#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিয়ের কথা শুনতেই চোখ মুখে আঁধার নেমে এলো মহুয়ার। তার মেয়ে সজ্ঞানে কোনো অন্যায় করতেই পারে না। এতটুকু বিশ্বাস উনার ভূমির প্রতি রয়েছে৷ এত মানুষের ভীড়ে আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে রইল মায়ের পেছনটায় লুকিয়ে রইল ভূমি। মায়ের আঁচল খানা খিঁচে ধরে রেখেছে সে৷ মহুয়া মেয়েকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন। ভূমি একবার মাথা তুলে মায়ের সুশ্রী পানে তাকাল৷ উদ্দীপ্ত‚ উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বলল‚
“আম্মা আমি কোনো অন্যায় করিনি— আর না আমি কোনো পাপ করেছি৷ তাহলে কেন শাস্তি পেতে হবে?”
মেয়ের এহেন কথা মায়ের মায়াময়ী হৃদয়কে ক্ষ’তবিক্ষ’ত করল। নিজেকে সামলে মহুয়া বললেন‚ “কোনো অন্যায় না করেও কিছু কিছু সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমাদের সবকিছু সহ্য করে নিতে হয়।”
“আমার কী দোষ ছিল আম্মা? ওই খারাপ লোকটাই তো আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।”
মাথায় র’ক্ত ছলকে উঠল মহুয়ার। এ কথা তো তিনি জানতেন না। অতিশয় ক্রোধে বশীভূত মানবী চেয়ে রইলেন মেয়ের মুখপানে৷ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন‚
“কে নিয়ে গিয়েছিল তোকে?”
মায়ের কণ্ঠস্বর বড্ড অচেনা মনে হলো। মুখ তুলে তাকাল ভূমি। ক্রন্দনরত অবস্থাতেই বলল‚ “মকবুল কাকা।”
শরিয়ত মতে বিয়ের কাজ সুসম্পন্ন হলো। নালিশে উপস্থিত কাউকেই স্থানচ্যুত হতে দেয়নি প্রলয়। বরঞ্চ সে নিজের সিদ্ধান্তে অটোল৷ আজ বিয়ে হবে মানে আজই হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না। অত্যন্ত রোদের তপ্ততা আর বিরক্তিতে চোখ মুখ ঝলসে যাচ্ছে বাকিদের। দাঁত কিড়মিড় করে সকলেই চেয়ে রয়েছে প্রলয়ের দিকে৷ মনে হচ্ছে যেন কাঁচাই চিবিয়ে যাবে। বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবার পরেও মানুষগুলোর কানাঘুষা বন্ধ হলো না। বরঞ্চ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের কানাঘুষা তড়তড় করে বাড়তে লাগল। প্রলয় শান্ত স্নিগ্ধস্বরে শুধাল‚
“কাজ খতম? এখানে তো আপনাদের আর কোনো কাজ নেই! দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“এই ন’ষ্টা মাইয়ারে এই গ্রামে দেখতে চাই না মোড়ল সাব। আমরাও তো পরিবার নিয়া বাস করি৷ পোলা মাইয়ারা কী শিখব?”
অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্বরের কথা ছুড়ে দিল প্রলয়‚ “শুনেছি আপনি স্কুল শিক্ষক। আপনার থেকে এমন ব্যবহার আশা করা যায় না।”
গম্ভীর স্বরে প্রলয়ের বলা কথাটায় ভড়কে গেলেন আজিজ মাস্টার। কিছু বলতে পারলেন না ঠিকই কিন্তু আমতা আমতা করতে লাগলেন। আরেকজন বলে উঠল‚
“বিয়ার কাম শেষ। শুনছিলাম আপনেরা নাকি শহরে চইলা যাইবেন?”
অর্পণ বলল‚ “হ্যাঁ চলে যাব— তাতে কী?”
