#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিছানা গুছিয়ে ঘুমোনো বন্দবস্ত করছে অর্পণ। এতক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। একাকী নিজেকে সময় দিতে ভীষণ ভালো লাগে তার। সময়ের পর সময় বয়ে যায়। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে‚ অর্পণ বারান্দায় বসেই রাত কাবার করে দিয়েছ। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে‚ মশা লাভ বাইট দিয়ে দেয়। ফোন চার্জে লাগানো। এদিকে অর্পণ বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। তখনই বেহায়া ফোনটা বাজতে শুরু করল অনবরত। এবার যেন আলসেমি জেঁকে বসেছে৷ বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করল না। বিছানা যে বলছে‚ ‘আমাকে ছেড়ে যেও সোনা। ধরিত্রীর সাধ্যি কোথায় তোমাকে আমাকে আলাদা করার!’ কিন্তু ওইযে নির্লজ্জ মোবাইল। কোন খ্যাপা তার ঘুমের পিছু লেগেছে সেটাও তো জানতে হবে৷ অগত্যা বিছানা ছাড়তে বাধ্য হলো অর্পণ। বিছানাটা যেন আবারও ফিসফিসিয়ে বলছে‚ ‘তুমিও আমাকে ঠকালে? তোমার আমার ভালোবাসা কেউ মেনে নিল না।’
ওয়ারড্রবের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল অর্পণ। স্ক্রিনে সেই একই নাম ‘ইরাবতী’। সমস্ত বিরক্তি ভাব মূর্ছা গেল। প্রাপ্তবয়স্ক আঁখিপল্লব হতে ঘুম পালিয়েছে। চিত্তচাঞ্চল্য হাস্যজ্বল হয়ে উঠল মুখটা। তবুও কণ্ঠ খাদে নামিয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“এতবার কল দিচ্ছ কেন?”
“এত রাতে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে কেন কল দেয় জানেন না বুঝি?”
“আবেগ দিয়ে জীবন চলে না মেডাম।”
“চলবে না কেন? অবশ্যই চলবে।”
“তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। পারবেন তো মেডাম?”
“কী মনে হয় আপনার?”
“আমার মনে হওয়া দিয়ে কী হবে? তোমার মুখেই শুনি৷”
ইরা চোখ বন্ধ করে বলল‚ “আপনার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি। শুধু শেষ অবধি আপনি থেকে যাবেন।”
ফোন কানে রেখে কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরল অর্পণ। পুনর্বার কিছু বলার ইচ্ছে হলো না। খানিকটা সময় নীরবতায় কাটুক। অপরপ্রান্ত থেকে গুনগুন ধ্বনি ভেসে আসছে। গুনগুনানো উপলব্ধি করল অর্পণ। তার মনে পড়ল‚ প্রলয় ভূমির রিসেপশনের কথাটা ইরাকে জানানো উচিত।
“বুধবারে ভাই আর ভূমির রিসেপশনের আয়োজন করা হবে। তোমাদের বাড়িতে হয়তো বাবা-ই নিমন্ত্রণ করে আসবেন। বাবা তো তোমাদের বাড়িতে রয়েছেন।”
“হ্যাঁ ভাইয়া জানিয়েছিল।”
“তা মেডাম এত রাত জাগলে চলবে? ঘুমতে হবে তো! এরপর চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে।”
“তখন বুঝি আমাকে আর পছন্দ করবেন না আপনি?”
“মেয়েরা যে‚ বুঝে কম লাফায় বেশি এটাই তার প্রমাণ।”
“আমার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত নারী জাতিকে অপমান— এ আমি কিছুতেই সহ্য করব না। কদাপি নহে।”
“আমার এত বড়ো সাহস আছে নাকি? একটাকেই সামলাতে হিমসিম খাচ্ছি। পুরো নারী জাতিকে কী করে সামলাব?”
❑
করিডরে পায়চারি করছেন মেহরাব শিকদার। ঘুম আসছে না কিছুতেই। চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে৷ এতকাল পরে অতীত আবার কেন সামনে এসেছে? চোখের সামনে নিজের বিনাশ দেখতে পারছেন তিনি। না— যে করেই হোক এই সমস্যা থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই হবে। অতীত মুছে ফেলতে হবে। কিন্তু কীভাবে কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।
ফিরোজা নাম্বার থেকে কল আসতেই সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন মেহরাব শিকদার। উচ্ছ্বাস নিয়ে ফোন রিসিভ করলেন তিনি। ওপাশ থেকে প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো‚
“কবে আসবে তুমি?”
