রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩০| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
640

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অবসন্ন কৃষ্ণ আঁধার বাহ্যজগতে৷ অম্বরের একফালি রূপালি চাঁদ। যার নিজস্ব কিরণ আজ অবসর নিয়েছে। ভূমি একদৃষ্টে প্রলয়ের দিকে চেয়ে রয়েছে৷ লোকটা কী এত ভাবছে? থেকে থেকে বাঁকা হাসছেও। বুঝে এলো না ভূমির৷ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে এত ভাবারই বা কী আছে? এতক্ষণে কফি ঠান্ডা বরফ হয়ে গিয়েছ বোধহয়। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ভূমি বলল‚

“থাক আপনাকে কোনো উত্তর দিতে হবে বা৷ আপনি ঠান্ডা কফি খান!”

ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভূমি। পায়ে তার অল্পস্বল্প ব্যথা। হাঁটতে চলতে কোনো অসুবিধেই হচ্ছে না৷ আয়নায় লক্ষ্য করল ভূমির চলে যাওয়া। পেছন থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রলয় বলল‚

“ভূমি কন্যার আগমনে চিত্ত হয়েছিল অতি চাঞ্চল্য। প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের আভাস পেয়েছিলাম প্রতিনিয়ত।”

চলে যেতে নিয়েও থমকে দাঁড়াল ভূমি। প্রলয়ের বলা কথাটাকে তার প্রশ্নের উত্তর বলে মনে হলো না। লোকটা ভীষণ ত্যাঁদড় পদের। কোনো কথার সোজাসাপটা উত্তর দিতে জানেই না৷ অর্পণকে কম নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে নাকি! কাল রাতে তো ছেলেটার লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছিল৷ ভাইয়ের জন্য চিন্তা হয় বলেই তো সঙ্গে যেতে চেয়েছিল! তাই বলে এভাবে সকলের সামনে লজ্জা দেবে? পেছন থেকে আবারও সেই ভরাট কণ্ঠস্বর‚

“কোথায় চললে বউ?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই পূর্ণ দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভূমি। প্রলয়ের অধর কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা। লোকটাকে সেই প্রথম দিনে মতো লাগছে না একটুও৷ প্রথম দেখাতে মনে হয়েছিল— লোকটা ভীষণ রাগী‚ গম্ভীর গোছের হবে হয়তো। যত দিন যাচ্ছে ততই ভূমি ধারণাও পরিবর্তন হচ্ছে৷ লোকটা ভীষণ যত্নশীল। রাগীও বটে। হুটহাট রেগে আগুন হয়ে যায়৷ যে-ই পাশ দিয়ে যাবে তাকেই ঝলসে দেবে৷ রাগী প্রলয়কে ভীষণ ভয় করে মাঝে মাঝে৷ লোকটা যখন গম্ভীর হয়ে থাকে তখন দুরুদুরু বুকে চুপ মে’রে থাকে সে।

এরই মাঝে পূর্ণতা এসে দরজার কড়া নাড়ল। বিছানার উপর ভাজ করে রাখা টিশার্ট পড়ে নিল প্রলয়। অনুমতি পেয়েই পূর্ণতা ঘরে প্রবেশ করে বলল‚ “বড়ো ভাইয়া তোমার একটা পার্সেল এসেছে৷”

“হুম যাচ্ছি।”

পূর্ণতা চলে গেল৷ প্রলয়ও ঘর থেকে বের হবার আগে ভূমিকে বলএ গেল‚ “কোথাও ছোটাছুটি করবে না— ঘরেই থাকবে। আমি এক্ষুনি আসছি।”

স্বামীর কথানুযায়ী ঘরেই রইল ভূমি। বের হলো না একটুও৷ পাছেই না লোকটা রাগ করে বসে৷ কারো রাগ সামলানোর হিম্মত নেই তার। এমনিতেই ভীষণ ভীতু ধাঁচের সে৷ মিনিট পাঁচেকের মাঝেই প্রলয় ঘরে ফিরে এলো৷ তার হাতে একটা মাঝারি আকৃতির ব্যাগ৷ ঘরে এসেই ব্যাগটা ভূমির হাতে তুলে দিল প্রলয়। বিষয়টিতে ভূমি অবাক না হয়ে পারল না ভূমি। ব্যাগ ভেতর কী আছে জানা নেই তার৷

“হা করে থাকলে চলবে? প্যাকেট খুলে দেখ! এটা তোমার জন্যই।”

“কী আছে এটাতে?”

