#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা অতিক্রমণ করে কালো রঙা গাড়িটা এসে থেমেছে মালঞ্চ নীড়ের সামনে৷ গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতেই দারোয়ান প্রবেশদ্বার খুব ভালো করে আটকে দিল। সেগুন কাঠের কারুকাজ করা সদর দরজার কাছে হরিদ্রাভ আলো জ্বলছে। অলিগলিতেও সোডিয়াম বাতি জ্বলছে। ঝিঁঝি পোকার ঝাঁক বসেছে। সোডিয়াম আলোতে মালঞ্চ নীড় আবছা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যার বহির্ভাগ শ্বেতরঙায় মোড়ানো। পুরোটা সময় প্রলয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে এসেছে ভূমি। অচৈতন্য অবস্থাতে বুঝতেও পারেনি— আর পাশে ঢাল হয়ে বসেছে তার অর্ধাঙ্গ। গাড়িতে বসেই ফ্যালফ্যাল করে দেখছে চারিপাশটা। এদিকে অর্পণ দুটো লাগেজ নিয়েই বড়ো বড়ো পা ফেলে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে৷ গ্রামের ঝামেলা মিটে গেলেও বাড়ির ঝামেলা কী করে মেটাবে বুঝতে পারছে না অর্পণ। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার৷ এদিকে প্রলয় বেশ চিন্তাশূন্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে তার কোনো চিন্তাই নেই পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে। প্রলয় এসে গাড়ির দরজা খুলল। হাত এগিয়ে দিল ভূমির দিকে৷ কিছুটা ভড়কে গেলে নিজেকে সামলে নিল ভূমি। কম্পিত কণ্ঠে বলল‚
“আ..আমি পারব!”
“আপনার পা শুকতে সময় তো লাগবে৷ এমতাবস্থায় হেঁটে যেতে সমস্যা হতে পারে৷”
ভূমিকে প্রত্যুত্তর করবার সুযোগ না দিয়ে‚ তার পিঠে হাত রাখল প্রলয়। থেকে থেকে কেঁপে উঠল ভূমি। প্রলয়ের কাঁধে হাত রেখে শরীরের ভর ছেড়ে দিল সে৷ ভূমিকে কোলে তুলে নিল প্রলয়। এগিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। সদর দরজা আগে থেকেই খোলা রয়েছে৷ এতক্ষণে সবাই বৈঠকখানায় উপস্থিত৷ ভূমিকে কোলে করে নিয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে দাঁড় করাল প্রলয়। মেয়েটা যাতে পড়ে না যায়‚ সেজন্য ভূমির বাহু ধরে রাখল প্রলয়। সকলের দৃষ্টি ওদের দুজনের দিকেই। মাধুরী একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। একপ্রকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। মেয়েটার কপালে আর পায়ে বেন্ডেজ করা। বেন্ডেজের উপরও ছোপ ছোপ র’ক্তের দাগ। মেয়েটার ফর্সা মুখশ্রীতে চিন্তার ভাজ। পড়নে তার কলাপাতা রঙা আটপৌরে শাড়ি। মাধুরী উনার ছেলেকে শুধালেন‚
“মেয়েটা কে?”
অকপটে স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রলয় বলল‚ “আমার স্ত্রী।”
পা দুটো কেঁপে উঠল মাধুরীর। ছেলে যে এভাবে কাউকে না জানিয়ে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেবে এটা তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি। একটি মাত্র ছেলে উনার। অনেক স্বপ্ন‚ অনেক আশা ভরসা ছিল ছেলেকে নিয়ে৷ কথায় আছে না‚ ‘শখের পিঠা মাঝখানে কাঁচা!’ এ ব্যাপারে ঠিক তেমনটাই হয়েছে। রাগে দুঃখে কাঁদছেন তিনি। ফিরোজা কাছে এসে দাঁড়ালেন। মাধুরীর কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিলেন। আফসোসের সুরে মাধুরী বললেন‚
“এ তুই আমার কী সর্বনাশ করলি প্রলয়? তোকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন ভরসা ছিল! তুই সব শেষ করে দিলি।”
প্রলয় কিছু বলল না৷ মা তো ভুল কিছু বলছেন না। কিন্তু সেও যে অপারগ ছিল। ওমন একটা মুহূর্তে বিয়ে করা ছাড়া কীইবা করার ছিল তার। প্রলয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভূমিকে দেখে খুব বেশি হাইপার হয়ে উঠলেন মাধুরী। ফিরোজা উনাকে শান্ত করার জন্য বললেন‚
“ভাবি তুমি একটা শান্ত হও। এবার তো তোমার প্রেসার বেড়ে যাবে৷”
মাধুরী তো শান্ত হলেনই না বরঞ্চ আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। প্রলয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন‚
“কোন কুক্ষণে তুই গ্রামে গিয়েছিলিস? না তুই গ্রামে যেতিস আর না এই সর্বনাশ তোর দ্বারা হত৷”
একটু থেমে মাধুরী পুনশ্চ বললেন‚ “অ্যাই অর্পণ তুই বল— কী হয়েছিল?”
