রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৮| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
609

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

প্রলয় যা বো’মা ফাটিয়েছে‚ যতবার দুজনের চোখাচোখি হচ্ছে ততবারই বুক কেঁপে উঠছে ভূমির৷ আদুরে গালের কথা শুনেই সে কুপোকাত। আরও কিছু শুনলে না জানি কী হয়! বড়ো ডাইনিং টেবিলে খাবারের বিশাল আয়োজন। আজ অর্পণের পছন্দের চিকেন রান্না হয়েছে৷ প্রলয়ের পছন্দের গলদা চিংড়ি। পূর্ণতা পুষ্পিতার পছন্দসই ইলিশ ভাপা। মেয়ে দুটো কাঁটা বেছে খেতে পারে না৷ তবুও ইলিশ মাছ তাদের ভীষণ প্রিয়৷ মোর্শেদ শিকদার নিজে মেয়েদের কাঁটা বেছে দেন৷ এত সব প্রিয়র মাঝে কেউ ভূমির প্রিয় খাবারের কথা জানতেই চাইল না৷ তারও যে পছন্দের খাবার থাকতে পারে— সেটা কারো মাথাতেই এলো না৷ ভূমি শুধু অপলক চেয়ে দেখল মেয়েদের প্রতি বাবার নিখাদ ভালোবাসা৷ আজ বাবা থাকলে হয়তো তাকেও এভাবে ভালোবেসে মাছের কাঁটা বেছে দিত? অজান্তেই মন খারাপের জেঁকে বসল। খুব একটা পাত্তা দিল না ভূমি। খাওয়াতে মনোযোগী হলো। খাওয়ার এক ফাঁকে অর্পণ বলল‚

“বাবা কাল আমি হসপিটাল যাব না।”

খাওয়া থামিয়ে মেহরাব শিকদার শুধালেন‚ “কেন?”

“কাল ভাইয়ের দলীয় হতে একটা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে৷ ভাইকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।”

“প্রলয়কে থাকতে হবে৷ সেখানে তোর কাজ কী? সবে হসপিটাল জয়েন করলি। এখনই এভাবে না যাওয়াটা কী ঠিক হবে?”

“তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে না। চাচ্চু তো ঠিকই বলেছে৷”

“তোমাকে আমি একা ছাড়ব না ভাই।”

“মেয়েদের মতো চিন্তা করা বন্ধ কর অর্পণ। তুই এভাবে চিন্তা করলে তোর ভাবি লজ্জা পাবে।”

থমথমে হয়ে গেল অর্পণের মুখখানা৷ এভাবে মুখের উপর কেউ অপমান করে? এমন কাজ তার ভাই ছাড়া কেউই করতে পারে না৷ ভাগ্যিস ‘মেয়েদের মতো চিপকে থাকিস কেন?’ এটা বলেনি। আজকের মতো বেঁচে গেল অর্পণ। নয়তো এতগুলো মানুষের সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেত৷

প্লেটে খাবার নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করছে ভূমি। খাবারের গন্ধে ম-ম করছে ডাইনিং স্পেস। ফিরোজা ইলিশ মাছে বাটি নিয়ে ভূমির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইলিশ মাছ নেবে না সে৷ তখন মোর্শেদ শিকদারকে কাঁটা বাছতে দেখে মনে মনে ভাবল‚ ‘মাছের কাঁটা যে সেও বেছে খেতে পারে না৷’ গ্রামে থাকাকালীন সময় দুয়েকবার খাওয়া হয়েছিল ইলিশ মাছ৷ তখন আম্মা কাঁটা বেছে দিয়েছিল। মোড়ল বাড়ির দৈনন্দিন রান্না করা খাবার তো আসতই সেই সঙ্গে ভালোমন্দ কিছু রান্না হলে‚ দুজনের জন্যই তরকারির নেওয়ার কথা বলে দিতেন নাজমা৷ পুরোনো কথা স্মৃতিচারণ হলো। ফিরোজা শুধালেন‚

“তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না ভূমি! ইলিশ দিই তোমাকে?”

“আমি ইলিশ মাছ খাব না চাচি মা।”

“তা খাবে কী করে? এত সব খাবার কোনোদিন চোখে দেখেছ?”