“সবে একটা দিন হলো।”
“আমার মনে হচ্ছে একযুগ হয়ে গিয়েছে।” একটু থেমে‚ “তোমাকে একটা কথা বলি?”
“আমাকে কিছু বলার জন্য অনুমতি লাগবে বুঝি?”
“তোমাকে না জানিয়ে আমি দুই জোড়া ঝুমকো গড়াতে দিয়েছি।”
অবাক হয়ে মেহরাব শিকদার শুধলেন‚ “হঠাৎ?”
“একজোড়া ভূমির জন্য। আর আরেকজোড়া আমার অর্পণের বউয়ের জন্য।”
“আমার বউয়ের জন্য কিছু বানাতে দাওনি?”
সলজ্জে হেসে ফিরোজা বললেন‚ “ধ্যাৎ তুমিও না।”
“আমি আবার কী করলাম?”
“বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে।”
“অ্যাই তুমি আমাকে বুড়ো বললে? একমাত্র ছেলেকে এখনো বিয়ে করালাম না। নাতি নাতনির মুখ দেখলাম না। আর তুমি আমাকে বুড়ো বলে আখ্যায়িত করলে?”
“অবশ্যই! আচ্ছা— খেয়েছ তুমি? ওখানে সব ঠিকটাক তো?”
“হ্যাঁ আমি খেয়েছি৷ আর এখানে সবকিছু ঠিকটাকই৷”
“তুমি আরশের বাবা মাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ো।”
“কীসের?”
“বাহ্ রে! প্রলয় ভূমির রিসেপশনের কথা ভুলে গেলে তুমি?”
“এতকিছুর মাঝে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি উনাদের বলব।”
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলেন মেহরাব শিকদার। রাত হচ্ছে। সময় বারোটার কাছাকাছি। গ্রামে এটাই গভীর রাত। সবকিছু নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে অদূরে কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজ ভেসে আসছে। গ্রীবাভঙ্গি পরিবর্তন হতেই মহুয়াকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। এদিকে টিপ্পনী কে’টে মহুয়া শুধালেন‚
“বউয়ের সঙ্গে কথা বলছিলে বুঝি?”
“আড়ি পাতছিলে বুঝি?”
“ওসব আড়ি পাতা আমার স্বভাব নয়। সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম কথাগুলো কানে এলো।”
“আমার তো অন্য কিছু মনে হলো!”
“তোমার মনে হওয়া দিয়ে আমার কাজ নেই। সে যাকগে— একটা কথা না বললেই নয়।”
ভ্রুযুগল উঁচিয়ে মেহরাব শিকদার শুধালেন‚ “কী কথা?”
“তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার খুবই আফসোস হচ্ছে৷”
কথাটা বলে থামলেন মহুয়া৷ কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললেন‚ “ঘরে বউ বাচ্চা রেখে পরকীয়া করেছ সেটা যদি তোমার বউ জানে— ভাবতে পাচ্ছ কী হবে তোমার? সত্যিটা জানার পর‚ এত ভালোবাসা টিকে থাকবে তো? এই কথা ভাবতেই তো আমার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে৷”
“তোমাকে নিয়েও আমার খুব আফসোস হচ্ছে।”
“তোমারও আফসোস হয় বুঝি?”
“কেন হতে পারে না বুঝি? এইযে আমার আফসোস হচ্ছে— আমার পরিনতি‚ দোষক্ষালন দেখার জন্য তুমি থাকবে না।”
“মে’রে ফেলবে বুঝি আমাকে? ড. মেহরাব শিকদার বুঝি খুব বেশিই ভয় পেয়ে গিয়েছে?”
“আমার আরও একটা আফসোস হচ্ছে!”
