলা আর কটু কথা শোনায় সেখানে ইনিই একজন। যিনি ভূমির ভালো মন্দ প্রায়শই জিজ্ঞেস করেন। অশ্রুসিক্ত হলো নেত্রযুগল। মুখে হাসির রেখা প্রসারিত করে মহুয়া নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন।

খাঁ খাঁ মধ্যদুপুর। রোদের তপ্ততা প্রখর। মোড়ল বাড়িতে খাবার দাবারের এলাহি কারবার। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে রান্নাঘর ম-ম করছে। সব একা হাতে রান্না করেছেন মহুয়া। উনার রান্নার হাত ভালো। অতিথিশালা পরিপাটি করে গুছিয়ে ছিলেন সেই সকালেই। এক ফাঁকে যোহরের নামাযটা আদায় করে নিয়েছিলেন মহুয়া। শাহাদাৎ মোড়ল এখন বাড়িতেই রয়েছেন। কালো রঙা বড়ো গাড়িটা এসে থেমেছে মোড়ল বাড়ির সামনে৷ গাড়ি থেকে প্রথমে নামল আরশ৷ শাহাদাৎ মোড়লের বড়ো ছেলে৷ এরপর নামল অর্পণ। সবার শেষে নামল প্রলয়৷ আরশের সঙ্গে এগিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। প্রলয় আর অর্পণ একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল‚

“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন আঙ্কেল আন্টি?”

শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমা একসঙ্গেই বললেন‚

“আমরা ভালো আছি। তোমরা কেমন আছ? আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”

“কোনো অসুবিধে হয়নি আমাদের৷”

শাহাদাৎ মোড়ল বললেন‚ “আরশ বাবা— প্রলয় আর অর্পণকে ওদের ঘরে নিয়ে যাও। ওরা ফ্রেশ হয়ে নিক। অনেকটা পথ তো জার্নি করে এসেছে৷ একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পর টেবিলে খাবার দেওয়া হবে।”

“আচ্ছা বাবা।”

মিন্টু ওদের ব্যাগ সঙ্গে করে নিয়ে গেল দোতলার তিন নাম্বার ঘরে। আরশ বলল‚

“চলুন ভাইয়া— আয় অর্পণ।”

ওরা চলে গেল৷ টেবিলে খাবার গুলো গুছিয়ে রাখছে মহুয়া। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ওরা খেতে আসবে৷ নাজমা নিজেই বলেছেন খাবার গুলো নিয়ে আসতে। মিনিট বিশেক পর অর্পণ আর প্রলয়কে নিয়ে বৈঠকখানায় এসে দাঁড়াল আরশ৷

“এসো বাবা। খাবার খেয়ে নাও৷ দুপুর তো অনেক হলো। তোমাদেরও নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছে!”

সবাই চেয়ার টেনে বসল। শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমাও খেতে বসলেন। মহুয়া একে একে সবাইকে খাবার বেড়ে দিলেন৷ সবাই নিজেদের মতো খেয়ে যাচ্ছে৷ খাওয়ার মাঝেই আরশ জিজ্ঞেস করল‚

“ইরা কোথায় মা?”

“তোর নানু বাড়িতে গিয়েছিল৷ যখনই শুনেছে তুই আসছিস ওমনি ছুট লাগিয়েছে৷ এই এলো বোলে।”

খাওয়ার এক পর্যায়ে অর্পণ বলল‚ “আন্টি খাবার গুলো খুব টেস্ট।”

নাজমা কিছু বলার আগেই আরশ বলল‚ “মহুয়া আন্টি খুবই ভালো রান্না করেন৷”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here