#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সকালে ঘুম থেকে উঠে ভূমিকে কোথাও দেখতে পেল না প্রলয়৷ সেই যে কাল রাতে অভিমান করে বসেছিল এখনো তা অব্যাহত রয়েছে৷ মেয়েটা সকালে তাকে ঘুম থেকে ডাকেনি পর্যন্ত৷ বিছানায় থম মে’রে বসে রইল প্রলয়। ভাবছে কীভাবে বউয়ের মান ভাঙানো যায়! পরক্ষণেই ভাবল ঘরটা অন্তত আজ সেই-ই গুছিয়ে রাখুক। তাহলে যদি একটু মন গলে! চট করে বিছানা ছেড়ে নামল প্রলয়। বালিশ‚ চাদর ঠিকঠাক করে বিছানা ঝাঁট দিল৷ এলোমেলো করে রাখা নিজের শার্ট পাঞ্জাবি বিনে রাখল। এগুলো আধোয়া৷ ড্রেসিং টেবিল এলোমেলো ছিল‚ সেটাও গুছিয়ে নিল প্রলয়। এরপর বারান্দায় গেল সে। গাছে অনেকগুলো গোলাপ ফুটেছে আজ৷ কাল তো শুধু একটা হলুদ গোলাপ ফুটেছিল। আজ যেন ফুলের সমাহার। ফুলগুলো দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল প্রলয়ের।
রান্নাঘরে সমস্ত কাজ একা হাতে করছে ভূমি। ঘরে যেন যেতে না হয় সেজন্য সকল কাজ নিজের দায়িত্বে নিয়েছে আজ৷ বৈঠকখানার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে প্রলয়৷ মাঝে মাঝে রান্নাঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সোফায় বসে রয়েছেন মোর্শেদ শিকদার‚ মাধুরী‚ ফিরোজা এবং অর্পণ। উপস্থিত বাকিরা মিটমিট করে হাসছে। সাবিনা বাকিসব কাজগুলো করছে। ফিরোজা রান্নাঘরের দিকে গেলেন। চুলোতে সবে চায়ের পানি বসানো হয়েছে। সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়ানোতে ব্যস্ত ভূমি। ফিরোজা নিজে থেকে বললেন‚
“তুমি এখন ঘরে যাও। আমি বাকি কাজ করে রাখছি।”
“আমি এখানেই থাকি চাচি মা?”
ফিরোজার সঙ্গে চোখাচোখি হলো প্রলয়ের। লজ্জায় মাথা নিচু করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলা চলে গেল। হয়তো নিজের ঘরে গিয়েছে। ক্ষীণ হাসলেন ফিরোজা। ভূমিকে আবারও বললেন‚
“তোমার এখানে থাকতে হবে না‚ এদিকটা আমি সামনে নেব। প্রলয় হয়তো ঘরে গিয়েছে‚ দেখ ওর কী কী লাগে আর এখানে তো সাবিনা আছেই।”
“আচ্ছা চাচি মা।”
ঘরে ক্রমাগত পায়চারি করছে প্রলয়। অপেক্ষা করছে ভূমি কখন আসবে। মেয়েটা কাল থেকে থাকে ইগনোর করছে। দেখেও যেন দেখছে না। ঘরে আসুক মজা দেখাবে— মনে মনে এটাই পরিকল্পনা করছে। এরই মাঝে ভূমি করে প্রবেশ করল। প্রলয় কিছুটা ভাব নিয়ে বিছানায় চুপ করে বসে রইল। কোনো রকম অনুভূতি ব্যক্ত করল না। ভূমি একবার তাকাল প্রলয়ের দিকে। এরপর আলমারির দিকে অগ্রসর হলো। আলমারি থেকে প্রলয়ের জন্য সাদা পাঞ্জাবি বের করে বিছানা এনে রাখল। এবার নীরবতা কাটিয়ে প্রলয় বলে উঠল‚
“শপিং এ যাব৷ ঝটপট তৈরি হয়ে নেবে৷ দুপুরে ওইদিকটায় জ্যাম থাকে।”
ভূমি কিছুই বলল না। কাল রাতের কথা ভুলে যায়নি সে৷ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা লোকটা তার উপর চেঁচিয়েছে৷ কই আম্মা তো কখনো তার উপর চেঁচামেচি করেননি? বাবা থাকলেও নিশ্চয়ই এমন করতেন না৷ তাহলে তিনি কেন এমন করবেন? অভিমান হয়েছে ভীষণ। মেয়েটার নিস্তব্ধতায় আবারও রাগ চড়তে শুরু করল প্রলয়ের মস্তিষ্কে। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ভূমিকে শুধাল‚
“কী হলো কথা বলছ না কেন?”
