রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৬| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
597

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বিশাল কামরায় সবুজরঙা ঘুম বাতি জ্বলছে৷ রাতের গভীর অমা ঘুটঘুটে রূপ নিয়েছে৷ গভীর হচ্ছে যামিনী। সকলের তন্দ্রাপ্রহর নামলেও দুটো মানুষ এখনো জেগে রয়েছে৷ খাবার টেবিলের উপর থাকা এঁটো বাসন গুলো রান্নাঘরে রেখেই চলে এসেছে ভূমি। প্রলয় কিছুতেই তাকে বাসন গুলো ধুতে দিল না। যেন ঘোর অন্যায় হয়ে যাবে বাসন ধুলে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ভূমির হাত ধরে ঘরে নিয়ে এসেছে প্রলয়। বিছানার উপর ভেজা তোয়ালে পড়ে রয়েছে৷ ভূমি সেটা আলগোছে তুলে নিয়ে বারান্দায় মেলে দিয়ে এসেছে৷ এরই মাঝে ভূমির পায়ের দিকে নজর পড়ল প্রলয়ের৷ দেখা মাত্রই শুধাল‚

“পায়ের ড্রেসিং করেছিলে?”

কী বলবে ভেবে পায় না। কাল দুপুর থেকেই তো এভাবে বেন্ডেজ করা। বিয়ের পড়ানোর পরপরই যখন ভূমি জ্ঞান হারিয়েছিল তখনই মূলত আরশ বেন্ডেজ করে দিয়েছিল পায়ে। ব্যথা জায়গায় নুরিকণার আঘা’তে পুরশু রাতের ক্ষ’ত থেকে র’ক্ত বের হচ্ছিল ক্রমাগত। কাল আরশ বারবার বলে দিয়েছিল ড্রেসিং করে নিতে। এতকিছুর মাঝে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ভূমি৷ কীভাবে ড্রেসিং করতে হয় সেটাও জানা নেই। এ ঘরে কোথায় কী রাখা আছে সেটাও জানা নেই! প্রলয় যা বুঝার বুঝে নিল। ভূমিকে বলল‚

“বোসো বিছানায়৷”

প্রলয়ের কথানুযায়ী বিছানায় বসল ভূমি। একটু খানি ঝুকে বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফার্স্টএইড বক্স বের করল প্রলয়৷ বসে বসে হাই তুলছে ভূমি। ঘুম পেয়েছে ভীষণ। দুপুরে ঘুমোনোর সুযোগ পেল কোথায়? দুপুরে ঘুমোনো অভ্যেস আছে তার৷ মুখ তুলে একবার ভূমির দিকে তাকাল প্রলয়। এভাবে হাই তুলতে দেখে নিঃশব্দে হাসলও খানিকটা৷ ফার্স্টএইড বক্স বিছানার উপর রেখে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসল। কিছুটা ভড়কাল ভূমি৷ পায়ে স্পর্শ করার আগেই পিছিয়ে গেল সে৷ প্রলয় কী করতে চাইছে তা বুঝতে পারল। নিজে থেকেই বলল‚

“আপনি ব্যস্ত হবেন না৷ আমি করে নেব।”

“বাড়তি কথা শুনতে চাইছি না। পা এগিয়ে দাও।”

খুব অস্বস্তি হলো। সে বুঝতে পারল প্রলয় তার সাথে সহজ হবার চেষ্টা করছে৷ এভাবে পা তুলে দেওয়া মানে তো বেয়াদবি করা। প্রলয় তার গুরুজন। এটা তো সে কস্মিনকালেও করতে পারবে না। কেন বুঝতে পারছে না প্রলয়? সে কী এতটাই অবুঝ? ভূমি শুনল না তার কথা৷ প্রলয় নিজে থেকেই ভূমির পা নিজের হাঁটুর উপর রাখল। বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে ডান হাত দ্বারা বেন্ডেজ খুলে দিল। ক্ষ’ত শুকতে শুরু করছে। ভূমি একটি বার তাকিয়ে দেখল। এরপর সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিল। এসব কা’টাছেড়া ক্ষ’ত সে দেখতে পারে না৷ ভয় করে ভীষণ।