“এই অপয়া মাইয়ারে লগে কইরা নিয়া যাইবেন। এরে আমরা আমগোর গেরামে কিছুতেই রাখমু না।”
এবার মুখ খুললেন শাহাদাৎ মোড়ল। তিনি বললেন‚ “আপনাদের কথা মানা হয়েছে। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
ভীড় কমতে শুরু করল। ভূমিকে ছেলের বউ বানানোর ইচ্ছে দমন হলো নাজমার। মনে মনে তিনি বেশ বড়োসড়ো ইচ্ছে পোষণ করছিলেন। হোক মেয়েটা গরীব— তাতে কী? এত বছর ধরে মহুয়া উনাদের বাড়িতে কাজ করছে। কখনো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেননি তিনি। বরঞ্চ মহুয়া উনার বেশ বিশ্বস্ত। ভূমি‚ মেয়েটা বেশ শান্তশিষ্ট। একদম মহুয়ার কার্বনকপি। প্রথম থেকেই মহুয়াকে বোনের মতো দেখে এসেছেন নাজমা। ভূমিকে তিনি সেদিন প্রথম দেখলেও মণির কাছ থেকে সমস্ত খোঁজ খবর আগেই রেখেছিলেন। চুপসানো মুখ নিয়েই স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন নাজমা। উনার পাশেই একটা চেয়ারে ভূমিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে৷ মেয়েটার পায়ের ব্যথা আগের তুলনায় বেড়েছে। দাঁতে দাঁত খিঁচে ব্যথাকে সংবরণ করছে মেয়েটা। মেয়েকে সামলে রেখেছেন মহুয়া।
অর্পণ আর আরশ দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়ের পাশে। অর্পণ চেয়েও কিছু করতে পারল না। তার ভাই যেটা বলেছে সেটা করেই ছাড়বে। অ্যাট এনি কস্ট! অনেক কিছুই জানার রয়েছে অর্পণের। তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার ভাইয়ের দিকে। প্রলয় বুঝতে পেরে বলল‚
“এখানে একটা কথাও না। আমি আজই ঢাকা ফিরতে চাই। সব ব্যবস্থা কর।”
অকপটে অর্পণ শুধাল‚ “আর ভূমি?”
“উনি এখন আমার দায়িত্ব— কথাটা ভূলে যাস না।”
হন হন করে মোড়ল বাড়ির ভেতরে চলে গেল প্রলয়। ভেতরে দাবিয়ে রাখা তুমুল ক্রোধ আর কিছুতেই দমন করা যাচ্ছে না। বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় নিজেদের কাঙ্ক্ষিত কামরায় গিয়ে দুয়ার আটকে দিল প্রলয়। এক হাত দূরত্বে সাজিয়ে রাখা ফুলদানিটা সজোরে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল৷ চোখের পলকে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল ফুলদানিটা৷ রাগ কিছুতেই কমছে না। আরও অনেক কিছুই ভাঙতে ইচ্ছে হলো কিন্তু সে তো এই বাড়ির অতিথি। অতিথি হয়ে এমন আচরণ মোটেই ভদ্রতার পরিচয় দিচ্ছে না।
❑
সময় এসে ঠেকেছে ভরদুপুরে। দুর্বল শরীর নিয়ে এতটা সময় রোদের তপ্ততা সহ্য করে‚ একপর্যায়ে কাল রাতের মতো পুনশ্চ জ্ঞান হারাল ভূমি। সকালে অল্প কিছু খাবার খেয়েছিল বটে। অচৈতন্য ভূমিকে নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানার সোফায় লম্বা করে শুইয়ে দেওয়া হলো। মেয়ের চোখ মুখে ক্রমাগত পানি ছিটিয়ে দিচ্ছেন মহুয়া৷ তবুও মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে না৷ উপায়ন্তর না পেয়ে ইরা ছুটে গেল তার ভাইয়ের কাছে। আরশ ছুটে এলো বৈঠকখানায়।
“অতিরিক্ত দুর্বল হওয়ায় এমনটা হয়েছে। আন্টি আপনি কী ওকে সকালে খাবার আর ঔষধটা খাইয়েছিলেন?”
শশব্যস্তভাবে মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে মহুয়া বললেন‚ “হ্যাঁ!”
“ওর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। ওকে ধরে যদি একটু ইরার ঘরে নিয়ে যেতে পারেন।”
আরশের কথা শেষ হবার পূর্বেই প্রলয় সেখানে উপস্থিত হলো। সঙ্গে করে নিজের লাগেজ নিয়ে বেরিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। তাকে দেখা মাত্রই শাহাদাৎ মোড়ল অসহায় কণ্ঠে বললেন‚
“মেয়েটার শরীর তো দুর্বল। আবারও জ্ঞান হারিয়েছে৷ বিকেলে রওনা দিলে হয় না?”