ভূমির স্বাভাবিক জবাব‚ “আপনি আমার উপর চেঁচিয়েছেন।”
“তখন মাথায় রাগ চেপে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো আমি স্যরি বলছি। রাতে একটু বেশি রাগ করে ফেলেছিলাম।”
“সেই রাগটা কী আমাকে নিয়ে?”
“একদমই না। তোমার উপর রাগ করা যায় না৷”
পাল্টা প্রশ্ন করল ভূমি‚ “তাহলে?”
“অফিসিয়াল লাইফ আর পারসোনাল লাইফ দুটোকে আমি মিলাতে চাইছি না।”
ভূমি বুঝলো প্রলয় তাকে ওই ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছে না তাই সেও আর কিছু জিজ্ঞেস করল না৷ বিছানায় বসে রয়েছে আর ভুমি বিছানার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরপর প্রলয় নিজে থেকেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ভূমিকে। মেয়েটা কোনো রকম দ্বিরুক্তি করল না৷ চুপটি করে মাথা রাখল নিরুপদ্রব বক্ষঃস্থলে।
হসপিটালে…
নিজের কেবিনে বসে রয়েছে অর্পণ। এখন একটু ব্রেক টাইম চলছে। বসে বসে বোর হচ্ছিল৷ তখন একবার ভাবল ইরার সঙ্গেই নাহয় কথা বলা যাক। সময়ও কে’টে যাবে। এই সময়টাতে ইরা হোস্টেলেই থাকে৷ আর কোনো কিছু না ভেবেই ইরার নাম্বারে কল লাগাল৷ কয়েকবার রিং হওয়া সত্ত্বেও কেউ ফোন রিসিভ করল না। অর্পণ ভাবল‚ হয়তো ঘুমচ্ছে তাই আর বিরক্ত করল না ইরাকে। ইউটিউবে প্রলয়ের একটা প্রেস কনফারেন্স ছিল সেটাই দেখছে অর্পণ। মিনিট পাঁচেক পর ইরার নাম্বার থেকে কল এলো। রিসিভ না করে উল্টো কে’টে দিয়ে নিজেই কল ব্যাক করল অর্পণ। ইরাকে শুধাল‚
“কল রিসিভ করছিলে না— কোথায় ছিলে?”
“ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।”
“ও আচ্ছা!”
“কিছু কী বলবেন? হঠাৎ আয়োজন করে কল দিলেন!”
“কাল একবার আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে?”
ইরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”
“সকালে দেখলাম ভূমির মন খারাপ। তোমাকে দেখলে হয়তো ভালো লাগবে। হয়তো খুশিও হয়ে যেতে পারে।”
“ওর খুশি নিয়ে খুব বেশি ভাবা হচ্ছে দেখছি!”
“পূর্ণ পুষ্প যেমন আমার ছোটো বোন‚ ভূমিকেও তেমনি ছোটো বোনের মতোই দেখি। তারউপর ওর সঙ্গে আমার ভাই জড়িয়ে আছে। ভূমির মন খারাপ দেখে আমার ভাইও গম্ভীর হয়ে রয়েছে।”
“আচ্ছা মশাই চিন্তা করবেন না। আমি কাল সকালে আসব। তবে আমাকে দেখে আপনার পরিবার কেমন প্রতিক্রিয়া করবে সেটা নিয়েই টেনশন হচ্ছে।”
“তুমি কিছু চিন্তা কোরো না। আমার পরিবারের সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। আমি রাতে বলে রাখব সবাইকে।”
“তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই।”
“আচ্ছা আমি এখন রাখছি। পরে কথা হবে।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
❑
মহুয়া কে নিজেদের ঘরে ডেকে এনেছেন নাজমা। উনার কিছু কথা বলার আছে। যে কথাগুলো না বললেই নয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সত্যি তো উনারও জানা প্রয়োজন। মহুয়া হাতের কাজগুলো সেরে শাহাদাত মোড়লের শয়ন কক্ষে এলেন। নাজমা উনার জন্যই অপেক্ষা করছেন। মহুয়াকে আসতে দেখেই নাজমা বললেন‚ “বোসো!” কথানুযায়ী মহুয়া বিছানায় বসলেন। নাজমা জিজ্ঞেস করলেন‚
“মেহরাব শিকদারকে কী তুমি আগে থেকে চিনতে মহুয়া?”
