#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। মোর্শেদ শিকদার আর মেহরাব শিকদার নিজেদের ঘরে চলে গিয়েছেন৷ সময় গড়াচ্ছে৷ উনাদেরও কাজে বের হতে হবে। এদিকে অর্পণের খাওয়া শেষ। সে প্রলয়কে বলল‚
“ভাই আমাকে হসপিটাল যেতে হবে।”
মুখে খাবার নিয়েই প্রলয় বলল‚ “জানি। অল দ্য বেস্ট। এ নতুন কিছু না৷ ডাক্তার হয়েছিস হসপিটালে তো জয়েন করতেই হবে।“
থতমত খেয়ে গেল অর্পণ। শব্দ করে হেসে উঠল পূর্ণতা পুষ্পিতা। একপলক সবার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল ভূমি। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্পণের অস্বস্তি হতে পারে বলে মনে হলো তার৷ পুষ্পিতা বলল‚
“ছোটো ভাইয়া তুমি তো বড়ো ভাইয়ার কাছ থেকে পাত্তাই পেলে না।”
আর একদণ্ড বসল না অর্পণ। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে নিজের ঘরে চলে গেল৷ হসপিটালে যেতে হবে তাকে৷ আজই হসপিটালে তার প্রথম দিন। কাল রাতেই মেহরাব শিকদার বলে দিয়েছিলেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আগেই দেওয়া হয়েছিল। মেহরাব শিকদারও সেই একই হসপিটালে কর্মরত। খুব কম সময়েই তিনি সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন এই হসপিটাল থেকে৷
খাবার পর্ব চুকিয়ে প্রলয় বলল‚ “পূর্ণ পুষ্প!”
পূর্ণতা পুষ্পিতা একই সঙ্গে বলে উঠল‚ “জি বড়ো ভাইয়া?”
“খাওয়া শেষ হলে তোদের ভাবিমণিকে ঘরে নিয়ে আসবি।”
এবারও দুজনে একসঙ্গে সায় জানাল। প্রলয় ঘরে যাওয়ার পূর্বে তার মায়ের দিকে একবার তাকাল৷ টেবিলের উপর থেকে এঁটো প্লেট গুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। প্রলয়কে যখনই দেখলেন তখনই মুখ ফিরিয়ে নিলেন মাধুরী। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল প্রলয়৷ আবারও ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ পার্টি অফিসের দিকে বের হতে হবে৷ পরশুদিন একটা কলেজে সমাবেশের আয়োজন করা হবে। সেটা নিয়েই মূলত একটা মিটিং রয়েছে।
মেদহীন দীর্ঘ দেহাবয়ব। গায়ে শুভ্র শার্ট জড়ানো। হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রাখা। হেয়ার ব্রাশ দিয়ে চুল স্যাট করে নিল প্রলয়। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করে চশমা ঠিক করল। এরই মাঝে ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রমণী খুব ধীরেই বিছানার কাছে এলো। কী করা উচিত বুঝতে পারছে না যেন। প্রলয় নিজে থেকেই অগ্রসর হলো ভূমির সমীপে৷ হাতে শীতল স্পর্শ অনুভূত হতেই কেঁপে উঠল যেন। হাতের মুঠোয় প্রলয়ের ঘড়ি। তাকে কেন দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারল না সে! প্রলয় হাতটা বাড়িয়ে বলল‚
“ঘড়িটা পড়িয়ে দাও।”
বিনাবাক্য ব্যয়ে ঘড়িটা পড়িয়ে দিল ভূমি। তবে মনে মনে ভাবল ‘ঘড়িটা তো নিজেও পড়ে নিতে পারতেন— আমাকে দিয়েই কেন পড়ালেন?’
“আমার আসতে দেরি হবে৷ আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করতে যেও না। মা এখনো ক্ষেপে আছেন৷ দরকার হলে উনি নিজেই তোমাকে ডেকে নেবেন।”
কোমল স্বরে ভূমি বলল‚ “জি!”
পরবর্তীতে প্রলয় আর কিছুই বলল না। চার্জে বসানো ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ের ঘরে গিয়ে বিদায় নিয়ে মালঞ্চ নীড় হতে বের হলো সে। নিজের গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছে৷ বাহিরে গেলে প্রলয় কখনো ড্রাইভার নিয়ে যায় না৷ নিজে ড্রাইভ করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।
মেজাজ খিটখিটে হয়ে রয়েছে মাধুরীর। চোখ মুখে এখনো আঁধার নেমে রয়েছে। খাবার টেবিলে তখন স্বামীর কথা একটুও পছন্দ হয়নি উনার৷ কই স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন তা না করে পরের বাড়ির মেয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন। মোর্শেদ শিকদারের দিকে অফিস ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললেন‚
“খাবার টেবিলে তুমি কাজটা ঠিক করলে না।”
ব্যাগটা নিয়ে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “কোন কাজটা?”
