#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘর থেকে বেরিয়ে ভূমি নিজেদের ঘরে এলো। প্রলয় এখনো বের হয়নি। লোকটা নিশ্চয়ই গোসল করছেন। এতটা সময় ধরে গোসল করতে হয়? পুরুষ মানুষের গোসলে এত সময় লাগতে হবে কেন? তারা যত দ্রুত সম্ভব গোসল করে বের হবে। কই তার তো এত সময় লাগে না গোসল করতে! তবে যেদিন চুলে শ্যাম্পু করে সেদিন একটু আধটু দেরি হয় বৈকি। এসমস্ত ভাবতে ভাবতেই এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করে নিল ভূমি। পুরো ঘরময় একপলক চোখ বুলিয়ে নিল। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে চলে গেল৷ ভূমিকে দেখে মাত্রই মাধুরী মুখ ঝামটা দিলেন। গম্ভীর অতিশয় কর্কশ কণ্ঠে বললেন‚
“শোন মেয়ে তোমাকে একটা কথা বলি!”
চলার পথেই থেমে গেল ভূমি। মাধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল‚ “জি মা?”
“ঘটা করে আমাকে মা না বললেও চলবে৷ আসল কথায় আসি! শুধু শুয়ে বসে থাকলেই তো চলবে না— কাজও করতে হবে৷ আমি কী বলতে চাইছি‚ আশা করি বুঝেছ!”
মাথা নিচু রেখেই ভূমি বলল‚ “জি আমি বুঝতে পেরেছি।”
“এখানে সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তোমার চাচি মার সঙ্গে কাজে সাহায্য কর।”
“জি!” কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ভূমি। মাধুরী ঘরে চলে গেলেন। মোর্শেদ শিকদার অনেকক্ষণ হলো ডেকেছেন উনাকে৷ না গেলে নিশ্চয়ই এবার চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করবেন৷ বয়স বাড়ছে না কমছে— বুঝে আসে না মাধুরীর৷
খাবার টেবিলে…
সবাই খেতে বসেছে৷ ভূমি গিয়েছে পূর্ণতা পুষ্পিতাকে ডাকতে। মেয়ে দুটো এখনো হয়তো ওঠেনি। মাধুরী বুঝেশুনে ভূমিকে পাঠিয়েছেন৷ এদিকে সবাই খেতে বসে পড়েছে। মাধুরী আর ফিরোজা সকলে প্লেটে নাস্তা নিয়ে নিজেরাও বসে পড়েছেন। প্রলয় খাচ্ছে না দেখে মাধুরী বললেন‚
“কী হলো বাবা খাচ্ছিস না কেন?”
“সবাই আসুক। একসঙ্গে খাব।”
উপস্থিত সকলেই বুঝলেন প্রলয় ভূমির জন্য অপেক্ষা করছে৷ মাধুরী বাদে বাকিরা মুখ টিপে হাসছে৷ এরই মাঝে উপস্থিত হলো ভূমি‚ পূর্ণিতা পুষ্পিতাকে নিয়ে খাবার টেবিলের সামনে চলে এসেছে। মুখে আঁধার নেমে এলো মাধুরীর৷ ভূমিকে সহ্য হয় না উনার। ছেলের পাশে তো একদমই না। কী করবেন— না পেরে সহ্য করতে হয়। প্রলয় দাঁড়িয়ে পড়ল। ভূমির চেয়ারটা টেনে বসার জন্য ইশারা করল৷ ভূমি বসতেই তার প্লেটে খাবার এগিয়ে দিল প্রলয়৷ উপস্থিত সকলে চুপ করে পর্যবেক্ষণ করছে সবটা৷
রান্নাঘরে তখন ধুয়ে রাখা বাসন গুলোকে মুছে রাখছিল ভূমি। বৈঠকখানায় উপস্থিত মেহরাব শিকদার‚ মোর্শেদ শিকদার‚ মাধুরী আর ফিরোজা। বাকিরা নিজেদের ঘরে চলে গিয়েছে। পূর্ণতাকে দিয়ে একবার ডেকে পাঠিয়েছিল প্রলয়৷ এদিকে কাজ শেষ না হওয়া অবধি ঘরে যেতে বারণ করছেন মাধুরী৷ এরই মাঝে ফিরোজা রান্নাঘরে এসে বললেন‚
“তোমার চাচ্চু ডাকছেন।”
কাজ বন্ধ করে রান্নাঘর থেকে বের হলো ভূমি। বড়োদের কথা অবজ্ঞা সে কোনো দিনও করতে পারে না। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবে— কখনো যে তার আম্মার শিক্ষা নিয়ে কেউ আঙুল না তুলতে পারে৷ ফিরোজার পিছু পিছু বৈঠকখানায় চলে এলো ভূমি। তাকে দেখা মাত্রই মেহরাব শিকদার বললেন‚