“সুযোগ আছে সকল আফসোস বলে দাও।”
“উনিশ বছর আগেই তোমাকে আমার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে কাহিনী এতদূর গড়াত না।”
তাচ্ছিল্য করে হাসলেন মহুয়া। মেহরাব শিকদার আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না সেখানে। করিডোর থেকে প্রস্থান নিলেন। মহুয়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
সাড়ে বারোটা…
“কাজটা আপনি ঠিক করছেন না নাজিম চৌধুরী।”
“……”
“আমি বরাবরই রাজনীতি আর ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা রেখেছি। আমি চাইছি না আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করুন।”
“……”
রাগে শরীর কাঁপছে। কিছুতেই সেই রাগেই বহিঃপ্রকাশ করতে পারছে না প্রলয়। সর্বস্ব দিয়ে ফোনটাকে মেঝেই আছাড় মে’রেছে সে৷ নীলচে জোছনার আলো এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে৷ কিন্তু আফসোস আঁধারিয়া বারান্দায় ভাঙা ফোন কোথাও দেখা গেল না৷ অতিরিক্ত রাগ দাবিয়ে রাখতে না পেরে একের পর এক সিগারেট ধরিয়েই যাচ্ছে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে কোথাও প্রলয়কে দেখতে পেল না ভূমি। এইতো কিছুক্ষণ আগেও বিছানায় শুয়ে ছিল লোকটা৷ ভূমি বারান্দার দিকে গিয়ে দেখল প্রলয় সেখানেই। তার দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ভূমি তাকে ডাকল‚
“শুনছেন? ঘুমবেন না?”
প্রলয়ের কাছ থেকে প্রত্যুত্তর পেল না ভূমি। বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারল না তার স্বামী রেগে রয়েছে। সে আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“শুনছেন?”
রাগ তখন মাথায় চড়ে বসেছে। ভূমির কাছ থেকে লাই পেয়ে প্রলয় তেড়ে এলো। চোখ দিয়েই অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। প্রলয় চেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ভূমির। নেত্রযুগল অশ্রুপ্লাবিত হলো। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভূমি। গলা ঝেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফিরিয়ে ভূমি ঘরের ভেতরে চলে এলো। ঘরের লাইট অফ করে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল ভূমি। খুব অভিমান হয়েছে তার। বিনাদোষে তাকে ধমক দিয়েছে। এত সহজে তো ক্ষমা করবে না সে৷
এরপর শত চেষ্টা করেও ভূমিকে নিজের দিকে ফেরাতে পারল না প্রলয়। মেয়েটা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তখন অতিরিক্ত রেগে থাকায় ভূমিকে একটা ধমক দিয়েছিল৷ সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা কেঁদে দিয়েছিল৷ হয়তো ভয় পেয়েছে৷ প্রলয়ের রাগের সঙ্গে তো মেয়েটা পরিচিত নয়। পুরুষ মানুষ সারা দুনিয়ার কাছে বাঘ হয়ে থাকলেও স্ত্রীর কাছে ভেজা বিড়ালই হয়ে যায়৷ ভূমির অভিমান ভাঙতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল প্রলয়৷ খুবই নিভৃতে ভূমির গ্রীবায় উষ্ণ অধর ছোঁয়াল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল‚
“এভাবেই অভিমান করে থেক— আমি প্রতিদিন তোমার অভিমান ভাঙাব।”
তবুও মান ভাঙল না ভূমির। মেয়েটা সেই মুখ ফিরিয়েই রেখেছে। পরপরই সে ভূমিকে লজ্জায় ফেলতে প্রলয় আবার বলল‚
“কাঙ্ক্ষিত সেই দিনটার জন্য নিজেকে তৈরি কর ভূমি কন্যা। আমি বেশ বড়োসড়ো উপহার চাই।”
প্রলয়ের বলা কথাটা স্বাভাবিক ছিল না৷ উষ্ণ নিশ্বাস এখনো গ্রীবায় অনুভূত হচ্ছে৷ চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছে ভূমির। দ্রিমদ্রিম মাদল বেশ উপলব্ধি করছে সে। কথাটার রেশ এখনো রয়ে গিয়েছে। সে তো অবুঝ নয়! প্রলয়ের বলা প্রত্যেকটা কথা সে বুঝেছে৷ লোকটা এতটা কবে বদলে গেল? আগের মতো গম্ভীর নেই কেন? পরক্ষণেই মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগেই তার উপর চেঁচিয়েছে।
চলবে?…..