মাধুরীর কথা বেশ লাগল। উপস্থিত সকলে বুঝতেও পারেনি উনি এমন একটা কথা বলে বসবেন৷ নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল গৌর কপোল জুড়ে। সকলের আড়ালেই অশ্রু মুছে নিল ভূমি। কিন্তু কারো দৃষ্টিই এড়াল না ভূমির নীরব কান্না৷ মায়ের প্রতি বিস্তর রাগ মনের ভেতর চেপে বসল৷ প্রলয়কে কিছু বলতে না দিয়ে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚

“তুমি থামবে মাধুরী? এ কোন ধরনের আচরণ? মানছি তুমি ওকে পছন্দ করো না তাই বলে এভাবে কথা বলবে?”

“আমাকে থামাচ্ছ কেন? আমি এতসব বেহায়াপনা নিতে পারছি না৷”

“কোনটাকে তোমার বেহায়াপনা মনে হয়েছে?”

মাধুরী কিছু বলতে নেবেন তার আগেই ভূমি বলল‚

“হয়তো এত বিলাসিতায় বড়ো হইনি। কিন্তু আমার আম্মা নিজের সাধ্য অনুযায়ী যতটু পেরেছেন করেছেন। ক্ষমা করবেন আমাকে।”

ভূমি আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না৷ খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না৷ মা’রের চাইতে যে অপমানের করাঘা’ত একটু বেশিই ক্ষ’ত তৈরি করে৷

বালিশের উপর রোদন বৃষ্টি হচ্ছে৷ এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে বলায় খুব কষ্ট পেয়েছে ভূমি। কিছুতেই কান্না নিবারণ করতে পারছে না। কেন তাকে সবার এত অপছন্দ? ছোটো বেলা থেকে তো কম হেলা‚ তিক্ত কথা হজম করতে হয়নি তাকে৷ তবুও কখনো ভেঙে পড়েনি সে৷ বিছানায় উপুড় হয়ে ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা৷ অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠে গিয়েছে৷ মাথাও ধরছে ভীষণ।

ত্রস্ত পায়ে ট্রে হাতে নিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল প্রলয়৷ সে জানত মেয়েটা এখন গলা ছেড়ে কাঁদবে৷ হলোও তাই৷ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিল প্রলয়। এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। হাতে থাকা ট্রে টা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে বলল‚

“ছোটো ছোটো কথা কান্না করতে আছে? তুমি তো দেখছি খুবই ছিঁচকাঁদুনে।”

তবুও মুখ তুলে তাকাল না ভূমি। প্রলয় কিছুটা ঝুঁকে ভূমি চুলে আলতো হাত রাখল। তবুও মেয়েটা উঠল না। কান্না বেগ বেড়েছে। শব্দ করে না কাঁদলেও প্রলয় অনুভব করল মেয়েটার শরীরের কম্পন। ভূমির মাথার কাছের বসে বলল‚

“আমার ভূমি কন্যাকে যে রণরঙ্গিণী হতে হবে। ”

মুখ তুলে সিক্ত নেত্রেই প্রলয়ের দিকে তাকাল ভূমি। কানে বারবার প্রলয়ের বলা “আমার ভূমি কন্যা” ডাকটা প্রতিধ্বনি তুলছে। ডাকটা যে ভীষণ আদুরে৷ কান্না বন্ধ হয়ে গেল ভূমির৷ হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিল প্রলয়। কান্না করে চোখমুখ ইতিমধ্যেই ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। মুখ টমেটো হয়ে আছে। ভূমিকে শান্ত করতে প্রলয় বলল‚

“আরেকটু কাঁদবে প্লিজ? মুখটা লাল টমেটোর মতো হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি।”

প্রলয়ের এহেন কথায় হেঁচকিও বন্ধ হয়ে গেল ভূমির। হতভম্ব ভূমি নাক ফোলাল। প্রলয় আবারও বলল‚

“লজ্জা পেলেও নিশ্চয়ই এমন টমেটো হয়ে যাও?”