“এইতো ভূমি চলে এসেছে৷”
কথাটা বলেই মেহরাব শিকদার ভূমির সামনে এসে দাঁড়ালেন। একটা লাল বক্স ভূমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন‚
“এটা তোমার জন্য আমার তরফ থেকে সামান্য উপহার৷”
ভূমি তাকাল ফিরোজার দিকে। উনি ইশারায় বক্সটা নিয়ে বলছেন। সৌজন্যতা বজায় রেখে মেহরাব শিকদারের হাত থেকে বক্সটা নিল সে৷ বিনিময়ে মিষ্টি হেসে বলল‚ “ধন্যবাদ চাচ্চু।”
মাথায় হাত রেখে ক্ষীণ হাসলেন মেহরাব শিকদার। এরই মাঝে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসেছে অর্পণ। বাবা ছেলে আজ একসঙ্গে হসপিটালে যাবে। একদম ফর্মাল ড্রেসআপে বের হয়েছে অর্পণ। ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মেহরাব শিকদার। এদিকে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে‚ মোর্শেদ শিকদারও বেরিয়ে পড়লেন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে প্রলয়। সেই কখন ভূমিকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কই মেয়েটা তো এলো না। রাগ হলো কিছুটা। ভূমি আসার পর থেকে রাগ করা বেমালুম ভুলে গিয়েছে প্রলয়। এদিকে ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল ভূমি। প্রলয় তাকে বকবে না তো? সেই কখন ঘরে আসতে বলেছিলেন।
“এই তোমার সময় হলো ঘরে আসার?”
“একটু কাজ ছিল৷”
আর কিছু বলল না প্রলয়৷ নিজের মতো তৈরি হতে লাগল৷ হাতে ঘড়ি পড়ে‚ ওয়ালেট আর চার্জে বসানো মোবাইলটা পকেটে নিয়ে নিল৷ ভূমির উপর থেকে জমা সুপ্ত রাগ নিভে গিয়েছে৷ প্রলয় ভূমির মাথায় হাত রেখে বলল‚
“আসছি৷ সাবধানে থাকবে। সময় মতো খাবার খেয়ে নেবে।”
কিছুটা লাজুক হেসে ভূমি বলল‚ “আপনিও সাবধানে যাবেন।”
ভূমির এই একটা কথায় মনপিঞ্জরে আটকে থাকা পাখিগুলো ডানা জাপ্টাতে শুরু করল যেন। ভূমির সঙ্গে সঙ্গে প্রলয়ও ক্ষীণ লাজুক হাসল।
❑
আজ তাড়াতাড়িই বাড়িতে ফিরে এসেছে প্রলয়। বাড়ি ফিরে বৈঠকখানায় ভূমিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ঘরে চলে এলো। যা ভেবেছিল তাই! ভূমি ঘরেই রয়েছে। মাথায় বড়ো ওড়না পেচিয়ে শরীর ঢেকে জায়নামাযে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা দৃঢ় মনোযোগে নামায আদায় করছে। প্রলয় নিঃশব্দে ঘরের ভেতরে গেল৷ মাথা ধরেছে ভীষণ। কড়া করে এক মগ কফি খেলে হয়তো কিছুটা মাথা ব্যথা কমবে। গা থেকে শার্ট খুলে বিছানার উপর রেখে আয়নার সামনে অগ্রসর হলো। হাত থেকে ঘড়ি‚ পকেট থেকে মোবাইল আর ওয়ালেট বের করে ড্রেসিং টেবিল রাখল৷ তোয়ালে নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।
গোসল করে বেরিয়ে ঘরে ভূমিকে কোথাও পেল না প্রলয়। তার মনে হলো মেয়েটা শুধু পালাই পালাই করছে। একটু যে চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে তা না— শুধু চোখের আড়াল হয়ে যায় বারবার। মিনিট পাঁচেকের মাথায় ভূমি ঘরে ফিরে এলো। এসেই প্রলয়কে দেখতে পেয়ে শুধাল‚
“আপনি কখন এলেন?”