“আমি কেন বলব? তুমিই খুলে দেখ!”

প্যাকেট খুলল ভূমি ভেতরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন রয়েছে৷ ভূমি তাকাল প্রলয়ের দিকে।

“এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি তো ভাইয়ার ফোন থেকে আম্মার সঙ্গে কথা বলে নিতাম।”

“আমার বউ অন্যের ফোন দিয়ে কেন কথা বলবে? ফোনটা আরও আগে কিনে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল৷ তাহলে অন্তত আমি যেকোনো সময় বিরক্ত করতে পারতাম।”

“আমি তো কখনো ফোন ব্যবহার করিনি।”

“তাতে কী? আমি শিখিয়ে দেব৷”

প্রলয় একটা পারসোনাল সিম নিয়েছে ভূমির ফোনে ব্যবহার করার জন্য। বাড়ির সকলের নাম্বার স্যেভ করে দিয়েছে৷ ইরার নাম্বারও স্যেভ করে দিয়ে প্রলয়। সবার ফোন নাম্বার যার যার নামেই স্যেভ করে‚ নিজের নাম স্যেভ করেছে “এমপি মশাই” দিয়ে। সকালে পুষ্পিতার থেকে শুনেছিল— ভূমি তাকে এমপি মশাই বলে সম্বোধন করেছে। ডাকটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল৷ এর আগেও এমপি মশাই ডাক শুনেছে। তবে এতটা ভালো আগে লাগেনি।

খাবার টেবিলে সবাই বসে রয়েছে৷ প্রলয় ভূমি এখনো অনুপস্থিত। ইশারায় ডাকত্র বললেন মাধুরী। নিচে থেকেই ডাক দিলেন ফিরোজা। সিঁড়ি ভেঙে দুজনেই নেমে এলো। নিজেদের চেয়ারে বসল। ফিরোজা খাবার বেড়ে দিলেন। খাবার খাওয়ার একপর্যায়ে মাধুরী বললেন‚

“তরকারির বাটিটা এদিকে দাও ভূমি।”

মাধুরীর শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠ অবাক করল সবাইকে। কতটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছেন একদিনের মাঝে৷ একদিন বললে ভুল হবে— এক রাতের মাঝেই সব স্বাভাবিক। সকাল থেকেই তিনি ভূমির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছেন৷ ভূমি দাঁড়াল৷ তরকারির বাটি মাধুরীর দিকে এগিয়ে দিল। খাওয়া ব্যতীত টেবিলে আজ কোনো শব্দ নেই৷ সবকিছু নিস্তব্ধ। এমন পরিবেশই প্রলয়ের খুব পছন্দের৷ আজ মনে হচ্ছে সে বাড়িতে খাচ্ছে। দুদিন ধরে মনে হচ্ছিল— সে কোনো মাছের বাজারে রয়েছে৷ ভূমির গ্লাস খালি দেখে প্রলয় পানি ভরে দিল৷ সবাই দেখেও দেখল না যেন। স্ত্রীর খেয়াল রাখা স্বাভাবিক নয় কী? অবশ্যই স্বাভাবিক।

বিছানায় বসে রয়েছে ভূমি। তার কোলে মাথা রেখে শুয়েছে প্রলয়৷ মসৃণ ছোটো ছোটো চুলে কোমল হাতের বিচরণ। দুহাতে ভূমির পেট জড়িয়ে রেখেছে প্রলয়৷ পেটের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে৷ আড়ষ্টতায় বিমূঢ় ভূমি থেকে থেকে কেঁপে উঠছে৷ মুখ তুলে তাকাল প্রলয়৷ ঘুমু ঘুমু আধবোজা চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে শুধাল‚

“আমি শুনেছিলাম তুমি নাকি ভীষণ ভালো নাচতে পারো?”