“তুমি আমার পক্ষ না নিয়ে ওই মেয়েটার পক্ষে কথা বলেছ।”
“তুমি মা! তুমি যদি সন্তানকে ক্ষমা করে না দাও‚ সন্তানকে বুকে টেনে না নাও তাহলে কে নেবে? আমি জানি আমার রূপমাধুরী এতটাও নির্দয়া নয়৷ এখন হয়তো রাগের মাথায় অনেক কিছুই বলছ কিন্তু একটা সময় গিয়ে তুমিও সবটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে।”
“ওই মেয়েকে আমি কোনোদিনও মেনে নেব না৷”
মোর্শেদ শিকদার মুখ কিছু না বললেও নিঃশব্দে হাসলেন। স্ত্রীকে তিনি খুব ভালো করেই চেনেন৷ ভূমিকে মেনে নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। রাগ পড়ে গেলেই সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মাধুরী গিয়ে আলমারি খুললেন। লকারে তালাবদ্ধ করে রাখা একটা মাঝারি দেখতে কাঠের বাক্স বের করলেন তিনি৷ আলমারি আটকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন বাক্সখানা। বহু বছরের যত্নে রাখা অলঙ্কার গুলো বের করে রাখলেন বিছানার উপর। একজোড়া কঙ্কণ বের করে দেখতে লাগলেন। উনি ছিলেন শিকদার বাড়ির বড়ো বউ৷ বিয়ের দিনই এই কঙ্কণ জোড়া উনার শাশুড়ী পড়িয়ে দিয়েছিলেন। বংশের পরম্পরায় এই কঙ্কণ জোড়া বাড়ির বড়ো বউয়ের হাতেই শোভা পায়৷ সেক্ষেত্রে মাধুরী পর এই কঙ্কণ জোড়ার হকদার প্রলয়ের বউ অর্থাৎ ভূমি।
“হঠাৎ গহনা বের করছ কেন?”
“তোমার ছেলে যে বিয়ে করেছে— এটা কী পাড়াপড়শির জানতে বাকি আছে নাকি? তারা যদি তোমার ছেলের বউকে দেখতে আসে তখন কী এভাবেই ছেলের বউকে দেখাবে নাকি?”
এবারও নিঃশব্দে হাসলেন মোর্শেদ শিকদার। মুখ ফুটে শুধু একটা কথাই বললেন‚ “আমার ছেলে বিয়ে করে বউ এনেছে। সে বুঝি তোমার কেউ না?”
“আমার হয়েছে যত জ্বালা।”
হাতের তালুতে রাখা কঙ্কণ জোড়া বাক্সতে ভরে নিলেন মাধুরী। বিনা সময় ব্যয়ে বাক্স খানা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। নিচ তলা থেকে সোজা দ্বিতীয় তলায় চলে গেলেন। উপর তলায় ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা কামরা৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা ছোটো বেলা থেকে একসঙ্গে থেকে অভ্যস্ত। প্রলয়ের ঘরের সামনে এসে ভদ্রতার খাতিরে কড়া নাড়লেন মাধুরী। ভূমি তখন বিছানায় চুপটি করে বসে ওড়নার আঁচল হাতের আঙুলে পেঁচাচ্ছিল৷ এমন সময় বড়ো বড়ো পা ফেলে মাধুরী ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। উনাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াল ভূমি৷ তিনি এগিয়ে গেলেন বিছানার কাছে।
“বোসো দাঁড়াতে হবে না।”
মাধুরী এসে বিছানায় না বসা অবধি ভূমি দাঁড়িয়েই রইল। এভাবে গুরুজনদের সামনে বসে থাকা মানেই বেয়াদবি। আম্মা শিখিয়েছিলেন। আবারও গভীর দৃষ্টে পর্যবেক্ষণ করলেন মাধুরী। গম্ভীর স্বরে শুধালেন‚
“তা তোমার পুরো নাম কী?”
“ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”
“তোমার বাবা মায়ের নাম?”
