রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৫| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
623

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বিস্তীর্ণ অম্বর জুড়ে র’ক্তজবারয় বিচরণ। নীলিমা ম্লান করছে একটু একটু করে। অলিগলির সোডিয়াম বাতি গুলো একটা একটা করে জ্বলে উঠছে৷ অদূরে মসজিদে আযানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। মাথায় ওড়না জড়িয়ে বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলো ভূমি৷ পাড়াপড়শিরা চলে গিয়েছে আধ ঘণ্টা হবে হয়তো। ঘরে এসেই শাড়িখানা পাল্টে নিয়েছিল সে৷ শাড়িতে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না সে। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোধূলি লগ্ন উপভোগ করছিল। ভূমি ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো। ওযু করে মাগরিবের নামায আদায় করে নেবে৷ সেই সকাল থেকে এই কামরার চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে রয়েছে৷ ভালো লাগছে না আর। কেউ তাকে কোনো কাজের জন্যও ডাকছে না। একটু কাজের মাঝে থাকলেও তো কিছুটা ভালো লাগবে৷ নামায আদায় করে‚ চুলে বিনুনি গেঁথে নিল ভূমি। এরপর মাথায় ওড়নার ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হতেই দেখতে পেল সদর দরজা পেরিয়ে অর্পণ আসছে। হসপিটাল থেকেই ফিরছে বোধহয়। কাল তো উনার ফোন থেকেই আম্মার সঙ্গে কথা হয়েছিল৷ আজও যদি একটু কথা বলতে পারত৷ মনে মনে ভাবতে শুরু করল ভূমি। অর্পণের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ কিছুটা আমতা আমতা করেই বলল‚

“ভাইয়া আমাকে একটু আম্মার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন?”

অর্পণ অকপটেই জবাব দিল‚ “একটু অপেক্ষা করুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

ভূমি সায় জানাতেই অর্পণ সিঁড়ি ভেঙে তার ঘরে চলে গেল। ফিরোজা রান্নাঘরে সাবিনার সঙ্গে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত৷ সন্ধ্যেবেলায় একেক ধরনের নাস্তা বানানো হয়৷ আজ তিনি বেগুনি‚ ডিমের চপ আর পিয়াজু বানাচ্ছে৷ ডিমের চপ অর্পণ খুব পছন্দ করে৷ আজ মুড়ি মাখা হবে। পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্য নুডলস রান্না করা হয়েছে। এরা দুবোন মুড়ি খেতে চায় না। এদের আবার আলাদা আবদার। ভূমি রান্নাঘরে গেল৷ তাকে রান্নাঘরে দেখেই ফিরোজা বললেন‚

“একি তুমি রান্নাঘরে আসতে গেলে কেন? তোমার পায়ে তো এখনো ব্যথা রয়েছে।”

“সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না চাচি মা৷ আমি একটু সাহায্য করি।”

গাল এলিয়ে হাসলেন ফিরোজা। প্রত্যুত্তর করলেন না তিনি। ভূমির হাতে তিনটে নুডলসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন‚

“দুটো বাটি পূর্ণ পুষ্পর। আরেকটা তোমার। এখন আপাতত তোমার এটাই কাজ।”

ভূমি নুডলসের দিকে তাকাল। একবার মেলায় গিয়ে খেয়েছিল খেতে খুব একটা ভালো লাগেনি। এরপর অবশ্য আম্মা কয়েকবার বাজার থেকে নুডলসের প্যাকেট এনে দিয়েছিলেন৷ নিজেই রান্না করাও শিখিয়েছিলেন। খেতে বেশ সুস্বাদু ছিল। ভূমি ট্রে খানা হাত নিয়ে নিল। ফিরোজা বললেন‚

“পূর্ণ পুষ্পর ঘরটা চেন তো?”