নাজমার কথা শুনে অনেক খুবই অবাক মহুয়া। স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন‚ “হঠাৎ এমন কথা বলছেন কেন ভাবি?”
“কাল রাতে তোমাদের কথা আমি শুনেছিলাম। তোমরা কি একে অপরকে আগে থেকেই চেন?”
মহুয়া আর লুকিয়ে রাখলেন না। সব কথা বলে দিলেন নাজমাকে। সঙ্গে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছেন যেন এই কথা অন্য আর কেউ না জানে। সব কথা শোনার পর ঘৃণায় চোখ মুখ কুঁচকে এলো নাজমার। মেহরাব শিকদারকে কত ভালই না মনে করেছিলেন তিনি! তবে এই ভালো মানুষের মুখোশের পেছনে রয়েছে এক নির্মম সত্যি। আর সত্যি এটাই যে ভূমি মেহরাব শিকদারের মেয়ে। তবে তিনি কেন এটা স্বীকার করছেন না? এসব কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নাজমার। মহুয়াকে তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না আর। বিছানায় বসে ক্রমাগত কাঁদছেন। নাজমা নিজে থেকেই বললেন‚
“ভূমি যেদিন এই সত্যিটা জানতে পারবে‚ ভাবতে পারছ কী হবে?”
“যেই বাবাকে কখনো চোখেই দেখেনি ভূমির তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা। আমি কী করে সত্যিটা বলে মেয়েটার মনে আঘাত দিতে পারি? এটা যে আমি কক্ষনো করতে পারবো না। মেয়েটা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করত‚ ‘আমার বাবা কোথায় আম্মা?’ তখন আমি মুখ ফুটে সত্যিটা বলতে পারতাম না। একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমার মেয়েটা ছটফট করত। শুধু মায়ের ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়। একটা সন্তানের জন্য বাবা মায়ের ভালোবাসা দুটোই প্রয়োজন হয়। আমার মেয়েটা আজও অপেক্ষায় আছে‚ তার বাবা একদিন আসবে। কিন্তু ভূমি তো এটাই জানে না যে‚ সে তার বাবার কাছে পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেহরাব শিকদারও জানেন না যে‚ ভূমিই উনার সন্তান।”
“সত্যি কোনদিন চাপা থাকে না মহুয়া। সত্যিটা একদিন সবাই জানবে। তার আগেই উচিত ভূমিকে সব সত্যি জানিয়ে দেওয়া তাহলে হয়তো মেয়েটা কষ্ট একটু কম পাবে।”
“আমি প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করছি। কিছুতেই পারছি না মেয়েটাকে এত বড়ো দুঃখের মুখোমুখি করতে। আমার মেয়েটা যে বড্ড কোমল।”
“আরেকটা কথা তোমাকে জানানোর আছে।”
“কি কথা ভাবি?”
“আমাদের সবাইকে শহরে যেতে হবে। তোমাকেও যেতে হবে। প্রলয় আর ভূমির রিসেপশনের আয়োজন করা হবে। মেহরাব শিকদার কিছুক্ষণ আগে আরশের বাবাকে জানিয়েছিলেন। ভাবলাম তোমাকেও বলে দিই। তখনই কাল রাতের কথাটা মনে পড়ল। তাই তোমাকে ডেকে আনলাম।”
“আমি শহরে গেলে যে‚ মেহরাব শিকদার জেনে যাবেন ভূমিই উনার মেয়ে। আমি কিছুতেই এই সত্যিটা উনার সামনে আনতে দিতে চাইছি না। হতে পারে এই সত্যিটা জানার পর উনি আমার মেয়েকে কখনো সুখীই হতে দেবেন না।”
“তুমি আমাদের পরিবারের একজন সদস্য তাই তুমি আমাদের পরিচয়ে যাবে। কোন ধরনের সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।”
চলবে?…..