সকালে…

সকালের নীরব শান্ত পরিবেশে হানা নিয়েছে পাখির কিচিরমিচির কলরব। জানালা ভেদ করে সোনালি রোদ আছড়ে পড়ছে৷ দিবসপতির তপ্ততা ভীষণ। রুঠো তপ্ততায় গরম অনুভূত হচ্ছে খুব। ঘুম ভেঙেছে ভূমির। আজও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে৷ দেহে বন্ধন উপলব্ধি করতেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল ভূমি। দেখতে পেল প্রলয়ের সঙ্গে নিজের বন্ধনদশা। তার স্পষ্ট মনে আছে দুজনে দু’প্রান্তে শুয়েছিল। এখন দেখে মনে হচ্ছে ভূমি নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে প্রলয়ের বক্ষঃস্থলে৷ ঘুমের ঘোরেই উষ্ণতা খুঁজে নিয়েছে যেন৷ ভাবতেই মাথা কা’টা যাচ্ছে তার। লজ্জা তখন আকাশস্পর্শী। এ মুখ কী করে দেখাবে? সে যে নিজ থেকে এগিয়ে গিয়েছে প্রলয়ের সমীপে। লোকটা ঘুমিয়ে আছে বিধায় লজ্জার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে৷ মানে মানে কে’টে পড়ার চেষ্টা করতেই রুক্ষ হাতের স্পর্শ গভীর হলো। ক্ষিপ্রবেগে প্রলয়ের দিকে তাকাল সে৷ লোকটা জেগে গিয়েছে৷ ইস! কী লজ্জা— কী লজ্জা! চোখে চোখ রাখতে পারল না ভূমি। মাথা নিচু করে চোখ বন্দ করল৷ ঘুমন্ত ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো‚

“সারাটা জীবন আমাদের একসঙ্গেই কা’টাতে হবে তাই নিজেকে আমার সঙ্গে সহজ করার চেষ্টা কর।”

বিনিময়ে কিছু বলল না ভূমি। সহস্র অস্বস্তি নিয়ে সেভাবেই শুয়ে রইল প্রলয়ের বুকের উপর মাথা রেখে। মনে মনে ভাবল— জীবনটা কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে৷ কখনো কী ভেবেছিল‚ তার বিয়ে এভাবে হয়ে যাবে? কখনো কী ভেবেছিল‚ এরকম একটা সমৃদ্ধিশালী পরিবারের বউ হয়ে আসবে? ভাবেনি তো! তবুও জীবন কী অবলীলায় রঙ পাল্টাচ্ছে।

প্রলয়ের ঘুম ভেঙেছে সাড়ে আটটায়৷ ভূমির ঘুম তো হয়ইনি উল্টো এতটা সময় হাঁসফাঁস করছিল ছাড়া পাওয়ার জন্য। ভাগ্যিস প্রলয় উঠে পড়েছে নয়তো এতক্ষণে হয়তো অস্বস্তিতেই অক্কা পেত সে৷ এদিকে প্রলয় ওয়াশরুমে গিয়েছে সেই সুযোগে ভূমি বিছানা‚ ঘর গুছিয়ে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরের দিকে ছুটেছে। ভেবেছিল আজ আর প্রলয়ের মুখো হবে না৷ কিন্তু তা আর হবে কোথায়? খাবার খেতে গেলেও তো এমপি মশাইয়ের মুখদর্শন করতে হবে। ঘরে গেলেও তো সেখানে এমপি মশাই উপস্থিত থাকবে৷ ডান হাতের নখ খুটছে আর কী করবে সেটাই ভাবছে ভূমি। এই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির মনে হচ্ছে৷ নিজের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে৷

পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে একবার কড়া নাড়ল ভূমি। ভেতর থেকে কোনো পাল্টা জবাব এলো না৷ হয়তো ঘুমিয়ে রয়েছে৷ সেই ভেবে চলে যেতে নিলেই পূর্ণতা দরজা খুলে দিল। তার ঘুম খুবই হালকা। আওয়াজ পেয়েই উঠে পড়েছিল। পুষ্পিতা এখনো কোলবালিশ আঁকড়ে ঘুমচ্ছে। ঘুমু ঘুমু চোখে ভূমিকে দেখে পূর্ণতা শুধাল‚

“তুমি এই সকাল সকাল আমাদের ঘরে?”