অর্পণ সকলের সামনে সব কথা খুলে বলল। সবকিছু শুনে রেগে গেলেন মাধুরী৷ তেড়ে গেলেন ভূমির সমীপে। মায়ের রাগ সম্পর্কে অবগত প্রলয়। ভূমিকে নিজের আড়াল করে নিল। মাধুরী চেঁচিয়ে উঠলেন‚
“এই মেয়েটা আমার ছেলেকে ফাঁসিয়েছে৷ অলক্ষ্মী‚ অপ’য়া মেয়ে— তোর জন্য আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। আমার ছেলের সুন্দর ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে এগোল।”
নীরবে অশ্রুবর্ষণ করছে ভূমি। সেই সকাল থেকে একই কথা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ প্রায়। প্রলয় সঙ্গ দিয়ে বলল‚
“উনাকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ হবে না মা। এখানে উনার কোনো দোষ নেই। ওই মুহূর্তে আমার যা ঠিক মনে হয়ে আমি সেটাই করেছি। আর হ্যাঁ আমি আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো কটু কথা শুনতে চাই না৷ যা হবার হয়ে গিয়েছে৷ ভাগ্য হয়তো এমনটাই চাইছিল।”
মোর্শেদ শিকদার আর মেহরাব শিকদার এখনো বাড়ি ফেরেননি। উনারা এই ব্যাপারে কিছু জানেনও না৷ নিজেদের ঘরে পড়তে বসেছিল পূর্ণতা পুষ্পিতা। মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে বৈঠকখানায় না এসে পারল না৷ এসেই দেখল তাদের বড়ো ভাইয়া এসেছে। সঙ্গে একটা মেয়েও দাঁড়িয়ে। বোকা দুই বোন কিছুই বুঝতে পারল না৷ কিছু বলতে নেবে তার আগেই অর্পণ ইশারায় তাদের চুপ থাকতে বলল। নয়তো মায়ের কাছে হয়তো বকাও শুনতে পারে৷ পূর্ণতার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে পুষ্পিতা বলল‚
“অ্যাই পূর্ণ! বড়ো ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে রে?”
“আমি তো তোর সঙ্গেই এলাম। বেশি কথা বলিস না। দেখছিস তো মা আজ ক্ষেপেছে।”
এবার ফিরোজাকে উদ্দেশ্য করে প্রলয় বলল‚ “চাচি মা খাবার বেড়ে দাও৷ উনি ভীষণ দুর্বল।”
কথাটা বলেই ভূমিকে কোলে তুলে নিল। মেয়েটা এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে উপরে যেতে পারবে না৷ ভূমিকে নিজের ঘরেই নিয়ে গেল প্রলয়। বিছানায় বসিয়ে— তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। বিছানায় বসে পুরো কামরা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল ভূমি৷ আসবাবপত্রে সাজানো গোছানো সুন্দর এই কামরা তাদের ছোটো ঘরের এক অংশ মাত্র। এমন সময় দুয়ারে কেউ কড়া নাড়ল।
“আসব?”
নড়েচড়ে বসল ভূমি৷ দরজা ভেদ করে অর্পণ ঘরের ভেতর প্রবেশ করল৷ বিছানার কাছে গিয়ে নিজের ফোনটা ভূমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল‚
“আপনার মা কথা বলবেন।”
হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল ভূমি। অর্পণ আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেল। ভূমি ফোনটা কানে নিল। ফোনের অপরপ্রান্ত নীরবতায় আচ্ছন্ন। ভূমি নিজে থেকেই বলল‚
“আ..আম্মা!”