প্রলয় ঘাড় বাকিয়ে তাকাল ভূমির দিকে৷ অচৈতন্য অবস্থাতেও মেয়েটা কপাল কুঁচকে রেখেছে। একপলক দেখে নিল প্রলয়। দমে গেলে যেন। মহুয়া গিয়ে ভূমিকে ওঠানোর চেষ্টা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থ হলেন তিনি। প্রলয় কোনো কথা না বলেই কোলে তুলে নিল ভূমিকে। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে ইরার ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে ইরা তার ঘরের দুয়ার খুলে দিল। প্রলয় সন্তপর্ণে বিছানায় শুইয়ে দিল ভূমিকে। পেছন পেছন মহুয়া ছুটে এলেন। মেয়ের মাথার কাছটায় গিয়ে বসলেন তিনি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। ভূমির জ্ঞান ফিরেছে অনেকটা সময় আগেই। অপরিষ্কার জামাকাপড় পাল্টে নাজমা একটা নতুন শাড়ি দিয়েছে ভূমিকে পড়ার জন্য। ইরা নিজেই শাড়িটা পড়িয়ে দিয়েছে। মহুয়া নিজ হাতে মেয়েকে খাবার খাইয়ে দিয়েছেন। এরপর আর কোনোদিন সুযোগ হবে কি-না আল্লাহ মালুম। ভূমিকে হাতমুখ ধুইয়ে গোছগাছ করিয়ে দিয়েছিল ইরা৷ বেশ কয়েকটা নতুন জামাকাপড় সঙ্গে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই ওরা বেরিয়ে পড়বে। ভূমি তার মাকে জড়িয়ে ধরে সমানে বিলাপের সুরে কাঁদছে।
“আমি তোমাকে ছাড়া কী করে থাকব আম্মা? আমি যে মরেই যাব। তুমি উনাদের বারণ করে দাও৷ আমি কোত্থাও যেতে চাই না।”
বুকটা ধক করে উঠল মহুয়ার৷ মেয়েকে ছাড়া কী করে থাকবেন ভাবতেই বুকটা ছিড়ে যাচ্ছে৷
“ও আম্মা গো আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না আম্মা। তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না আম্মা।”
অতিরিক্ত কান্নার ফলে কপালে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভূমি সেই ব্যথার তোয়াক্কা করল না৷ গলা ছেড়ে কাঁদছে মেয়েটা। মেয়ের কান্নায় কাঁদছে মায়ের হৃদয়। মহুয়া মেয়ের হাতটা প্রলয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন‚
“আমার পদ্মিনী বড্ড কোমল। বিয়েটা খুব খারাপ পরিস্থিতে হয়েছে। এর শাস্তি আমার মেয়েটার উপর যেন না পড়ে বাবা। আমার মেয়ের জন্য অবশ্যই তুমি একজন দায়িত্ববান জীবনসঙ্গী হবে। আমি এই ভেবে নিশ্চিন্ত হব যে— আমার পরেও ভূমিকে দেখে রাখার মতো মানুষের হাতে আমার মেয়েটা পৌঁছেছে। এ দুনিয়া আমার মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না‚ আমার জীবন যে জড়িয়ে রয়েছে ওর সঙ্গে। তুমি সবসময় ওর পাশে থেক বাবা।”
“আপনি চিন্তা করবেন না৷ এখন থেকে উনি আমার দায়িত্ব। আমি অবশ্যই নিজের দায়িত্ব কর্তব্য দুটোই খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করব।”
একটা কাগজের টুকরো মহুয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রলয় বলল‚ “এটা আমার নাম্বার আর বাড়ির ঠিকানা৷ মেয়েকে যখনই দেখতে ইচ্ছে হবে তখনই চলে আসবেন।”
আড়ালেই চোখ মুছে নিলেন মহুয়া। কালো রঙা গাড়িটা চলতে শুরু করল৷ কান্নার বেগ বেড়েছে ভূমির। বুক চিড়ে কান্না পাচ্ছে তার। হুট করে জীবনটা এভাবে পাল্টে না গেলে হত না? আর যে আম্মাকে কাছে পাবে না সে। মাথার উপর থেকে আদুরে সেই হাত আজ থেকে আর থাকবে না। আম্মাকে একা ছেড়ে সে যে বহু দূরে চলে যাচ্ছে। আবার কবে দেখা হবে আম্মার সঙ্গে? ভাবতেই এবার শব্দ করে কেঁদে দিল ভূমি। হুট করে এমন কান্না করায় ভড়কে গেল প্রলয়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে ভূমির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটা নিল না৷ সে কী দেখতে পাচ্ছে না গম্ভীর লোকটা তার অশ্রু মোছানোর জন্য রুমাল এগিয়ে দিয়েছে? নাকি ইচ্ছে করে দেখতে চাইছে না। প্রলয় একটি বার তার বাম পাশে তাকাল৷ এরই মাঝে মেয়েটা পুনশ্চ জ্ঞান হারাল? ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। আয়নায় সবটাই খেয়াল করল অর্পণ। ইশারায় জিজ্ঞেস করল ‘কী হয়েছ?’
“সেন্সলেস হয়ে পড়েছে আবার।”
অর্পণ বলল‚ “চিন্তার কিছু নেই। অতিরিক্ত কান্না করার ফলে জ্ঞান হারিয়েছেন।”
চলবে?…..