“আমার বাবা নেই। আম্মার নাম মহুয়া। সারাটা জীবন খুব কষ্টে আমাকে মানুষ করেছেন৷”
শিথিল হলেন মাধুরী৷ কিছুটা নরম স্বরে বললেন‚ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না— বসো।”
মাধুরীর কথানুযায়ী ভূমি বসে পড়ল বিছানায়। এবার কিছুটা ব্যঙ্গোক্তি করে বললেন‚
“দুদণ্ড কথা বলছি বলে ভেব না আমি তোমাকে মেনে নিয়েছি! আমি মোটেও তোমাকে মেনে নিইনি।”
ভূমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেও কিছু বললেন না মাধুরী৷ কঙ্কণ জোড়া ভূমির হাতে পড়িয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে কানে‚ নাকে আর গলায় একটা চিকন চেইন পড়িয়ে দিলেন৷ এক অন্যরকম দীপ্তি ছড়াচ্ছে৷ এবার দেখে মনে হচ্ছে নতুন বউ৷
“এই খবর হয়তো পাড়াপড়শির জানতে আর বাকি নেই। ওরা হুমড়ি খেয়ে এলো বোলে৷ আমাদের পরিবারের একটা মানসম্মান আছে৷ যা বলবে বুঝে শুনে বলবে। এর প্রতিক্রিয়া যেন আমার ছেলের রাজনীতির ক্যারিয়ারে না পড়ে।”
ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। মাধুরী যেভাবে এসেছিলেন আবারও ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ঘরের দরজা ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গেলেন।
বিকেলে…
রান্নাঘরে তাড়াহুড়ো করে কাজ করছে সাবিনা। আজ চাপটা একটু বেশিই। তারউপর ‘বিন বুলায়ে মেহমান’ হিসেবে হাজির হয়েছে পাড়াপড়শি। হাতে হাতে সাহায্য করছেন মাধুরী৷ ফিরোজা গিয়েছেন প্রলয়ের ঘরে৷ ভালো একটা শাড়ি পরিয়ে তৈরি করে দিলেন ভূমিকে৷ এরপর নিজের সঙ্গে করে ভূমিকে নিয়ে এলেন বৈঠকখানায়। মাধুরী এসে বসলেন ছেলের বউয়ের পাশে৷ না জানি কখন কী উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে বসেন অন্যরা৷ টি-টেবিলের উপর নাস্তা মিষ্টি দেওয়া হয়েছে। একজন জিজ্ঞেস করে উঠলেন‚
“তা বউমা তোমার নাম কী? বাড়িতে কে কে আছে?”
একসঙ্গে এত এত প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে গেল ভূমি। মাধুরী আর ফিরোজাও এখানেই বসে রয়েছেন। ভূমি বলল‚
“ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি। শুধু আমার আম্মা আছেন।”
মাধুরী কথা কা’টানোর জন্য বললেন‚ “উনাদের নাস্তা গুলো এগিয়ে দাও৷”
ভূমি মিষ্টির প্লেট গুলো এগিয়ে দিল সকলের হাতে হাতে। প্রতিবেশী লিপি ভাবি বললেন‚
“ছেলের বিয়ে নিয়ে একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেললে মাধুরী। আমার মেয়ে কী এই মেয়ের থেকে কম সুন্দরী ছিল?”
আরেকজন বলল‚ “বউ তো দেখতে শুনতে ভালোই। তা ছেলের জন্য এমন পরী কোথা থেকে আনলে মাধুরী?”
“অনেক খুঁজে বের করেছি এমন হিরে৷ যেমন রূপ তার তেমনই গুন। আমার প্রলয়ের যোগ্য জীবনসঙ্গী।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানসম্মান বাঁচাতে কিছুটা মিথ্যে বলতে হলো বৈকি। ভূমি মাথা নিচু করে রইল৷ পাশের বাড়ির তনিমা ভাবি বললেন‚
“কত মেয়ের ছবি দেখালাম তোমাকে। তখন তো কাউকে পছন্দ হলো না। বেছে বেছে গ্রামেই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আনলে। আর ছেলের বিয়ের এত তাড়াহুড়োই বা কেন?”
ভূমির কাঁধে হাত রেখে মাধুরী বললেন‚ “এমন সুন্দরী মেয়ে কী আর হাতছাড়া করা যায়? তবে তোমরা চিন্তা কোরো না। আসছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি বেশ বড়ো করে রিসেপশনের আয়োজন করা হবে।”
একটু থেমে মাধুরী গলা ঝেড়ে সাবিনাকে ডাকলেন৷ পরপরই সাবিনা ট্রে-তে করে আরও নাস্তা আর কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে এলো৷ সবাইকে হাতে হাতে নাস্তা আর কোল্ড ডিংকস এগিয়ে দিল সাবিনা৷ এরপর আবারও রান্নাঘরে ছুটে গেল। মাধুরী বললেন‚
“বউমা তুমি ঘরে যাও৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা তোদের ভাবিমণিকে ঘরে নিয়ে যা৷”
মাধুরীর মুখে বউমা ডাকটা শুনে আঁখিদ্বয় অশ্রুপ্লাবিত হলো৷ মিথ্যে হলেও ডাকটা ভীষণ আদুরে আর স্নেহমাখা ছিল৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা নিয়ে যেতে এলো ভূমিকে।
চলবে?…..
–
–
রাত নয়টার আগে যদি দুইশ+ রিয়েক্ট হয় তাহলে রাতে আরেকটা পর্ব দেব ইনশাআল্লাহ। সবাই বেশ বেশি রেসপন্স করুন। আসসালামু আলাইকুম।