“জি।”

“আচ্ছা যাও।”

ভূমি ধীর পায়ে যেভাবে এসেছিল আবার সেভাবেই সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল। অর্পণের পাশের ঘরটায় ওরা দুবোন থাকে। ভূমি গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল‚

“আসব।”

পড়তে বসেছিল পূর্ণতা পুষ্পিতা। ভূমির গলার স্বর পেয়েই তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিল পুষ্পিতা৷ বইয়ের দিক থেকে মুখ তুলে তাকাল পূর্ণতা। ভূমিকে পেয়ে খুশি হয়ে গেল দুটোতে৷ পুষ্পিতা বলল‚

“আরে ভাবিমণি। ঘরে এসো।”

পুষ্পিতা ট্রে টা নিজের হাতে নিয়ে নিল। ভূমি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরটা বেশ খোলামেলা। পূর্ণতা বই রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভূমিকে নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানাতে৷ ওরা দুবোনও বিছানায় বসল৷ পূর্ণতা একটা বাটি এগিয়ে দিল ভূমির দিকে। মুচকি হেসে নুডলসের বাটিটা নিল ভূমি। বাকি দুটো বাটি ওরা দুবোনও ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

গোসল করে বের হয়েছে অর্পণ। হুট করেই মনে পড়ল ভূমি তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল৷ গোসল করতে ঢুকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে। না জানি মেয়েটা কী ভাবছে৷ তাড়াতাড়ি করে ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট বের করে পড়ে ফেলল। এরপর বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিল। ঘর থেকে বেরিয়ে প্রলয়ের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে থেকেই ইরার নাম্বারের ডায়াল করল। কেউ কল তুলল না। দরজা কড়া নাড়তেও ওপাশ থেকে কারো সাড়া মিলল না৷ অর্পণ নিচে রান্নাঘরের দিকে গেল। না! এখানেও নেই।

“উনি কোথায় না?”

বুঝতে পারলেন না ফিরোজা। মুড়ি মাখছিলেন তিনি। কাজ থামিয়ে দিয়ে বললেন‚

“কী বললি— বুঝিনি আমি।”

“ভূমি কোথায়?”

“ও তো পূর্ণ পুষ্পর ঘরে৷”

আর কিছু বলল না অর্পণ। পূর্ণ পুষ্পর ঘরের দিকেই অগ্রসর হলো। এদিকে ইরা কল ব্যাক করেছে অর্পণের নাম্বারে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইরার কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো। ইরা বলছে‚

“কী ব্যাপার— আজ নিজে থেকে কল করেছেন?”

“আমার বয়েই গিয়েছে তোমার সাথে কথা বলার।”

“তাহলে কল কে’টে দিই?”

“অ্যাই না।”

“এই তো বললেন— আপনার বয়েই গিয়েছে।”

কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “মহুয়া আন্টি আছেন সামনে?”

“হ্যাঁ! আন্টি এখন রান্নাঘরে।”

“একটু দেওয়া যাবে? ভূমি কথা বলবেন।”

“হ্যাঁ দিচ্ছি।”

এতক্ষণে পূর্ণ পুষ্পর ঘরের সামনে চলেই এসেছে। বাহির থেকে ডাকতেই পূর্ণতা দরজা খুলে দাঁড়াল। অর্পণ ঘরে প্রবেশ করেই ভূমির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল‚

“মহুয়া আন্টির সঙ্গে কথা বলুন।”

ফোনটা নিয়ে নিল ভূমি। অর্পণ এতক্ষণে চলে গিয়েছে। ফোন কানে ধরে শুধাল‚

“কেমন আছ আম্মা?”

“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই ভালো আছিস তো? জামাই কেমন আছে? বাড়ির সকলে ভালো তো?”

“হ্যাঁ আম্মা সকলেই ভালো আছেন৷ আমিও ভালো আছি। আমার তোমাকে খুব মনে পড়ছে আম্মা৷ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷”

আঁচল টেনে চোখের পানি মুছে নিলেন মহুয়া৷ এদিকে অশ্রুপ্লাবিত হয়েছে ভূমির অক্ষিকোটরে। যেকোনো সময় উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে পারে৷ মেয়ে দুটোর সামনে কিছুতেই কাঁদবে না সে। আড়ালেই চোখের জল মুছে ফেলল ভূমি। ওপাশ থেকে মহুয়া বললন‚

“সময় করে জামাইকে নিয়ে ঘুরে যাবি।”

রাতে…

অমা বিদায় নিয়ে জোছনা উঁকি দিয়েছে অন্তরিক্ষে৷ হাতে গোনা কয়েকটা তারাও উঁকি দিচ্ছে। গায়ের ওড়না জড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। প্রলয়ের আসার অপেক্ষা করছে সে। সবাই হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে। তখন আম্মা পই পই করে বলেছেন কোনো কাজ দেখলে গুটিয়ে বসে না থাকতে। সকলের মন জুগিয়ে চলতে। স্বামী যতক্ষণ না বাড়ি ফিরছে ততক্ষণ জেগে থাকতে। স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। এই কথাটা শুনে কিছুটা লজ্জায় বোধ হয়েছিল তখন। সকালে তো দুজনে একসঙ্গে নাস্তা করেছিল৷ আম্মার কথা মেনে রাতের খাবার খায়নি এখনো। গ্রামে থাকলে তো এতক্ষণে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েই পড়ত৷ রাত অনেক হয়েছে। ঘুমও পাচ্ছে ভীষণ।