কতটা সময় পর মেয়ের গলার আওয়াজ পেলেন মহুয়া। কলিজা শীতল হলো৷ বাঁ হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললেন‚
“আমার মা। কেমন আছিস তুই? ঠিক আছিস তো? কেউ তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি তো?”
মাধুরীর করা খারাপ ব্যবহারের কথা আম্মার কাছে বলল না। অযথা আম্মাকে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ভূমি বলল‚
“আমি একদম ঠিক আছি আম্মা৷ কেউ আমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। সবাই আমাকে মেনে নিয়েছে।”
“শ্বশুর বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলবি মা৷ এখন থেকে ওটাই তোর পরিবার। এতকাল ধরে আফসোস করে এসেছিস তোর বাবা নেই বলে। এখন একটা পরিবার পেয়েছিস৷ ইরার থেকে শুনেছি প্রলয়দের বিশাল বাড়ি‚ বিশাল পরিবার। শ্বশুর‚ শাশুড়ী‚ দেবর— ননদ‚ চাচা শ্বশুর‚ চাচি শাশুড়ী পেয়েছিস৷ তাদের সবাইকে মান্য করে চলবি। কখনো কারো মনে আঘা’ত দিবি না। সবার কথা মতো চলবি। কেউ যেন বলতে না পারে— আমি তোকে কোনো শিক্ষা দিইনি।”
“পরিবার পাওয়ার লোভে আমি যে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি আম্মা। তুমি যে আমার থেকে বহু মাইল দূরে। চাইলে আমি তোমার কাছে ছুটে যেতে পারব না। আমি তোমাকে ছাড়া কী করে থাকব আম্মা?”
আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন মহুয়া৷ কথা বলতে পারছেন না তিনি। ইরা উনার থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল‚
“তুমি একদম চিন্তা কোরো না ভূমি। এখন থেকে যখনই আন্টির কথা মনে পড়বে আমার নাম্বারে কল দেবে। আন্টিকে আমরা আমাদের বাড়িতে রেখে দেব৷ উনারাও আর একলা মনে হবে না।”
রাত তখন সাড়ে এগারোটা৷ খাবার আর ঔষধ খেয়ে অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে ভূমি। বাড়িতে এসে প্রলয়ের বিয়ের কথা জানার পরও চুপ করে ছিলেন মোর্শেদ শিকদার। মাধুরীকেও চিৎকার চেঁচামেচি করতে বারণ করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে প্রলয়ের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চেয়েছেন মোর্শেদ শিকদার৷ প্রলয়ও তার বাবার কথা মতো স্টাডি রুমে গিয়েছে কথা বলার জন্য৷
“গ্রামবাসীর কথায় এভাবে বিয়ে করে নিলে? অর্পণকে নিয়ে কাল রাতেই ফিরে আসতে।”
“বিয়ে করার সিদ্ধান্ত একান্তই আমার। তুমি আমাকে খুব ভালো করেই জানো বাবা। কারো সাধ্য নেই সেহরিশ আরশান প্রলয়কে জোর করার। তোমার ছেলে কাপুরুষ নয় যে‚ রাতে আঁধারে কাউকে বিপদে ফেলে পালিয়ে আসবে।”
“এখন কী করবে কিছু ভেবেছ?”
মোর্শেদ শিকদারের কথা কিছু বুঝল না প্রলয়। বাবাকে শুধাল‚ “মানে?”
“এভাবে হুট করে বিয়ে— সমাজ কী বলবে? গ্রামের ওই জঘন্য কথা যদি মিডিয়ার কাছে পৌঁছয়‚ ভাবতে পাচ্ছ কী হবে? তুমি হচ্ছ এখানকার এমপি। খবরটা মিডিয়ার কাছে গেলেই ভাইরাল।”
“এসব নিয়ে আমি কিছু বলছি না বাবা। বিয়েটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। জনে জনে জানাতে আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছি না। তবে চাইলে ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে বড়ো করে রিসেপশনের আয়োজন করতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। ততদিন ভূমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। পরিবারের সঙ্গে মিশে যেতে পারবেন।”
চলবে?…..