কান গরম হলো ভূমির৷ প্রলয়ের কথা মতো সে কী লজ্জা পেতে শুরু করেছে? না এই লোকের সামনে তো লজ্জা পেলে চলবে না৷ একদম না! প্রলয় বিছানা ছাড়ল। হাত ধুয়ে খাবারের প্লেটটা হাতে নিল। ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে‚ ভূমির মুখের সামনে লোকমা তুলে বলল‚

“চুপচাপ খাবারটা মুখে নাও৷ খাবারের উপর রাগ করে থাকা যাবে না৷”

“আমি খাব না। আমার পেট ভরে গেছে৷”

“আমাকে আর রাগিয়ো না ভূমি কন্যা। আমি এমনিতেই প্রচণ্ড রেগে আছি।”

প্রলয়ের হাতে ভূমি খাবার খেয়ে নিল। এরই মাঝে প্রলয়ও নিজের খাবার খেয়ে নিয়েছে। এদিকে বিছানার উপর বসে আছেন মোর্শেদ শিকদার। ঘুমনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মাঝে ঘরে প্রবেশ করলেন মাধুরী। এসেই স্বামীকে বললেন‚

“তুমি দেখলে তোমার ছেলে আমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলল!”

তখন খাবার টেবিলে…

ভূমি তার ঘরের দিকে ছুটে যেতেই টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল প্রলয়৷ মায়ের প্রতি রাগ প্রকাশ না করলেও চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে৷ তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে মাধুরী শুধালেন‚

“একি তুই উঠে দাঁড়ালি কেন?”

মায়ের কথার উত্তর দিল না প্রলয়। ফিরোজার দিকে তাকিয়ে বলল‚ “চাচি মা একটা ট্রে তে করে ভূমির খাবারগুলো একটু গুছিয়ে দেবে? ইলিশ মাছও দেবে৷ আর হ্যাঁ আমার খাবারগুলোও দিয়ে দাও।”

ফিরোজা চোখের পাতা ঝাপ্টে বললেন‚ ”দিচ্ছি।”

ছেলের কাছ থেকে অবজ্ঞাত সহ্য হলো না মাধুরীর। গম্ভীর স্বরে তিনি আবারও শুধালেন‚

“কী হলো আমার কথা কী তোমার কানে যাচ্ছে না?”

“যে খাবার টেবিলে আমার স্ত্রীকে অপমান করা হয়— সেখানে নিশ্চয়ই আমি বসে বসে পঞ্চব্যঞ্জন গোগ্রাসে গিলব না।”

“পরের মেয়ের জন্য তুই কেন খাওয়া বন্ধ করবি?”

“তোমার মেয়ে দুটোও একদিন শ্বশুর বাড়িতে পরের বাড়ির মেয়ে হবে।”

মাধুরী খানিকটা চেঁচিয়ে বললেন‚ “নিজের মাত্রা অতিক্রম করো না প্রলয়।”

“তুমিই আমাকে বাধ্য করছ। আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তোমার এত সমস্যা কেন হচ্ছে মা?”

বিষয়টা ফিরোজারও খুব খারাপ লেগেছে৷ কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না তিনি। যার বউ তাকেই মুখ ফুটে কিছু বলা উচিত৷ প্রলয়ের কথায় সায় জানিয়ে এবার মেহরাব শিকদার বললেন‚

“প্রলয়ের সাথে আমি একমত। তুমি এই ব্যবহারটা ঠিক করলে না ভাবি।”

এখন…

চোখের চশমা ঠিক করে বিছানায় নড়েচড়ে বসলেন মোর্শেদ শিকদার। ইদানীং স্ত্রীর ব্যবহারে হতাশ তিনি। মাধুরীকে অনেক কিছুই শোনাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কিছু মুখে এলো না। কিছু শান্ত স্বরেই বললেন‚

“ভুল কিছু তো বলেনি। মেয়েটাকে এভাবে না বললেও পারতে৷ মানছি ওকে তুমি মেনে নিতে পারছ না তাই বলে এভাবে কষ্ট দিয়ে কথা বলাটা কী ঠিক?”

“এখন তো আমিই ভিলেন সবার কাছে।”

“তুমি সহজ বিষয়টাকে জটিল করে তুলছ৷”

মুখ ঝামটা দিয়ে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালেন মাধুরী। মোর্শেদ শিকদার পুনশ্চ বললেন‚

“আমার সামনে যদি কেউ তোমাকে হেয় করে কথা বলে— নিশ্চয়ই আমি তা চুপচাপ মেনে নেব না৷ তাহলে প্রলয়ের দোষটা কোথায়? এক্ষেত্রে আমি আমার ছেলেকে সম্পূর্ণ সমর্থন করব।”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here