এক টুকরো রূপালি চাঁদ নিজের আত্মশ্লাঘা ছড়াচ্ছে। মুক্ত হস্তে দান করছে নিজস্ব কিরণ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল কালো রঙা গাড়িটা মালঞ্চ নীড়ে ফিরেছে৷ বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল ভূমি। ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলো। পায়ে ব্যথা নিয়েই সদর দরজার কাছে চলে গেল৷ হুট করে তার কী হয়েছে জানা নেই৷ সবকিছুই যেন অজানা। সদর দরজা খুলে দিতেই প্রলয় বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল৷ ভূমিকে এই সময় দরজা খুলতে দেখে অবাক হলো ভীষণ। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতেই শুধাল‚

“কী ব্যাপার আজ এখনো জেগে আছ যে?”

ভূমি হাতে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে বলল‚ “ঘুম আসছিল না।”

চোখের চশমা ঠিক করে প্রলয় আবারও বলল‚ “কিন্তু আমি যে দেখতে পাচ্ছি ঘুমে চোখ টইটুম্বুর!”

ভূমি এবার বলল‚ “আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন। আমি আপনার খাবার বাড়ছি।”

“রাতের খাবার খেয়েছ?”

এবার কথা কা’টাবে কী করে? সেটাই ভাবতে শুরু করল ভূমি। তাকে চুপ থাকতে দেখে প্রলয় বলল‚

“খাওয়া হয়নি কেন?”

অকপটে জবাব দিল‚ “তখন আমার ক্ষিধে ছিল না। আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন।”

কিছু বলল না প্রলয়। দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল৷ ভূমি রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করতে শুরু করল। সাবিনা শিখিয়ে দিয়েছে— কীভাবে গ্যাসের চুলো জ্বালাতে নেভাতে হয়। এখন বেশ ভালোই পারছে৷ রাতের জন্য রাখা খাবার গুলো গরম করে নিল৷ এরই মাঝে গোসল সেরে নিয়েছে প্রলয়। আজ ঝড়ের গতিতে গোসল করেছে সে। পড়নের টিশার্টটা ঠিক করতে করতেই নিচে নেমে এলো৷ চুলগুলো সদ্য ভেজা৷ ভূমি তখন খাবার গুলো টেবিলে রাখছিল৷ প্রলয় গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। তাকে দেখেই ভূমি বলল‚

“অসময়ে গোসল করবেন না— ঠান্ডা লেগে যাবে।”

ভূমির কথার প্রত্যুত্তর করল না প্রলয়। প্লেটে খাবার বেড়ে দিল ভূমি। নিজের জন্যও খাবার বেড়েছে। প্রলয় হাত ধুতে ধুতে বলল‚

“আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকার প্রয়োজন নেই। তোমার যখন ক্ষিধে পাবে তখনই খেয়ে নেবে। মনে থাকবে আমার কথা?”

ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। সে নিজেও খেতে বসেছে। ক্ষিধে পেয়েছিল খুব। প্রলয় ভাত মাখতে শুরু করল৷ প্রথম লোকমা ভূমির মুখের সামনে তুলে ধরল প্রলয়। ইশারায় বলল খেয়ে নিতে৷ অস্বস্তি হচ্ছে ভূমির। ভীষণ রকমের অস্বস্তি। দুদিনের মাঝে এতটা স্বাভাবিক আচরণ কী করে করতে পারে? বুঝে পেল না ভূমি। মুখের সামনে লোকমা সেভাবে তুলেই প্রলয় বলল‚

“স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে খেতে বসলে যেমন ভালোবাসা বাড়ে তেমন স্ত্রীকে খাইয়ে দেওয়াও সুন্নত।”

প্রলয়ের কথায় থতমত খেয়ে গেল ভূমি। লোকটা বুঝে গেল! ভাবতেই লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। মুখের সামনে ধরে রাখা লোকমা নিঃশব্দে খেয়ে নিল সে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here