“আমি এসেছি অনেকটা সময় হয়েছে৷ আমার খেয়াল রাখার মতো সময় কী মেডামের আছে নাকি? বারবার কোথায় চলে যাও?”
প্রলয়ের কথা বোধগম্য হলো না তবু আমতা আমতা করে বলল‚ “পুষ্পিতা ডেকেছিল আমাকে।”
“এখন কোথাও যাবে না। যা কাজ আছে এখানে— ঘরে বসেই কর!”
ভূমির মনে পড়ল বারান্দা থেকে কাপড়গুলো আনা হয়নি। প্রলয়ের কথার উত্তর না দিয়ে বারান্দায় চলে গেল৷ এদিকে এই মেয়ের ছুটোছুটি বন্ধ করতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। মাথা ধরা কমেনি। তাই ভাবল নিজেই গিয়ে কফি বানাবে। যেই ভাবা সেই কাজ৷ ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল প্রলয়।
মিনিট দশেক পর…
দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রলয়। হাতে তার কফি মগ৷ নিজেই বানিয়ে নিয়ে এসেছে সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বিছানার এক কোণে বসে কাপড় ভাজ করছে৷ সকালে প্রলয়ের জমিয়ে রাখা ভেজা টিশার্ট আর ট্রাউজার ধুয়ে দিয়েছিল। সেগুলো আর সেইসঙ্গে নিজের জামাকাপড় গুলোও ভাজ করছে ভামি। প্রলয়ের আজও মনে পড়ে সেই প্রথম সাক্ষাতের কথা। সেই অশ্রুপ্লুত মৃগনয়না বিশেষ। গৌর সুশ্রী। গাল দুটো মিষ্টি গোলাপের পাপড়ি। ঘণ দিঘল ভেজা কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ। যে-ই দেখবে তাক লেগে যাবে। এ সাক্ষাৎ নির্মলা ভূমি কন্যা। একা একাই হাসতে শুরু করল প্রলয়৷ তাকে এভাবে দেখলে যে কেউই বলবে পাগল হয়ে গিয়েছে। কফি মগ নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল প্রলয়৷ গিয়ে বসল বিছানার অপর পাশে৷ ঠিক ভূমির মুখোমুখি। কফিতে চুমুক দিয়ে একটু থেমে প্রলয় বলল‚
“একটা কথা বলব?”
ভাজ করা কাপড়টা বিছানার একপাশে রেখে আরেকটা কাপড় নিয়ে ভূমি বলল‚ “জি বলুন!”
“তোমার গাল গুলো ভীষণ আদুরে।”
ব্যাস! বো’ম ফাটা হয়েই গেল! ভূমির হাত থেকে পড়ে গেল কাপড়। আর পরিস্থিতি উপলব্ধি করে প্রলয়ের মুখ থেকে কফি বেরিয়ে গেল৷ কথাটা অজান্তেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে প্রলয়। লজ্জা এসে ভর করেছে প্রাপ্তবয়স্ক সেই গম্ভীর চোখের পাতায়। না! ঘরে আর একমুহূর্ত থাকা যাবে না। ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রলয়৷ এতক্ষণের আটকে রাখা তপ্ত নিশ্বাস ফেলল ভূমি। নিশ্বাস নিতেও বেমালুম ভুলতে বসেছিল। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম বাজছে৷ শব্দ তুলছে ভীষণ করে৷ হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে হাত রাখল ভূমি। এ কেমন অনুভূতি? অনুভূতি গুলো যে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে লাজ নিবারণে নিমগ্না ভূমির ওষ্ঠজোড়া কেঁপে উঠল। তখন প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গিয়েছিল৷ প্রলয়ের সামনে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বোধহয় ভালো হয়েছে।
চলবে?…..