হাত দুটো থেমে গেল৷ নাচ তো সে একটু আধটু করে। আম্মা শিখিয়েছিলেন৷ আম্মা খুব ভালো নাচ করেন। নাচের প্রত্যেকটা ছন্দ তো সে তার আম্মার কাছ থেকেই শিখেছে কিন্তু এমপি মশাই জানল কী করে? ভূমি আমতা আমতা করতে শুরু করল৷ প্রলয় ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে বলল‚

“হুহ্! এত আমতা আমতা করতে হবে না৷ আমি তোমাকে নাচতে বলছি না। ভয় পেতে হবে না।”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ভূমি। প্রলয় আগের ভঙ্গিতে ভূমি কোলে মাথা রাখে কোমর জড়িয়ে ধরল। ভূমি আবারও প্রলয়ের চুল টেনে দিতে শুরু করল।

রাত সাড়ে বারোটা…

বিছানায় শুয়ে রয়েছে অর্পণ। রাত হয়েছে অনেকটা৷ ঘুম আসছে না। সকালেও তাড়াতাড়ি উঠতে হবে৷ চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করল অর্পণ। এরই মাঝে ফোন বেজে উঠল৷ ইরার নাম্বার থেকে কল আসছে। তবে কী মেয়েটা ঘুমোয়নি? কল রিসিভ করার বদলে কে’টে দিল। পুনর্বার নিজে থেকে ইরার নাম্বারে ডায়াল করল। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হলো অপরপ্রান্ত থেকে। ফোন কানে নিয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚

“এত রাতে জেগে থাকা হচ্ছে কেন?”

“ঘুম আসছিল না।”

“কেন ঘুম আসছিল না?”

“কেউ একজন যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে চলে গেছে— সেই খবর কী কেউ রেখেছে?”

“বলো কী! ঘুম চুরি হওয়া তো ভালো লক্ষ্মণ না।”

“সেটা আপনি বুঝলেন কোথায়?”

“বুঝিনি বলতে চাইছ? ডাক্তার কিন্তু মনে খবর জানে।”

“তাহলে আমার ভাই জানে না কেন? সেও তো ডাক্তার!”

“আমি ডাক্তার বলেছি— ডাক্তাররা নয়!”

“তা কোন খবরটা জানলেন মশাই?”

“এটাই জেনেছি যে‚ দুটো অন্তরিন্দ্রিয় বিনিময় হয়েছে৷”

“ধ্যাৎ! কী যে বলেন না!”

“ঝাঁসির রানি কী লজ্জা পাচ্ছে?”

“আপনাকে বলতে বাধ্য নয় সে।”

ক্ষীণ হেসে অর্পণ শুধাল‚ “তাই?”

“হুম তাই!”

নেমে এলো অবাক নীরবতা। সেই নীরবতা কাটিয়ে অর্পণ বলল‚ ”ঘুমিয়ে পড়লে?”

কানে ফোন রেখেই ইরা বলল‚ “উঁহু! আমি তো কারো হৃৎস্পন্দন অনুভব করছিলাম।”

অকপটেই অর্পণ শুধাল‚ “কার?”

“আছে একজন বদ লোকের।”

“বাই এনি চান্স— তুমি আমাকে বদ লোক বললে?”

“বুঝলাম আপনার ব্রেন খুবই শার্প। সবকিছু খুব সহজেই বুঝতে পারেন। শুধু একটা জিনিস ছাড়া!”

“সেই জিনিসটা কী?”

“বলব না। কদাপি নহে!”

“এ বাবা না বললে বুঝব কী করে?”

“সব বুঝেও কেন অবুঝ হয়ে আছেন?”

“বলছ— আমি সব বুঝি?”

“কেন বোঝেন না বুঝি?”

“কী জানি!”

“রাখছি! আমার ঘুম পেয়েছে।”

“এই না বললে তোমার ঘুম চুরি হয়েছে?”

আর কোনো উত্তর এলো না অপরপ্রান্ত থেকে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই বুঝতে পারল কল কেটে গিয়েছে সবেই৷ গাল এলিয়ে হেসে উঠল অর্পণ। মেয়েটা বড্ড চঞ্চলা। গ্রামে যাওয়ার আগে থেকে ওদের যোগাযোগ। অথচ সামনাসামনি কেউ কাউকে সামান্য পাত্তা টুকু দেয় না৷ সেদিন মেয়েটা ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল। সেখানেও দুজন দুজনকে যেন চেনেই না এমন একটা ভান ধরেছিল। মনে পড়তেই সশব্দে হেসে উঠল অর্পণ। মনে মনে কয়েকটা কথা আওড়াল‚

“শুধু এখন না‚ প্রত্যেকটা দিন— প্রত্যেকটা মুহূর্তে তোমার জীবনে শুধুই আমার বিচরণ থাকবে৷ ভালো তুমিও বাসো আমিও বাসি৷ তোমারটা প্রকাশিত‚ আমারটা ব্যক্তিগত।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here