“আমি কী তোমাদের কল ঘরে যেতে পারি?”

“হ্যাঁ ভাবিমণি।”

সম্মতি পেয়ে ভূমি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। হাই তুলতে তুলতে পূর্ণতা গিয়ে শুয়ে পড়ল পুষ্পিতার পাশে৷ তার ঘুম হয়নি আরও ঘুমবে। এমনিতেই কয়েকদিন ধরে দুবোন সকাল দশটার আগে ওঠে না৷ আজও তার অন্যথা হবে না নিশ্চয়ই।

রান্নাঘরে…

ফিরোজা নিজ হাতে স্যান্ডউইচ তৈরি করছেন। সকালের নাস্তাটা তিনি নিজেই তৈরি করেন। শুরু থেকেই এই কাজটা উনার দায়িত্বে রয়েছে৷ দুপুরের রান্না দুই জা মিলেই রান্না করেন। ফিরোজা সাবিনাকে বলে দিয়েছেন ডিমের অমলেট করার জন্য৷ বেলা তো অনেক হলো। ঘড়িতে এখন সকাল নয়টা। মেহরাব শিকদার সাড়ে নয়টার দিকে হসপিটালে যান৷ দশটায় মোর্শেদ শিকদার নিজের অফিসে যান৷ আজ স্কুল নেই পূর্ণতা পুষ্পিতার৷ টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে বিধায় বোর্ড পরিক্ষার আগ পর্যন্ত আর ক্লাস নেই দুজনের। আর বাকি রইল প্রলয়‚ অর্পণ। প্রলয় বের হয় সাড়ে দশটার পর। অর্পণ এতদিন ছাড়া হাত-পা ছিল। আজ থেকেই হসপিটাল অ্যাটেন্ড করবে সে৷ রান্নাঘরে আসার পূর্বে ডেকে এসেছিলেন ফিরোজা৷ বাবা ছেলে আজ একসঙ্গেই হসপিটালে যাবে।

স্বামীকে চা দিয়ে রান্না ঘরে এসেছেন মাধুরী। উনার হাতের চা না হলে চলে না মোর্শেদ শিকদারের। এটা প্রতিদিনকারই রুটিন। রান্নাঘরে কাজের তাড়াহুড়ো লেগেছে ফিরোজার৷ এক চুলোয় অমলেট তৈ হচ্ছে আরেক চুলো দুধ গরম হচ্ছে৷ স্যান্ডউইচ তৈরি করে এখনো মাল্টার জুস বানাচ্ছেন ফিরোজা৷ হসপিটাল থেকে ফেরার পথে টাটকা মাল্টা কিনে এনেছিলেন মেহরাব শিকদার। এভাবে তাড়াহুড়ো করতে দেখে মাধুরী বললেন‚

“একা হাতে আর কত কাজ করবি৷ সকালে তো অনেক চাপ করে যায় তোর উপর। তাড়াহুড়োয় নাস্তা তৈরি করতে হয়৷ ওই মেয়েকে আজই বলতে হবে‚ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে। কাজ করলে শিকদার বাড়ির বউ হবার শখ মিটে যাবে।”

“আমার কোনো সমস্যা হয় না। আমি একাই পারব ভাবি। মেয়েটা এসেছে আজ সবে দুদিন হলো। সময় হলে নিজে থেকেই সব করবে হাতে হাতে।”

“আমি তো সবই দেখছি। মনে হচ্ছে কিছুই শেখায়নি তার মা। নয়তো কাজ রেখে এভাবে বেলা অবধি ঘুমাতে পারত না৷”

“মেয়েটা সুস্থ হলেই না হয় রান্না দায়িত্ব দিয়ো ভাবি।”

“অসুস্থতা সবই বাহানা৷ দিব্যি তো ওই মেয়ে সারা বাড়ি এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

ফিরোজা কিছু বললেন না৷ কীইবা বলবেন তিনি! এই বাড়ি বউ হয়ে আসার পর কারো মুখের উপর টু শব্দটি করেননি তিনি। আজও কী তার অন্যথা হবে? কক্ষনো না!

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here